- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
এক: ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়’
“ফকির লালন সাঁই আপাদমস্তক চর্চায়-চিন্তায় তান্ত্রিক” -- লালন সম্পর্কে আগ্রহী একজনের এই প্রকার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়েই এই লেখাটি লিখেছি। মন্তব্যটি কোন একজন ব্যাক্তির ধারণা বলে আমি মনে করি না, তাই তার নাম এখানে আর সরাসরি উল্লেখের প্রয়োজন বোধ করছি না। কারণ একে ব্যাক্তির মন্তব্য বা দাবি হিসাবে নয়, বরং লালনে আগ্রহী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের প্রবল ধারণা হিসাবে বিবেচনা করাই সঙ্গত। সাধারণ মানুষ লালনপন্থীদের সাধনা নিয়ে কৌতুহলী বটে, তবে ফকিরদের সামগ্রিক জীবন যাপন তারা সরাসরি প্রত্যক্ষ করে বলে তন্ত্র বা গুহ্যবিদ্যা ফকিরদের জানা বোঝার জন্য মুখ্য বিষয় নয়। অন্তত বাংলাদেশে।
আমার জীবনের বড় একটি অংশ লালনপন্থীদের সঙ্গে কেটেছে। বাকি জীবনও ভিন্ন হবে বলে মনে হয় না। লালনপন্থীরা নিজেদের ‘ফকির’ বলেন। এঁরা নদিয়ার ভাবের ভাবুক বা ভাবচর্চাকারী। সাধক। বাউল নামে যারা পরিচিত তারা ফকির লালন শাহকে ভালবাসেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। তারা লালনের ‘পদ’ বা ‘কালাম গেয়ে থাকেন। কিন্তু লালনের ঘরের সাধকের কাছে লালন স্রেফ গীতিকার নন। গুরু ও ঐতিহ্য পরম্পরায় লালনের ঘরে জীবনচর্চার সুনির্দিষ্ট কিছু বিধিবিধান বা ধারা আছে। কোথাও শিথিল, কোথাও বা কঠোর। লালনের গান গাওয়াই লালনপন্থীদের জীবন নয়। অর্থাৎ শুধু লালন গীতি গেয়ে যারা বাউল, লালনপন্থীরা সে রকম ‘বাউল’ নন। এটা ভালমন্দের বিচার নয়, হোসেন শাহের আমলে শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে বাংলায় যে রাজনৈতিক ও ভাবগত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল লালনপন্থিরা সেই অভিমুখ ধারণ করেন। তারা নদিয়ার ভাবের উত্তরাধিকারী।
তারপরও বলে রাখা ভালো বাংলার ভাব ও সংস্কৃতির জগতে বাউলদের অবদান অস্বীকার করবার কোন সুযোগ নাই। ‘বাউল’ মানেই সাধক নন, কিম্বা নদিয়ার ভাষায় বাউল মানেই কোন বিশেষ ঘরের দীক্ষা, শিক্ষা, সাধন পদ্ধতি ও জীবন যাপন চর্চার অনুগামী -- এটা সবসময় ঠিক নয়। হলেও তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধারা, স্রোত, চর্চা ও জীবন যাপন আছে। সেখানে তাদের পরস্পরের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বাউলদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে গড়ে হরিবোলে বাউল সাধনা, বাউল তত্ত্ব, চারি চন্দ্র ভেদ, ইত্যাদি বিভিন্ন সাধন পদ্ধতি সকল স্রোত বা ঘরের ওপর নির্বিচারে চাপিয়ে দেওয়া না। কিন্তু এটাই এ যাবতকাল হয়ে এসেছে। এটা ঘটে নিছক অনুমানের কারণে, গবেষণার অভাবে কিম্বা চরম অজ্ঞতার পরিণতি হিসাবে।
তাছাড়া বাউলদের বিভিন্ন গুহ্য বিদ্যা চর্চার সঙ্গে গড়ে হরিবোলে তন্ত্রকে একাকার করে ফেলা হয়। বাউল নিয়ে মধ্যবিত্তের অনুসন্ধিৎসা ও গবেষণা মানেই এই সকল গুহ্য চর্চার বিষয়াদির প্রতি অতি আগ্রহ, যা বাউলদের বলার কথা নয় সেই সব অকহিতব্য কথা সরবে প্রচার করা। পরিহাস যে এমন কোন চর্চা এখন আর অবশিষ্ট নাই যা আর গুহ্য বা গোপন। সবই উদাম ও উলঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। এই গুহ্যবিদ্যা বা তন্ত্র সম্পর্কে এখন পণ্ডিতেরও আর অভাব নাই। তাই এক কথায় বলে দেওয়া যায় “ফকির লালন সাঁই আপাদমস্তক চর্চায়-চিন্তায় তান্ত্রিক”। এর প্রতিবাদ করা জরুরি।
এই মন্তব্য ভুল। কারণ লালন কখনই নিজেকে তান্ত্রিক বলেন নি। তাছাড়া তন্ত্র এক প্রকার নয়, হাজার প্রকার। বলা হয় সব মিলিয়ে ১৯২টি তন্ত্র আছে, তার মধ্যে ৬৪টি বঙ্গদেশের। তার ওপর রয়েছে নানান উপতন্ত্র। তো লালন কোন ধারার তান্ত্রিক?
তদুপরি এই মন্তব্য বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। ক্ষতিকর এ কারণে যে সাধারণ ভাবে তন্ত্র বলতে বোঝায় দেহকে উপায় গণ্য করে তান্ত্রিকের (সাধনার) উদ্দেশ্য সাধন। এর ফলে শরীর স্রেফ হাতিয়ারে পরিণত হয় এবং সেই ক্ষেত্রে উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হয় নারীর শরীর। নারীকে ব্যবহার করা হয় ‘সাধন সঙ্গিনী’ বা ‘সেবাদাসী’ হিসাবে। তন্ত্র এই চর্চায় নারীর ওপর তান্ত্রিক পুরুষের ভায়োলেন্স বা যৌন সন্ত্রাসের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা একই সঙ্গে প্রাচীন তান্ত্রিক ধারা থেকে ছেদ বটে – যার গভীরতা ও বিস্তৃতি বোঝাতে আমি তাকে ‘ভাবান্দোলন বলে থাকি। এই আন্দোলনের চরিত্র শুধু জাতপাত বিরোধী ছিল না, একই সঙ্গে নারীর ওপর পুরুষের সহিংসতারও বিরোধী ছিল। ফকির লালন শাহ এই ধারারই উত্তরাধিকারী। লালনকে তান্ত্রিক বলার অর্থ দাঁড়ায় নারীর শরীরকে পুরুষের সাধনার উপায় বা হাতিয়ার গণ্য করে নারীদেহের ওপর শারিরীক সহিংসতা বহাল রাখা। এ কারনেই যাঁরা “ফকির লালন সাঁই আপাদমস্তক চর্চায়-চিন্তায় তান্ত্রিক” বলে দাবি করছেন আমি তার প্রতিবাদ করা কর্তব্য মনে করেছি। ফকির লালন শাহ যে রাঙাচরণ পাবার সাধনা করেছেন তার প্রধান শর্তই হচ্ছে ভাব দিয়ে ভাব নেওয়া – ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়’। তিনি বাংলার সেই কৃষ্ণের ভজনা করেছেন যিনি ‘ভগবান’ হয়েও শ্রীমতী রাধার ‘দাস’ হতে চেয়েছেন।
কথাটা প্রতিকী ও নৈতিক-ব্যবহারিক উভয় অর্থেই বলা। , নারী, কিম্বা প্রকৃতির দাসত্ব একই রাজনৈতিক অর্থে পুরুষতন্ত্রের ভিত্তিকে উপড়ে ফেলা যার সঙ্গে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র্য সুরক্ষার আন্দোলন যুক্ত। অর্থাৎ প্রকৃতিকে জয় করা, প্রকৃতির ওপর আঢিপত্য কায়েম, প্রকৃতির ওপর মানুষের মালিকানা বা একচ্ছত্র ভোগদখলের অধিকার কায়েম – পুরুষতন্ত্রের এই প্রকার নানান রূপ ও ইতিহাসের বিরোধিতা করা। যে কারণে বলেছি নারী বা প্রকৃতির দাস হবার সাধনার নৈতিক-ব্যবহারিক দিক রয়েছে, যার তাৎপর্য অসাধারণ। কিন্তু লালনকে স্রেফ তান্ত্রিক বানিয়ে দিয়ে সেই তাৎপর্য অনুসসন্ধানের সদর দরজা বন্ধ করে দেবার কাজ আধুনিক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকজন দীর্ঘদিন্ধরেই করছে। এর অবসান হওয়া জরুরী। নদিয়ার বিপ্লবকে সে কারণে তন্ত্র থেকে শ্রীচৈতন্যের রসতত্ত্বে এবং রসতত্ত্ব থেকে ভাবচর্চার বিপ্লব হিসাবে বোঝা ও ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা আছে।
দুই: তন্ত্র, পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদ্যা ও পর্নোগ্রাফি
তন্ত্র একাট্টা কিছু নয়; তার নানান বাঁক, মোচড়, শাখা উপশাখা আছে। সংস্কৃত শব্দ ‘তন্ত্র’ বৈদিক সময় থেকেই চালু। তন্ত্র বলতে সুতা বোনা থেকে শুরু করে, বস্তুর সারপদার্থ, কোনো না কোনো বিধি, বিধান, তত্ত্ব, শাস্ত্র, শাসন ইত্যাদি নানান কিছুই হতে পারে। চর্চা হিসাবে শিব ও শক্তির উপাসনা বিস্তারের শাস্ত্র থেকে শুরু করে এখন যেভাবে একে গুহ্য যৌন চর্চার ধারা হিসাবে বোঝানো হয় তার সবই ‘তন্ত্র’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত। তো লালন তান্ত্রিক মানে কি? তিনি শৈব? নাকি শাক্ত?
কল্পনা, চিন্তা ও চর্চায় দেহ বা শরীর মুখ্য হলেই তাকে ‘তন্ত্র’ বলে না। ‘দেহ’ বা ‘শরীর’ নিয়ে কোনো কারবারের কথা শুনলেই অনেকে মনে করে এটা তান্ত্রিক ব্যাপারস্যাপার। দেহবাদী জীবনযাপন, বিভিন্ন প্রকার সাধন প্রণালী বা বা ধর্মচর্চা নিয়ে সুশৃংখল কোনো গবেষণা আজও হয় নি। দেহ বা শরীর ভাবগত ভাবে, দর্শনের বিষয় হিসাবে এবং জীবনচর্চায় নদিয়ার নানা ভাবে এসেছে। প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে ভারতে ও ঔপনিবেশিক আমলে যেসকল লেখালিখি হয়েছে সেখানে সাহেবদেরই প্রাধান্য। তন্ত্রকে দেখা হয়েছে ঔপনিবেশিক ও প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিকোন থেকে। সাহেবদের লেখালেখির প্রকট প্রভাব তন্ত্র নিয়ে গবেষণা ও লেখালিখিতে রয়ে গিয়েছে। পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবাদী লেখালিখির প্রভাবে এই অঞ্চলের বিভিন্ন সাধকদের সাধন প্রণালী বোঝা কঠিন হয়ে গিয়েছে। পদ্ধতি ও প্রকরণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রও চরম অজ্ঞতা রয়ে গিয়েছে। নিম্নবর্গের মানুষের দৈনন্দিনের জীবন জীবিকা ক্ষমতার লড়াই সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে তার ধর্ম চর্চা বা তথাকথিত গুহ্যচর্চার ওপর অতিরিক্ত আগ্রহ গড়ে উঠেছে। সত্য বলতে কি এর ফলে ভক্তি ও ভাবান্দোলন সম্পর্কে চরম অজ্ঞতাই তৈরি করেছে। এই চরম অজ্ঞতার কারণে দেহ বা শরীর শুনলেই আমরা মনে করি এই বুঝি তন্ত্র নিয়ে কথা হচ্ছে।
শক্তির পূজা উপমহাদেশে নতুন কিছু না, পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেটা কমবেশি বিভিন্ন রূপে দেখা যায়। বলা হয় খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দি থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দি পর্যন্ত এখানে শক্তির পূজা, শক্তিবাদ, তান্ত্রিক আচার-ব্যবহার, যোগক্রিয়া ইত্যাদি ছিল। কিন্তু কতটুকু কিভাবে ছিল সেটা অনেকটাই অনুমান নির্ভর। হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্র পরস্পরকে প্রভাবিত করলেও এবং উভয়ের দেবদেবির মধ্যে মিশ্রণ ঘটলেও তদের মধ্যে ফারাক আছে। শিব-দুর্গা, বিষ্ণু-লক্ষ্মী, উপায়-প্রজ্ঞা, বজ্রসত্ত্ব-বজ্রেশ্বরী ইত্যাদি প্রকৃতি ও পুরুষের নানান দ্বিধা বিভক্তি এক রকম নয়। দেহ সংক্রান্ত ধারণা ও চর্চার মধ্যেও ফারাক রয়েছে। বিভিন্ন চরিত্রকে কিভাবে কল্পনা করা হয়েছে সেই দিকে নজর দিলে হয়তো কিছুটা আন্দাজ করা যায়। রাধা-কৃষ্ণ রূপে তার যে অভিপ্রকাশ যদি তাকেও শক্তির উপাসনার দিক থেকে দেখতে চাই তাহলে বড় ধরনের হোঁচট খেতে হয়। তার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় কাব্যে বা সাহিত্যে থাকলেও কোনো পুরাণ ও তন্ত্রাদি ধর্মশাস্ত্রে রাধাকৃষ্ণের মধুর যুগল লীলার কোনো নিদর্শনই নাই। রাধা কৃষ্ণ প্রাচীন ভারতীয় কাব্য ও সাহিত্যের ব্যাপার হয়ে ছিল। এই লোককথা কোনো ধর্মের প্রণোদনা তৈরি করে নি বা ধর্ম হয় নি। একান্তই কাব্য ও সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বাংলায় এটা নতুন জিনিস, এই ভাব ও তার চর্চা একান্তই বাংলা ও তার আশপাশের। কাব্য, সাহিত্য ও ধর্ম এখানে একাকার হয়ে গিয়েছে। অন্য কোনো বিচারে যদি প্রবেশ নাও করি, এই পার্থক্যই তো দারুণ ব্যাপার। এই মৌলিক বিবেচনা মনে না রাখলে নদিয়ার ভাব সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা করাও অসম্ভব।
ইতিহাসে বড় ধরণের ছেদ আছে, বড় বড় মোড় ও পথের ফারাক আছে। সেইসবের কোনো খবর না রেখে যেহেতু লালনের মধ্যে দেহের কথা আছে, দ্বিদলের কথা আছে, অমাবস্যায় পূর্ণিমার কথা আছে তাকে এক কথায় ‘তন্ত্র’ বলা বিশুদ্ধ আহাম্মকি মাত্র।
ক্ষিতিমোহন সেন একবার বাউলদের গান ছেপেছিলেন। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সেই সব গানে মুগ্ধ হয়ে বাংলার আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ালেন, কিন্তু সেই গান আর খুঁজে পেলেন না। উপেন্দ্রনাথ তার ‘বাংলার বাউল’ বইতে লিখেছেন: “ক্ষিতিমোহন বাবুর গানের অনুরূপ ভাবপ্রকাশক গান দুই একটা মিলিলেও ঐরূপ প্রকাশভঙ্গী দেখা যায় না।…ক্ষিতিমোহনবাবুর গানের রচয়িতা বাউলরা কোথায় গেল?” (ভট্টাচার্য, ১৪০৮ বাংলা, পৃ. ৭১)। তিনি ঠিকই বলেছেন, “অধ্যাপক মন্সুরুদ্দিন সাহেব সম্পাদিত দুই খণদ ‘হারামণি’তে যেসমস্ত বাউল-গান সগৃহীত হইয়াছে, স্থানে স্থানে পাঠ-বিকৃতি বাদ দিয়া ধরিলে, সেই গুলিই বাংলার প্রকৃত বাউল গান ওই রকমের গানই আমি নানাস্থানে পাইয়াছি’। (ভট্টাচার্য, ১৪০৮ বাংলা, পৃ. ৭১)
ক্ষিতিমোহন সেন বাংলার সাধকদের সাধন প্রণালী সম্বন্ধে আদৌ কিছু জানেন কিনা সে ব্যাপারে উপেন্দ্র ভট্টাচার্যের সন্দেহ দেখা দিল। তিনি সেন বাবুর সঙ্গে সরাসরি দেখা করলেন। কিন্তু ক্ষিতিমোহন সেন, উপেন্দ্র ভট্টাচার্যের প্রশ্নের কোনো প্রত্যক্ষে উত্তর না দিয়ে গাল গল্পে সময় কাটিয়ে দিলেন। এর কিছুদিন পর ক্ষিতিমোহন সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লীলা-বক্তৃতা’ দিলেন। সেই বক্তৃতা শুনে হতাশ হয়ে উপেন্দ্র লিখছেন, “দুঃখের বিষয়, যে ঐতিহাসিক ও বিচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার বাউল মতবাদের প্রকৃত স্বরূপ ও তাহাদের সাধনার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করা প্রয়োজন, তাহার সন্ধান মিলিল না। বেদ ও উপনিষদ প্রভৃতি হইতে কতকগুলি অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতির পর শেষের দিকে হিন্দু তন্ত্রানুযায়ী যোগ ও ষটচক্র ভেদের কথা বলিয়া পূর্ণানন্দের ‘ষটচক্রনিরূপন’ হইতে একটি সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া তিনি প্রবন্ধ শেষ করিলেন। বাউলেরা কি প্রকারের যোগ সাধন করে, হিন্দু তন্ত্রোক্ত ষটচক্র ভেদ ও তাহাদের যোগের মধ্যে কি সাদৃশ্য ও প্রভেদ আছে, সে সম্বন্ধে কিছুই বলা হইল না। ষট-চক্র ভেদ সম্বন্ধে শ্লোক উদ্ধৃতিরই বা অর্থ কি?” (ভট্টাচার্য, ১৪০৮ বাংলা, পৃষ্ঠা ৭২) ।
উপেন্দ্র ভট্টাচার্যের দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলাম কারন বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনচর্চার ধারা বোঝার জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। কলকাতায় বসে যারা কেতাব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন বাংলার সাধনার ধারা– যাকে আবার ভদ্রলোকরা ‘বাউল’ বলে চিহ্নিত করে– সেটা আসলে তন্ত্র মাত্র, উপেন্দ্রের এই কথাগুলো তাদের গালে থাপ্পড় হিসাবে পড়েছিল। তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, বাংলার এই বিশেষ ধারার সাধনাকে ক্ষিতিমোহন সেন ও শান্তিনিকেতনী পণ্ডিতরা ধরে নিয়েছিলেন, মধ্যযুগের উত্তর ভারতের সাধন পদ্ধতিরই বঙ্গদেশীয় রূপ। সরাসরি খোঁজখবর নেবার প্রয়োজন মনে করেন নি। উপেন্দ্র বলছেন, “এগুলো (অর্থাৎ যেসকল তান্ত্রিক পদ্ধতির কথা বঙ্গের ভাব ও জীবনচর্চার ওপর ক্ষিতিমোহন সেন আরোপ করেছিলেন সেইসব) ধর্মতত্ত্ব ও সাধন পদ্ধতি হিসাবে মধ্যযুগের উত্তর ভারতের সাধক– নানক, কবীর, দাদু, রজ্জব প্রভৃতির মধ্যে চলিয়া থাকিতে পারে, কিন্তু বর্তমান বাংলায় বাউলরা ঠিক ঐ পদ্ধতিতে সাধনা করে না। বর্তমানে বাংলার বাউলরা যে গান করে, যে ভাবে ধর্ম-জীবন যাপন করে, ধর্ম-কর্ম করে, তাহার সহিত ক্ষিতিমোহন বাবু কর্তৃক প্রচারিত গান বা বা তাঁহার বর্ণিত সাধন-প্রণালীর বিশেষ কোনো মিল নাই। মনে স্বভাবতঃই প্রশ্ন ওঠে– বাংলার এ কোন্ অবাস্তব বাউলদের কথা তিনি আমাদিগকে শুনাইতেছেন? ইহারা কাহারা? কোথায় ইহাদের বাড়ী? ইহাদের কি কখনো বাংলায় আবির্ভাব ঘটিয়াছিল?” (ভট্টাচার্য, ১৪০৮ বাংলা, পৃ. ৭৩)
কলকাতায় বসে একই কাণ্ড করেছেন শশীভূষণ দাশগুপ্ত। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য-চরিতামৃতে’ গৌরতত্ত্ব ও রাধাতত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেই সকল তত্ত্ব আলোচনার সময় তিনি কোন কামগন্ধ পান নি। সেখানে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের সমস্ত জীবন হোল ‘অপ্রাকৃত রাধা প্রেমের ভাব-ব্যাখ্যা’। তার ‘শ্রীরাধার ক্রমবিকাশঃ দর্শনে ও সাহিত্যে’ গ্রন্থটির ঠিক পরবর্তী অধ্যায়েই বৈষ্ণব সহজিয়াদের সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত হচ্ছে সহজিয়াদের জীবন চর্চা “বৈষ্ণব দার্শনিক সিদ্ধান্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত নহে”। (দাশগুপ্ত, ১৩৯৬ বাংলা, পৃষ্ঠা ২৭৬)তাহলে তাদের আর বৈষ্ণব সহজিয়া বলারই বা দরকার কি? শশীভূষণ বলছেন, “এ ধর্মের প্রতিষ্ঠা আসলে কতগুলি গুহ্য সাধনের ওপর। সহজিয়াগণের এই গুহ্য সাধনার ধারাটি ভারতীয় সাধনার ক্ষেত্রে একটি অতি প্রাচীন ধারা। এই সাধনাগুলি বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্মমতের সহিত যুক্ত হইয়া বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিয়াছে; কোথাও ইহা তান্ত্রিক সাধনা রূপে প্রচলিত, কোথাও ইহা আসিয়া গ্রহণ করিয়াছে বৌদ্ধ-সহজিয়াদের ভিতরে রূপান্তর; সেই সকল সাধন-প্রণালী বৈষ্ণব ধর্মের সহিত যুক্ত হইয়া আবার বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায় গড়িয়া তুলিয়াছে”। অর্থাৎ এত বিবর্তন, পরিবর্তন ও রূপান্তরের পরও তারা সেই পুরানা জিনিসই রয়ে গিয়েছে। বলছেন, “এই সকল ধর্ম-সম্প্রদায় বাহির হইতে যতোই পরস্পর থেকে পৃথক বলিয়া মনে হোক, আসল সাধনা বিচার করিলে সকলের ভিতরেই একটা গভীর ঐক্য অনুভূত হইবে”। কারণ কি? কারন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ‘সাধনার প্রচলন’ যাই হোক বা তাদের সাধন পদ্ধতির মধ্যে বিশাল পার্থক্য থাকুক বা না থাকুক, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ‘কতগুলি দার্শনিক সিদ্ধান্ত’ জড়িত। আবার তাদের সব সিদ্ধান্তের মূলে নাকি এক ‘চরম সত্য’ আছে। সেই “চরম সত্য’ হোল, ‘এক অদ্বয় পরমানন্দ স্বরূপ’। এই অতি বিমূর্ত কায়দায় ও অতি উচ্চ বিভিন্ন সাধন পদ্ধতি তাদের দর্শনের মধ্যে অতি কষ্টে ঐক্য অনুমান করে শশীভূষণ দাবি করেছেন তন্ত্রের কেবলানন্দই নাকি ‘অখণ্ড যুগল তত্ত্ব’। অদ্বয় তত্ত্বের দুটা ধারা। একটা ‘শিব’ আরেকটি ‘শক্তি’। তন্ত্রে এই দুই শক্তির মিলনে যে তুরীয় আনন্দ ঘটে সেটাই ‘কেবলানন্দ’। কেবল আনন্দ, বা সোজা কথায় কেবল তুরীয় যৌনানন্দ লাভই নাকি সকলেরই ‘চরম সত্য’। সেটা বৌদ্ধদের ‘যুগনদ্ধতত্ত্ব’ বলি, কিম্বা অন্যদের চর্চায় ‘মিথুনতত্ত্ব’, ‘যামলতত্ত্ব’ বা সহজিয়াদের ‘যুগলতত্ত্ব’ বলি সকলই হরে দরে তন্ত্রের ‘কেবলানন্দ’ মাত্র। (দাশগুপ্ত, ১৩৯৬ বাংলা, পৃ. ২৭৭)
এই বৈচিত্র, বিভিন্নতা, পার্থক্য ও নানান ঐতিহাসিক পরিববর্তন ও রূপান্তর সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এবং অতিশয় কঠিন ও কষ্টকর চিন্তার কসরত প্রদর্শন করে শশিভূষণ ‘তন্ত্রের নারী পুরুষের মিলিত সাধনার রহস্য’ উদ্ঘাটন করেছেন। দাবি করেছেন বৌদ্ধ ধর্ম আশ্রয় করে যে গুহ্য সাধনপদ্ধতি বাঙলাদেশে প্রচলিত ছিল, সেই সাধনা আর হিন্দুতন্ত্রোক্ত সাধন পদ্ধতি ‘মূলত এক’।
সব যদি হরেদরে এক হয় তাহলে আর পার্থক্যের কথা বলে কি লাভ? ক্ষিতিমোহন সেন, শশীভূষণ দাশগুপ্ত কলকাতায় বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলার সাধনার ধারার গোড়ার সত্য তন্ত্র এবং তার লক্ষ্য তুরীয় যৌনানন্দ কেবল। এই সিদ্ধান্ত প্রচার করে বাংলার ভাবচর্চা ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জীবনযাপনের সংস্কৃতি সম্পর্কে যে ভুল ধারণা দিয়ে গিয়েছেন তা কাটিয়ে ওঠা আজ অবধি দুঃসাধ্য হয়ে রয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে তন্ত্রের যে ব্যাখ্যা তারা দাঁড় করিয়েছেন সেটা ঔপনিবেশিক আমলে পাশ্চাত্য তন্ত্রকে যেভাবে দেখেছে তার চেয়ে পৃথক না। এই আনন্দ মূলত (তান্ত্রিক) পুরুষের, নারী এখানে আনন্দ লাভের উপায় বা হাতিয়ার মাত্র। তন্ত্র সম্পর্কে এই ধারণাই ক্ষিতিমোহন, শশীভূষণ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। এই ধারনারই দাপট দুনিয়াব্যাপী চলছে। পশ্চিমা ‘তন্ত্র’ বলতে কি বোঝে তা অনুধাবন করবার জন্য গুগলে ‘তন্ত্র’ সার্চ দিলেই গড়গড় করে বেরিয়ে ‘পর্নো’ সাইট। এটা যৌনানন্দ লাভের একটা উপায় মাত্র। ক্ষিতিমোহন, শশীভূষণদের দাবি এটাই তন্ত্র, কেবলানন্দের চর্চা। শুধু বাংলা নয়, এই উপমহাদেশে তন্ত্র ও নানাবিধ সাধনার ধারার মধ্য দিয়ে যে বিচিত্র ও বিভিন্ন ভাব ও দর্শন ও জীবন যাপন সাধনার ধারা গড়ে উঠেছিল তাদের সবকিছুকেই একাট্টা একপ্রকার কেবলানন্দে পর্যবসিত করে কিভাবে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদ্যার ধারায় তাদের পর্নোগ্রাফিতে পর্যবসিত করা হয়েছে সে এক বিস্ময় বটে? লালনকে তান্ত্রিক বললে সে কারনে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে যেভাবে ভয় পায় আমাদেরও সেই ভাবেই ভীত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ধর্মচর্চার ইতিহাসের জায়গা থেকে বিচার করলেও ‘তন্ত্র’ বলতে কি বোঝায় বা কে কি বোঝে সেটা পরিচ্ছন্ন করে তোলা সহজ নয়। শব্দটি কেন্দ্র করে যে ধারণা গড়ে উঠেছে তাকে পুরাটা প্রাচ্যদেশীয় বলা যাবে না। পাশ্চাত্য প্রাচ্যের ধর্মাচার কি চোখে দেখেছে ও কিভাবে সেই দেখাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। বিশেষত ঔপনিবেশিক আমল থেকে এ দেশের জনগণের জীবন, ধর্ম, আচার অনুষ্ঠান দেখে প্রাচ্যের ‘অসভ্যতা’ ও ‘বর্বরতার’ নিরিখে পাশ্চাত্য যেভাবে নিজেদের ‘সভ্য-ভব্য’ ভাববার ধারণা গড়ে তুলেছে তন্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই সকল নানান জটিল দিকও এসে পড়ে। এই দিক গুলো অস্পষ্ট রেখে লালনকে ‘তান্ত্রিক’ বলা বিপজ্জনক। কারণ লালনকে ‘তান্ত্রিক’ বললে ‘তন্ত্র’ সম্পর্কে যেসব অস্পষ্ট, অপরিচ্ছন্ন ও আজগবি চিন্তা সমাজে জারি রয়েছে তার খোপের মধ্যে তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। লালনকে একটা খোপের মধ্যে পুরে ফেললে লালনের চিন্তা ও চর্চাকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিচার করে জানা, বোঝা ও বিশ্লেষণ কঠিন হয়ে পড়ে। এটা মস্ত ক্ষতির জায়গা। আগাম অনুমান গবেষণার পথ অপরিচ্ছন্ন করে তোলে। দেহবাদিতা মানেই তান্ত্রিকতা এই ধারণা বা অনুমানের পক্ষেও কোনো যুক্তি নাই। কিন্তু ‘তন্ত্র’ সম্পর্কে এমনই এক ধারণা তৈরি করে রাখা হয়েছে যাতে দেহ নিয়ে আলোচনা মানেই যেন তাকে প্রাচীন তন্ত্রই হতে হবে। আর কিছু না। এবং সেটা কেবলই গুহ্য যৌনাচার।
বলা বাহুল্য, দেহ সম্পর্কে ফকির লালন শাহের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী ও শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত হবার নির্দিষ্ট বিধি বিধান ও চর্চা আছে। নিজের ও অপরের প্রতি। এক ও অনেকের। অবশ্যই। দেহের ধারণা ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত হবার যে চর্চা লালন করেছেন এবং তার অনুসারীরা করে তাকে সুনির্দিষ্ট ভাবেই বোঝা দরকার। সেখানে নারীপুরুষ সম্পর্কের দিক যেমন রয়েছে, তেমনি খাদ্য ব্যবস্থা, সেবা আয়োজনের রীতি, সেবা দেওয়া ও নেওয়ার বিধি বিধান অন্তর্ভুক্ত। অথচ এই দিকগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া দূরে থাকুক একদমই আমলে না নিয়ে গুহ্য যৌন চর্চার প্রতি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হাস্যকর। ভাবগত দিক থেকে লালনের বৈপ্লবিক চিন্তার খবর নেওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। তার পরিণতি দাঁড়ায় গাঁজা ও নেশা দ্রব্য গ্রহন এবং নারীসঙ্গলোভী কামার্ত জীবনের পক্ষে লালনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার।
বিপদ হোল, একালেও যারা নারীকে নিছকই ব্যবহারযোগ্য বস্তু বা যন্ত্র গণ্য করে তারা লালনকে এভাবেই বুঝতে চায়। আমাদের আপত্তি এখানে। ‘সাধনা’ নামক ব্যাপারটাকেও তারা সেভাবেই বোঝে। লালনকে তান্ত্রিক প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এদের আগ্রহই অত্যধিক। প্রাচীন তন্ত্র সম্পর্কেও তাদের চিন্তা সংকীর্ণ। বুঝি কোনো ছেদ, বিবর্তন বা পরিবর্তন ছাড়া তা লালন অবধি একই প্রকার গুহ্য যৌন সাধন পদ্ধতি হিসাবে হাজির হয়েছে।
নদিয়ার ভাবকেন্দ্রিক আলোচনাকে সুনির্দিষ্ট করতে হলে প্রাচীন তান্ত্রিক ধারা সম্পর্কে যে সাধারণ ধারণা প্রবল তার আলোকেই লালন সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। লালনের কাছে নারী ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার নয়। তন্ত্র সম্পর্কে এটাই ‘সাধারণ’ ধারণা। অর্থাৎ মোটা দাগে তন্ত্র বলতে আমরা এটাই বুঝি। কিন্তু এটাই তন্ত্র, আমরা সেই দাবি করি না, কারন সম্পর্কে পর্যালোচনামূলক গবেষণা যথেষ্ট দেখা যায় না।
তবে আমরা চূড়ান্ত বিচারের আগে এই সিদ্ধান্ত অনায়াসে নিতে পারি যে নদিয়া ভাবগত ভাবে গড়ে উঠবার আগে তন্ত্রাচারে যে ধারাকে আমরা ‘সাধারণত’ মানুষকে যন্ত্র বা হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করতে দেখি তার সঙ্গে লালনের মিল নাই। শরীরকে হাতিয়ারমূলক ভাবে দেখার আলোকে টেকনলজি, দেহ ইত্যাদির বিচার করা দরকার। ‘সাধারণত’ কথাটার মানে এটাই। এই ভাবে মানুষের দেহ বা শরীরকে দেখা আমরা মূলত প্রাচ্যবিদ্যাকেন্দ্রিক বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর কল্যাণে রপ্ত করেছি।
তন্ত্রকে এভাবে প্রাচ্যবিদ্যা কেন্দ্রিক বা বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার বিপদ হচ্ছে একে নিছকই একটা গুহ্য সাধন পদ্ধতি হিসাবে প্রমাণ করে সমাজে ও ভাবচর্চার বৃহত্তর পরিসরে লালনকে ‘বর্তমান’ করে তোলার পথ অংকুরেই রুদ্ধ করে দেওয়া। তাকে সমাজের বাইরে একটা প্রান্তিক বিষয়ে পরিণত করা, গুহ্য যৌন চর্চা ছাড়া তার বুঝি আর কোনো জীবন নাই বা ছিল না যা সমাজে অনুসরণীয়। যারা সজ্ঞানে অজ্ঞানে লালনকে অপাংক্তেয় ও প্রান্তিক করে রেখেছেন সে কারনে তাদের বিরোধিতা করা জরুরি।
যারা লালনকে তান্ত্রিক বলছেন তন্ত্র সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ ধারণার আধিপত্যের আলোকেই তান্ত্রিক বলতে চান। নারী ব্যবহার যোগ্য হাতিয়ার মাত্র এই অর্থেই লালনকে ‘তান্ত্রিক’ বলে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান তারা। যদি না চাইতেন তাহলে এই দেখার মুশকিল নিয়ে আগে আলোচনা জরুরি ছিল। দ্বিতীয়ত, এটা বোঝা কঠিন নয় যে নদিয়া তন্ত্র ও তান্ত্রিকদের ধারা পর্যালোচনা করেই গড়ে উঠেছে। লালনের সাধন পদ্ধতি বাছবিচার ছাড়া গড়ে ওঠে নি। বিশেষত সেই সকল তান্ত্রিক ধারা যেখানে শরীর — পুরুষ ও নারী উভয়েরই দেহ — নিছকই শক্তি চর্চার যন্ত্র বা হাতিয়ার – নদিয়া তা পরিহার করতে চেয়েছে। শক্তির পূজা – শরীরের এই ব্যবহার -- নারীর ওপর সাধনার নামে বিশেষ ভাবে অত্যাচার হয়েছে, অনেক সময় অবর্ণনীয়। ব্যতিক্রম নাই তা নয়, কিন্তু এটাই মূল প্রবণতা। লক্ষ্যণীয় তন্ত্রের ‘পর্যালোচনা’ মানে এই চর্চার ধারা থেকে সাধক ও শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয়ের যে অভিজ্ঞতা তার সফলতা ও বিফলতা উভয় দিক বিচার করে দেখা যেতে পারে। একাট্টা সমালোচনা বা বিরোধিতা নয়।
ধরা যাক তারপরও কেউ লালনকে তান্ত্রিক বলতে চান। তর্কটা শব্দ নিয়ে নয়। তাহলে তিনি কোন অর্থে ‘তান্ত্রিক’ সেটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এটা ব্যাখা না করলে ফকির লালনের সাধনাকে ‘তান্ত্রিক’ বলার কোনো যুক্তি নাই। যদিও আগেই বলেছি লালন নিজেকে তান্ত্রিক বলেন নি, এমনকি বাউলও বলেন নি। তন্ত্র সম্পর্কে প্রাচ্যবিদ্যার বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্যের কারণে লালনকে তান্ত্রিক বলার অর্থ তাকে নিন্দনীয় করে তোলা মাত্র। লালনকে তান্ত্রিক বললে তাকে বুঝতে সুবিধা হয় না। বরং বাধা তৈরি করে। তাছাড়া লালন অনুসারীরা তাদের সাধনাকেও কখনো ‘তন্ত্র’ বলেছেন এমন নজির নাই। সাধুগুরুরা একে ‘ঘরের কাজ’ বা ‘করণ কর্ম’ বলে থাকেন। সেখানেও গুরু ভেদে ও ভক্তের গ্রহণ ক্ষমতা ভেদে পার্থক্য রয়েছে। ‘যেখানে সাঁইর বারামখানা / শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে/ দেখতে যেমন ভূজঙ্গনা’। সেখানেও ফণিধর বিষাক্ত সাপ ভীষণ ফণা তুলে থাকে; এদিক ওদিক হলে সর্বনাশেরই সম্ভাবনা– এই কথা বলে লালন বরং সে পথে যেতে ভয়ই দেখিয়েছেন। বারবার নিরুৎসাহিত করেছেন।
লালনকে তান্ত্রিক বলার অর্থ প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতেই লালনকে দেখা ও সেভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা। সেটা যদি কেউ করতে চায় তাহলে প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর পর্যালোচনা করে দেখাতে হবে ‘তন্ত্র’ সম্পর্কে আমরা যা জানি বা শুনি সেটা ঠিক না। ইন্টারনেটে ‘তন্ত্র’ নামে গুগুল করলে কেন পর্নোগ্রাফির সাইট আসে, এই বিকারটাও ব্যাখ্যা করতে হবে। তাছাড়া যৌনতা ও নেশা দ্রব্যের প্রতি অতি উৎসাহীদের কবল থেকে লালনকে রক্ষা করেই দেখাতে হবে নাথপন্থী, বৌদ্ধ বা সহজিয়া ধারার কোন্ বিশেষ স্রোত লালনে এসে মিশেছে। লালন সতী মায়ের ঘরকে ‘গদি মান্য’ করেছেন। কর্তাভজাদের কাছে তিনি ঋণী। তার মানে সকল সহজিয়া ধারাকে তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করেন নি। তাহলে লালনকে বুঝতে হলে কর্তাভজাদের ওপর গভীর গবেষণার দরকার আছে। এইসকল ক্ষেত্রে তন্ত্র নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা ও পর্যালোচনার অনুপস্থিতি রয়েছে। তার পরও আরো জানা বোঝার কষ্ট ও অধ্যবসায়ে মনোযোগ না দিয়ে যারা এক কথায় লালনকে ‘তান্ত্রিক’ বলেন তারা লালনকে একজন যৌন সাধকের অধিক মর্যাদা দেন না। লালনকে একজন তান্ত্রিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে তারা সুনীল ও গৌতম ঘোষের মতো নিন্দনীয় কাজটিই জারি রেখেছেন। তো অসংখ্য সুনীল-গৌতমরা আমাদের চারদিকেই আছে। লালনকে এদের হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন কাজ বটে।
তিন: ‘দেহ’ কথাটার বিবর্তন
অথচ দরকার প্রাচীন তন্ত্র থেকে শুরু করে চৈতন্যের রসতত্ত্ব, এবং লালনের ‘ভাব দিয়ে ভাব নেওয়া’ অবধি ‘দেহ’ কথাটর কিভাবে বিবর্তন ঘটেছে তার হদিস নেওয়া। বাংলার ভাব ও ভাবচর্চার জগত আর প্রাচীন তন্ত্রের জায়গায় পড়ে নাই। তার বিবর্তন আছে, ইতিহাস আছে। যারা কিছুই বদলায়নি অনুমানে দাবি করেন, লালন “তান্ত্রিক” তারা অনৈতিহাসিক এবং তাদের নির্বিচার অবস্থান নদিয়ার ভাব বোঝা ও পর্যালোচনার জন্য বড় একটি বাধা। লালনের সামগ্রিক চিন্তা সম্পর্কে হুঁশিয়ার না থেকে এবং নদিয়ার জাতপাত বিরোধী আন্দোলনের সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য উপেক্ষা করে একটি কি দুটি গানের দুই একটি পদ বিক্ষিপ্ত ভাবে তুলে এনে তাকে আক্ষরিক ভাবে ব্যাখ্যা করার ফলে এই বিপত্তি বারবার ঘটে।
যেমন, লালনের গানে ফুল আছে। কেউ হুট করে একটি গানের উদাহরণ দিয়ে যদি কটাক্ষ করে জানতে চায়, ‘এই ফুল কি গোলাপ ফুল? জবা ফুল? নাকি জবাকুসুম?’। তাকে মনে করিয়ে দেই, যে-গানের উদাহরণ দিয়েছেন তার বিষয় নিছকই আক্ষরিক অর্থে তন্ত্রের ‘ফুল’ নয় এবং নিছক ফুলও নয়। বরং ‘ফুলের মর্ম’। গানেও তাই আছে। বোঝাবুঝির জায়গা ফুলের মর্ম নিয়ে এবং সেটা ভাব বিচার ছাড়া সম্ভব না। এই কালামে ‘ফুল ছাড়া নয় গুরু পূজা’, এই কথাও আছে। অর্থাৎ ‘ফুল ছাড়া গুরু পূজা’ হয় না। তো কেউ তন্ত্রের জায়গা থেকে আক্ষরিক ভাবে বুঝলে গুরুকে তো ফুল পূজা দিতে হবে। সেই ফুলের ‘ধ্বজা’ জন্মের পথে। তো বাকিটুকু ভক্তকে– বিশেষত তিনি যদি নারী হয়ে থাকেন– কি করতে হবে বুঝে নিন। লালনের গানকে এইভাবে ভাবে ব্যাখা করে ফকিরীর নামে কি হয় সে সম্পর্কে হুঁশ থাকা দরকার। অথচ এই কালামেই এই ইঙ্গিত ও ইশারাও স্পষ্ট যে এটা ‘সামান্য’ ফুল নয়। এই ‘এক’ ফুল যেখান থেকে নবিও পয়দা হয়েছেন। নবিজীও মায়ের জন্মপথেই এসেছেন, তিনিও তো মানুষই ছিলেন। তো লালন সেই বিশেষ ‘ফুল’ নিয়ে কথা বলছেন, সব ফুল নিয়ে কি? আর, চিরদিন সেই ফুল দিন দুনিয়ার মকবুল বা ইচ্ছা বা আকাংখা হয়ে আছে (চিরদিন সেই যে ফুল/দিন দুনিয়ার মকবুল)। তাহলে পরমার্থিক আকাংখারও একটা ব্যাখ্যা এই গান দাবি করে। পরমার্থিক আকাংখার দিক ব্যাখ্যা করার যদি যোগ্যতা না থাকে তবে স্বার্থান্বেষী সস্তা যৌন অর্থই ওখান থেকে বের হবে এ আর নতুন কি!
দেখা যায় এই গানেই উপমান্তরে গেলে প্রথাগত তান্ত্রিক ব্যাখ্যা আর টেঁকে না। এই গানের উদ্ধৃতি দিয়ে একজন যে তর্ক তুলেছিলেন তাতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন জানি না। গানটি তার বদ হজম হয়েছে এটা বুঝতে পারছি। ঠিক মতো পড়লে ‘ভাব দিয়ে ভাব নেবার’ তাগিদই বরং তীব্র হয়। লালনের ‘ফুল’ নিয়ে কটাক্ষে অসুবিধা নাই, কিন্তু বোঝা দরকার ফুলকে যে অর্থেই ব্যবহার করি না কেন ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়’ – লালনের এই প্রস্তাবনাকে এড়িয়ে গিয়ে গানটিকে ব্যাখ্যার কোন উপায় নাই। ‘ফুলের মর্ম’ বোঝার চেয়েও ফুলকে স্থূল দেহাত্মবাদী অর্থে বোঝার দিকে ঝোঁক লালনের ‘ভাব দিয়ে ভাব নেবার’ ভাবের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
লালনের আগে পিছে ও মাঝখানে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব সহজিয়াসহ আরও নানান ধারা ও উপধারা তো আছেই। কিন্তু লালনের চর্চা এই ভাব দেওয়া নেওয়ার ওপরই দাঁড়ায়। তারপর অন্য কথা। প্রাচীন তান্ত্রিক চিন্তার কাঠামোর মধ্যে থাকলে চৈতন্য নদিয়াতে আসলে কী ‘দিব্যযুগ’ দেখিয়ে গেলেন তার অর্থ বোঝাও কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষত ‘রস’ নিয়ে যে ধারণা রয়েছে তাতে গুরুত্বপূর্ণ আন্তরিক আলোচনা বাংলাদেশে এখনও কঠিন ব্যাপার।
যারা লালনকে তান্ত্রিক বলেন তারা একই নিঃশ্বাসে বলেন, ‘সহজিয়া, চৈতন্য এবং লালন আদিম তন্ত্রের খণ্ডিত উত্তরাধিকার মাত্র। তন্ত্র হচ্ছে ফিয়ারলেস ফ্রিডম’। তো লালন যদি তান্ত্রিক হয়ে থাকেন তো নির্ভয়ে কিসের স্বাধীনতা ভোগের কথা তারা বলেন সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। এই প্রকট পুরুষতন্ত্র ও প্রচণ্ড ব্যাক্তিতান্ত্রিক আধুনিকতাবাদের কাছে ব্যাক্তি স্বাধীনতাই ‘ফ্রিডম’। এবং সেটা আবার ‘ফিয়ারলেস’ – অর্থাৎ এই ফিয়ারলেস ইগো কোন সামাজিক বন্ধন বা অপরের প্রতি দায় মানে না, কিম্বা তার নিজের কাজের পরিণতি সম্পর্কে হুঁশ নাই– আধুনিক অপরিণামদর্শী ব্যাক্তিরা ব্যাক্তিতন্ত্রকেই ‘তন্ত্র’ বোঝেন। এবার দেখুন, আমরা কোথায় এসে ঠেকেছি। আর তিনিই আমাকে বলছেন, আমি নাকি বৈদিকদের ‘আধুনিক’ প্রতিনিধি।
যদি ‘মর্ম’ বাদ দিয়ে আক্ষরিকতায় বন্দী হয়ে স্থূল দেহাত্মবাদী ব্যখ্যা কারো বাসনা হয়, সেটা সে করতেই পারে। ‘নদিয়ার ভাব’ কথাটা বলে আমি একটা প্রশ্ন ও কর্তব্য জারি রাখার চেষ্টা করি। সেটা হোল, এই ভাবের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যট কি? সেটা শনাক্ত করতে হলে এটা যে স্রেফ তন্ত্র নয় এই প্রাথমিক অনুমান জারি রাখা। যেন সেই বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।এবং সেই কাজে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি। ‘কেবলানন্দ’কেই মুখ্য জ্ঞান করে তন্ত্রে দেহকে স্রেফ হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের যে আধিপত্য এখনও পুরা দস্তুর বহাল রয়েছে নদিয়ার ভাব যে মোটেও তার ধারাবাহিকতা নয় সেটা বোঝা ও অন্যকে বোঝানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নদিয়ার ভাব জাতপাত বিরোধী, শ্রেণি ভেদ ও নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসাবে গড়ে উঠেছিল। নিছক আহাম্মক না হলে সেই ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে নিছকই যৌনচর্চা কেন্দ্রিক তান্ত্রিক ধারার ধারাবাহিকতা বলা যায় না। তারপরও লালনের গানের ‘মর্ম’ বাদ দিয়ে তন্ত্রবাদী আক্ষরিকতায় বন্দী স্থূল দেহাত্মবাদী ব্যখ্যা সহজে বন্ধ করা যাবে না। কারন লালনকে প্রান্তিক করে রাখার ক্ষেত্রে সমাজের উচ্চ ও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সহ সমাজের নানান স্বার্থ জড়িত। নারীকে যৌন পণ্য ও যৌনানন্দের হাতিয়ার বানানোর পুঁজিতান্ত্রিক প্রাবল্যও এই ধরনের ব্যাখ্যার বিকট কারন হয়ে আছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া সহজ কোন পথ আমাদের কাছে খোলা নাই। লড়াইটা এই অর্থে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। লালনের তাৎপর্য বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক বলে আমি মনে করি। এই বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ভাব ও ভাবচর্চার ইতিহাসে পার্থক্যসূচক ছেদ বা উল্লম্ফন বলা যেতে পারে। সেই ইতিহাস শুধু তন্ত্রের ইতিহাস না। সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির। ওপরে ইঙ্গিত দিয়েছি সেটা টেকনলজি বা কৃৎকোশোলেরও গোড়ার প্রশ্ন।
ইতিহাস তো সরল রেখায় আগায় না, তার ধারাবাহিকতা যেমন আছে, তার মোড়, ছেদ, পার্থক্য, মোচড় ইত্যাদিও আছে। এমন কিছু ছেদ বা মোচড় আছে যার পর নতুন বৈশিষ্ট্যকে আর আগের অবস্থা জ্ঞান করে বিচার করা চলে না। কার্ল মার্কসের মধ্যে হেগেল আছে – কান্ট থেকে শুরু করে পুরা এনলাইটমেন্ট ধারার কিছু না কিছু উপাদান তো আছেই, কিন্তু যদি বলি তিনি আপাদ মস্তক চিন্তায় ও চর্চায় হেগেল ছাড়া কিছু না, তখন এই দাবিই করা হয় যে মার্কসের নিজস্ব কোন অবদান নাই, । এই ধরনের দাবি করবার লোকের যেমন অভাব নাই, তেমনি ফকির লালন চিন্তায় ও চর্চায় একজন তান্ত্রিক – এটা প্রমাণ করবার লোকেরও অভাব দেখছি না। এর আশু বিপদ হচ্ছে:
এক: দর্শন বলি, ভাব বলি কি চিন্তা বলি তাকে ঐতিহাসিক ভাবে বিচারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা। কার্যত এটাই দাঁড়ায় যে আমাদের চিন্তার কোন বিবর্তন বা ইতিহাস নাই। কোন্ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তার বিবর্তন ঘটেছে সেই ইতিহাস অনুসন্ধানেরও অতএব কোন দরকার নাই। নদিয়া এখনও তান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চায় জায়গায় পড়ে আছে। নদিয়ার ভাব আর নতুন কিছু না। পুরানা তন্ত্র সম্পর্কে জানলেই চলবে। অন্যদিকে তন্ত্র সম্পর্কে এখন যে ধারণার আধিপত্য রয়েছে তাকে মেনে নিয়ে। তন্ত্রের বিরুদ্ধে যে সকল প্রচার প্রপাগাণ্ডা হয়েছে তাকেও পরোক্ষে স্বীকার করে নিতে হয়। কারন ‘তন্ত্র’ বলতে সেটাই ধরে নেওয়া হচ্ছে ঔপ্নিবেশিক আমলে সাহেবদের লেখালিখিতে যা প্রতিষ্ঠিত। সেটা হচ্ছে যে এটা নিছকই একটা গুহ্য যৌনাচার, যার লক্ষ্য তুরীয় যৌনানন্দ। আর, এটাই নাকি এক্সময় এদেশের মানুষের প্রধান ধর্ম ছিল।
দুই: অথচ বাংলার বস্তুবাদী চিন্তার ধারা বিবর্তনের একটি প্রধান স্রোত তান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে, যেখানে মানুষ মানে দেহসম্পন্ন মানুষ। স্রেফ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন বিমূর্ত চিন্তাশীল সত্তা নয়। এই বিচারের অভাবে গণমানুষের বস্তুবাদী চিন্তার শক্তিশালী ধারা আমাদের নজরের বাইরে চলে যায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বস্ ধাতু থেকে ‘বস্তু’, বসত, বসতি, ইত্যাদি। পরম যেখানে বসত বা বিরাজ করেন সেটাই বস্তু। তো তিনি তো মানুষের দেহেই বসত করেন। এই অনুমান থেকে কিভাবে দেহবাদ মূলত বস্তুবাদের ধারা হিসাবে বিবর্তিত হয়েছে সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। অন্যদিকে ‘বস্তুরক্ষা’ বলতে সাধকরা কি বোঝান সেটাও এই বোঝাবুঝির সঙ্গে জড়িত । এই চিন্তার ফল, বিকার ও পরিণতিগুলোও অনুসরণ করা খুবই জরুরী। অথচ এই কাজগুলো পড়ে আছে। দীর্ঘদিন। যদি বলি তন্ত্রকে প্রাচ্যবিদ্যা মতে যেভাবে জেনেছি সেটাই শেষ কথা তাহলে গবেষণার আর বিশেষ দরকার পড়ে না।
তিন: লালনকে নিছক তান্ত্রিক বললে লালনের ভাব ও চর্চা এখন কি অবস্থায় বিরাজ করছে তাকেও সরাসরি জানা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়। কানকথা নিয়ে খুশি থাকা, আর কী! লালনের মধ্য দিয়ে যদি নতুন কোন ভাব বা চর্চার উদ্বোধন ঘটে থাকে তাহলে তার বিকাশ রুদ্ধ হবার কারণ কি? তার অনুসন্ধানও এতে মারাত্মক ভাবে বিঘ্নিত হয়। শুধু লালন বা নদিয়ার ভাব সম্পর্কে নয়, ‘তন্ত্র’ সম্পর্কে যেসকল ভুল ও ক্ষতিকর চিন্তা সমাজে রয়েছে তাকেও মোকাবিলা করবার বুদ্ধিবৃত্তিক হিম্মত অর্জন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্য আমাদের প্রবল।
চার: ‘দেহ’ ভাবান্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অনুমান, কল্পনা, ক্যাটাগরি ও প্রত্যক্ষ পরীক্ষানিরীক্ষার বিষয়। এই বিচার যদি রুদ্ধ হয় তাহলে পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে লড়াইয়ের ভাবগত ও রাজনৈতিক জায়গা মারাত্মক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্টসূচক লক্ষণ হচ্ছে এখানে ‘শরীর’ বা ‘দেহ’ অনুপস্থিত। বিপরীতে বাংলার ভাব বলি কি রাজনীতি বলি দেহ নানান সময়ে নানা ভাবে সর্বত্র মুখ্য হয়ে থেকেছে। তাহলে বাংলার ভাবান্দোলনে দেহ কিভাবে হাজির তার বিচার সম্পন্ন করার অর্থ পাশ্চাত্য জ্ঞানকাণ্ডের পর্যালোচনার শর্ত তৈরি করা। আমামদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকাণ্ডের জায়গা থেকে। এই দিক থেকে ‘দেহ’ বা ‘শরীর’ সম্পর্কে ধারণার বিবর্তন বিচার ছাড়া লালনকে স্রেফ তান্ত্রিক বলা চরম মূর্খতা ছাড়া কিছুই না।
পাঁচ: সর্বোপরী লালনকে তন্ত্রের খাপে ফেলে দিলে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের অধীনস্থ ও টেকনলজি শাসিত এই দুনিয়ার রূপান্তরে নদিয়ার ভাব ও চর্চা আমাদের নতুন কোন রাজনীতির সম্ভাবনা তৈরি করে কিনা সেটা বিচার করবার সম্ভাবনাও রুদ্ধ হয়ে যায়। পরিণতি হয় ‘তন্ত্র’ নামক যে খোপটা বানানো হয়েছে, লালনকে নিয়ে সেই খোপের মধ্যেই ডুবিয়ে ফেলা। খাবি খাওয়া। প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠা করা আমাদের চিন্তার ক্ষমতা নাই, ভাব চর্চার হিম্মত নাই। অতএব আমাদের কোনও ইতিহাসও নাই। পাশ্চাত্য চিন্তার আধিপত্য মেনে নেওয়াই আমাদের নিয়তি।
ছয়: তন্ত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা না করে ও বদ্ধমূল অনুমানগুলোকে নাকচ না করলে লালনকে তান্ত্রিক বলার অর্থ তাকে ব্যভিচারী হিসাবে প্রতিষ্ঠা। এতে বাংলাদেশে সংবেদনশীল বিশাল ও সচেতন জনগোষ্ঠিকে দূরে ঠেলে দেওয়াই হয়। কাজের কাজ কিছু হয় না। কারণ তন্ত্র সম্পর্কে এটাই প্রধান ধারনা। যারা লালনের গান শোনে, ব্যান্ডে বাজাতেও পছন্দ করে, তারাও এই ধারণার বশবর্তী হয়ে গাঁজা খাওয়া ও যৌনাচার ছাড়া তার ভাব ও চর্চার জগত থেকে কিছু শিক্ষণীয় আছে মনে করে না।
পাঁচ: একালে লালনের প্রাসঙ্গিকতা বাদ দিয়ে লালন তান্ত্রিক কি তান্ত্রিক না – এই তর্ক নিস্ফল ও অনুর্বর তর্ক। যারা তা করতে চাইছেন তাদের সঙ্গে এই তর্ক চালিয়ে যাওয়া নিরর্থক। কারন এটা আজকের তর্ক নয়। ক্ষিতিমোহন, উপেন্দ্র, শিশিভূষণদের সময়ের তর্ক। এই তর্ককে সাময়িক পাশে রেখে তন্ত্রের প্রশ্ন মূলত দেহ ও টেকনলজির মধ্যে সম্পর্ক বিচারের মামলা -- এভাবে ভাবা অনেক বেশী ফলপ্রসূ। যারা এই মুল আলোচনার জায়গা বাদ দিয়ে লালনকে তান্ত্রিক বানাতে অতি উৎসাহী তারা সেটা করে যেতে পারেন। আমরা তাতে বাধা দিতে পারবো না। কিন্তু আমার তাতে বিশেষ আগ্রহ নাই।
আমার আলোচনার ভারকেন্দ্র মূলত রাজনৈতিক। আগেই বলেছি ‘নিজের ভেতর ও বাইরের সঙ্গে কি ধরণের সম্পর্ক রচনা করব তার বিচারে নিবিষ্ট থাকা’ রাজনৈতিক কারনেই জরুরী। অর্থাৎ নিজের ও অন্যদের শরীর আমরা কিভাবে দেখব, কিভাবে বিচার করব যার সঙ্গে নিজের শরীরের সঙ্গে সজ্ঞান সম্পর্ক রচনা করবার প্রশ্ন জড়িত। সেই সম্পর্ক রচনার জন্য নতুন কর্তাসত্তার উদ্বোধন জরুরী। কিন্তু সেটা ঘটাতে গেলে চিন্তা ও চর্চার যে সকল ধারা ‘দেহ’ বা ‘ শরীর’কে শুধু মাত্র ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার গণ্য করে তাদের শনাক্ত করা ও চিনিয়ে দেয়া অতি প্রাথমিক কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। দেহ এখানে শুধু রক্তমাংসের মানুষ নয় – পুরা প্রকৃতিও বটে, কারণ মানুষ এই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোন সত্তা নয়। সম্পর্কিত। যা ভাণ্ডে তা ব্রহ্মাণ্ডে, কিম্বা যা ব্রহ্মাণ্ডে তা ভাণ্ডে – এই কথাগুলো টেকনলজি শাসিত কালে নতুন ভাবে বোঝা দরকার হয়ে পড়েছে। শুধু প্রজননের সম্পর্ক ও প্রজননকেন্দ্রিক প্রতীক, উপমা বা ইশারায় বুঝলে চলছে না। তন্ত্রের বিচার ততোটুকুই দরকার যতোটুকু এই সময়ের জন্য জরুরী।
একই ভাবে আমরা এখন বুঝি, মানুষ সামাজিক শরীর থেকেও আলাদা নয়। মার্কসের অবদানে সেই সামাজিক শরীরের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের সম্পর্ক বিচারও আমার লক্ষ্য। সে সম্পর্ক বিচার – মার্কস যাকে ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ বলেছেন – সম্পর্ক শাস্ত্রের জায়গা থেকে মানুষকে সমাজদেহের অবিচ্ছেদ্য বিষয় গণ্য করা হয়েছে। এর পুরা তাৎপর্য বোঝা জরুরী।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই টেকনলজি ও দেহ নিয়ে মন্তব্য করেছি। ভাবনা উস্কে দেবার জন্য। টেকনলজির কারনে আমাদের দেহের কি রূপান্তর ঘটছে, সেটা তুমুল আগ্রহের বিষয়। আলোচনার ভারকেন্দ্র কোথায় সেটা আমার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছি আবার:
‘বস্তু ও বিষয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ধরণ আমাদের শরীর ও ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার বদলে দেয়। সেটা নিজের শরীর হোক, কিম্বা শরীরের ভেতরে বা বাইরের কিছু হোক। নতুন সম্ভাবনা যেমন তৈরি করে, তেমনি বিপদও ঘটায়। কিভাবে নিজের সঙ্গে এবং বাইরের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে আমি আমার সম্পর্ক রচনা করব সে ব্যাপারে নদিয়া সবসময়ই সচেতন ও হুঁশিয়ার থেকেছে, থাকতে চায়। এই সজ্ঞান সম্পর্ক রচনাই তার সাধনার সারকথা। তার ভাবচর্চা ও করণ এই সজ্ঞান সম্পর্ক রচনার তাগিদ দ্বারা তাড়িত।
এই অর্থে এগুলো সবই দেহতত্ত্ব। ফলে সম্পর্কের নিত্য রূপান্তরশীল জীবন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই নদিয়া বৃহত্তর অর্থে দেহ ব্যাপারটা আসলে কি সেটা জানতে, বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে চায়। তাহলে একালের টেকনলজিও বাদ যাবে না। বই, টেলিভিশান, কম্পিউটার, ওয়ার্ড প্রসেসিং – সবই। কি হারাচ্ছি কি পাচ্ছি তার হিসাব নিকাশে পাক্কা থাকতে চায়। এই সারকথা বুঝতে ও ধরতে পারলে আমরা ফকির লালন শাহের তাৎপর্যটা এ কালেও কতোটা বিপুল ও প্রখর হতে পারে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারব”।
সম্পর্কের নিত্য রূপান্তরশীল জীবন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই নদিয়া বৃহত্তর অর্থে ‘দেহ’ ব্যাপারটা আসলে কি সেটা জানতে, বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে চায়। দেহ সম্পর্কে যে বিশেষ চিন্তার ভিত্তিতে ঘরের কাজ বা করণ কর্ম নির্ণয় করা হয়েছে একালে তার উপযোগিতা বিচার ছাড়া লালনের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
একালে লালনের দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উপযোগিতা আছে বলে যারা মনে করেন, আমার আশা তাঁরা আমার কথা বুঝবেন।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪। শ্যামলী।
বইপত্রের হদিস
দাশগুপ্ত, শশিভূষণ
শ্রীরাধার ক্রমবিকাশঃ দর্শনে ও সাহিত্যে ; কলিকাতা: এ মুখার্জি এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৯৬ বাংলা.
ভট্টাচার্য, উপেন্দ্রনাথ
বাংলার বাউল ও বাউল গান. কলিকাতা: ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৪০৮ বাংলা.
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)