- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
তথ্য বিকৃতি : দমন পীড়নের সহজ উপায়
ইনডিয়ার সরকার যখন বনবাদাড়ের মানুষ ও মাওবাদীদের দমনে সেনা ও বিমান বাহিনী পাঠানোর কথা ভাবছে তখন শহরে ঘটে চলেছে অদ্ভূত কিছু ঘটনা।
এ বছরের দোসরা জুন ‘কমিটি ফর দ্য প্রটেকশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস’ (সিপিডিআর) মুম্বাইতে একটি জনসভা করে। সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’র সম্পাদকীয় উপদেষ্টা গৌতম নাভলাখা এবং আমি নিজে। সংবাদ মাধ্যমের উপস্থিতি ছিল প্রচুর। সভাটি ছিল দুই থেকে তিন ঘণ্টার। বিজলি এবং ছাপা উভয় গণমাধ্যমেই সভার ভালো গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। তেসরা জুন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল এবং রেডিফ ডটকম এর মত অনলাইন মাধ্যমগুলা আমাদের সভার ওপর সঠিক প্রতিবেদন করে। টাইমস অফ ইনডিয়াতে (মুম্বাই সংস্করণ) এ নিয়া ‘আমাদের এমন একটি চিন্তা দরকার যেটা বামও না ডানও না’ শিরোনামে একটা প্রতিবেদন ছাপায়। একইভাবে দ্য হিন্দু পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘আমরা কি পর্বতে বক্সাইট রেখে আসতে পারি?’ সভাটির রেকর্ডিং ইউটিউবেও ছাড়া হয়।
সভার একদিন পর দ্য প্রেস ট্রাস্ট অফ ইনডিয়া (পিটিআই) আমার সেদিনের বক্তব্য নিয়া সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে একটা লাজলজ্জাহীন মিথ্যা প্রতিবেদন ছাপে। পিটিআই’র ওই প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশ হয় তেসরা জুন ইনডিয়ান এক্সপ্রেস অনলাইনে। শিরোনামে বলা হয় ‘অরুন্ধতী মাওবাদীদের পক্ষে কথা বললেন: তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে ধমক দিলেন’। তাদের প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরলাম; ‘লেখক অরুন্ধতী রায় মাওবাদীদের সশস্ত্র হামলাকে ন্যায়সঙ্গত বলেছেন এবং প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, মাওবাদীদের সমর্থন করার দায়ে পারলে তাকে গ্রেফতার করা হোক।’ ‘নকশাল আন্দোলন সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই না। যদিও আমি সহিংসতা পছন্দ করি না।
একইসাথে আমি সরকারের জঘন্য আচরণেরও বিরোধী।’ “এটা একটা সশস্ত্র আন্দোলনই হওয়া উচিত। গান্ধীর মত করে বিরোধিতা করলে তা শোনার মত যে শ্রোতা দরকার, এখানে তা নাই। জনগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেই আন্দোলনের এই রাস্তা বেছে নিয়েছে।’ ‘নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে মাওবাদীদের ভয়ানক হামলায় ৭৬ সিআরপিএফ এবং পুলিশ কচুকাটা হওয়ার পরও তিনি দান্তেওয়ালার জনগণকে অভিবাদন জানিয়েছেন।’ ‘তিনি দেমাগ দেখিয়ে বলেন, আমি এদের পক্ষে, পারলে আমাকে উঠিয়ে নাও এবং জেলে দাও, তাতে আমি কিছু পরোয়া করি না।’
প্রতিবেদনটির শেষ থেকেই শুরু করি। মাওবাদীদের হাতে ৭৬ জন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) সদস্য নিহত হওয়ার পর দান্তেওয়ালার জনগণকে আমার পক্ষ থেকে অভিবাদন জানানোর কথা আমার বিরুদ্ধে একটা বড় অপবাদ। সিএনএন-আইবিএনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে আমি এ ব্যাপারে আমার অবস্থান পুরাপুরি স্পষ্ট করেছি। বলেছি, সিআরপিএফ সদস্যদের মৃত্যুকে আমি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা হিশাবে দেখছি এবং আমি এও মনে করি যে, গরিব মানুষের বিরুদ্ধে ধনীদের যুদ্ধে সিআরপিএফকে ব্যবহার করা হয়েছে।
মুম্বাইয়ের সেই সভায় আমি বলেছি, গণমাধ্যম যে ধরনের দোষারোপের কারখানা খুলে রেখেছে তা আমার কাছে ঘৃণ্য মনে হয়েছে। একইভাবে যুদ্ধ যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং সহিংসতা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাও গ্রহণযোগ্য না। দুইপক্ষ যেভাবে নৃশংসতা প্রকাশ করছে তাতে নৈতিকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। আমি বলেছি, সাধারণ মানুষ হত্যা আমরা কোনভাবেই সমর্থন করতে পারি না, সেটা মাওবাদীদের দ্বারাই হোক কিংবা সরকারি বাহিনীর দ্বারা হোক। সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন, একে-৪৭, ৩৮ আইএনএসএএস, ৭ এসএলআরস, ৬ লিগ এইচটি মেশিনগানস, একটি স্টেনগান এবং দুই ইঞ্চি মর্টার দিয়ে উপজাতীয় অঞ্চলগুলাতে সিআরপিএফ কি করছে? সিআরপিএফ সদস্যরা নিয়মিত যদি সেখানে যুদ্ধেই থাকে, মাওবাদীরাও তো তাহলে তাই (যুদ্ধ) করছে। এ ক্ষেত্রে সিআরপিএফ সদস্যদের হত্যার একতরফা নিন্দা জানানোর মানে হচ্ছে এ যুদ্ধে সরকারের পক্ষ নেয়া। অথচ আমরা তো এ যুদ্ধই সমর্থন করি না। পিটিআইয়ের প্রতিবেদনের বাকী অংশও--আমি সভায় যা বলেছিলাম-- তা বিকৃত করে বিদ্বেষপূর্ণভাবে হীনস্বার্থে তুলে ধরা হয়েছে।
মাওবাদীদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার। তাদের ব্যাপারে ইতিপূর্বে আমি অনেক লিখেছি। সভায় আমি বলেছিলাম, জমি জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যের কমবেশি তফাত থাকার পরও আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যবদ্ধ সম্পর্ক তৈরি করেছে। যাদের মধ্যে মাওবাদীরা সবচেয়ে যুদ্ধমুখী অবস্থান নিয়েছে। অথচ সরকার সামরিক অভিযানের মাধ্যমে দমন পীড়ন চালানোর জন্য জনগণের সবার আন্দোলনকেই মাওবাদী আন্দোলন এবং প্রত্যেককেই মাওবাদী হিশাবে প্রচার করছে। নিরীহ জনগণকে মাওবাদী মুখোশ লাগিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
সভায় আমি এ দিকটা জোর দিয়েই বলেছিলাম, যারা সরকারের বিরোধিতা করছে এবং ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে তাদের প্রত্যেককে একই মুখোশ লাগিয়ে দেয়ার জন্য সরকার আদতে ‘মাওবাদী’ শব্দটির অর্থই টেনে লম্বা করছে। কলিঙ্গনগর এবং জগতসিংপুরের জনগণের প্রতি উদ্দেশ্য করে আমি বলেছিলাম, তারা দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে অথচ সর্বক্ষণ তাদের আইনশৃংখলা বাহিনীর অবরোধের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। শতশত সশস্ত্র পুলিশ তাদের ঘিরে রেখেছে ফলে আন্দোলন করতে গেলে তারা পুলিশী হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
আমি বলেছিলাম, স্থানীয় জনগণ তাদের প্রতিরোধ আন্দোলনে কোন কৌশল গ্রহণ করবে এটা দীর্ঘদিন ধরে চিন্তাভাবনা ও চেষ্টা করেই আজকের এ অবস্থানে এসেছে। গভীর বনবাদাড়ে বসবাসকারী সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত এ মানুষগুলার পক্ষে গান্ধীর মত অহিংস আন্দোলন করা সম্ভব না। কারণ সত্যাগ্রহ হচ্ছে এমন এক শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন যেটা কার্যকর করতে হলে এর প্রতি সমবেদনশীল শ্রোতা জরুরি। কিন্তু এখানে সেটা নাই। আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম, যেসব জনগণ খেতে না পেয়ে ২৪ ঘণ্টাই ক্ষুধার্ত থাকে তারা কিভাবে অনশন ধর্মঘট করবে? আমি নিশ্চিত, কখনো এমন কথা বলি নাই-- ‘এটা একটা সশস্ত্র আন্দোলন হওয়া উচিত’ (আমি নিশ্চিত না এর দ্বারা ওই গণমাধ্যমটি কি বুঝাতে চাইছে।)
আমি আগে থেকেই বলে এসেছি, আজকের সব ধরনের আন্দোলনকে আলাদা না ভেবে আমাদের বুঝতে হবে, এরা সবাই একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সুতরাং তারা সবাই একই পক্ষের। আর আমি তাদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এ পক্ষে দাঁড়িয়ে শুধু সরকারকে না, আমাদের নিজেদেরও কিছু প্রশ্ন করতে হবে। আমার সঠিক বক্তব্যের এই অংশটি তুলে ধরলাম:
‘আমি মনে করি, আমাদের এই প্রতিরোধ আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন থাকতে পারে। এ ব্যাপারে আমার অবস্থান পরিস্কার। আমি নির্যাতিতদের পক্ষের। এ কারণে পারলে আমাকে উঠিয়ে নিন, জেলে দিন। আমি এসবের পরোয়া করি না। এই পক্ষে আমি সবসময় আছি এবং আমরাই সফল হব।’ এরপর আমি বললাম, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের একটা মৌলিক ও বৈপ্লবিক উন্নয়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পথ অনুসরণ করে তারা সফলতা পায় নাই। সেখানে মাওবাদীদের প্রতিরোধের নিজস্ব তরিকাই সফল হয়েছে। আমি অবাক হই, সেখানে কি করে তারা এ পদ্ধতিতে উন্নয়নের আশা করে?
কিন্তু পিটিআইয়ের প্রতিবেদনটা ছিল নিজেদের বানানো এবং আমার বিরুদ্ধে পরিস্কার মিথ্যাচার। অদ্ভূত ব্যাপার হল, একদিনের পুরানা এই প্রতিবেদনই কয়েকটি পত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ছেপেছে আর কয়েকটি চ্যানেল সম্প্রচার করে ৪ জুন। এখানে সবচেয়ে অবাক হওয়ার মত বিষয় হচ্ছে, পত্রিকাটি এবং চ্যানেলগুলার নিজস্ব প্রতিবেদকরাই এর আগের দিন আমাদের সভার ওপর যথাযথ প্রতিবেদন করেছিল। নতুন এ প্রতিবেদনটি যে মনগড়া এবং মিথ্যাচার এটা তো এরা জানত। দ্য ইকোনমিক টাইমস লিখেছে, প্রচারে আগ্রহী অরুন্ধতী রায় এখন অং সান সুচি হতে চাচ্ছে। আমি জানতে চাচ্ছি, কেন পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলগুলো একই খবর দুইবার প্রচার করেছে। একবার সঠিক খবর, আরেকবার ডাহা মিথ্যা।
সেদিন অর্থাৎ ৪ জুন সন্ধ্যায়, প্রায় ৭ টার দিকে দুই জন মটরসাইকেল আরোহী দিল্লীতে আমার বাসার সামনে আসল, এসেই তারা আমার বাড়ির জানালা লক্ষ্য করে ইট পাথর ছুঁড়তে লাগল। পাশেই বাচ্চারা রাস্তায় খেলছিল, একটি বাচ্চার গায়ে পাথর প্রায় লেগেই গিয়েছিল। পরে ক্ষুদ্ধ জনতা এসে ধাওয়া করলে এরা পালিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই টাটা ইনডিকায় চড়ে এক লোক আসল। সে জিটিভির একজন প্রতিবেদক। জানতে চাইল, এটা কি অরুন্ধতী রায়ের বাসা? এখানে সমস্যা কি হয়েছিল? আমার তখন বুঝতে বাকী রইল না, আসলে এখানে একটা নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছে আমাদের ক্ষুধা কাতর টিভি চ্যানেলগুলার জন্য।
আমার সৌভাগ্য, সেদিন তাদের সাজানো প্রতিবেদনটিতে কিছুটা ভুল ছিল। কিন্তু আমার জন্য আরো অনেক কিছু অপেক্ষা করছিল। পাঁচই জুন রায়পুরের দৈনিক ভাস্কর সংবাদ প্রতিবেদন ছাপল, ‘যদি সাহস থাকে তাহলে এসি কামরা ছেড়ে জঙ্গলে আসুন অরুন্ধতী’। ওই প্রতিবেদনে ছত্তিশগড় পুলিশের মহাপরিচালক বিশ্বরঞ্জন আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, যদি সাহস থাকে তাহলে আমি যেন মাওবাদীদের সাথে যোগ দিয়ে বনবাদাড়ে এসে পুলিশের মোকাবেলা করি। একবার ভাবুন, পুলিশের মহাপরিচালক (ডিজিপি) এবং আমি মুখোমুখী, ম্যান টু ম্যান। অবশ্য তার চেয়েও আরো বড় হুমকি এসেছে। ছত্তিশগড়ের ভারতীয় জনতা পার্টির একজন নেতা মিস পুনম চতুর্বেদি গণমাধ্যমে ঘোষণা দিলেন, প্রকাশ্য রাস্তার মোড়ে আমাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। এবং আমার মত অন্যান্য যেসব চক্রান্তকারী রয়েছে তাদেরও মৃত্যুদ- দেয়া হবে। (আশা করি কেউ একজন তাকে বলবে যে, সহিংসতা ছড়াতে পারে এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য ইনডিয়ান পেনাল কোডে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।)
সালওয়া জুদুম এর প্রধান মাহেন্দ্র কর্মা যে হত্যা-ধর্ষণ সহ অসংখ্য অপরাধে অপরাধী, সে বলেছে আমার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। মঙ্গলবার, ৮ জুন হিন্দি দৈনিক নয়া দুনিয়া প্রতিবেদন করেছে, ছত্তিশগড়ের দুটি পুলিশ কেন্দ্র--ভাটা পদা এবং টেলি বান্দায় আমার বিরুদ্ধে আলাদা দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মাওবাদীদের প্রতি আমার প্রকাশ্য সমর্থনের অভিযোগ করে দুইজন ব্যক্তি এ দুটি অভিযোগ দায়ের করে।
এটাই কি সেনা গোয়েন্দাদের সেই মনস্তাত্ত্বিক অভিযান (সাইকোলজিক্যাল অপারেশন)? নাকি এটা সবুজ শিকার অভিযানের (অপারেশন গ্রিন হান্ট) শহুরে অবতার? যার মাধ্যমে একটি সরকারি সংবাদ সংস্থা কল্পিত ও মনগড়া তথ্য প্রমাণ আবিষ্কার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সাহায্য করে সরকার বিরোধীদের দমন পীড়নে। না কি পিটিআই চেষ্টা করছে সহিংসতা উস্কে দিয়ে আমাদের মত অধিক পরিচিতদের উগ্র দুষ্কৃতিদের হাতে ছেড়ে দিতে, যাতে আমাদের জেলে নেয়া বা সরিয়ে দেয়ার ঝুঁকি সরকারকে না নিতে হয়। এতে করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের সুনাম নষ্ট হবে না। নাকি এটা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চিরাচরিত হাস্যকর সেই মেরুকরণ- যদি তুমি আমাদের সাথে না থাকো তাহলে তুমি একজন মাওবাদী। শুধু মাওবাদীই না একজন মূর্খ, উদ্ধত এবং উচ্চাভিলাষী মাওবাদী। যাই হোক, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং লজ্জাকর একটা বিষয়। কিন্তু এটা নতুন না। এ ব্যাপারে একজন কাশ্মিরী বা একজন তরুণ মুসলিমকে জিজ্ঞেস করুন, যাকে সন্ত্রাসী চিহ্নিত করে ধরা হয়েছে কোন প্রমাণ ছাড়া, শুধুমাত্র প্রচার মাধ্যমগুলার ভিত্তিহীন প্রতিবেদনে। মোহাম্মদ আফজালকে জিজ্ঞেস করুন, যাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে সমাজের সামষ্টিক ফ্যাসিবাদী চেতনাকে খুশি করার জন্য।
এখন অপারেশন গ্রিন হান্ট আমার মত ব্যক্তিদের দরজায় করাঘাত করতে শুরু করেছে। একবার ভাবুন, আমার মত পরিচিত একজনের সাথে যদি এমন আচরণ করা হয় তাহলে অপরিচিত ভিন্ন আন্দোলনের বা রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে কি আচারণ করা হতে পারে? এ ধরনের শতশত কর্মী রয়েছে যাদের জেলে ঢুকানো হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে এবং অনেককে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে শুধু সেন্সরশিপই সমস্যা না, বিকৃত ও মনগড়া খবর তৈরিও এর চেয়ে বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডন পত্রিকা থেকে তরজমা করেছেন শরীফ হোসেন