- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন
পরাশক্তির হয়ে যারা আন্তর্জাতিকভাবে গবেষণা, নীতিনির্ধারণী আলোচনা এবং পরামর্শ দেয়, তাদের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী একটা সংগঠন হচ্ছে আইসিজি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ)। বাংলাদেশসহ পুরা দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তর্জাতিক শক্তিগুলার পররাষ্ট্রনীতির প্রায়োগিক দিকগুলাই এরা বিভিন্ন প্রতিবেদনের মারফতে সময় সময় প্রকাশ করে। বাংলাদেশ নিয়ে আইসিজি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন ছিল জেএমবি’র হুমকি এবং তা মোকাবেলায় সরকারে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ। এ বছরের পহেলা মার্চ সে প্রতিবেদনটা প্রকাশ করেছিল তারা।
লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, ওই প্রতিবেদনটাতে তারা ‘জেএমবি হুমকি’কে আলোচনা করেছে মূলত দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকির দিক থেকে। আরো বিষেশত ইনডিয়ার, এমনকি সরাসরি কাশ্মির ভিত্তিক ‘জিহাদী’ সংগঠনগুলার সাথে জেমমবি’র যোগাযোগ ও সম্পর্ক বাড়ানোর কথাও প্রচার করে তারা। বিশেষত, লস্কর-ই তাইয়েবা বাংলাদেশে সক্রিয় এবং এখান থেকে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা পাচ্ছে--এই অভিযোগও আনে প্রতিষ্ঠানটি। ইনডিয়ার নিরাপত্তা ভাবনার আলোকে বাংলাদেশকে কিভাবে সাজাতে হবে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ওই প্রতিবেদনের আসল লক্ষ্য। তাই বাংলাদেশকে পরামর্শ দেওয়া হয় ইনডিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা চুক্তি করতে।যেন আঞ্চলিক শক্তি হিশাবে ইনডিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে যা কিছুকে তারা বাধা মনে করে, সেগুলা সরানোই এখন থেকে বাংলাদেশের কাজ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট দেশগুলার জন্য যা এক বিপজ্জনক মাত্রা তৈরি করেছে। তবে আইসিজি যা দেখতে পায় নাই তা হল; এই উদ্যোগ কার্যত পরাশক্তি ও ইনডিয়ার চাহিদার বিপরীত ফলই বয়ে আনবে।
ইনডিয়ান ইউনিয়নভুক্ত নানা রাজ্যে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন ও মুক্তিকামী জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। এই মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীগুলার বিরুদ্ধে ইনডিয়ার সামরিক এবং রাজনৈতিক দখলদারি ও দমন-পীড়ন কৌশলকে পরাশক্তির তরফে আইসিজি পরিস্কার অনুমোদন দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান আবারো পরিষ্কার হল এই অনুমোদন থেকে। বাংলাদেশের জন্য বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হল, সেই সামরিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ইনডিয়ার পক্ষভুক্ত করে নেয়ার রাস্তা বাতলানো এবং এর ন্যায্যতা দেয়ার ভিত্তি হিশাবে কাশ্মিরের সমস্যার সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করে দেখানো। পরাশক্তির স্বার্থ রক্ষার জন্য ইনডিয়াকে আঞ্চলিক সরদার বানাবার এককেন্দ্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা। ফলে এ অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলাকে ইনডিয়ার বলয়ের মধ্যে অধীন করে রাখার কৌশল নিয়েছে আইসিজি। কিন্তু ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর সামরিক স্বার্থের প্রতি এমন নির্বিচার অনুমোদন দেয়ার পরিণতি মোটেই তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের পক্ষে যাবে না। বাংলাদেশ এবং নেপালের মত ছোট রাষ্ট্রগুলা নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই পাল্টা মেরুকরণের পথ ধরবে। ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করবার জন্য শক্তিসমাবেশ ঘটাবে। আখেরে তা ইনডিয়া বা আমেরিকার মিত্রজোট; কারও জন্যই সুখের হবে না। লক্ষ্য অর্জন তো দূরে থাক বরং তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য। কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিকে ইনডিয়া গত দুই দশক ধরে ‘সীমান্তের বাইরে থেকে আসা সন্ত্রাসবাদ’ বলে আখ্যা দিয়ে আসছে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’র সূচনা লগ্নে আমেরিকাকে নিঃশর্তে সামরিক স্থাপনা সহ যাবতীয় সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল ইনডিয়া। দখলদারি ও দমনের শিকার সব জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ এবং সব অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক সমস্যাকে একচোটে ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়ে আমেরিকাকেনিঃশর্তে সামরিক স্থাপনা সহ যাবতীয় সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল ইনডিয়া।
দখলদারি ও দমনের শিকার সব জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ এবং সব অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক সমস্যাকে একচোটে ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়ে আমেরিকার যুদ্ধের সমীকরণে ফেলে দিতে ইনডিয়া মুখিয়ে ছিল। এ সব কিছুকে সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্তের বাইরে থেকে করা নাশকতা বলে সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধের খাপে পুরে দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে তারা। এ লক্ষ্যে আগে থেকে চালানো প্রচারণার সাথে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির সমাবেশ ঘটানো হয়। তাতে অনেকটাই সফল হয় ইনডিয়া। বুশ প্রশাসনের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে দেশটা। সামরিক সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা চুক্তির বদৌলতে এক্ষেত্রে তাদের প্রধান সহায় হয় ইজরাইল। তাতে করে অন্যান্য মুক্তিকামী অঞ্চলের মত সাময়িকভাবে কাশ্মিরকে কিছুটা দমাতে পারলেও লাগাতার হত্যা, নির্যাতন, গ্রেফতার ও বর্বর নিপীড়নের সাথে বঞ্চনার ক্ষোভ আবারো গণবিস্ফোরণের দিকে ঠেলে দেয় দখলকৃত অঞ্চলটাকে।
ঠিক এরকম একটা সময়ে গত তেসরা জুন কাশ্মির নিয়ে সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইসিজি। কাশ্মির বিষয়ে এর চার বছর আগে প্রকাশিত নিজেদের প্রতিবেদনটার মত আবারো ইনডিয়ার বয়ান এবং মূল সুরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ‘আন্তর্জাতিক’ সমস্যা আকারে হাজির করে। ‘শান্তির জন্য পদক্ষেপ: কাশ্মিরিদের অগ্রাধিকারে রাখা’ (স্টেপ টুয়ার্ড পিস: পুটিং কাশ্মিরিজ ফার্স্ট) এই হল প্রতিবেদনটার শিরোনাম। আমরা সেই প্রতিবেদন যাচাই করলে দেখব, দখলকৃত কাশ্মিরের স্বাধীনতার লড়াইকে ইনডিয়ার সরকারি ভাষ্য মোতাবেক একটা অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অনুন্নয়নের সমস্যায় পর্যবসিত করেছে আইসিজি। কাশ্মিরি জনগণের অগ্রাধিকারের কথা বলে তাদের স্বাধীনতার দাবি বা আন্দোলনকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে আস্থা তৈরির পদক্ষেপ বা কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস (সিবিএম)। নিয়ন্ত্রণ রেখার দুইভাগের মধ্যে চলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ালে এবং গোয়েন্দা কড়াকড়ি শিথিল করলে অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মত দেয় পরাশক্তির এই গবেষণা মুখপাত্রটি। স্বাধীনতার দাবি নিস্তেজ হয়ে গেলে, বিষয়টাকে অমীমাংসিত রেখেই ইনডিয়া তার উঠতি এবং বাড়তি খায়েশ মিটিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে--এ হল তাদের ধারণা। কিন্তু সেটা যে হচ্ছে না, তার প্রমাণ সম্প্রতি সেখানে ‘আজাদি’র দাবিতে গণবিষ্ফোরণের প্রবল মাত্রা। এখনো মাত্রার দিক থেকে নব্বইয়ের তেহরিক আন্দোলনকে ছাপিয়ে না গেলেও গুণগতভাবে ভিন্নতর এবং আরো বেশি শক্তিশালী এই গণবিস্ফোরণ।
কারণ, এবারের বিক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্ত, রাজনৈতিকভাবে অসংগঠিত এবং নেতৃত্বহীনভাবে পরিচালিত--এই স্বীকারোক্তি খোদ কাশ্মির রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ’র। জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা এবং ওই জনগণের শক্তিকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ এই আন্দোলনের অন্যতম বিশেষ দিক হল--এবার কিশোর, তরুণ এবং বয়স্ক নারীরাও আপনাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে; কারফিউর মধ্যে পুলিশ-আধাসামরিক সিআরপিএফ এবং সেনাবাহিনীর বুলেট-টিয়ার গ্যাস-লাঠি উপেক্ষা করে। ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদার মত শিশু কিশোররাও ঢিল আর গুলতি ছুঁড়ছে দখলদার সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর যুদ্ধংদেহী সদস্যদের ওপর। কিছুতেই তাদের মুখ থেকে ‘আজাদি... আজাদী ...’ শ্লোগান কেড়ে নেয়া যাচ্ছে না। আটচল্লিশ থেকে দীর্ঘ চার দশকের চরম দমন অভিযান শেষে গত দু’দশক ধরে ইনডিয়া প্রচার করে আসছে, কাশ্মিরে আসলে কোন স্বাধীনতার আন্দোলন নাই। কিছু বিছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সীমান্তের বাইরের মদদে সেখানে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। যাকিছু সমস্যা, সেসব নেহায়েতই অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অনুন্নয়নের ফলে। আবার সেখানে উন্নয়ন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেই সমস্ত ‘সন্ত্রাসবাদী’ অপতৎপরতার কারণে।
আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো জোটের যুদ্ধ শুরু হবার পর এমনিতেই পাকিস্তানকে চাপের মধ্যে থাকতে হয়েছে। কাশ্মির ভিত্তিক সংগঠনগুলাকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিশাবে ঘোষণা এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে আমেরিকা নানা সময়ই পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের মুম্বাই আক্রমণের পর জোরদার দমন অভিযান চালায় পাকিস্তান। নিয়মিত বিরূপ প্রচারণার মুখে, কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠনগুলার জন্য পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এবং পাকিস্তানে থাকা সহযোগী ও সমর্থক সংগঠনগুলার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তারওপর, প্রথমত; পারভেজ মোশাররফের দিল্লি সফরে কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের বেনজির নমনীয়তা, দ্বিতীয়ত; তার পরে আসিফ আলি জারদারি আলোচনার টেবিল থেকে কাশ্মিরকে ছুড়ে ফেলায় এটা স্পষ্ট যে, কাশ্মির বিষয়ে সরকারি এবং রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান আর আগের জায়গায় নাই। গত ১১ জুন থেকে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভের জবাবে সর্বশেষ সামরিক দমন অভিযানে প্রায় অর্ধশত কাশ্মিরি খুন হওয়ার পরও পাকিস্তানের নিরব ভূমিকায় সেটা আরো বেশি স্পষ্ট। কিন্তু ‘কাশ্মিরি সন্ত্রাসবাদ’ তত্ত্বের গুরুদের অবাক করে দিয়ে এই ‘পাকিস্তানি নিরবতা’ই প্রধান শক্তির জায়গা হয়ে উঠেছে কাশ্মিরিদের জন্য। পাকিস্তানের মদদে ‘সীমান্তের বাইরের সন্ত্রাসবাদ’ তত্ত্বকে উল্টে দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহে ফেটে পড়েছে কাশ্মিরি জনগণ। তবু পরাশক্তির টনক নড়ছে না। তাদের সংবাদ মাধ্যম এবং রাজনৈতিক এজেন্ডায় এখনো বিষয়টাকে ইনডিয়ার স্বার্র্থে চেপে রাখার দৃষ্টিভঙ্গি বহাল রেখেছে। যেন সামান্য আইন-শৃঙ্খলার অবনতির চেয়ে বেশি কোন কিছু সেখানে ঘটে নাই। এই ভুল ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের সাথে অবশ্যই যোগ হবে আফগানিস্তান।
সাম্প্রতিক বছরগুলাতে এ অঞ্চলে আমেরিকান আগ্রাসন ও আগ্রাসন বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের ফলে আঞ্চলিক-ক্ষমতার ভারসাম্যে পরাশক্তির অবস্থানগত বদল ঘটেছে। আমেরিকা এবং তার মিত্রদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছে আফগানিস্তান। এর সাথে পুরা দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতা বিন্যাস এবং আঞ্চলিক শক্তি হিশাবে ইনডিয়ার উঠে আসার প্রশ্ন জড়িত। আর চিন তো ইতিমধ্যে নিজের জায়গা তৈরিতে অনেক এগিয়েছে। কিন্তু আমেরিকা বা ইওরোপিয় ইউনিয়নের ন্যূনতম চাহিদাও আফগানিস্তানে কোনদিন পূরণ হবে না, যদি না তারা কাশ্মির প্রশ্নে তাদের বর্তমান নীতি না বদলায়। অর্থাৎ ইনডিয়াকে মিত্র হিশাবে পাওয়ার জন্য সব কিছুতে চোখ বুজে থাকার--কিম্বা ইনডিয়ার ভাষ্যকেই নিজের ভাষ্য এবং পররাষ্ট্র নীতির অংশ করে নেয়ার চর্চার--নীতি থেকে তারা বের হয়ে না আসে। এ নীতি বদলাতে ব্যর্থ হলে এমন চড়া মূল্য দিতে হবে আমেরিকা ও ইওরোপিয় শক্তিগুলাকে যে মূল্য পরিশোধের সামর্থ্যও তাদের অবশিষ্ট থাকবে না। আফগানিস্তানে আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে তালেবানরা যে অপরাজেয় তা এখন প্রমাণিত, নয় বছর পর অধিকাংশ ভূখন্ড এখন আবারো তাদের নিয়ন্ত্রণে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে; কখন তারা বিজয়ের কাছাকাছি পৌঁছাবে এবং কাবুলে তারা ক্ষমতা দখল করলে কি ঘটবে।
সম্প্রতি কাশ্মিরের বিষয়ে ইনডিয়ার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, ‘পাকিস্তানের উচিত জঙ্গিদের তার ভূখ- ব্যবহার করতে না দেয়া।’ সেটা ইনডিয়ার দিক থেকে হয়ত দরকার। কিন্তু নিজেই যে সে সমস্যার কেন্দ্রে আছে সেটা স্বীকার করতে ইনডিয়া কখনো রাজি না। নিজেদের দিক থেকে সমাধান প্রচেষ্টার চেয়েও তারা বেশি আগ্রহী অন্যদের ওপর দোষ আরোপ করতে। এবং তাদের যুদ্ধটা অন্যদের দিয়ে করিয়ে নিতে। ইনডিয়া চায়; অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধযুদ্ধগুলা দমন, দখলদারি প্রতিষ্ঠা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বেশ কিছু দিক নিশ্চিত করার কাজগুলা প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রগুলাকে দিয়া করিয়ে নিতে। একই সাথে এই প্রতিবেশীরা ইনডিয়ার আধিপত্য মেনে নিক--এটাও ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর চাওয়া। ইনডিয়া চায়; উত্তরপূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলাতে যে যুদ্ধ সে চালাচ্ছে সে যুদ্ধে বাংলাদেশ শরিক হোক। পাকিস্তানের কাছে ইনডিয়ার চাওয়া হচ্ছে; জম্মু-কাশ্মির থেকে হাত গুটিয়ে এবং আজাদ-কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সক্রিয় সংগঠনগুলার ঘাড় মটকিয়ে দেয়। যাতে আঞ্চলিক পরাশক্তি হবার পথে সবচেয়ে বড় বাধাগুলার অন্তত একটা সরানো যায়।
পাকিস্তান তার নিজের দক্ষিণ এশিয়া নীতি, বিশেষ করে এ বিষয়ক ভূরাজনৈতিক কৌশল বিবেচনা করে, যে কারণে আফগানিস্তানকে একটা কৌশলগত গভীরতা (Strategic depth) হিশাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়--সেই আঁকড়ে ধরার পেছনে থাকা অন্যতম প্রধান কারণও হচ্ছে কাশ্মির বিরোধে সুবিধাজনক অবস্থানে এগিয়ে থাকা। কারণ, এছাড়া তাদের হাতে আর কোন চাপ সৃষ্টির উপায় (Leverage) অবশিষ্ট নাই। আমেরিকা যতই চেষ্টা করুক কিম্বা পাকিস্তান যতই অস্বীকার করুক, আফগানিস্তানে তাদের দুই পক্ষের এই খেলা বন্ধ হবার বাস্তবসম্মত কোন কারণ নাই। আখেরে তা আমেরিকার জন্য বেরোবার রাস্তা বন্ধ করে পালিয়ে বাঁচার রাস্তাই তৈরি করবে। যাতে কোনভাবেই এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আসবে না। একটা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত এবং যুদ্ধের হুমকিকেই শুধু বাড়াবে।