দুর্যোগের মাঝেও ত্রাণ নিয়ে নানা শর্ত আরোপ

স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান। মাত্র বছরখানেকও হয়নি যেখানে নিজদেশের সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে বসতবাড়ি ছাড়া হয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ। সেই এলাকায় এবার নেমে এসেছে আরেক দুর্ভোগ। সেই দুর্বিসহ অসহায়ত্বের মধ্যেই বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রচার মাধ্যম থেকে ক্রমাগত আশঙ্কা ছড়ানো শুরু হয়। বলা হয় এই বন্যার ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে আসলে তালেবানরা। তাদের হাতে ত্রাণের অর্থ ও নানা প্রকারের সাহায্য চলে যাচ্ছে বলে জোর প্রচার চালানো হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে আরেকটা রাজনৈতিক আঘাত। পাকিস্তানের সরকারি পর্যায়ে বেশ কয়েকবার এই দিকটাকে আশ্বস্ত করতে হয়েছে। তবুও অনেক ধীর গতি এবং এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অপ্রতুল সাহায্য ও ত্রাণ সরবরাহের পিছনে এটাই অন্যতম প্রধান কারণ। সর্বকালের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে থেকেও পাকিস্তানের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে শর্তপূরণ আর আশঙ্কা দূর করার পূর্বাপর প্রতিশ্রুতি দিতে দিতে। চিন্তা প্রতিবেদন

গেল মাসের ছাব্বিশ জুলাই শুরু হওয়া পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত সরকারি হিশাবে কমপক্ষে ষোল শত লোক মারা গেছে। ব্যাপক মৌসুমি বৃষ্টির প্রভাবে সৃষ্ট এ বন্যা পাকিস্তানের উত্তরে সোয়াত উপত্যকা ও উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ পর্যন্ত বহমান সিন্ধু নদের দুপাশের অববাহিকা এলাকাকে প্লাবিত করেছে। সোয়াত উপত্যকা, খাইবার, পাখতুন, পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানের বেশিরভাগ এলাকা এ দুর্যোগের শিকার। প্লাবিত এলাকা, বন্যা প্রবাহের স্থায়ীত্ব ও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে গত আশি বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র এ বন্যায় আক্রান্ত অঞ্চলগুলার সাত লাখ বাইশ হাজারের মত ঘরবাড়ি পুরাপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতিসংঘ বলছে, এক লাখ ষাট হাজার বর্গ কিলোমিটারের ভিতরে দুই কোটিরও বেশি লোক বন্যার ফলে দুর্ভোগে পড়েছে। দুই হাজার পাঁচ সালের কাশ্মিরের ভূমিকম্প, চার সালে ইনডিয়ান মহাসাগরে সুনামি বা এ বছরের হাইতিতে যে ভূমিকম্প হয়েছে, পাকিস্তানের এ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি তারচেয়েও অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। জাতিসংঘের তরফ থেকে জানানো হয়, গোটা পাকিস্তানের পাঁচ শতাংশ এলাকা এখন বন্যা আক্রান্ত। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন যে এটা হল তার জীবনের দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি।

মৌসুমি বৃষ্টির ফলে বন্যা?

পাকিস্তানি আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে মৌসুমী বৃষ্টির কারণে এ বন্যার সূত্রপাত। পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, চব্বিশ জুলাই থেকে পরের ছত্রিশ ঘণ্টায় তিনশ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি পড়েছে। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে পাকিস্তানের স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক বেশ কিছু সংস্থা ও গোষ্ঠী দাবি করছে, দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হারপ (Haarp) প্রযুক্তি ব্যবহারের করে এ বন্যা সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হারপের পুরো নাম হল হাই ফ্রিকোয়েন্সি একটিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর আর্থিক সহায়তায় আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিরক্ষা উন্নয়ন গবেষণা কর্মসূচী সংস্থা (ডিআরপিএ) হারপ গবেষণা চালাচ্ছে উনিশশ’ তিরানব্বই সাল থেকে। এ কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য হল আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে রেডিও সংকেতের মাধ্যমে আয়নমণ্ডলের সৌর বিদ্যুতের উপর প্রভাব তৈরি করা। এভাবে আবহাওয়া পরিবর্তন করে বন্যা, সুনামি ও ভূমিকম্প সৃষ্টি করে কোন অঞ্চলকে ধ্বংস করা যায়। হারপের মাধ্যমে বন্যা সৃষ্টি করা হয়েছে এই মতের সমর্থকরা বলছেন, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল যেহেতু তালেবান ও আল কায়েদার নিয়ন্ত্রণে সেহেতু হারপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার মাধ্যমে এ অঞ্চলে পুরাদস্তুর বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর সেখানে মানবিক সাহায্য পাঠিয়ে সাধারণ লোকদের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করে তালেবানদের হামলা করার সহজ কৌশল বেছে নিবে। তবে এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করে জানা যায়নি।

কয়েক লাখ লোক এখন উদ্বাস্তু

পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যায় উদ্বাস্ত হয়েছে পাঁচ লাখেরও বেশি লোক। বন্যায় ঘর-বাড়ি সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এদের। পাখতুন প্রদেশের তথ্যমন্ত্রী ইফতেখার হুসেন সংবাদমাধ্যম কে জানিয়েছেন, তালেবানদের সাথে আমেরিকা এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধে এ অঞ্চলের প্রায় সব অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাকি যা ছিল বন্যা এসে তাও ধ্বংস করেছে। উনিশশ’ তিয়াত্তর সাল থেকে শুরু করে পাকিস্তানে বন্যায় সাত হাজার পাঁচশ তেয়াত্তুর জন লোক মারা গেছে। ডুবে গেছে প্রায় নিরানব্বই হাজারের মত গ্রাম। এ বন্যা শুরুর পর পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী জানান, ত্রাণ বিতরণ এবং উদ্ধার তৎপরতার পর নতুন করে পুনর্বাসন করতে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার দরকার পড়বে। গত চৌদ্দ বছর যাবত সিন্ধু বাঁধ পর্যাপ্ত পানি ধারণ করতে পারে নাই। ভাটার সময়ে ইঁদুর এবং অন্যান্য প্রাণী গর্ত খুড়ে বাঁধটাকে দুর্বল করেছে। এসব কারণে তিয়াত্তর সাল থেকে বারটার মত বড় বন্যার সৃষ্টি হলেও পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে কখনো সতর্ক হয় নাই। পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণে যে সকল প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেগুলাতে সমন্বয়ের অভাব আছে। সাতই আগস্ট সিন্ধু নদীর তীরে শুকরু জেলায় পঞ্চাশ হাজার থেকে ষাট হাজার কিউসেক পানি উপচে পড়েছে। শুকরু, লারকানা, নওয়াবশাহ, হায়দারাবাদ এবং নওশেরাহ ফিরোজ জেলাগুলা প্রধানত নিচু সমভূমির। তাই স্বভাবতই এগুলো বন্যায় ডুবে যাওয়ার কথা। বন্যা শুরু হলে সিন্ধু নদী থেকে কাসমা অঞ্চলে সাত লাখ অষ্টআশি হাজার কিউসেক পানি উপচে পড়েছে। তানসা জেলায় উপচে পড়েছে প্রায় নয় লাখ কিউসেক পানি। অথচ পাকিস্তান সরকারের এ ব্যাপারে আগে-পরে খুব কমই সতর্ক হতে দেখা গেছে। বড় বন্যা হলে বাঁধগুলোর সে বন্যা ঠেকানোর কতটুকু সামর্থ্য আছে, তা নিয়ে এর আগে পাকিস্তান সরকারের কোন ভূমিকা নাই। বিশেষজ্ঞরা জানান এই ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতির জন্য পাকিস্তান সরকারের অবহেলাই দায়ী। জাতিসংঘ বলেছে বন্যার এই ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে কমপক্ষে দুইশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ত্রাণ দরকার পড়বে।

বন্যা কবলিত দেশের রাষ্ট্রপতির বিদেশ সফর

পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি ইওরোপ সফরে পাঁচই আগস্ট ব্রিটেনে ওই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে জুলাইয়ে ইনডিয়া সফরে ক্যামেরন পাকিস্তানকে সন্ত্রাস রফতানিকারক দেশ হিশাবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন পাকিস্তান দুই কূল রক্ষার খেলা খেলছে। অর্থাৎ একদিকে সন্ত্রাসের মদদ দিচ্ছে, অন্যদিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের অগ্রসেনা বলে দাবি করছে নিজেকে। কাজেই পাকিস্তানের এই খেল বন্ধ করতে হবে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তাকে কোন পাত্তা দেয় নাই তা বলার দরকার পড়ে না। জারদারি যখন ইওরোপ সফর করছেন, তখন পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় প্রায় হাজার দেড়েক লোক মারা গেছে। জারদারি ইওরোপ সফর শুরু করেন ফ্রান্স দিয়ে। তিনি ফরাসি রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজির সাথে সাক্ষাৎ করেন। সারকোজির সাথে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে কথা বলেন। জারদারি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে তার দেশের ভূমিকার কথা বলেন সরাকোজিকে। গেলো বছর মে মাসে জারদারির ফ্রান্স সফরকালে সারকোজি বারো মিলিয়ন ইউরো সহযোগিতার কথা ঘোষণা করে ছিলেন। সোয়াত উপত্যকায় তালেবান ও আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় বাস্তুচ্যুত হওয়া লোকদের পুর্নবাসনে এই অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা। পাকিস্তান বংশোদ্ভূত কয়েক ব্রিটিশ রাজনীতিবীদের সাথে জারদারির সাক্ষাত করার কথা ছিল। কিন্তু তারা জারদারির সাথে তাদের সাক্ষাতের বিষয়টি প্রত্যাখান করেন। বিশ্লেষকরা বলেন, জারদারির সফর পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতারা বললেন দেশের এই সংকটে বর্তমান সরকার কোন ভূমিকা রাখতে পারে নাই। সাবেক ক্রিকেট তারকা ও বর্তমানে বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতা ইমরান খান আইটিভির এক সাক্ষাতকারে বলেন, জারদারির উচিত সবকিছু বন্ধ করে এ দুর্যোগে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ব্রিটেনেও দেশের অর্থ অপচয়ের জন্য জারদারিকে দায়ি করে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে প্রবাসী পাকিস্তানীরা।

বন্যা ও ত্রাণ থেকে তালেবানরা সুবিধা নেবে; যুক্তরাষ্ট্রের দাবি

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বিল বারটন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদ্বিগ্ন যে তালেবান-আল কায়েদারা বন্যা পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। তারা পাকিস্তানিদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা বাধাগ্রস্তও করতে পারে। পাকিস্তানিরা ইতোমধ্যে বন্যায় প্রচুর লোক হারিয়েছে। দেশের বড় একটা অংশ বন্যার পানিতে ডুবে আছে। যদি তালেবানরা তৎপরতা শুরু করে দেয়, তবে পাকিস্তানিরা এ বিপর্যয় থেকে সহজে মুক্তি পাবে না। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পূরণ হতে অনেকটা দেরি হবে। অর্থাৎ বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের জায়গা থেকে পাকিস্তান সরকার আমাদের সাথে একই রাস্তায় হাটছে, তাই আমরা মনে করি পাকিস্তান সরকার এটা হতে দেবে না। আমরা আসলে তাদের ব্যাপারেই উদ্বিগ্ন যারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায় এবং লোকজনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে নাজেহাল করতে চায়। সুতারাং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যেমনি আমরা উদ্ধিগ্ন, ওইসব সশস্ত্র বিদ্রোহীদের ব্যাপারেও আমরা একইরকম চিন্তিত। হোয়াইট হাউজ পুরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। মুখপাত্র জানান, পাকিস্তান সরকারের এ ব্যাপারের যে কোন অনুরোধে তারা সাড়া দিতে প্রস্তুত।

বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার ঋণ সহায়তা

ইউনিসেফ প্রতিনিধি ড্যানিয়েল টলি’র মতে পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে কঠিন জরুরি অবস্থা চলছে পাকিস্তানে। এর চেয়ে তীব্র জরুরি অবস্থা আর হতে পারে না। প্রায় ষাট লাখ লোককে ত্রাণের আওতায় আনতে হবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী দশ লাখের কম লোকের মধ্যে খাবার বিতরণ করতে পেরেছে। কেবল চুরানব্বই হাজার লোককে তাবুর নিচে আশ্রয় নিতে পেরেছে। এখনও আরও প্রায় অর্ধ কোটি লোকের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রিজগুলো সব বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পাহাড় ধ্বসে রাস্তার চিহ্ন পর্যন্ত মুছে গেছে, অধিকাংশ হাইওয়ে এখন শুধু উঁচু উঁচু মাটির স্তুপ হয়ে আছে। দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ পৌছানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া দুইশ ষোল কোটি ডলার সাহায্য দেয়ার ওয়াদা দিয়েছে। জাপান এবং তুরস্ক দুই দেশই একশ কোটি ডলার করে সাহায্য দেয়ার ওয়াদা করেছে। সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে তার দেশ দুইশ কোটি ডলার মূল্যের সাহায্য পাঠিয়েছে পাকিস্তানের বন্যা দুর্গতদের জন্য।


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 5488 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD