- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
এবার ১৪২৩ বাংলা সালে গৌর পূর্ণিমার তিথি পড়েছিল ২৭ ফাল্গুন (১১ মার্চ ২০১৭) তারিখে। ছেঁউড়িয়ায় এই দিনটি উৎসবের দিন। শ্রী গৌরাঙ্গ এই ফাল্গুনি পূর্ণিমাতেই নদিয়ায় নিজের আবির্ভাব ঘটান; অবতরণ করেন। জননী শচিদেবী সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘নিমাই’, তাঁর রূপের জন্য পাড়ার লোক নাম দিয়েছিল ‘গোরা’ (গৌরাঙ্গ), গুরু নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণচৈতন্য, সেখান থেকে চৈতন্য। তিনি নদিয়ার প্রথম ‘ফকির’। নদিয়ার সাধকদের কাছে শ্রীচৈতন্য ‘ফকির’ বলেই প্রসিদ্ধ।
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার ফকির লালন শাহ তাঁর জীবদ্দশায় নদিয়ার ফকিরদের নিয়ে যে সাধুসঙ্গ প্রবর্তন করেছিলেন, সেটাও ফাল্গুনি পূর্ণিমাতেই। তিনি ফাল্গুনি পূর্ণিমার এই দিনটি বেছে নিয়েছিলেন নদিয়ার প্রথম ফকির শ্রীগৌরাঙ্গের আবির্ভাব তিথি উদযাপন করবার আনন্দ হিসাবে। নদিয়ার ফকিরদের জন্য এটা উৎসবের দিন। যেহেতু তিথিটি একই সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের দোল উৎসবের সঙ্গে জড়িত তাই একে গৌরপূর্ণিমার সাধুসঙ্গ না বলে সাধারণত ‘দোল উৎসব’ বলা হয়। ফাল্গুনি পূর্ণিমা তিথি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও যেমন তেমনি বৌদ্ধ ধর্মালম্বিদেরও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দিন।
নদের নিমাইয়ের আবির্ভাব মুহূর্তের হিসাব ধরে ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন সাঁই ‘সাধুসঙ্গ’ প্রবর্তন করেছেন। দোলের তিথিতে হয় বলে এটাই অনেকের কাছে ‘দোল’ বা দোল উৎসব’ নামে পরিচিত। কিন্তু গৌর পূর্ণিমার তাৎপর্য ভুলে গেলে এই উৎসবের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। এ সময় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় প্রতিবছর লাখ লাখ লালন অনুসারী, ভক্ত, অনুরাগী ও পরমার্থিক প্রেমের কাঙ্গাল নানান মনের আশেকান ছেঁউড়িয়ায় সাঁইজীর ধামে আসেন।
যিনি ধর্মভেদ মানেন না সেই লালন ফকির কেন একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় তিথিতে তাঁর ‘সাধুসঙ্গ’ স্থির করেছিলেন তা নিয়ে অনেকবার অনেকে প্রশ্ন করেছেন। আসলে ছেঁউড়িয়ার অনুষ্ঠান 'দোন পূর্ণিমা' উদযাপন নয়, গৌর পূর্ণিমা উদযাপন। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির অনুষ্ঠানে তা নিয়ে অনেকবার আলোচনাও করেছি। নদিয়ার ফকিরদের কাছে এই দিনটির গুরুত্ব একান্তই গৌরের আবির্ভাব মূহূর্ত হবার কারণে। শ্রীকৃষ্ণের নানান রূপ আছে, তাঁর লীলার নানান বৈচিত্র আছে। সেই সকল লীলার ব্যাখ্যা ধর্ম, বিশ্বাস ও জীবনযাপন ভেদে বিভিন্ন। তবে রাসলীলা, হোলি বা রঙ খেলা, কিম্বা কৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে লীলা নদিয়ার ভাবচর্চার অন্তর্গত নয়। নদিয়া যুগল ভজনা করে, ষোল শত গোপিনী নিয়ে লীলার কোন তাৎপর্য নদিয়ায় নাই। ফাল্গুনি পূর্ণিমা সে কারণে নদিয়ায় একান্তই গৌর পূর্ণিমা। এই বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে এই লেখা।
নদিয়ার ‘ফকির’ শ্রীগৌরাঙ্গের তাৎপর্য
“এমন বয়সে নিমাই ঘর ছেড়ে ফকিরী নিলে ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে, ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে” – ফকির লালন শাহের বিখ্যাত একটি গান। সেই গানে আছে, ‘ধন্যরে নদিয়াবাসী, হেরিল গৌরাঙ্গ শশী/ যে বলে জীব সেই সন্যাসী/ লালন কয় সে প’ল ফে’রে”। নদিয়াবাসীরা ধন্য যে তারা শ্রীগৌরাঙ্গের দর্শন পেয়েছে। যারা বলে সন্যাসী গৌরাঙ্গ ‘জীব’ মাত্র, তারা মহা ভুল করছে। নিম গাছের নীচে জন্ম দিয়েছেন বলে শচিমাতা নাম রেখেছিলেন নিমাই। দেখতে ছিলেন ফর্সা, দারুণ সুন্দর, তাই পাড়ার লোক ডাকত গৌরাঙ্গ: গৌর যার অঙ্গ। ভারতী গোঁসাই যখন নিমাইকে সন্যাস দিলেন তখন নাম দিলেন ‘কৃষ্ণচৈতন্য’। সেখান থেকেই শ্রীচৈতন্য। নিমাই, গৌরাঙ্গ ও শ্রীচৈতন্য একই মানুষ। কিন্তু তিন রূপ। নিমাই জীব, গৌরাঙ্গ ন্যায়শাস্ত্রে ও যুক্তিবিদ্যায় পণ্ডিত, নৈয়ায়িক; আর, শ্রীচৈতন্য ‘জ্যান্তেমরা’ ফকির। জীবিত অথচ মৃত। কেন? পরমের সঙ্গে প্রেমের বাসনা ছাড়া তাঁর আর কোন জীবাকাংখা ছিল না। তিন রূপ মিলে এক রূপ।
এমন বয়সে নিমাই
ঘর ছেড়ে ফকিরী নিলে
ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে
ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে।।
ধন্যরে ভারতী যিনি
সোনার অঙ্গে দেয় কৌপিনি।
শিখাইলে হরিধ্বনি
করেতে করঙ্গ দিলে।।
ধন্য পিতা বলি তারে
ঠাকুর জগন্নাথ মিশ্রে।
যার ঘরে গৌরাঙ্গ হারে
মানুষ রূপে জন্মাইলে।।
ধন্য রে নদিয়াবাসী
হেরিল গৌরাঙ্গশশী
যে বলে সে জীব সন্ন্যাসী
লালন কয় সে প’লো ফ্যারে।।
এই গানে দুটো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ফকির লালন শাহ চৈতন্যকে ‘ফকির’ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ নিমাইয়ের সন্যাস গ্রহণ ও ‘কৃষ্ণচৈতন্য’ নাম গ্রহণ লালনের কাছে ‘ফকিরী’। তাঁকে ‘সন্যাসী’ বলা হয়েছে বটে, তাতে নদিয়ার আপত্তি নাই, কিন্তু তিনি নদিয়ায় ফকির। চৈতন্যের পিতা, গুরু এবং নদিয়াবাসী এ কারনেই ধন্য যে খুবই কম বয়সে নিমাই ‘ঘর ছেড়ে’ ভারতী গোঁসাইয়ের কাছে ‘ফকির’ হয়েছিল। এটা স্রেফ ‘সন্যাস’কে ‘ফকিরী’ গ্রহণ বলা নয়। বরং চৈতন্যের ‘সন্যাস’কে তার প্রথাগত অর্থ থেকে ছেদ ঘটিয়ে নতুন তাৎপর্য দান করা। নদিয়ার ফকিরগণ তাঁদের জীবনচর্চা ও ভাবচর্চার মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে গৌরাঙ্গের তাৎপর্য গৌরতত্ত্বে আরও বিকশিত করেছেন এবং গৌরকে নতুন তাৎপর্যে নদিয়ায় কায়েম করেছেন। বৃন্দাবনী গোস্বামীদের গৌর-ভাবনা থেকে নদিয়ার গৌর ভজনা ও তার তাৎপর্য আলাদা। নদিয়ার গৌর ব্রাহ্মণের বা উচ্চকোটির ‘শ্রীচৈতন্য’ নন। ইনি সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের গৌরাঙ্গ যাদের মধ্যে জাতপাত, জাতিভেদ, ধর্মভেদ নারী-পুরুষ ভেদ নাই। ইনি নদিয়ায় ‘নতুন আইন’ জারি করেছিলেন।
“এনেছে এক নবীন গোরা নতুন আইন নদিয়াতে
বেদপুরান সব দিচ্ছে দুষে সে আইনের বিধান মতে” (ফকির লালন শাহ)
গৌরাঙ্গ আসলে পুরানের শ্রীকৃষ্ণ, নদিয়ায় তিনি মানুষের রূপ নিয়ে মনুষ্য লীলা করে গিয়েছেন। নদিয়ায় কৃষ্ণই গৌরাং, কিম্বা গৌরাঙ্গই কৃষ্ণ। তিনি তাই অবতার। কিন্তু কথাটা নিছকই আক্ষরিক অর্থে নয়, বরং এই অর্থে যে পুরানের চরিত্র এখানে ইহলৌকিক ইতিহাসের চরিত্র হয়ে উঠেছে। শ্রীচৈতন্য পুরান এবং ইতিহাসের সন্ধিবিন্দু । নদিয়ার ভাবচর্চায় পুরান ও ইতিহাসের সম্বন্ধ বিচার সে কারনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গৌরাঙ্গ জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু এমনই এক ব্রাহ্মণ যিনি ব্রাহ্মণত্ব ছেড়ে নিম্নবর্গের জগতে ‘অবতরণ’ করেছেন। তাই তিনি ‘অবতার’। নদিয়ার জীবনচর্চা ও ভাবচর্চার ইতিহাসে গৌরাঙ্গই নদিয়ার প্রথম ফকির। তাই নদিয়ার জনপ্রিয় গান:
‘যদি এসেছো হে গৌর জীবকে তারিতে
জানব এই পাপী হতে’
গৌর, তুমি যদি পাপীকে তার পাপ থেকে ত্রাণের জন্য অবতরণ করে থাকো তাহলে আমার মতো পাপীকে ত্রাণ করো। পার করে নাও। যদি ত্রাণ করতে পারো তবেই বুঝব কথাটা সত্য। বুঝব যে তুমি আসলেই অবতার।
ঘটনাটি ঘটছে সুলতানী আমলে। সেই সময়ের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয় নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আগের অবস্থার চেয়েও অনেক পরিচ্ছন্ন এবং স্পষ্ট। সুলতানী আমলে প্রথম ফকির হিসাবে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে আমরা চাইলে এখন অনেক পরিচ্ছন্ন ও পর্যালোচনামূলক আলোচনা করতে পারি। তবে এই লেখায় সেই কাজ করবার অবসর হবে না। অবন্তীকুমার সান্যাল ও অশোক ভট্টাচার্য সম্প্রতি শ্রীচৈতন্যের কালপর্ব সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন সংক্ষেপে তার তাৎপর্য বোঝাতে সেখান থেকে আপাতত একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেব:
“বখতিয়ার খলজীর গৌড় অধিকারের পর প্রায় তিনশো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং দেড়শো বছর আগেই ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাভাষী প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে চৈতন্যের সমকালে সেই স্বাধীন রাষ্ট্রে সম্প্রসারিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ওড়িষ্যার সীমান্ত, উত্তর-পূর্বে কোচবিহার থেকে উত্তর পশ্চিমে বিহার, এমন-কি উত্তর প্রদেশের সীমান্ত পর্যন্ত। যদি মেনেও নেওয়া যায় যে, তুর্কী অভিযানের সঙ্গেই বাংলাদেশে বি-ধর্ম ইসলামের প্রবেশ, তাহলেও তিনশো বছরে তা হয়ে উঠেছে বাংলাভাষী এক বিরাট সংখ্যক মানুষের স্ব-ধর্ম, যে ধর্ম শাসকের ধর্ম। বহিরাগত শাসনকর্তারা এবং তাঁদের অনুবর্তীরাও বাংলাদেশ ও বাংলাভাষাকে নিজেদের দেশ ও ভাষা বলে গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। রাষ্ট্রপরিচালনার বিজিত হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায়ের সহযোগিতা লাভ করেছেন। তুর্কী অভিযানের প্রথম অরাজকতা, উপদ্রব, অনিশ্চয়তা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ঝড় মন্দীভূত হয়ে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছে। এই সতাটি উপলব্ধি করেছিলেন স্বাধীন সুলতানী বাংলার প্রতিষ্ঠাতা সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ যাঁর সার্থক উপাধি হয়েছিল ‘শাহ-ই-বাংঙ্গালিয়াঁ’। তারই ফলে বাংলার মুসলমান রাজশক্তির স্বাধীনতা অর্জনে এবং সেই স্বাধীনতা রক্ষায় বাঙ্গালী হিন্দু শেষদিন পর্যন্ত তৎপর থেকেছে। মুসলমান ও হিন্দুর সহযোগিতায় যে রাষ্ট্রীয় আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, চৈতন্যের সমকাল পর্যন্ত সেই আদর্শ অনুসরণ করে এসেছেন বাংলার সুলতানরা। ইলিয়াস শাহের পরবর্তী স্বাধীন সুলতানী বাংলার সিকান্দার শাহ, আজম শাহ, জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ, রুকনুদ্দিন বারবক শাহ, সর্বোপরি আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মতো এমন “মহাবিদগ্ধ”ও “পরম দুর্বার” সুলতানের পরম্পরা নিঃসন্দেহে যে কোনো জাতির, যে কোনো দেশের শ্লাঘার বস্তু। হুসেনশাহী আমলে তো বটেই সুলতানী আমলের কোনো পর্বেই বাংলায় জিজিয়া করের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে না। একাধিক বি-ধর্মী সুলতান সম্পর্কে হিন্দু সম্প্রদায়ের স্মৃতিকার,পণ্ডিত,কবিদের অকুন্ঠ প্রশস্তিগুলোকে রাজানুগৃহীতের স্বভাবসিদ্ধ স্তুতিবাদ বলে মনে না করে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাই হয়তো ইতিহাসসম্মত হবে।
সুলতানী আমলের বাংলার শক্তিসমৃদ্ধির যথেষ্ট সংবাদ আছে একাধিক বিদেশী ভ্রমণকারীর বিবরণে। মুসলমান-হিন্দুর সহযোগিতায় গড়ে তোলা কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী রাষ্ট্র বাংলার সীমান্ত সুরক্ষিত করেছে,কৃষি ও বাণিজ্যের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। গৌড়ের সুলতানের দরবারে মুসলমান ও হিন্দু নির্বিশেষে শাস্ত্রকার,পণ্ডিত,কবি প্রভৃতি বিবিধ বিদ্বজ্জনের সমাবেশ ঘটেছে। তাঁরা ফারসী,সংস্কৃত এবং সবোর্পরি মাতৃভাষা বাংলায় কাব্যরচনা করেছেন, স্মৃতিগ্রন্থ, শব্দকোষ রচনায় রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন ও বিবিধ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।পাণ্ডিত্য ও সংস্কৃতির এই পৃষ্ঠপোষণা বিশেষ বিশেষ সুলতানের ব্যক্তিগত রুচি বা আগ্রহের পরিচয় নয়, গোটা সুলতানী আমলেরই শতাব্দীবাহিত ঐতিহ্য তো বটেই,মধ্যযুগের বাংলার সংস্কৃত সাহিত্যও প্রধানত সুলতানী দরবারের পোষিত বললে অতিরঞ্জন হয় না। বাঙালীর জাতিসত্তার আবশ্যিক শর্তগুলোর পূরণ হয়েছে এই সুলতানী আমলেই”। (দেখুন অবন্তীকুমার সান্যাল ও অশোক ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘চৈতন্যদেব: ইতিহাস ও অবদান’, পৃষ্ঠা, ২৫)
দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছি এটা বোঝাবার জন্য যে সুলতানী আমলের ইতিহাস থেকে গৌরাঙ্গের আবির্ভাবকে বিচ্ছিন্ন ভাবে আলোচনা করা যায় না। চৈতন্য বা শ্রীগৌরাঙ্গের তাৎপর্য বুঝতে হলে এই ইতিহাস অবশ্যই মনে রাখা দরকার। এতে বোঝা যায় নদিয়ায় শ্রীচৈতন্যকে ‘ফকির’ বলা ফকির লালন শাহের স্রেফ একটি উৎপ্রেক্ষা নয়। ব্রাহ্মণ হয়েও বর্ণাশ্রম প্রথা বা জাতপাতের বিরুদ্ধে গৌরাঙ্গের লড়াই একমাত্র সুলতানী আমলেই সম্ভব ছিল। গৌরাঙ্গ নিজে যখন নদিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারপর দুটো ঘটনা ঘটেছে। এক. তাঁকে ব্রাহ্মণকুল আবার তাদের উচ্চকোটির বর্গে তুলে নিলেন। সাধারন জনগণের মুক্তির জন্য যিনি অবতার হয়ে অবতরণ করেছিলেন তিনি হয়ে উঠলেন গোস্বামীদের সংস্কৃত ভাষায় চর্চার বিষয়। তিনি আর লৌকিক রইলেন না, উচ্চকোটির ঈশ্বরে রূপান্তরিত হলেন। চৈতন্য জীবনের এই এক বিশাল ট্রাজেডি। তিনি হয়ে গেলেন ইসলামের ‘আগ্রাসন’ প্রতিরোধ করবার জন্য ব্রাহ্মণদের অস্ত্র। নদিয়া তাকে ‘ফকির’ বলার মধ্যে বর্ণাশ্রম প্রথা ও জাত পাত বিরোধী সংগ্রামে তার ভূমিকাকেই স্বীকার করে নেয়। গোস্বামীদের চৈতন্য নদিয়ার আরাধ্য না। সেই চৈতন্যই নদিয়ার আরাধ্য যার মধ্যে সকল ধর্মভেদ মোমের মতো গলে গিয়েছে। যেখানে কোন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি নাই, বাংলায় বাঙালির ইতিহাসে চৈতন্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সন্ধিবিন্দু যাকে আরও গভীর ভাবে বোঝার কাজ এখনও বাকি রয়েছে।
এতো গেল ইতিহাসের একটি দিক। দ্বিতীয়ত নবদ্বীপের গৌর বা শ্রীচৈতন্য এবং তাঁর নবদ্বীপ লীলার বিশেষ গুরুত্ব। শ্রীচৈতন্য অবতার। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং নদিয়ায় মানুষের রূপ নিয়ে গৌর হয়ে ইহলোকে অবতরণ করেছেন, এটা এক প্রকার পুরান আশ্রিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা। এর সামাজিক-রাজনীতিক অর্থ হচ্ছে ব্রাহ্মণ নেমে এসেছে চাঁড়াল ও যবনদের স্তরে – উচ্চকোটির অবতরণ ঘটেছে নিম্নকোটিতে -- এই ঘটনা ছিল সেই সময়ের জন্য অসামান্য ঘটনা। সুলতানী আমলে শ্রীচৈতন্যের আন্দোলন লোকায়ত বাংলাভাষা, সংস্কৃতি ও লৌকিক ভাবের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পেরেছিল। শ্রীচৈতন্য জাতপাতের ভেদ অস্বীকার করেছেন, ঠিক। কিন্তু নবদ্বীপ বা নদিয়ায় তিনি শুধু ভক্তি আন্দোলনের গুরু নন, কিম্বা নিছকই যাকে তাকে ‘প্রেম’ বিলিয়েছেন স্রেফ তাও নয়। জাতপাতবর্ণসম্প্রদায়ের মধ্যে নানান কিসিমের ভেদবুদ্ধি, অসাম্য ও ঘৃণাচর্চার বিরুদ্ধে তাঁর বিক্ষোভ বা ‘নগর-সংকীর্তন’ একান্তই সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াই।
তিনি অবশ্যই সাংঘর্ষিক বা সহিংস সামাজিক সংস্কার বা রাজনীতি প্রচার করেন নি। এখানেই তাঁর রাজনীতির আরেক বিশেষ তাৎপর্য। ‘প্রেম’ যে প্রবল রাজনৈতিক অস্ত্র হতে পারে তার সম্ভাবনা দেখিয়ে নবদ্বীপে এক নতুন ভাবের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রেম বা ‘অপর’কে নিঃশর্তে ‘আলিঙ্গন’-এর রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে যথেষ্ট বিচার হয়েছে বলে আমি মনে করি না। নিঃসন্দেহে নিমাইয়ের নদিয়া-লীলা বা ‘নবদ্বীপ লীলা’ স্রেফ হরে কৃষ্ণ হরে হরে জাতীয় নামকীর্তন ছিল না। নবদ্বীপে তিনি শুধু বর্ণাশ্রম প্রথা বিরোধী ধর্ম সংস্কারক ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন হিন্দু মুসলমানসহ সকল সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক। এটা নদিয়ায় গৌরের তাৎপর্যের তৃতীয় দিক।
কিন্তু নদিয়া ত্যাগ করার পর শ্রীচৈতন্য তাঁর সেই ভাবমূর্তি রাখতে পারলেন না। প্রথমত সাধারণ মানুষ – বিশেষত চাঁড়াল ও যবনের জগত থেকে তিনি আবার ফিরে গেলেন উচ্চকোটির জগতে, আবার শাস্ত্রকার ও ব্রাহ্মণদের সংস্কৃত টীকাভাষ্যের মধ্যে তিনি উচ্চবর্ণের ব্যাখ্যার মধ্যেই আবার বন্দি হয়ে গেলেন। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা তাঁর আরেক রূপ খাড়া করল, যা হিন্দু সম্প্রদায়েরই আরেকটি সম্প্রসারণ মাত্র। তাঁকে তাঁর স্বগোত্রীয়রা আবার হিন্দু ব্রাহ্মণ বানিয়ে ছাড়ল। নদিয়ার ফকির হিসাবে ফকির লালন শাহ তাঁর এই উচ্চকোটির রূপ, বলাবাহুল্য, বরদাশত করেননি। নদিয়ার ফকিরদের কাছে তাঁর নবদ্বীপ লীলাই ভক্তি আন্দোলনের দিক থেকে যেমন, তেমনি সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থেও অর্থবহ। শ্রীচৈতন্য সেই অর্থেই ‘ফকির’ যিনি কোন জাতবর্ণ মানেন না, ধনি নির্ধনের ভেদ অস্বীকার করেন, নারী-পুরুষ ভেদ মানতে রাজি না, ইত্যাদি। একই সঙ্গে যিনি কোন সম্প্রদায় ভেদও মানেন না। তাঁর কাছে হিন্দুমুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাই। নদিয়ার ভাব এই রাজনীতির ওপর দাঁড়ানো। যেকারণে নদিয়া বৃন্দাবন ও গৌড়িয় বৈষ্ণবদের সম্মান করে, ভালবাসে, সাধুগুরু বৈষ্ণবদের তারা ভক্তিও দেয়, কিন্তু তারা নিজেদের বৈষ্ণব গণ্য করে না। কারণ ফকিরের কোন ‘সম্প্রদায়’ নাই। নবদ্বীপের লীলাকারী শ্রীচৈতন্য এই অর্থেও নদিয়ার প্রথম ফকির কারণ তিনি সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির অসারতা প্রকট বর্ণাশ্রমের কালে নিজে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হয়েও প্রচার করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ষড়গোস্বামীদের হাতে তৈয়ার হওয়া শ্রীচৈতন্য নদিয়ার ভাবের গুরু নন। সেখানে ব্রাহ্মণ আবার গৌরাঙ্গকে ব্রাহ্মণ বানিয়ে ছেড়েছে। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই ফের বন্দী হয়ে গেলেন।
চৈতন্যের সন্যাস গ্রহণকে ‘ফকিরী’ হিসাবে আত্মীকরণ করার অর্থ নদিয়ার ভাব জগতে বা ভাবপরিমণ্ডলের ভেদও স্পষ্ট করা। চৈতন্যের তাৎপর্যের এটা চতুর্থ দিক। গৌরাঙ্গের ফকিরী গ্রহণ ও শ্রীচৈতন্য নাম নেওয়ার মধ্য মধ্য দিয়ে একটা নতুন ভাবজগত বা ভাবপরিমণ্ডলের সূচনা ঘটেছে যা সেই সময়ের প্রাচীন তান্ত্রিক ও ভক্তির ধারার সঙ্গেও বিশাল ছেদ। বিশেষত তন্ত্রসহ অপরাপর ভক্তি আন্দোলন থেকে নদিয়ার ভাব আলাদা। নদিয়ার এই ভাবপরিমণ্ডল নতুন, নদিয়ার ভক্তি আন্দোলনকে সে কারণে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে বিচার জরুরী। শ্রীচৈতন্য নদিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রাচীন তান্ত্রিক ধারা থেকে শ্রীচৈতন্য চিন্তা ও চর্চার যে ছেদ ঘটিয়েছিলেন, লালন সেই পরিপ্রেক্ষিতেও ‘ফকির’ কথাটা ব্যবহার করছেন। তন্ত্র বা তান্ত্রিকতা থেকে নদিয়ার ভাবের ফারাক বোঝার জন্যও গানটি গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীগৌরাঙ্গকে যিনি নদিয়ার ‘ফকির’ বলে আত্মীকরণ করছেন, সেই লালন শাহ ‘তান্ত্রিক’ ছিলেন না। দেহ বা শরীর সম্পর্কে নদিয়ার অনুমানও তন্ত্র থেকে আলাদা।
জ্ঞাতিমিলন পূর্ণিমা, দোল পূর্ণিমা ও গৌর পূর্ণিমা
গৌতম বুদ্ধ রাজ্য, রাজ প্রাসাদ ও পরিবার পরিজন ছেড়ে জীবনের পরমার্থিক তাৎপর্যের সন্ধানে সংসার ছেড়েছিলেন। বোধিবৃক্ষতলে তিনি নির্বাণ বা ‘বুদ্ধত্ব’ লাভ করেছিলেন, এই তথ্যটুকু আমাদের জানা। কিন্তু এর বেশী বুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের জানবার আগ্রহ হয় না। তবে বুদ্ধত্ব লাভের পর দীর্ঘকাল পিতা- স্ত্রী-সন্তানসহ জ্ঞাতিদের সঙ্গে বুদ্ধ সাক্ষাৎ করেন নি। দীর্ঘ বিচ্ছেদে পিতা শুদ্ধোদন ও পরিবারের অন্যরা বুদ্ধদর্শনে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। রাজা শুদ্ধোদন কাতর হয়ে পুত্রের কাছে তার কাতরতার সংবাদ জানিয়ে বারবার দূত পাঠাতেন। কিন্তু তারা ফিরে আসত না। সংসারত্যাগী বুদ্ধ ছিলেন জীবের সকল প্রকার ইহলৌকিক আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত। জীবের ইহলৌকিক আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত মানুষকে নদিয়ার ভাষায় বলা হয় ‘জ্যান্তেমরা’; জীবিত কিন্তু যারমধ্যে ইহলোক ও পরলোকের ভেদ লুপ্ত, অনিবার্য মৃত্যুর বিপরীতে যিনি পলক খানেক মুহূর্ত মাত্র হয়ে বর্তমান থাকেন। যে জীবন আপাদমস্তক পরমার্থিক জীবন, স্রেফ বেঁচে থাকার জীবন নয়, তাকে জীব বলা অসঙ্গত। রাজা শুদ্ধোদনের দূত হিসাবে বুদ্ধের কাছে থেকে যারা যেতো তারা সংসারত্যাগের গুরুত্ব ও ইহলৌকিক আকাংখা মুক্ত পরমার্থিক জীবনযাপনের মর্ম বুদ্ধ দর্শনে প্রত্যক্ষ ভাবে উপলব্ধি করত। সংসারের উর্ধে যাঁর জীবন তিনি সকল প্রকার জীবপরায়ন আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছেন ও জয়ী হয়েছেন, এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধের কাছে গিয়ে কেউ আর তাই ফিরে আসতেন না, বুদ্ধের রূপে ও তাঁর কথনে মুগ্ধ হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে বুদ্ধের নিকটই থেকে যেতেন। এমনিভাবে রাজার দূত হিসাবে রাজার প্রাসাদ থেকে যারাই বুদ্ধ দর্শনে যেতেন তারা আর প্রত্যাবর্তন করতেন না। নদিয়া যখন ‘সাধু দরশন’ কথাটা বলে তখন এই নির্বাণপ্রাপ্ত বুদ্ধত্ব প্রত্যক্ষ দর্শনের দিকেও ইঙ্গিত করে।
কিন্তু যতোই দিন যায় রাজা শুদ্ধোদন বুদ্ধকে দেখবার জন্য আরও বেশি কাতর হয়ে পড়েন। শুদ্ধোদনের বুদ্ধদর্শন বাসনা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। বার বার দূত পাঠিয়ে তিনি হতাশ হন। অবশেষে শুদ্ধোদন কালুদায়ি নামে সিদ্ধার্থের এক বাল্যবন্ধুকে পাঠান। কালুদায়ির কাছে পিতার কাতরতার কথা শুনে বুদ্ধ পরিবার পরিজনদের দেখবার জন্য আবার কপিলাবস্তুতে পরিবারবর্গের সঙ্গে মিলিত হন। পিতা শুদ্ধোদন, স্ত্রী যশোধরা এবং পুত্র রাহুলসহ অন্যান্যদের তাঁর উপলব্ধির কথা জানান এবং তাদের তাঁর নতুন ধর্মে দীক্ষা দেন।
সেই দিনটিও ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন। এই পূর্ণিমা বৌদ্ধদের জন্য তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। এর অপর নাম ‘জ্ঞাতিমিলন পূর্ণিমা’ বা ‘জ্ঞাতি সম্মেলন তিথি’। একই কারণে নদিয়ার ফকিরদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। গৌরপূর্ণিমার ‘সাধুসঙ্গ’ একই সঙ্গে পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে উৎসবও বটে। ছেঁড়িয়ার সাধুসঙ্গ উৎসবে তাই সকল্কে আমন্ত্রণ জানানোই বিধি।
ফাল্গুনি পূর্ণিমা সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দোল পূজা বা দোল উৎসবের দিন। দোল হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। স্থান ও এলাকা ভেদে এই উৎসবের চরিত্র ও রীতি আলাদা। উত্তর ভারতে বা বাংলার অন্যত্র দোল উৎসব ‘হোলি’ বা রঙ খেলার উৎসব হিসাবে পরিচিত। রঙ খেলা বাংলার সংস্কৃতি নয়, মূলত হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতি। ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রাবল্যের কারণে বাংলার গায়েও রঙ মাখা আর আবীর ছড়াছড়ি আরম্ভ হয়েছে। রঙ খেলা বা আবীর মাখা স্বতঃস্ফূর্ত সাংস্কৃতিক বিনিময় ও প্রভাব ভাবলে ভুল হবে। বাংলাভাষী অঞ্চলে হোলি বা আবীর খেলা প্রবর্তনের পেছনে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সম্প্রসারণ জড়িত। একই সঙ্গে হিন্দি বলয়ের বাইরে উত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা বটে।সীমান্তের দুই পাশে বাংলাভাষী জনপদে আবীর ও রঙ খেলার বাড়াবাড়ি দেখে কথাটা বলতে হোল। আধিপত্য সম্প্রসারণের রাজনীতিটাই এখানে মুখ্য, সাংস্কৃতিক বিনিময় নয়। কিন্তু দোল গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। শ্রী চৈতন্যের অনুসারী বৈষ্ণবদের কাছে এর মর্যাদা ও পরমার্থিক গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ নিমাই ফাল্গুনের পূর্ণিমা রাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে বসন্তের আগমন উপলক্ষে নাচ-গান, আবৃত্তি ও নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করা হতো। যার কারণে রবীন্দ্র প্রেমিকদের কাছে ফাল্গুনি পুর্ণিমা বসন্তোৎসব হিসাবে মর্যাদা পেয়ে এসেছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাত দোলপূর্ণিমার দিনই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হয়। ফাল্গুনের ওই একই পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা।
‘দোলযাত্রা’, ‘দোলপূর্ণিমা’ বিশেষ ভাবে হিন্দু বৈষ্ণবদের উৎসব। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী এ দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকা এবং তার সখীদের সঙ্গে আবির খেলেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎবপত্তি। এ কারণে দোলযাত্রার দিন রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে নগর কীর্তন করা রীতি। কিন্তু এই পূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীচৈতন্য জন্মগ্রহণ করেন বলে এই তিথিকে ‘গৌরপূর্ণিমা’ও বলা হয়। নদিয়ার ফকিরদের নিমাইয়ের নদিয়ার আবির্ভাব তিথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছে তাই ফাল্গুনি পূর্ণিমা মূলত ‘গৌর পূর্ণিমা’ হিসাবেই স্মরণীয়।
ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়
ফকির লালন শাহের প্রতি আমার প্রাথমিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল কবিতার জন্য। অর্থাৎ তাঁর গানের কাব্যগুণ আর দশজনের মতো আমাকেও আগ্রহী করে তুলেছিল। এরপর তাঁর প্রতি আমার আগ্রহের কারন তাঁর খাদ্য ব্যবস্থার বিধান এবং গাছপালার ঔষুধি গুণের প্রতি তাঁর আগ্রহ। আমার পড়াশোনা ফার্মাসি বা ওষুধ শাস্ত্রে, এরপর অর্থশাস্ত্রও পড়েছি মার্কসের ইঙ্গিত অনুসরণ করে দর্শন হিসাবে। কিন্তু লালন ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন এটা বিজ্ঞানে উৎসাহী আমার জন্য ছিল বিশাল একটা খবর। কিভাবে তিনি ১১৬ বছর বাঁচলেন, কি খেতেন, অসুখ বিসুখ সামলাতেন কিভাবে সেই সকল বিষয় সম্পর্ক তুমুল আগ্রহ নিয়েই আমি ছেঁঊড়িয়া যাওয়া আসা শুরু করি।
এই প্রকার নিষ্ঠার ভাল ফল আমি প্রথম থেকেই পেতে থাকি। ফকির বাউলদের সম্পর্কে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পারভার্টেড ধারণা বুঝতে পেরেছি অনায়াসেই। ফকির দরবেশরা উদাসী ঘরছাড়া শূন্যবিহারী মানুষ – এই বাজে ধারণাগুলো সম্পর্কে শুরুতেই আমি সতর্ক হতে পেরেছিলাম। লালন যদি এতোই উদাসী হতেন তাহলে নিজের খাদ্যব্যবস্থা সম্পর্কে এতো সচেতন থাকলেন কিভাবে? ‘বাউলতত্ত্ব’, ‘গুহ্যসাধন প্রণালী’ নামক মধ্যবিত্তের রগরগে কামুকতা এবং বাংলার সাধনার ধারার ওপর সেটা নির্বিচারে চাপিয়ে দেওয়ার অজ্ঞতা কিম্বা সচেতন রাজনীতি আমি শুরুতেই খুব সহজেই বুঝি। এর বিরাট সুবিধা হোল ছেঁউড়িয়া, মেহেরপুর, দৌলতপুর ইত্যাদি অঞ্চলে আমি অনেক বড় বড় সাধকদের সাক্ষাৎ পাই, যাঁরা ছিলেন নদিয়ার ভাবচর্চার দুর্দান্ত কাণ্ডারি। এই আন্তরিক সাধুসঙ্গের কারনে ‘নদিয়ার ভাব’ ও ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে আমার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে নদিয়ায় ভাবচর্চা – অর্থাৎ বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ভাবে গড়ে ওঠা একটা জমিন পরিস্ফূট হতে থাকে। দর্শনচর্চার ক্ষেত্র হিসাবে নদিয়া আমার কাছে ভিন্ন একটি তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়, যার মূল্য অপরিসীম। সাধকদের সঙ্গে সঙ্গ ছিল তুমুল আনন্দের। তাঁরা দারুন শিক্ষকও ছিলেন।
সহজ জিনিস শুরুতেই সহজ ভাবে বলি। লালন ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন কথাটি খুব সহজ তথ্য নয়। তার মানে তাঁকে তাঁর নিজের শরীরের যত্ন নিতে হয়েছে, খাবারদাবার বাছ বিচার করতে হয়েছে। খাবারদাবার বাছবিচার করা এবং শরীরের যত্ন নেওয়ার অর্থ দেহ বা শরীরের প্রতি যত্নবান হওয়া। তিনি গাঁজা খেয়ে ১১৬ বছর বাঁচেন নি, নিজে ভাবের নেশা ছাড়া অন্য যে কোন নেশার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। কিম্বা মেয়ে মানুষ নিয়ে ‘গুহ্য সাধনা’ করে লালন দীর্ঘায়ু হন নি। বোঝা যাচ্ছে তাঁর ‘দেহাত্মবাদ’ বা দেহ নিয়ে চর্চা আমাদের গুপ্ত তন্ত্রের ব্যাখ্যার বাইরে বুঝতে হবে। দেহ নিয়ে তাঁর করণকর্ম আছে, কিন্তু ‘বাউলতত্ত্ব’ নামে যেসকল গোপন কায়কারবার চালু রয়েছে লালন সেটা না একদমই। হয়তো তার বিপরীত জিনিস। দর্শনের প্রশ্ন হিসাবে আমার মনে প্রশ্ন জাগল ফকির লালন শাহ ‘দেহ’ নিয়ে তাহলে আসলে কি ভেবেছেন? প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রের সঙ্গে তার সম্পর্কটাই বা কী? এটা একালের খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলো মনে জাগবার পর থেকেই ‘নদিয়ার ভাব’ – লালন যা চর্চা করেছেন – তাকে ভাবান্দোলন বা দর্শনের ক্ষেত্র থেকে বিচারের গুরুত্ব আমি বুঝতে শুরু করি। ফকির লালন শাহ নিয়ে আমার লেখালিখির ভারকেন্দ্রটা সে কারণে ভাবচর্চা বা দার্শনিক বিচার, যার সঙ্গে ভাবানুসারে চর্চা বা ‘করণ’ পর্যালোচনাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
‘নদিয়ার ভাব’ কথাটা ফকির লালন শাহের; তিনি সহ নদিয়ার আরও চারটি ‘ঘর’ এই ভাব চর্চা করতেন বলে ‘নদিয়ার ভাব’ কথাটার অর্থ দাঁড়িয়েছে লালনসহ নদিয়ার পাঁচটি ঘরের সাধনার ধারা এবং সেই সাধনার ধারার মধ্যে বিভিন্ন ‘ভাব’ বা দার্শনিক বিষয়াদির বিচার। এই পাঁচঘরের সাধুসন্তরাই এই বিচারের ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন ও টিকিয়ে রেখেছেন। তাঁদের সকলের ‘ভাব’ বা চর্চা একই রকম ছিল এটা অনুমান করারা কোন কারন নাই। নদিয়ার ভাবচর্চার নিজস্ব ভাষা ও পরিভাষা আছে, যাঁরা নদিয়ার ভাবের সাধনা করেন তাঁদের কাছে সেই ভাষা ও পরিভাষা পরিচিত। সেই ভাষা, ভাব, তর্কবিতর্ক এই পাঁচ ঘরের সাধন ভজন কেন্দ্র করেই প্রধানত হয়ে থাকে। ফকির লালন ছাড়া এই পাঁচঘরের বাকি চারঘরের মধ্যে আছেন সতী মা বা কর্ত্তাভজা --সহজিয়া বৈষ্ণবদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘর; এরপর পাঞ্জু শাহের ঘর, অন্য ঘরের তুলনায় যে ঘরে দেহকেন্দ্রিক সাধনভজনের গুরুত্ব অধিক; আছে চৌধুরির ঘর, নবীতত্ত্ব ও নদিয়ার ভাবের জায়গা থেকে আরব দেশ থেকে আসা ইসলামের পর্যালোচনার জন্য যে ঘর গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আছেন দেলবার শাহ, যিনি গানের জন্য বিখ্যাত। লালনের গানের সুরের ঐতিহ্য বা প্রামান্যতা এই ঘরই ধরে রেখেছিল বলে নদিয়ার ভাবানুরাগীরা মানে। এরা সকলেই ফকির লালনের কমবেশী সমসাময়িক এবং সাধন ভজন ও তত্ত্বচর্চার দিক থেকে সকলেই ফকির লালনের মতোই সমান মাত্রার গুরুত্বপূর্ণ। লালনপন্থি ফকিরদের ভাষায় এরা ‘গদিমান্য’। অর্থাৎ নদিয়ার ভাবচর্চায় তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, লালন এঁদের কাছে ঋণী। এই জন্য সাধুসঙ্গে সেবা দেবার সময়, এই চারঘরের কেউ প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত থাকলে মাথায় বয়ে আনা পরমার্থিক ‘সেবা’ নিজ নিজ গুরুর সামনে নিবেদন করবার সময় একই সঙ্গে উপস্থিত চার ঘরকেও নিবেদন করতে হয়। এটাই সাধুসঙ্গের রীতি। বাকি চারঘরের কেউ আছেন কিনা এটা জোরে সাধুর সভায় জিজ্ঞাসা করতে হয়। দ্বিতীয়ত তাঁরা ‘আসন প্রাপ্য’। অর্থাৎ লালনপন্থিদের অবশ্যই এই ঘরের সাধকদের আলাদা আসন ও ভক্তি দিতে হবে। এই বিধানগুলোর মধ্য দিয়ে নিজের ভাবচর্চা ও সাধন ভজনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকলেও নিজের ভাবের প্রেরণা ও বিকাশের জন্য লালন এই চারটি ঘরের কাছে ঋণ যেমন স্বীকার করেছেন, তাঁর অনুসারীদেরও ঋণ স্বীকার করতে বলেছেন। পাঁচটি ঘরের আভ্যন্তরীণ তর্কবিতর্ক কিম্বা কোন বিষয় নিয়ে বিচারের ক্ষেত্র এই চারঘরের সাধনভজন। এদের ভাবের ভূগোলকে আমরা নদিয়ার পরিমণ্ডল বলতে পারি।
তবে মনে রাখা দরকার ঘরগুলো ‘গদিমান্য’ হলেও তাদের ভাব, চিন্তা কিম্বা করণ কর্ম একাট্টা একই রকম এই অনুমান ঠিক না। ভাবজগতে অন্য ঘরগুলোর চিন্তা ও চর্চাকে লালন অস্বীকার করেন নি, কিন্তু যে কথা বলে তিনি সবার কাছ থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন সেটা ভাবের আদানপ্রদানের ধারণা। ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়’। ভাব ছাড়া শুধু ভক্তি কিম্বা শুধু দেহাত্মবাদী সাধনভজন তিনি মানেন নি। সেটা তাঁর চর্চা ছিল না। দরকার ‘ভাব দিয়ে ভাব নেওয়া’। ভাবচর্চার একটা শিখর তিনি স্পর্শ করেছিলেন যা তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় ভিন্ন। তিনি নদিয়ার চারঘরের ‘গদি’ মানেন। কিন্তু তাঁকে বুঝতে হলে তাঁর অনন্য বৈশিষ্টের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ রাখতে হবে।
নদিয়ায় ভাবচর্চার ভাষা গদ্য নয়, গান
নদিয়ায় ভাবের বিচার কিম্বা দর্শন চর্চার ভাষা গদ্য নয়, গান। সেই গানের ভাষা অভিধান ঘাঁটলে বোঝার উপায় নাই। কারণ সেই ভাষা মুদ্রন যন্ত্রের বিকাশের মধ্য দিয়ে নয়, কান এবং কন্ঠকে মাধ্যম মেনে চর্চা করা হয়েছে। ফলে সেই ভাষা বোঝা সহজ নয়। যে কারনে ফকির লালন শাহের অল্প কয়েকটি সাধারণ দীনতা প্রকাশক গান ছাড়া অধিকাংশ গানের ভাবার্থ উদ্ধার ও উপলব্ধি বই পড়া শিক্ষিতদের জন্য খুবই কঠিন। এর জন্য যে পরিশ্রমটুকু করবার সেটা করবার আগ্রহ বাংলাদেশে নাই বললেই চলে।
অপরিচিত বটে, তবে এমন নয় যে লালন তাঁর ভাষায় কোন ‘গুহ্য’ বা গোপন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি যাদের ভেবে তাঁর গান লিখেছেন তাদের কাছে নদিয়ার সাধন ভজনের ভাষা – প্রতীক, উৎপ্রেক্ষা, ইঙ্গিত বা ইশারা ইত্যাদি -- অপরিচিত কিছু নয়। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে লালনের গান বোঝা কঠিন হলেও লালনের ভাষা ‘গুহ্য’ বা গোপন ভাষা নয়। তাঁর এই ভাবুকতাকে বাংলার ভাবচর্চার ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারের খুব কম উদ্যোগই শিক্ষিতদের মধ্যে দেখা যায়। ফলে লালন ফকির ও নদিয়ার ভাব শহুরে শিক্ষিতদের কাছে একটা রহস্যময় ব্যাপার হয়ে হাজির হয়।
নদিয়ার ভাবের ভাষার মহিমা হচ্ছে শব্দের মূর্ছনা ছাড়াও প্রতীক, উপমা বা ইশারা। ভাবার্থ উপলব্ধির আগেই যা হৃদয় অধিকার করে এবং সুর ও গায়ন পদ্ধতি প্রভূত আনন্দ দেয়। মুদ্রন যন্ত্রের যুগে যারা ছাপা বই বা বইকেন্দ্রিক তত্ত্ববিদ্যায় আগ্রহী শ্রুতি ও কন্ঠনির্ভর কথোপকথনের চর্চা তাঁরা সহজে বুঝতে পারেন না। সে কারণে নদিয়ায় ভাবুকতা চর্চা ও বিকাশের প্রকরণ সম্পর্কে তারা সহজে ধারণা করতে পারেন না। এর জন্য সাধকদের সঙ্গে দীর্ঘকাল সঙ্গ দেওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ নাই। একজন সাধক সারাজীবনের জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে যে উপলব্ধির স্তরে এসেছেন সেটা তিনি ‘বই’ লিখে প্রচারে আগ্রহী নন। বরং সারা জীবন একজন মনের মতো শিষ্য পাবার জন্যই তাঁদের আকুতি প্রবল থাকে। কারন শিষ্যই গুরুকে ‘পার’ করে। নদিয়া মনে করে না, মৃত্যুর পর আলাদা কোন জগত বা ‘পরকাল’ আছে। ফলে সাধক ‘অমর’ হতে পারে ইহলোকে তার কর্মের দ্বারা। গুরুর কথা ও কাজ গুরু কর্তব্য হিসাবে শিরোধার্য করা এবং তা শিষ্যপরম্পরায় বয়ে নিয়ে যাবার মধ্যেই সাধকের সার্থকতা।
নদিয়ায় ভাবচর্চার কিছু সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে, যা ‘সাধুসঙ্গ’ বলে পরিচিত। সেখানে নদিয়ার সাধকরা তাঁদের রীতি অনুযায়ী পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কিত হন এবং তাঁদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও চিন্তা পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করেন। এই মৌখিক চর্চার মধ্য দিয়ে যে ভাষার বিকাশ, বলা বাহুল্য, সেই ভাষা ছাপা বইয়ের ভাষা অনুসরণ করে না। তাছাড়া আধুনিক বাংলা গদ্যের উদ্ভব খুব বেশিদিনের নয়। সে কারনে ছাপাখানার বাংলা আর নদিয়ার ভাবচর্চার বাংলার মধ্যে ফারাক আছে। আছে বলেই প্রমিত বাংলাকে যারা বাংলা ভাষার আদর্শ মনে করে তারা ফকির-ফ্যাকড়ার ভাষা বোঝে না । তখন তারা একে ‘গুহ্য’ বা ‘সান্ধ্যভাষা’ বলে থাকে।
লালন নিয়ে এ যাবত যে সকল লেখালিখি হয়েছে তাকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটি যারপরনাই কুতর্ক এবং উপমহাদেশে হিন্দুমুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির চর্চা। সেটা হোল লালন হিন্দু ছিলেন নাকি মুসলমান ছিলেন এই সাম্প্রদায়িক বিবাদ। লালন জীবদ্দশায় তাঁর নিজের কোন পরিচয় কাউকে – এমনকি তার ঘনিষ্ঠতম শিষ্যদেরও জানান নি। তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও পালক পুত্র ভোলাই শাহও বলেছেন, লালন কাউকেই তাঁর পরিচয় জানান নি। কিন্তু তারপরও গবেষণা ও লালনের ইতিহাস খোঁজার নামে একদল তাকে হিন্দু আর আরেকদল তাঁকে মুসলমান দাবি করে।
দ্বিতীয় প্রকার লেখালিখি হোল বাউলদের গুহ্যসাধনা সংক্রান্ত লেখালিখি। লালন নিজেকে কোনদিন বাউল বলেন নি। কিন্তু তাঁকে ‘বাউল’ প্রমাণ করবার জন্য বিস্তর লেখালিখি হয়। ‘দেহ’ নদিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, কিন্তু লালন ‘দেহ’ সম্পর্কে আসলে কি ভাবতেন এবং শরীরের সঙ্গে ভাবে্র উদয় ও বিকাশের সম্পর্ক কিভাবে বিচার করতেন সে সম্পর্কে, বিস্ময়কর হলেও কোন গবেষণা নাই। বাউলদের ‘গুহ্য’ চর্চাই লালনের ওপর আরোপ করা হয়। নারীপুরুষ সম্পর্ক চর্চার কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশ লালনপন্থিরা মেনে চলেন, অবশ্যই। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে ‘দেহ’ সংক্রান্ত অনুমান নদিয়ার পাঁচ ঘরের মধ্যেও আলাদা। দেহ সংক্রান্ত অনুমানের সঙ্গে খাদ্যব্যবস্থার সম্পর্ক জড়িত। লালনের খাদ্য ব্যবস্থা – বিশেষত ‘সেবা’ পদ্ধতি পরিপূর্ণ ভাবে না বুঝলে ‘দেহ’ সম্পর্কে লালনের ধারণা বোঝা কঠিন। লালনের দেহ একশ ষোল বছর কোন রোগব্যাধি ছাড়া সবল ও সচল ছিল। লালন ফকির কিভাবে তা অর্জন করলেন এটা ‘গুহ্য’ সাধন পদ্ধতি চর্চার কেচ্ছা দিয়ে বোঝা যাবে না।
সবাইকে গৌরপূর্ণিমার শুভেচ্ছা জানাই।
১০ মার্চ ২০১৭। ২৬ ফাল্গুন ১৪২৩। শ্যামলী।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)