দক্ষিণ এশিয়ায় তৈরি হচ্ছে নতুন ‘ফিলিস্তিন’

আত্মরক্ষার নামে শিশু হত্যা

কাশ্মিরে ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন নতুন মাত্রা পেয়েছে। স্বাধীনতার দাবিতে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ লাগিয়ে গুলি করে খুন করা হচ্ছে। গত এগারো জুন থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনী গত রোববার পর্যন্ত উনপঞ্চাশ জন নিরস্ত্র কাশ্মিরিকে হত্যা করেছে। এদের প্রায় সবাই শিশু এবং কিশোর। এমনও দিন গেছে যেদিন এর মধ্যে একদিনেই ৬ থেকে ৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত ইনডিয়ার সেনাদের হাতে খুন হওয়া সবচেয়ে কম বয়সী শিশুটির বয়স মাত্র নয় বছর।

এ ঘটনাগুলার বেশিরভাগই ঘটছে জম্মু এবং কাশ্মিরের রাজধানী শ্রীনগরে। যখনই ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী কাউকে হত্যা করছে বিচার না পাওয়ায় তখনই অন্যরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে এবং নিরস্ত্র শিশুরা গুলির জবাবে নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পাথর ছুঁড়ছে। ট্যাঙ্ক সহ সামরিক বহর ওয়ালা ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সশস্ত্র বাহিনীর দিকে কিছু শিশুর পাথর ছোঁড়া খুবই বিপজ্জনক। সে কারণেই এ কে ৪৭ দিয়ে নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করে সৈন্যরা তার জবাব দিচ্ছে। একইসাথে কাশ্মিরের রাজ্যশাসক ও ইনডিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর এ গুলিবর্ষণকে আত্মরক্ষার কথা বলে ন্যায্যতা দিয়ে যাচ্ছে। নিরস্ত্র কিছু শিশু একটা সুসজ্জিত বাহিনীর জন্য হুমকি--বিশ্বকে এখন এটাও মেনে নিতে হবে।

অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণ

কাশ্মিরি নারীদের গুম করে নিয়ে ধর্ষণ করে ইনডিয়ার সেনারা। আবার খোলামেলা সবার সামনেই গণধর্ষণ করছে তারা। এটা সেখানে এখন খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়েছে। ইনডিপেন্ডেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী উনিশশ একানব্বই সালের বাইশে ফেব্রুয়ারি ইনডিয়ার সেনাবাহিনীর একটা দল কুনান পুশপরা গ্রামে এসে প্রথমে নারী ও পুরুষদের আলাদাভাবে আটক করে। এরপর চৌদ্দ থেকে একশ বছর বয়সের অন্তত তেইশ জন নারীকে তাদের স্বামী, সন্তান বা বাবার সামনে গণধর্ষণ করে।

গত পয়লা এপ্রিল জম্মু কাশ্মিরের পুলিশ জানিয়েছে, নভেম্বর দুই হাজার দুই থেকে জুলাই দুই হাজার আট সাল পর্যন্ত--ছয় বছরে ইনডিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে একান্ন জন নারী ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। কাশ্মিরের রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার কমিশন--স্টেট হিউমেন রাইটস কমিশন (এসএইচআরসি) ২০০৮-২০০৯ বছরে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ৪০৪ টা মামলা করেছে। যার মধ্যে ৬ টা ধর্ষণ, ৪৩ টা নিখোঁজ এবং ৯ টা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা অন্যতম। ‘ডেইলি গ্রেটার কাশ্মির’ ২৯ জুন প্রতিবেদন ছাপে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত কাশ্মিরে নিহতের মধ্যে বারো জন ছিল তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের। তাদের মধ্যে নয় জনকেই আধা সামরিক বাহিনী সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ) সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে।

পত্রিকার পাতায় যে প্রতিবেদনগুলা ছাপা হয়েছে সেগুলা আসল ঘটনার খুবই সামান্য চিত্র। কারণ কাশ্মিরে ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলা অপরাধ করে সে অপরাধ প্রকাশের আলামত ও উপায়ও বন্ধ করে দেয়। একইভাবে মানবাধিকার কর্মী বা সাংবাদিকদের ওপর সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশে তারা তাদের সুবিধা মত বহু বিধি নিষেধ আরোপ করে রেখেছে। ফলে সেখানে ইনডিয়ান সেনাদের ভয়ে অত্যাচারিত হয়েও অনেক নিরীহ মানুষ মুখ খুলতে পারে না। যেকারণে গুমহত্যা সহ অসংখ্য হত্যা, ধর্ষণ এবং অপহরণের খবর অজনাই থেকে যায়।

একদিনে একশজনকে সরাসরি খুন

গাজা উপত্যকায় সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম নির্যাতন ব্যাপক আকারে শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের ২০ জানুয়ারি এক ব্যাপক হত্যাকা-ের মাধ্যমে। ওই ঘটনার প্রতিবাদ করতে মিছিল করে নিরস্ত্র মুক্তিকামী কাশ্মিরি জনগণ। কিন্তু ইনডিয়ার সেনা সহ রাজ্য সরকারে নিরাপত্তা বাহিনী মিছিলটিতে নির্বিচারে বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করে কমসে কম একশ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। গোয়াকাডাল ব্রিজে সংঘটিত সেই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বীভৎস স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় কাশ্মিরের জনগণকে। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত চলছে। ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এসব অবিচার এবং খুনের ঘটনার জন্য এ পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক নেতা কিংবা সেনা কর্মকর্তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয় নাই। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিটা খুনই জনমনে ক্ষোভ তৈরি করেছে। যেখানে একদিকে ইনডিয়ান সেনাদের জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, ধর্র্ষণ আরেক দিকে কাশ্মির রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর দমন পীড়ন, রাজ্যের বেআইনি হত্যাকা- ও অন্যায় নিপীড়ন সমান তালে চলছে কাশ্মিরে। মোটকথা এসব ঘটনা কাশ্মিরিদের বিক্ষোভ, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা আরো শক্তিশালী করে তুলছে।

বিশ বছরে লাখো মানুষ হত্যা

কাশ্মিরে এ পর্যন্ত ঠিক কতজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, কি পরিমাণ বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং কত সংখ্যক মানুষকে নিরাপত্তা বাহিনী ধরে নিয়ে ফেরত দেয় নাই তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। নানা পক্ষ থেকে নানা পরিসংখ্যান দাবি করা হয়েছে। কাশ্মিরের স্বাধীনতার প্রচারণা সংগঠন কাশ্মির আমেরিকান কাউন্সিলও (কেএসি) একটা পরিসংখ্যান করেছে। তাতে তারা দাবি করেছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের গত বিশ বছরে নারী, শিশু ও যুবক মিলিয়ে এক লাখ নিরীহ কাশ্মিরি ইনডিয়ান সেনা এবং রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে খুন হয়। স্থানীয় এনজিও আইপিটিকের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৮৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মির উপত্যকায় ইনডিয়ান সৈন্যদের হাতে নিহতের সংখ্যা সত্তর হাজারেরও বেশি।

কাশ্মিরের জনসংখ্যা এক কোটি দেড় লাখ। কিন্তু শুধু এ সামান্য নিরস্ত্র জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই ইনডিয়ান ইউনিয়ন সেখানে আধাসামরিক ও সামরিক বাহিনী মিলিয়ে ১০ লাখ সদস্যের নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন রেখেছে।

গণকবর খুঁজে পাওয়া : নৃশংসতার ব্যাপক আলামত

কাশ্মিরের স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল পিপলস ট্রাইব্যুনাল অন হিউম্যান রাইটস এন্ড জাস্টিস ইন ইনডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্র্যাড কাশ্মির (আইপিটিকে) সম্প্রতি কাশ্মিরে দুই হাজার তিনশটা গণকবর খুঁজে পেয়েছে। তারা বলছে, ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর নিজস্ব হেফাজত থেকে গুম হয়ে যাওয়া লোকদেরই লাশ রয়েছে এ গণকবরগুলাতে। তাদের দাবি, এ কবরগুলাতে অন্তত দুই হাজার নয়শ তেতাল্লিশ জন নারী, পুরুষ ও শিশুর লাশ আছে।

শ্রীনগরভিত্তিক সংগঠনটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী উনিশশ উনানব্বই সাল থেকে এ পর্যন্ত কাশ্মিরে আট হাজার লোক গুম হয়েছে। ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে ফেরত দেয় নাই। এবং এরপর তাদের আর কোন খোঁজও পাওয়া যায় নাই। সংগঠনটি তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখাচ্ছে, উত্তর কাশ্মিরের বান্ডিপুরা, ব্যারামুল্লা ও কুপওয়ারা জেলার পঞ্চান্নটা গ্রামে দুই হাজার সাতশটা অজ্ঞাত ও অশনাক্ত গণকবর আছে। এগুলা শনাক্ত করে লাশ উদ্ধারে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত পরিষদ গঠনে শ্রীনগর সরকার ও দিল্লি সরকারের কাছে আহবান জানিয়েছে আইপিটিকে।

আইপিটিকের আহবায়ক ও ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ ইন্টেগ্রাল স্টাডিজ এর সোশ্যাল এন্ড কালচারাল অ্যানথ্রোপলজির অধ্যাপক ড. অঙ্গনা চ্যাটার্জি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলেছি, বিষয়টা কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের থাকা জরুরি।

আইপিটিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে আহবান জানিয়েছে, কাশ্মিরে গত দুই দশকের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করতে। গণকবরের তদন্তের ব্যাপারে তারা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একই আহবান তারা মানবাধিকার বিষয়ক ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টের উপ-পরিষদকেও জানিয়েছে।

কিন্তু আইপিটিকে সক্রিয় হলেও অপরাপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলাকে কাশ্মির ইস্যুতে খুব বেশি সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে গণকবর ও যুদ্ধাপরাধ তদন্ত সহ কাশ্মিরে চলমান মানাবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলার ওপর কোন চাপ তৈরি হচ্ছে না।

হত্যার উদ্দেশ্যে মাথা ও বুক বরাবর গুলি বর্ষণ

ইনডিয়ার সরকার বলছে, তারা মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পায়ের নিচে গুলি করছে। কিন্তু হাসপাতালের রেকর্ড বুকগুলায় পায়ের নিচে গুলির আলামতের কোন কথাই নাই। কারণ বেশিরভাগ গুলি ও টিয়ারগ্যসের সেল ছোঁড়া হয় মাথা ও বুক বরাবর। কাশ্মিরের শীর্ষস্থানীয় ট্রমা সেন্টার এসএমএইচএস হসপিটালে বিশ দিনের একটা অনুসন্ধান করা হয়। তাতে দেখা যায়, নানা বিক্ষোভ ও আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ চৌদ্দ জনের মধ্যে ছয় জনের বুকেই গুলি পাওয়া যায়। একজনের গলায়, একজনের বাম কাঁধে এবং একজনের বাহুতে গুলি করা হয়েছে।

হাসপাতালের অপারেশন কক্ষের রেকর্ডবুকে গুলি লাগা বা গুরুতর আহত রোগীদের যে তথ্য সংরক্ষণ করা হয় সেখান থেকেই এ তথ্যগুলা পাওয়া গেছে। তিন সপ্তাহে তারা মাত্র একজনকে পেয়েছে, যে গুলিতে না টিয়ার সেলের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছে। এবং এটাও ছিল মাথায় আঘাত। হাসপাতালের দুর্ঘটনা বিভাগের একজন সিনিয়র ডাক্তার কাশ্মির টাইমসকে জানান, শরীরের নিচের অংশে গুলিবিদ্ধ হয়েছে এমন একটা ঘটনাও তারা গত তিন মাসে পান নাই। গুলি লেগে, টিয়ার সেলে বা বন্দুকের বাঁটের আঘাতে আহত--সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে দেহের ওপরের অংশেই আঘাতের দাগ। তিনি বলেন, এই কয়দিনে আমরা গুলি লাগা কাউকেই পাই নাই, যাকে দেখে মনে হয়েছে লক্ষ্যবস্তু ছিল দেহের নিচের অংশে। এমনকি আমরা অনেকের সম্পর্কে কোন তথ্যই নিতে পারি নাই। কারণ সেসব আহত রোগীদের ভয় ছিল এখানে তথ্য প্রকাশ করলে যেকোন সময় গ্রেফতার হতে পারে তারা। যেহেতু হাসপাতালের সব তথ্যই সিআইডি সদস্যরা প্রতিদিন নিয়ে যায়। এসব কারণে হাসপাতালে আসা সব আঘাত প্রাপ্তদের সংখ্যা জানা যায় না।

অপর এক সিনিয়র ডাক্তার বললেন, যেদিন পুরান শহরে সিআরপিএফ জাভেদ আহমেদ মোল্লাকে হত্যা করে সেদিন আমরা গুলি লাগার সাতটা ঘটনা পেয়েছি। আমার পরিস্কার মনে আছে, এদের প্রত্যেকের গুলি লেগেছে কোমরের ওপরের অংশে। কাশ্মিরে নতুন করে সংঘাত শুরুর পর প্রতিদিন অন্তত দশটা আঘাত প্রাপ্ত রোগী নিত এসএমএইচএস হাসপাতাল একাই। পুরা মাসজুড়ে যার সংখ্যা হয় দুইশ’র মত। এরা সবাই প্রতিবাদ মিছিলে নিরাপত্তার বাহিনীর হামলায় জখম হওয়া। হাসপাতালের এসব তথ্য থেকে সহজেই বুঝা যাচ্ছে, ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সাধারণ মানুষকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে কিভাবে ডাহা মিথ্যা বলে যাচ্ছে।

হত্যা সহ সমস্ত অপরাধ কর্মকাণ্ড চালানো বৈধ

ইনডিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মিরে খুন, অপহরণ, লুটপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিজস্ব হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা এবং অগ্নিসংযোগ সহ সব অপরাধ কর্মকা-ই বৈধভাবে করতে পারছে। এসব কর্মকা- অপরাধ হলেও এগুলা তাদের জন্য বৈধ। কারণ এর পেছনে আছে আর্মড ফোর্সেস অ্যাক্ট বা বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৫৮ (এএফএসপিএ)। আইনটার মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিয়োজিত বাহিনীর সব ধরনের অন্যায় ও অপরাধ কর্মকা- বৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে ইনডিয়া। আইনটা জারি করা হয় ১৯৯০ সালের জুলাই থেকে। এতে আসলে কাশ্মিরিদের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কোন অভিযোগ আনারই আইনগত অধিকার রাখে নাই ইনডিয়া সরকার। ফলে আইনটি ব্যবহার করে এখন ইনডিয়ান সেনারা নির্বিচারে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। মোটকথা এর ফলে জনগণের তরফে ন্যায্য অভিযোগ তোলারই কোন আইনি অধিকার নাই।

ইনডিয়া কাশ্মিরিদের যেমন মনে করে

ইনডিয়ান ইউনিয়ন তার সৈন্যদের ধারণা দিয়েছে, কাশ্মির ভূখ- দখলে রাখতে হবে এখানকার জনগণের ওপর দমন পীড়ন ও নির্যাতনমূলক আচরণ করে। ইনডিয়া অঞ্চলটিকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ দাবি করছে।

ইনডিয়ান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইজরাইলি সেনা কর্মকর্তারা

কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের দমনে ইনডিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রণকৌশলগত বন্ধু ইজরাইলের সহযোগিতা নিচ্ছে। ইজরাইলি সেনাকর্মকর্তারা কাশ্মিরে এসে ইনডিয়ান সেনাদের হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছে কিভাবে নির্যাতন চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে হয়। এবং সংখ্যাগুরু একটা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করে কিভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে হয়। এ সংখ্যালঘু করাটা তাদের নিছক একটা কৌশল; যার আসল মানে হল, সেখানকার স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

ইনডিয়া তার প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইটে বলেছে, ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ইজরাইলি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল আভি মিজরাহি অনির্ধারিত সফরে কাশ্মিরে এসে ইনডিয়ান সেনা ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। এছাড়া তিন দিন ইনডিয়ায় অবস্থান করে মিজরাহি উর্ধতন ইনডিয়ান সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি ইজরাইলি সেনাবাহিনীর দ্বারা ইনডিয়ার সন্ত্রাস বিরোধী কমান্ডোদের প্রশিক্ষণের খসড়া নিয়ে আলোচনা করেন। প্রশিক্ষণের ব্যাপারগুলাতে গোপনীয়তা বজায় রাখা এর অন্যতম নীতি। এ সফলে ইজরাইল ইনডিয়াকে পরামর্শ দিয়েছে, ‘আমরা ফিলিস্তিনিদের সাথে যা করছি তোমরাও কাশ্মিরিদের সাথে তাই কর। ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ইজরাইলের কাছ থেকে ইনডিয়া পাঁচ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনে। ইনডিয়ার সাথে ইজরাইলের সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করা যায় কারগিল যুদ্ধের সময়। ওই যুদ্ধে ইনডিয়াকে জয়ী করতে অস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণে এগিয়ে আসে ইজরাইল।

স্থানীয় গণমাধ্যমের ওপর নির্বিচার বলপ্রয়োগ

কাশ্মিরের গণমাধ্যমগুলাকে হত্যাকা- নিয়ে কথা বলতে দিচ্ছে না ইনডিয়া। সংবাদ পত্র এবং টিভি চ্যানেলগুলার ওপর কড়া সেন্সরশীপ আরোপ করেছে তারা। আদেশ অমান্য করলে পত্রিকা বন্ধ করে দিচ্ছে। আবার কোন কোন টিভি চ্যানেল বা পত্রিকার বিরুদ্ধে মামালা ঠুকে সংবাদ প্রচারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিক্ষোভের সংবাদ ছাপানোর অপরাধে এ পর্যন্ত কাশ্মিরের দুইটা টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে ইনডিয়া। যাদের বেশি বিপজ্জনক মনে করছে সে সব সংবাদিকদের গুম করে ফেলছে তারা।

কড়া বিধি নিষেধ জারি করায় নিরাপত্তা বাহিনীর অনুমতি বা ইচ্ছার বাইরে কোন তথ্য সংগ্রহ বা সরবরাহ করতে পারছে না সাংবাদিক ও মানবাধিকারা। কারফিউর সময় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা পাসও দেয়া হয় না। ফলে কাশ্মিরের ভেতরে আসলে লাখ লাখ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং আর্মি কি করছে তা জানার সুযোগ বাইরের দুনিয়ার খুব কমই আছে। সরকারের দমন-নির্যাতন ও বেআইনি কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কথা বলার মানে সেখানে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করা। এমনকি নির্যাতিতদের আইনি সহায়তাও জীবনের ঝুঁকি নিয়া করতে হয়। কারণ যারা এ সহায়তা দিচ্ছে তাদের ওপরও সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে। জম্মু এবং কাশ্মির বার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মেয়া গাইয়ুমকে গত মাসের সাত জুলাই মধ্যরাতে বাড়ি রেড দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। তার অপরাধ, তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কথা বলেছেন। এবং অত্যাচারিতদের আইনি সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনকি তাকে অন্যায়ভাবে নিয়ে যাবার প্রতিবাদ করলে বার এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জি এন শাহীনকেও আটক করে।

প্রতিরোধ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারই যখন বিকল্প

কাশ্মিরের জনগণের ওপর ইনডিয়ার দমনমূলক আচরণ তাদের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ দমন-নির্যাতন প্রক্রিয়া তারা দিনেদিনে আরো ব্যাপক করে তুলেছে। যেকারণে শিশুর কিশোর, নারীরাও এখন প্রতিবাদ প্রতিরোধে রাস্তায় নেমে আসছে। একইসাথে নিরাপত্তা বাহিনী হত্যা, নির্যাতন, হামলা ও দমনও আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব ঘটনা জারি রেখেই ইনডিয়া নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিশাবে দাবি করছে। আর কাশ্মিরিরা যুগের পর যুগ তাদের হত্যা, গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে। এখন তাদের সামনে প্রতিরোধ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কায়েমের জন্য গণভোটের দাবি ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই।


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 5722 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD