ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)
আবাসন ব্যবসায়ীরা কি ঢাকাকে বসবাসযোগ্য নগর থাকতে দিবে?
রাজধানীতে অধিবাসীর সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে। এই বাড়ন্ত অধিবাসী ও নগর অবকাঠামোর হিসাব মাথায় রেখেই ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছিল দুই হাজার চার সালে। দীর্ঘ ছয় বছর পর চূড়ান্তভাবে ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার, গত বাইশে জুন। পরিকল্পনাটার উদ্দেশ্য, ঢাকাকে একটা পরিকল্পিত বাসযোগ্য নগর হিশাবে গড়ে তোলা। আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা, বাণিজ্য এলাকা, রাস্তাঘাট, কৃষি জমি, বন্যা প্রবাহ এলাকা, খোলা জায়গা, বিনোদন পার্ক, খেলার মাঠ, জলাধার, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ইত্যাদি আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে পরিকল্পনাটিতে।
নগর বন্যামুক্ত রাখা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা সুবিধার জন্য ড্যাপে সুপারিশ করা হয়েছে একুশ শতাংশ জমি জলাধার হিশাবে রাখার। কিন্তু পরিকল্পনাটি নেয়ার পরও আবাসন ব্যবসায়ীরা এসব এলাকা ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে ও প্লট বানিয়ে বিক্রি করেছে। রাজউকের তখন এসব কাজে বাধা দেয় নাই, তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই রাজউকের আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছিল। তাছাড়া রাজউক নিজেই এমন অনেক জমি বেআইনিভাবে ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে। এখন সরকার এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে বেআইনিভাবে ও জোর করে দখল করা জমি রক্ষা করতে আবাসন ব্যবসায়ীরা ড্যাপের বিরুদ্ধে চরম অবস্থান নিয়েছে।
সময় ক্রম
১৯৯৩-১৯৯৫: এই সময়ের মধ্যে ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) নেয়া হয়। এ পরিকল্পনায় নগরায়নের কাঠামো ও পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। পরিকল্পনাটি নেয়া হয়েছিল জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি) এবং ইউএন-হ্যাবিট্যাটের আর্থিক সহায়তায়। ইউএন-হ্যাবিট্যাটের পুরা নাম হল জাতিসংঘ মানব আবাসন সংস্থান কর্মসূচি। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলার বিভিন্ন নগরকে সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে মজবুত করে গড়ে তোলা। ডিএমডিপিতে তিন ধাপ পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। প্রথম দুইটা হল অবকাঠামো পরিকল্পনা ও নগর এলাকা পরিকল্পনা। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা হল ডিএমডিপি’র সর্বশেষ ধাপ। ১৯৯৫ সালে ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা(ডিএমডিপি) চূড়ান্ত হয়।
১৯৯৭: এ বছর প্রজ্ঞাপন আকারে ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) প্রকাশ করা হয়। ৫৯০ বর্গ মাইলের নগরকে ছাব্বিশটা অঞ্চলে ভাগ করে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়। ডিএমডিপি’র প্রথম ধাপ দুইটা ছিল পরীক্ষামূলক।
২০০৪-২০০৮: দুই হাজার সালে ডিএমডিপির তৃতীয় ধাপ হিসাবে ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কাজ শুরু করা হয়। এতে জমি ব্যবহারের মূল পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। রাজউকের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করতে অস্বাভাবিকভাবে বেশি সময় লেগেছে। যার পরিমাণ হল পুরা চার বছর। যেসব জমি ড্যাপে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেসব জলাশয় ও খোলা জায়গার প্রায় পুরাটাই আবাসন ব্যবসায়ীরা জবরদখল করেছে এই চার বছরে--অনেক ক্ষেত্রে রাজউকের অনুমতি ছিল। দুই হাজার আট সালে ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়।
২০১০: আবাসন ব্যবসায়ীদের বড় একটা অংশ সরকারের ভেতরে থাকায় নিজেদের ভাগে তালগাছটা রেখেই দুই হাজার আটের ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ফলে নগর পরিকল্পনার চেয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের জমি জবর দখলে সুবিধা দেয়ার প্রতি বেশি নজর ছিল। কাজেই নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশ কর্মীর এর পরিকল্পনাটি পর্যালোচনার দাবি করেন। দুই হাজার নয় সালে সরকার একটি পর্যালোচনা পরিষদ গঠন করে। কমিটি ড্যাপের দুর্বলতাগুলা চিহ্নিত করে। এবং সংশোধনের লক্ষ্যে একটা সুপারিশমালা ছাব্বিশ মার্চ রাজউকের কাছে জমা দেয়। সংশোধন শেষে সরকার চূড়ান্ত পরিকল্পনাটির প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বছরের বাইশে জুন।
ছয় বছরের সরকারি অবহেলায় পরিকল্পনা এমনিতেই ‘অনুপযোগী’ হওয়ার পথে
ড্যাপ দুই হাজার আট সালের দিকে চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও সরকার সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ হিসাবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জনবল সংকটের কথা বলা হয়। কিন্তু পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ড্যাপ চূড়ান্ত না করতেই রাজউক গড়িমসি করেছে, কাজে বেশি সময় লাগিয়েছে। সবমিলিয়ে রাজউকের প্রতি অবহেলার অভিযোগ তাদের। বিআইপি’র চেয়ারম্যান ড. সরওয়ার জাহান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘কয়েক দফা জরিপ করতে অনেক সময় লেগেছে। তাছাড়া রাজউকের জনবল সংকটও রয়েছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর সবচেয়ে বড় কাজ হল বাস্তবায়ন করা’।
রাজউকের ভূমিকার বাইরে সরকারের অন্যান্য অংশের অবস্থানও পরিকল্পানটিকে অনুপযোগী করে তুলছে, ক্রমশ দেরি করানোর মাধ্যমে। রাজউকের কাজ হচ্ছে পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ করা। সে অনুসারে অনেক দেরি করে হলেও রাজউক তার কাজ শেষ করেছে। রাজউকের অভিযোগ; তারা পরিকল্পনা তৈরির সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলার সহযোগিতা পায় নাই। আর এখন ড্যাপ বাস্তবায়নে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তারা তাও নিশ্চিত না। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন, ভূমি, শিল্প ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমন্বয় ছাড়া ড্যাপের বাস্তবায়ন সম্ভব না।
কিন্তু পরিকল্পনা তৈরিতে রাজউকের কচ্ছপ গতির ফলে এখন বাস্তবায়ন করতে চাইলে আরও পাঁচ বছর লেগে যাবে। অথচ পরিকল্পনাটি নেয়া হয়েছে দুই হাজার পনের সাল পর্যন্ত সম্ভাব্য ভবিষ্যত অবস্থা ভিত্তি করে। সে পর্যন্ত ঢাকায় যে পরিমাণ জনসংখ্যা হবে, স্থাপনার দরকার হবে--সেটা ধার্য করেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই দুই হাজার দশ সালে এখনো নিশ্চিত না যে, কবে পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন শুরু হবে। (আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার এখন বলছে, প্রজ্ঞাপন জারি হলে কি হয়েছে, দরকার হলে আবার সংশোধন করা হবে)। ফলে দুই হাজার পনের সালের জন্য নেয়া পরিকল্পনা যদি চার বছর আগেও বাস্তবায়ন শুরু হয়, তবে সেটা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই ‘অনুপযোগী’ প্রকল্পে পরিণত হবে।
সংশোধন: যেকারণে, যেভাবে
ছয় সদস্যের পর্যালোচনা পরিষদ সভাপতি ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী। ‘চিন্তা’র সাথে আলাপে পরিষদের সদস্য ড. সরওয়ার জাহান বলেন, ‘ভুলে ভরা একটা ড্যাপ যখন তৈরি হল তখন আমরা সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করি।’ ড. জাহান নিজে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানারের চেয়্যারম্যান। তিনি বলেন, ‘এই যখন অবস্থা, ভুলে ভরা একটা ড্যাপ যখন তৈরি হল তখন আমরা সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করি। আমরা নিজেদের পয়সা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, সভা-সেমিনার করে ড্যাপের ভেতরে আবাসন ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও ভুলগুলোর ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করেছি।’ নিবিড় পর্যালোচনা শেষে পরিষদ ষোলটি আবাসন প্রকল্প, স্থাপনা ও দুই হাজার সাতশ চব্বিশটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে ড্যাপের অসংগতি চিহ্নিত করে।
কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে। তাই পরিষদ এগুলা অন্যস্থানে সরানোর সুপারিশ করেছে। ষোলটা আবাসন প্রকল্পের দশটা বেসরকারি ও ছয়টা সরকারি। পরিষদ যে প্রকল্পগুলা সরিয়ে নিতে সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে সরকারি প্রকল্প পানাগাও কনটেইনার পোর্ট, বিসিক শিল্প নগরী, সাভারের বালিয়াপুর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও কেরানিগঞ্জে প্রস্তাবিত কারাগার প্রকল্প অন্যতম। তবে সেনাবাহিনীর চৌদ্দ স্বতন্ত্র প্রকৌশলী ব্রিগেডের যে প্রশিক্ষণ এলাকাটি কেরানীগঞ্জে প্রস্তাবিত ছিল, সেটা এই সরিয়ে নেয়ার সুুপারিশের মধ্যে রাখে নাই পরিষদ। কারণ হিশাবে তারা দেখিয়েছে যে, প্রশিক্ষণ এলাকার জন্য জমি অধিগ্রহণে রাজউক অনাপত্তি দিয়েছিল। অথচ একই ধরনের অনাপত্তি অনেক আবাসন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকেও দিয়েছিল রাজউক, যেসব প্রকল্প এখনকার সুপারিশে উচ্ছেদ করার কথা বলা হয়েছে।
তাছাড়া ইতিমধ্যে যেসব প্রকল্প সরকারি অনুমোদন ছাড়া গড়ে উঠেছে; বিলামালিয়ায় মধুমতি মডেল টাউন, ইস্টার্ন মায়াকানন, দক্ষিণ রামচন্দ্রপুরের অ্যাডভান্সড অ্যাঞ্জেল সিটি, আশুলিয়া মডেল টাউন, কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ আবাসিক প্রকল্প, গাজীপুরের প্রবাসী পল্লী আবাসিক প্রকল্প, টঙ্গী পৌর এলাকার প্রত্যাশা আবাসিক প্রকল্প, উত্তরখানের শতাব্দী হাউজিং, সাভারের উত্তর কাউন্দিয়া মৌজার প্রস্তাবিত আদর্শ শিক্ষক আবাসিক প্রকল্প, সাভারের রামচন্দ্রপুরের ঢাকা উদ্যান ও অন্যান্য আবাসিক প্রকল্প--এগুলাকে অনুমোদন না দেয়ার কথা বলা হয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কমিটির সুপারিশ হল, ড্যাপের বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, নগর পরিকল্পনায় তা কোন প্রকারেই স্থান দেয়া যাবে না। শিল্পগুলো শ্রেণী অনুসারে অনুমোদিত শিল্প এলাকায় সরিয়ে নিতে হবে।
সুপারিশ শুধু ‘বন্যা প্রবাহ অঞ্চলে’ সীমাবদ্ধ
আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা দুই হাজার আটের ড্যাপে খুব বেশি সংশোধন আনে নাই পর্যালোচনা পরিষদ। শুধু ‘বন্যা প্রবাহ অঞ্চল’ বাড়ানো হয়েছে। যা সরাসরি আবাসন ব্যবসায়ীর অবৈধ ভরাটের বিরুদ্ধে গেছে। যার ফলে ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে বিরোধিতা এ পর্যন্ত গেছে যে, সরকারি সভায় তারা গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নানকে নাজেহাল করেছে। সেই সূত্র ধরে ড্যাপের বিষয়টা দেশের জনপরিসরে ও সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে।
কিন্তু এই বন্যা প্রবাহ অঞ্চল বাড়ানোর বাইরে খুব বেশি সংশোধন করে নাই পর্যালোচনা পরিষদ। জলাজমি, কৃষিজমি ও খোলা জায়গা নির্দিষ্ট করা এবং নগরে জনসংখ্যার বিন্যাস সহ অনেক দিক সংশোধন করে পরিকল্পনায় যোগ করা হয় নাই। এ বিষয়ে নগর অধ্যয়ন কেন্দ্রে’র (সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ-সিইউএস) সাধারণ সম্পাদক ড. নুরুল ইসলাম নাজেমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার ম্যাপে অনেক সমস্যা আছে। এ অঞ্চলে কি পরিমাণ লোক ধরবে। সে লোক বণ্টনও ঠিকমত হয় নাই। অর্থাৎ এসব এখনো পরিকল্পনার আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।’ ড. নাজেম বলেন, ‘এমনকি গেজেট আকারে প্রকাশ করা পরিকল্পনাও একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। এতসব ভুলচুক থাকা সত্ত্বেও আমরা শুধু বন্যা প্রবাহ অঞ্চলটা রক্ষার সুপারিশ করেছি। জলাভূমি, কৃষিজমি, খোলা জায়গা এসব তো রয়েই গেছে। কিন্তু এতটুকুতেই যে পরিমাণ হইচই হচ্ছে, তাতে বোঝা যায় গোটা পরিকল্পনায় সংশোধন আনলে তারা কেমন করতো’।
আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থের পক্ষে জনপ্রতিনিধিরা
ঢাকার প্রায় সবকয়টা সংসদীয় আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ড্যাপের প্রবল বিরোধিতা করছেন। এ বিষয়ে যারা শুধুই আবাসন ব্যবসায়ী তাদের চেয়ে এককাঠি এগিয়ে তারা। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তারা সাধারণ মানুষকে উসকানি দিচ্ছেন ড্যাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে, জনসভা-মিছিল-ভাংচুরেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা এই বেপরোয়া বিরোধিতায় সক্রিয় হলেন কেন?
এই প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করলেন ড. নুরুল ইসলাম নাজেম। ড. নাজেম বলছিলেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধি, তিনি আবাসন ব্যবসায়ী। জলাভূমি, বন্যা প্রবাহ অঞ্চল, কৃষি জমি ভরাট করে বাসাবাড়ি বানিয়ে যিনি প্লট ব্যবসা করছে। সেই তিনি জনগণের স্বার্থ দেখবেন কিভাবে?’ প্রায় একই রকম মত ড. সরওয়ার জাহানেরও, তার মতে ‘ঢাকা শহরের প্রায় সব জনপ্রতিনিধিই আবাসন ব্যবসায়ী। যারা ব্যবসা করছেন না, তাদের জমি আছে ড্যাপ এলাকায়। তারা ভাবছে ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে তো জমিতে স্থাপনা তৈরি করতে পারবেন না। প্লট ব্যবসা করতে পারবে না। তাই এর বিরোধিতা করে বেড়াচ্ছেন তারা।’
আন্দোলনে খুব সহজে সাধারণ মানুষকে জুড়তে পারছেন তারা। কারণ ড্যাপে সংরক্ষিত ঘোষিত জমির মালিকদের মধ্যে আবাসন ব্যবসায়ী ছাড়াও ব্যক্তি মালিকরাও আছেন। দুই ধরনের ব্যক্তি: এক. আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যারা প্লট কিনেছেন, দুই. আগে থেকেই ওসব এলাকায় যাদের জমি আছে। তাছাড়া আছেন ভূমিহীন মানুষ, যারা এসব খাস জমিতে ঘর তৈরি করে বাস করছেন, ক্ষমতাবান প্রভাবশালীদের নিয়মিত উৎকোচ দিয়ে। কাজেই ওইসব সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজেই ড্যাপের বিরোধিতার যৌক্তিকতা দেখানো সহজ হচ্ছে ব্যবসায়ী বা সুবিধা গ্রহণকারীদের জন্য।
পরিকল্পিত নগর না হলে . . .
একদিকে অস্বাভাবিক রকমের দেরি করে এল ড্যাপ, যে সময়ের মধ্যে ঢাকার অপরিকল্পিত নগর-পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। কাজেই পরিকল্পনা তুলনামূলক অনুপযোগী হয়েছে। অন্যদিকে সেই পরিকল্পনাটুকুও বাস্তাবায়িত না হতে দিতে সক্রিয় আবাসন ব্যবসায়ীরা। খোদ সরকারের আন্তরিকতা নিয়াও প্রশ্ন আছে। (যেমন, আবাসন ব্যবসায়ীরা সরকারের একজন মন্ত্রীকে ও ড্যাপ পর্যালোচনা পরিষদের সভাপতিসহ সদস্যদের চরম অপমান করার পরও সরকার কোন ব্যবস্থা নেয় নাই)। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদেও যদি কোন টেকসই নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করা হয় তবে সোয়া কোটি অধিবাসীর এই নগর আরো দ্রুতগতিতে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। ড. সরওয়ার জাহান বললেন, ঢাকার বাইরে থেকে যত দ্রুত গতিতে মানুষ আসবে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য, তত দ্রুত এই নগর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পেশাগত জীবনে ড. জাহান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বর্তমান চেয়াম্যান। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশে সবাইকে শহরেও বা আসতে হবে কেন। দেশের সবাইকে যে শহরে থাকতে হবে, এমন তো কথা নেই। ঢাকা শহর বিকেন্দ্রীকরণ করে জেলাশহরগুলাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।’
চিন্তার সাথে আলাপে এই প্রবীণ নগর পরিকল্পনাবিদ বলছিলেন, আপাতত ঢাকা নগর এবং নাগরিক জীবন রক্ষা করতে হলে বন্যা প্রবাহ অঞ্চল সংরক্ষণ করতেই হবে। নগরের পানি সরানোর এলাকা এবং কৃষি জমি যদি ভরাট করে আবাসন ব্যবসা করা হয় তার দায় তো নগরের অধিবাসীদেরকেই নিতে হবে। ফলে বন্যার পানি এসে যখন এই শহর ডুবে যাবে, তখন তাদের তৈরি করা বাড়িগুলোই সবার আগে ডুববে। স্বপ্ন বাসনা আর বিলাসের জীবনই আগে ডুববে। কারণ বর্ষাকালে নদীতে পানি ধারণ ক্ষমতার বেশি হলে, উপচে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। জলাভূমি ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি করায় পানি গিয়ে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নেবে তাদের তৈরি বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি আর মার্কেট গুলোতে। পানিতে ডুবে শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। জলমগ্ন হয়ে পড়বে ঢাকা মহানগরী।
আরো পড়ুন
এক নজরে ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা
প্রজ্ঞাপন জারির পর সরকারেই উল্টা সুর, জলাধার সংরক্ষণ হবে কিভাবে?
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি
প্রয়োজন ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার(ড্যাপ) দ্রুত বাস্তবায়ন
আমরা আগে শুনেছি খুব দ্রুত ড্যাপ বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু সে রকম কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ছেনা। দীর্ঘদিন সরকার বিভিন্ন মহলের চাপে আইন তৈরী করতে পারেনি। সরকার যেহেতু এমন জরুরী একটা উদ্যোগ নিয়েছে তাই তাদের উচিত এটি বাস্তবায়নে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া।