- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
‘আইনি নির্যাতনে’র বায়ান্ন বছর
আজ এগার সেপ্টেম্বর। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাতকন্যা অঞ্চলের মানুষের ওপর দখলদারি ও দখলদারির সহজাত নির্যাতনকে ইনডিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী আইনি বৈধতা দেয় উনিশশ’ আটান্ন সালের এদিনে। দেশটার সরকারি বাহীনিগুলাকে এ অঞ্চলে হত্যা-ধর্ষণসহ সব নির্যাতনের অপরাধ থেকে আগাম দায়মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা রেখে একটা আইন এদিন ইনডিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জারি করেন। এগার সেপ্টেম্বর জারি করলেও পেছনের সময়ে করা অপরাধ থেকে আইনি সুরক্ষা পেতে ওই বছরের বাইশে মে থেকেই আইনটা কার্যকর বলে ঘোষণা দেয় ইনডিয়া। প্রথমে দুইটা রাজ্যকে আইনের আওতাভূক্ত করা হলেও পরে নানা সময়ে অন্যান্য রাজ্য ও এর বাইরে দখলকৃত কাশ্মীরেও এ আইন জারি করা হয়। দুনিয়ার সবচে বড় গণতন্ত্রের দাবিদার দেশটিতে এখনও এই আইন কার্যকর আছে। সাতকন্যা রাজ্যগুলা ও কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলা সহ নানা শ্রেণীপেশার সাধারণ মানুষ আইনটার বিলোপ চাইছেন।
মাত্র সাত ঘণ্টায় সাতকন্যা’র জানের ওপর চেপে বসা
উনিশশ আটান্ন সালের দুই সেপ্টেম্বর ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট এই আইনটা--আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার (অসম, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল ও নাগাল্যান্ড) অ্যাক্ট বা স্বশস্ত্র বাহীনির বিশেষ ক্ষমতা আইন গ্রহণ করে। মাত্র সাত ঘণ্টায় জন্ম নিয়েছিল এই আইনটা। প্রস্তাবিত আইন বিষয়ে ইনডিয়ার পার্লামেন্টের লোকসভা’য় আলোচনা হয়েছিল মাত্র তিন ঘন্টা আর রাজ্যসভা’য় চার ঘন্টা। লোকসভা হল ইনডিয়ার পার্লামেন্টের নিম্ন সভা ও রাজ্যসভা হল উচ্চ সভা। আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে বলতে গেলে তেমন কোন আলোচনাই হয় নাই আইন বিষয়ে, হাতেগোনা কয়েকজনের বিরোধিতা চাপা দিয়ে আইনটা গ্রহণ করে ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী।
তবে আইনটা তার জন্মেরও অনেক আগে থেকেই কার্যকর হিশাবে গণ্য হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। পার্লমেন্টে গ্রহণ করার পর, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৯৮৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জারি করা হলেও, আইনত ওই বছরেরই ২২ শে মে থেকে কার্যকর বলে গণ্য করা হয় আইনটাকে। ফলে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে--যখন দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলার জীবন ও জনপদের ওপর দখলদারি শুরু করেছিল ইনডিয়া--তখন থেকে সব দখলদারির সামরিক অভিযান, ধ্বংসযজ্ঞ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, যৌন নির্যাতন সহ সব ধরনের নির্যাতনকে ‘আইনি বৈধতা’ দেয় ইনডিয়া, এই আইনের মাধ্যমে।
দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক যুদ্ধগুলার একটা
আটান্নর সেপ্টেম্বরে ইনডিয়ার পার্লামেন্টে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাগা পাহাড়ি এলাকায় ইনডিয়া বিরোধী বিক্ষোভ দমন করার জন্য ‘সাময়িক পদক্ষেপ’ হিশাবে আইনটার পক্ষে সাফাই গান। কিন্তু তারপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ দশক। এখনো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটা বিরাট অংশকে এই আইনের আওতায় ‘গোলযোগপূর্ণ এলাকা’ হিশাবে দেখানো হচ্ছে, ফলে আইনটা কার্যকর আছে। সামরিক আইনের চেয়েও কঠোর এই আইনের ভিতর দিয়ে দিন পার করছে ওই অঞ্চলের মানুষ। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটাকাদেশ, নির্বাসন ও জোর করে ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া; এসবকে পরোয়া করেই তাদের বেচে থাকতে হয়। পাশাপাশি এসবের শিকার হতে হয় তাদের।
ক্রমশ সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহীনিগুলার উপস্থিতি ও শক্তি বাড়ান হচ্ছে এসব এলাকায়। দুই হাজার সাত সালের বারই জানুয়ারি ইনডিয়ার সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা পৃথিবীতে প্রথম প্রচলিত নিয়মের বাইরের আরেক প্রকার যুদ্ধ চালাচ্ছে। তারা এটাকে সাব-কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার বা অপ্রচলিত যুদ্ধাবস্থা বলছে। ওই অঞ্চলের মানুষ তাদের জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, অপ্রচলিত যুদ্ধাবস্থা মানে হল তাদের বিরুদ্ধে পুরা শক্তি নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে একটা শক্তিশালী ও সুসজ্জিত বিপুল সংখ্যক সেনাসদস্য--অথচ সেই যুদ্ধকে সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ হিসাবে চিনতে দেয়া হচ্ছে না।
বর্তমানে এ সকল অঞ্চলে অপারেশন অল-ক্লিয়ার বা সব পরিস্কার অভিযান, ড্রাগনেট অভিযান ও টর্নেডো অভিযান পরিচালনা করছে ইনডিয়ান নিরাপত্তা বাহিনী। এই অভিযানের এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে মণিপুরে, আর ইনডিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কাশ্মিরে, এ দুটি রাজ্যের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। কারণ সরকারি সশস্ত্র বাহিনী সন্ত্রাস ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী অভিযানের’ নামে সাধারণ মানুষকে হত্যা, গুম করছে অবলীলায়। তল্লাশির নামে লুটপাট তো চলছেই।
হাজার বছরের মুক্ত অঞ্চলে ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসকরা
সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালা এশিয়ার দুইটা অঞ্চল--মধ্য এশিয়া আর দক্ষিণ এশিয়াকে আলাদা করে এগিয়েছে পূব দিকে। পূবে যেতে যেতে গঙ্গার ব-দ্বীপ--বাংলাদেশ পার হয়ে বহ্মপূত্র নদের ওপাশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ দিকে; হিমালয় এখানে আরো নীচু নীচু পর্বতমালা আর পাহাড়ের আকারে বিস্তৃত হয়েছে। মেঘালয়া-ত্রিপুরা-মিজো-নাগা আর অরুনাচল নামের সব পর্বতমালায়। পর্বতমালা আর পাহাড়সারি এখানে আলাদা হয়ে আছে নানা উপত্যকায়, আর উপত্যকাগুলা ছুয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী, যে নদীগুলা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে অঞ্চলে থিতু হয়েছে মানুষের নানা গোষ্ঠী, নানা অঞ্চল থেকে আসা নানা রকমের মানুষ। নতুনেরা আর পুরানোরা মিলেছে, নানা গোষ্ঠীর জীবনাচার-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের লেনদেনের মধ্য দিয়ে এক বৈচিত্রময় সমাজ কায়েম হয়েছে। নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক আর সামাজিক বৈচিত্রে অনন্য এই সাতকন্যা অঞ্চল।
কিন্তু আজকের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে এ অঞ্চলের একটা বিশাল অংশ ইনডিয়ান ইউনিয়নের সাতটা রাজ্যে বিভক্ত হয়ে সাতকন্যা নামে ইনডিয়া রাষ্ট্রের দখলে। অথচ ইতিহাসের সবসময়ই এ অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর আর্য কিম্বা মুসলিম শাসকরা দখল নিলেও এই দুই সাম্রাজ্য কখনও বহ্মপুত্র নদের পূব পারে পৌঁছতে পারে নাই। সবশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা এই বাধা পেরোয়।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে মনিপুর ও অসম অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে বার্মার শাসকরা। তখন ভারতবর্ষের বৃটিশ শাসকদের জন্য তা একই সাথে উদ্বেগ ও সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়। বার্মার সামনে মনিপুরের রাজা গম্ভীর সিংহের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একসাথে বার্মার সম্প্রসারণবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। শেষ পর্যন্ত বার্মা পিছু হটে, এবং ১৮২৮ সালে ইয়ান্দাবুর চুক্তি সই হয় দু’পক্ষের মাঝে। ওই চুক্তি অনুযায়ী অসম বৃটিশ ইনডিয়ার অর্ন্তভূক্ত হয়। এরপর অসমকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের বাদবাকি জায়গায় প্রভাব বিস্তারের রাজনৈতিক অভিযানে নামে ঔপনিবেশিক শাসকরা।
ওই অভিযানের বিপরীতে মনিপুরীরা দাঁড়ালে চূড়ান্ত সংঘাত বাধে বৃটিশদের সাথে। ১৮৯১ সালে ওই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত বৃটিশ বাহীনিকে রুখে দিতে পারে নাই মনিপুরিরা, কিন্তু বৃটিশরাও সরাসরি শাসন করার মত অবস্থা তৈরি করতে পারে নাই। কারণ, স্বাধীনতাকামী মানুষের সমর্থনে সশস্ত্র আন্দোলন কমবেশি চালু ছিল। আর নিরীহ জনতার প্রতিবাদ বিক্ষোভ তো ছিলই। মনিপুরি রাজারাই বৃটিশ শাসনের অনুগত থেকে শাসন করেছেন এ অঞ্চল। অসম ছাড়া বাদবাকী অঞ্চলে এরকম দেশিয় রাজ্য বা মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ স্বশাসিত অঞ্চলই ছিল।
যেভাবে ইনডিয়ার দখলদারি শুরু
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানি বাহীনি ওই অঞ্চলের সংকীর্ণ পথ দিয়ে বৃটিশ ভারতে আক্রমণ করা চেষ্টা করে। কোহিমা পর্বতমালা ও মণিপুরের ইম্ফলে এসে পৌঁছে তারা। পরে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার পর পিছু হটে। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে সাতকন্যা অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব পরিস্কার হয়ে যায় দুনিয়ার কাছে। ফলে পরবর্তীতে ইনডিয়ার সরকারের কাছেও এই অঞ্চল বিশেষ কৌশলগত ও সামরিক গুরুত্বের দিক থেকে সামনের কাতারে উঠে আসে।
মহাযুদ্ধ শেষে দুর্বল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থার ফলে বাধ্য হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে উপনিবেশ গোটানোর আয়োজন শুরু করে বৃটেন। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বিবেচনা না করেই এখানে কয়েকটা নতুন রাষ্ট্র বসানোর আয়োজন চলে অনেক দূরের কিছু শহরে; লন্ডন-লাহোর-দিল্লি-ইয়াংগুন-বেইজিং এ। নতুন শাসকদের দরকার-দরকষাকষি আর ইচ্ছার সামনে হারিয়ে যায় স্থানীয় মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে কাবো উপত্যাকা হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকা বা অরুণাচলের অঞ্চল ভাগাভাগিতে ব্যস্ত হয় নেহরুর ইনডিয়া, জিন্নার পাকিস্তান, সূচির বার্মা আর মাও-এর চীন। এসব পাহাড় আর উপত্যকায় হাজার বছর ধরে বসবাসরত মানুষদের পরিকল্পিতভাবে পুরা আলোচনা পক্রিয়া থেকে সরিয়ে রাখা হল। বৃটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এই রুটি ভাগাভাগির যে অংশটা ইনডিয়ার পেটে গেল তার-ই আজকের নাম সাতকন্যা রাজ্য (সেভেন সিস্টার স্টেটস), সাতটা প্রশাসনিক রাজ্যে বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় অঞলের মানুষ এখন ইনডিয়ার দখলদারির শিকার।
অসম তো আগেই থেকেই সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। সাতচল্লিশের পর থেকে একের পর এই অঞ্চলগুলাকে নানা উপায়ে অধিকার করে নেয় ইনডিয়া। রাজনৈতিক-আইনি ও সামরিক উপায়ে। যেমন মণিপুর; বৃটিশরা চলে যাবার সময়ই মনিপুরিরা ‘মনিপুর কনস্টিটিউশাল অ্যাক্ট’ গ্রহণ করে সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক (কনস্টিটিউশনাল মোনার্কি) রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু উনিশশ’ উনপঞ্চাশে মনিপুরের রাজাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সব কূটনৈতিক সব রীতিনীতি উপেক্ষা করে স্রেফ গায়ের জোরে মনিপুরের তখনকার রাজাকে বাধ্য করে ইনডিয়ার সাথে একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করতে।
‘আইনি’ দমনাভিযান ও নির্যাতনের অর্ধশতক
আটচল্লিশ সালেরর পর থেকেই ওই অঞ্চলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবিতে আন্দোলনরত মানুষের ওপর নির্বিচার দমন অভিযান ও নির্যাতন চালিয়ে আসছে ইনডিয়া। আর গত অর্ধশতকেরও বেশি সময় জুড়ে-- গত বায়ান্ন বছর ধরে এই দমনাভিযান ও নির্যাতন হচ্ছে আইনি বৈধতার মধ্যে। সশস্ত্র বাহীনির বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা-অপহরণ-গুম-ধর্ষণ-নির্যাতন-উদ্বাস্তুকরণ ও নিবর্তনমূলকভাবে আটক করে স্রেফ ওই আইনটার সুরক্ষায় রেহাই নিচ্ছে ইনডিয়ার সরকারী বাহীনি।
উনিশশ’ আশির দশ অক্টোবর ওই অঞ্চলের একটা মানবাধিকার সংগঠন ইনডিয়ার সুপ্রিম কোর্টে এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে একটা মামলা দায়ের করে। কিন্তু দীর্ঘ সতের বছর ধরে সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টি নিয়ে নিরব থাকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ পরে উনিশশ সাতানব্বই সালে ইনডিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির কঠোর সমালোচনা করলে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আশি সালের মামলাটির রায় দেয়। উল্লেখ্য নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের আওতায় জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলাকে মানবাধিকার পরিষদে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর নিজের রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়।
পরিষদে দাখিল করা ইনডিয়ার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পরিষদ এই পর্যবেক্ষণ দেয় যে, সশস্ত্র বাহীনির বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে ওই সনদের চতুর্থ অনুচ্ছেদের তৃতীয় অংশকে লঙ্ঘন করছে ইনডিয়া-- অর্থাৎ দেশটা জীবনধারণের অধিকার, নির্যাতন থেকে সুরক্ষা পাবার অধিকার, নিবর্তনমূলক আটকাদেশের বিরুদ্ধে অধিকার ও সুষ্ঠু বিচারের অধিকারের মত প্রত্যাখানের অযোগ্য সব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মানবাধিকার পরিষদ একই সাথে সনদের সাথে সশস্ত্র বাহীনির বিশেষ ক্ষমতা আইনটার সামঞ্জস্য পরীক্ষা করতে ইনডিয়ার সুপ্রিমকোর্টকে অনুরোধ করে।
এরপর কোর্ট প্রায় দুইদশক ধরে ঝুলে থাকা আবেদন নিষ্পত্তি করে পরিষদের আহবানে সাড়া দেয়ার ভান করে, কি ওই অনুরোধের বিষয়ে কিছুই করে নাই। রায়ে আদালত কিছু অধিকারের বর্ণনা দেয়, আদালতের মতে যা নাগরিকের থাকা ‘উচিত’, কিন্তু কোন অধিকার বলবৎ করার জন্য কোন ব্যবস্থা সুপারিশ করে নাই আদালত। ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী এতেও খুশি হয় নাই। দুই হাজার এক সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় সরকার তার দমন অভিযান অব্যাহত রাখতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আরও একটা রায় নিয়ে নেয়। যেই রায়ে আদালত সশস্ত্র বাহীনিকে বিশেষ অনুমতি দেয় যে তারা সন্দেহভাজ যে কাউকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।
আদালতের এমন সিদ্ধান্তের পর দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা আন্দোলন আবার চরম মাত্রা পায়। বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী ও বিশেষত সাধারণ ছাত্র জনতা আসাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে--সশস্ত্র বাহীনির বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করার দাবিতে। গণআন্দোলন সামাল দেয়ার চেষ্টায় ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আইনটি ও এর প্রয়োগ ‘পর্যালোচনা’র জন্য একটা পর্ষদ গঠন করে। জীবন রেড্ডির নেতৃত্বে ও পর্ষদ ২০০৫ এর জুনে তাদের পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দেয়। পাঁচ বছর পার হয়ে যাবার পরে এখনও আন্দোলনকারীদের ইনডিয়ার সরকার বলছে যে, সরকার প্রতিবেদনটি বুঝতে ও বিবেচনায় নিতে চেষ্টা করছে।
আইনটা কার্যকর করার বায়ান্নতম বার্ষিকী সামনে রেখে আবারও আন্দোলন তীব্রতর হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে। সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর ইনডিয়ার রাজধানী নয়াদিল্লিতে সাতকন্যা রাজ্যের মানবাধিকারকর্মী ও বিশেষত নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী কয়েকটা সংগঠনের উদ্যোগে আইনটা ‘বাতিল করার দাবিতে’ বিক্ষোভ করেছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের অধিকার কর্মীরা ছাড়াও সেখানে দেশটির বেশ ক’জন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী অংশ নেন। তারা বলেন, দীর্ঘ বায়ান্ন বছর ধরে এই আইনটা কাশ্মিরের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছে ওই অঞ্চলটাকে। পাশাপাশি, মনিপুরের কবি ও অধিকার কর্মী আইরম শর্মিলার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। দানবীয় ওই আইনটা বাতিলের দাবীতে শর্মিলা দীর্ঘ এক দশক ধরে অনশন করে আসছেন। আবার সেই অনশনকে ‘বিচ্ছিন্নতায় উসকানি দেয়া’ সাব্যস্ত করে এই দশককালে তাকে অনেকবার গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছে ইনডিয়ার সরকার।