নয়-এগার, সাম্রাজ্যবাদ এবং গণহত্যা থেকে জেগে ওঠা প্রতিরোধ


ওয়ার্ড চার্চিল
Friday 17 September 10

“কেউ না কেউ প্রত্যাঘাত করে” অথবা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পাল্টাধাওয়ার ন্যায়তত্ত্ব

[আমেরিকা মহাদেশ নামে যে বিশাল ভূখন্ডটি আমরা চিনি ওয়ার্ড চার্চিল বা কীটুয়াহ ব্রান্ড চেরোকি(১৯৪৭-) সেই মহাদেশের একজন আদি বা খাস অধিবাসী। যে শ্বেতাঙ্গ ইওরোপীয়রা দেশটি দখল করে নিয়েছে তাদের দখলদারি ভাষায় ওয়ার্ড চার্চিল একজন ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান’। তিনি লেখক, অধ্যাপক। সত্য উচ্চারণে নির্ভীক, এবং খোলামেলা। মার্কিনদেশে এরকম বিপ্লবী কণ্ঠস্বর বিরল। চার্চিল পূর্বপুরুষের রক্তের সাথে সাথে বয়ে বেড়ান সাম্রাজ্য পত্তনের সূচনায় আদি-ইন্ডিয়ানদের উপর চালানো বর্বর হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতম ইতিহাস। একটি মহাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এ জন্য কোন ঘটনাকেই নিছকই বিচ্ছিন্ন ব্যাপার আকারে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। পাঠ করেন পূর্বাপর মিলিয়ে, জায়মান প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের উৎসমুখে দাঁড়িয়ে। ইতিহাসের কথিত-অকথিত, দলিত-মথিত, চেপে যাওয়া চাপা দেওয়া সমস্ত কণ্ঠস্বরকে তিনি জড়ো করেন। সবার, সকলের-- দেশ থেকে মহাদেশ বিস্তৃত নিপীড়িত মানুষের মর্মবেগকে ঐক্যসূত্রে গাঁথেন। এত স্বচ্ছ দৃষ্টি আর অনুভবের গভীর থেকে কথা বলেন যে অনায়াসে হৃদয়ে বিঁধে যায়।

সেরকমই একটা লেখা, “কেউ না কেউ প্রত্যাঘাত করে” বা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পাল্টা ধাওয়ার ন্যায়তত্ত্ব (“সাম পিপল পুশ ব্যাক”: অন দ্য জাস্টিস অব রুসটিং চিকেনস)। এটা আসলে টুইন টাওয়ার ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া আকারে দেয়া একটা লেখা(১২ সেপ্টম্বর, ২০০১)। পরে লেখাটা আরো বিশদ করে একটা সম্পূর্ণ বইয়ের আকার দেন। সেইসময় দুনিয়াব্যাপী সরকারি বেসরকারি নিন্দার জোয়ার এবং সাম্রাজ্যের লাগাম ছাড়া আক্রোশের মধ্যেও সাহসের সাথে চার্চিল হাজির হন তাঁর বক্তব্য নিয়ে। যথারীতি শুরু হয়ে যায় আক্রমণ। চারদিক থেকে ভয়াবহ আক্রমণ শানানো হয়। কোমর বেঁধে তাঁকে নাস্তানাবুদ করার সবরকম চেষ্টা করা হয়। যুক্তি এবং তর্কে না পারলেও, সত্যের শক্তিতে তিনি অটল থাকলেও কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধানের পদটা তাকে তখনি হারাতে হয়েছে। পরে সাজানো অভিযোগ এনে চাকরিটাও খেয়ে ফেলা হয়। এ লেখার জন্য প্রায় শ’ খানেক হত্যার হুমকি পেয়েছেন। এর আগে অবশ্য কলম্বাস দিবস পালনের শোভাযাত্রায় বাঁধা দেয়ার জন্য গ্রেফতারও হয়ে ছিলেন।

ওয়ার্ড চার্চিল মূলত আমেরিকার ইতিহাস, আইনকানুন, সাহিত্য ও সিনেমা কিভাবে দখলদারি এবং উপনিবেশায়নের বয়ান তৈরি করে তা নিয়ে কাজ করেন। তিনি এথনিক স্টাডিজ-এর অধ্যাপক এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ান স্টাডিজ এর সমন্বয়ক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে কয়েকটা হল: ‘ফ্যান্টাসিস অব মাস্টার রেস’, ‘সিন্স প্রিডেটর কেইম’, ‘ফ্রম এ নেটিভ সান’ এবং ‘এ লিটল ম্যাটার অব জেনোসাইড: হলোকস্ট এন্ড ডিনায়াল ইন দ্য আমেরিকাস’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যাঁরা আদি অধিবাসী তাঁরা কিভাবে তাঁদের দেশ ইওরোপীয়দের দখলে চলে যেতে দেখেছেন সেই রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার কথা খুব কমই শুনেছেন; উপনিবেশায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে  তাঁদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ খুব কমই অবহিত। ওয়ার্ড চার্চিলের এই লেখাটির মধ্য দিয়ে তাঁরা বর্তমান বিশ্বরাজনৈতিক বাস্তবতার পর্যালোচনা পাঠ করবেন এমন এক মানুষের নজর দিয়ে যিনি দখলদারির দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানকে বিচার করছেন, যার নজির পাওয়া দুঃসাধ্য।এখানে সংক্ষেপে মূল লেখাটির একটা  তরজমা পেশ করা হল। তরজমা করেছেন মুসতাইন জহির ]

৯-১১’র পুণ্যাত্মারা

আততায়ীর হাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি খুন হওয়ায় সাংবাদিকরা ম্যালকম এক্স’র প্রতিক্রিয়া জানতে চান। তো সমবেত সাংবাদিকদের নিরাশ না করে, ১৯৬৩ সনের নভেম্বর মাসে, তিনি সরস একটা উত্তর দেন। তাঁর সেই বিখ্যাত উত্তর ছিল: এটা আহামরি কিছু না, কেবল “পাল্টা ধাওয়ার শুরু”--অন্যের উপর খাটানো জিনিস নিজের ঘাড়ে ফিরত আসার একটা নমুনা মাত্র।

সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ সকালে নিউ ইয়র্কে হুলুস্থুল বাধানো টুইন টাওয়ার ঘটনায় পাঁচ লক্ষ মৃত ইরাকি শিশুর পাশে, পাল্টা ধাওয়া খেয়ে সবেমাত্র কিছু মুরগি খোঁয়াড়ে ফেরত এসেছে। তো, এর মধ্যে আবার কয়েকটা মুরগির আদত নিবাস ছিল পেন্টাগন।

খুব ভালোকরে জেনেশুনে ১২ বছরের নীচে যাদের বয়স, সেইসব তরতাজা ইরাকি কিশোরদের মারা হয়। একদম সহজ হিশাবের মধ্যেই ছিল যে, তারা ১৯৯১ সনে মার্কিন “সার্জিক্যাল” বোমা বর্ষণে ছিন্নভিন্ন হবে। পানি শোধনাগার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা সহ অন্যান্য অবকাঠামোগত স্থাপনাকে সামরিক লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল। যার উপর নির্ভর করে [শহুরে]বেসামরিক লোকজনের খোদ জীবনযাপন, বেঁচে থাকা।

এই ধরনের বোমা হামলা ইতোমধ্যে বীভৎসতার চরম নজির ছাড়িয়ে গেছে। এও মনে রাখতে হবে “আসমানী যুদ্ধে”-র যে রেওয়াজ তারা চালু করেছে তা যেকোনো বিচারে ‘মানবতার’ বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ, সমস্ত রকমের আন্তর্জাতিক বিধিবিধানকে বুড়া আঙ্গুল দেখানো। এই অভিনব কায়দা ও “সভ্য ব্যবহার” দীর্ঘ এক দশকের মার্কিন আবরোধে মৃত্যুর সারিকে যারপরনাই অবিরাম বাড়িয়ে তুলেছে । ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি আর সময়ান্তরে বোমা হামলার মুখে রাখার পাশাপাশি নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জীবন রক্ষার ন্যূনতম উপকরণ, ঔষধপত্র সংগ্রহের রাস্তা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। নিঃসন্দেহে এই চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভোগ তাদের শারীরিকভাবে পঙ্গু ও মানসিক যন্ত্রণায় এতটাই বিপর্যস্ত করেছে যে পুরাপুরি সেরে উঠা রীতিমত অসম্ভব। বস্তুত একটা পুরা প্রজন্মকে এভাবে ধূলিসাৎ করে ফেলা হয়েছে।

এই নিধনযজ্ঞের(হলোকস্ট) কারণ খুব সাধারণ। মার্কিন মুল্লুকের ৪১তম “স্বাধীনতা-প্রেমী” রাজা বাবা বুশের সোজাসাপ্টা ঘোষণা: “বিশ্ববাসীকে অবশ্যই বুঝতে হবে, ‘আমরা যা বলি, তাই হবে’। আর ওভাল অফিসের ৪৩তম সম্রাট, স্বাধীনতার কারবারী পুত্রের গলায় তারই প্রতিধ্বনি শুনে উল্লসিত হাত তালিতে মাতোয়ারা ছিল সর্বত্র স্বাধীনতা-প্রেমী আমেরিকানরা। এটুকু শুধু স্মরণ করলেই চলবে, দিবারাত্রি অনর্গল টিভি চ্যানেলগুলাতে ইরাক যুদ্ধের মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণের ভিডিও প্রদর্শনের মাত্রাটা। আন্দাজ পাওয়া যাবে কত বেশি তারা জানতো!

যদি কেউ এসবের মানে খুঁজতে চান, তাহলে যুতসই হবে ঔসব টিভি রিপোর্টের বন্যায় আমেরিকানদের পুলক আর উৎসাহের আতিশয্যের সাথে [দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন] জর্মান ভদ্রলোকদের তুলনা টানলে। [প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়] মৃত্যুর মহাসড়কে একহপ্তায় জেট বিমান থেকে নির্বিচার গুলি চালিয়ে একলাখ ‘আচকান পরা’, ‘উটের জকি’ কিম্বা ‘মাঠের কালা আদমিদের’ বালিতে লুটিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ছিল নাৎসিদের রাশিয়া অভিযানের প্রথম মাসের কর্মকান্ডের মত।  নির্বিচার কচুকাটা হত্যা-লীলায় সেসময় ভালো-জর্মানরা আমোদিত অভিনন্দন জানিয়েছিল। বস্তুত ১৯৪৩ সনে স্টালিনগ্রাদে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত “নির্দোষ বেসামরিক’’ জার্মানদের মধ্যে হিটলারের প্রতি সমর্থনের আহামরি কোন খামতি ধরে নাই। [ঠিক যেমন ইরাক ও আফগানিস্তানে বিপর্যয়ের আগে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে বুশেরও কোনই অসুবিধা হয় নাই।]

এখানে ইতিহাসের অন্দরে মনোনিবেশ করলে গুরুত্বপূর্ণ মরতবা হাসেল হবে। সম্মিলিত অপরাধের মর্ম বোঝা যাবে। পূতপবিত্র এই আমেরিকানদের নেতৃত্বেই সম্মিলিত অপরাধের দায়ে দায়ী করা হয় সামগ্রিকভাবে জর্মান জনগণকে। এবং এটা কিন্তু তাদের কারো ব্যক্তিগত কৃতকর্মের জন্য নয় বরং তারা যার এখতিয়ার দিয়েছে--আরো যথাযথ করে বললে, তাদের নেতা ও সৈন্যবাহিনীকে জনগণের তরফে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রয়োগের যে ক্ষমতা তারা [রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে] হস্তান্তর করেছিল সে জন্য।

এই নীতি যদি তখন খাটে তাহলে এখনও তা সমানভাবে খাটানো যায়। যেরকম নির্দোষ ভাল জর্মানদের বেলায় প্রয়োগ হয়েছিল, ঠিক সেরকম ভালো আমেরিকানদের বেলায়ও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। মূল্যবোধের সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য গোটা জর্মান জাতিকে চরম-মূল্য দিতে হয়েছিল, তাদের দায় শোধ করানো হয়েছিল। [এর অন্যতম দার্শনিক বয়ান যাঁর হাতে তৈরি হয়েছিল তিনি কার্ল জেসপার। আগ্রহীরা তাঁর ‘দ্য কোশ্চেন অব জর্মান গিল্ট’(১৯৪৭), বইটা পড়তে পারেন]। উপসাগরীয় যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী নিষেধাজ্ঞা আর অবরোধের ধারাবাহিকতা ক্লিন্টন প্রশাসনের পর বড় বুশের নেতৃত্বে মার্কিন সামরিক-অর্থনৈতিক আধিপত্যের “নতুন বিশ্বব্যবস্থা” প্রতিষ্ঠার উদ্দাম মত্ততায় পৌঁছায়। দুনিয়া দখলের চূড়ান্ত রফা করার ঘোষণায় তাদের ধনুর্ভঙ্গপণ মধ্যপ্রাচ্যে আকসার প্রয়োগ হয়। কি রকম বর্বরতার ভিতর দিয়ে ইরাকের শিশুসহ প্রতিটি মানুষকে যেতে হয়েছে তার একটা নমুনা স্মরণ রাখা যেতে পারে। খোদ মানবিক সাহায্য বিতরণ কাজ সমন্বয়ে নিয়োজিত ছিল এমন দুজন জাতিসংঘ কর্মকর্তাকে মার্কিনীদের চাপানো নীতির বিরোধিতা করে অবশেষে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

এর একজন জাতিসংঘের সাবেক সহকারি মহাসচিব ডেনিস হাল্লাডে বারবার বলেছিলেন, যা ঘটছিল তা একটা “পদ্ধতিগত পরিকল্পনা... ইচ্ছাকৃত গণহত্যা”। এই বিবৃতি নিউ ইর্য়কসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় ১৯৯৮ সনের শরতের সময় ছাপা হয়। ফলে কিছুতেই বলা যাবে না যে মার্কিন জনগণ এটা “জানতো না”; বরং কিছুদিন পরে ব্যাপক দর্শকপ্রিয় একটা টিভি অনুষ্ঠানে (মিট দ্য প্রেস) সাংবাদিকরা তৎকালিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইটকে জিজ্ঞাসা করলে স্বীকার তো করা হয়ই, উত্তরে হিমশীতল গলায় সরাসরি বলে: যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনের জন্য “এই খরচা বেশি কিছু না”।

হানাদার জনগণের রাজনীতি

সর্বোপরি মার্কিন জনতা এসমস্ত নৃশংসতাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আর হাই তুলতে তুলতে টিভিপর্দায় লক্ষ লক্ষ ইরাকির মৃত্যু ও দুর্ভোগের মত অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দিয়ে তাদের অবসর কাটিয়েছে ‘জেরেমি’ কিংবা ‘এলিংটন’র সাপ্তাহিক সসার গেম শো দেখে।

সত্যিকার অর্থেই স্বীকার করতে হবে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া ইরাকি শিশুদের প্রতি যা করা হয়েছে/হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অতিশয় ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র নগণ্য একটা অংশমাত্র ‘প্রতিবাদ’ জানিয়েছিল। একইসাথে অবশ্য এটাও মানতে হবে প্রতিবাদে অংশ গ্রহণকারীরা নিছক স্বাক্ষর দেওয়া আর মৃতের স্মরণে মোমবাতি জ্বালানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যের এই নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে রাস্তায় প্লাকার্ড নাড়ানো ‘বিরোধিতা’ সর্বস্বতার অধিক এককদমও আগ বাড়ানোর কারও কোন আগ্রহ ছিলনা। তারা ওইসব সুশীলপনা প্রদর্শন করে “নীতিবোধের সাক্ষী” বনেছে যখন কিনা বিশাল অঞ্চল জুড়ে বাদামি চামড়ার পাঁচ বছরের শিশুরা চোখে বিভীষিকাময় আতঙ্ক নিয়ে অন্ধকারে বসে থরথর কাঁপছিল। আর অকল্পনীয় যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যখন ওরা শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তখনও চলছিল কেবলই তাদের প্যানপ্যান-ঘ্যানঘ্যান।

ঠিক এইটা হল আদত মর্মের জায়গা। ওইসব ভিন্নমতালম্বীদের বিবেকের তাড়না এতটাই প্রখর যে, কর্পোরেশনের মুনাফাখোরি ও বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে অল্পকিছু লোকের জানালার কাচ ভাঙা কিম্বা বিক্ষোভ ঠেকাতে তারা নিজেরাই পুলিশি দায়িত্ব পালন করার জন্য আগবাড়িয়ে “শান্তিরক্ষীর” ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

মার্কিন জনতার মনোভাব এবং অন্যান্যদের ভিন্নতর অবস্থান জানান দেওয়ার যে নমুনা দেখা গেছে তাতে নিঃসন্দেহ হয়ে বলা যায়, দৃশ্যত কোন আমেরিকান সরকারিভাবে স্বীকৃত গণহত্যা বন্ধে উল্লেখযোগ্য কিছুই করেনি। [তুলনা করা যায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিপেক্ষিতে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মাত্রা ও প্রবলতার সাথে]। ফলত যে যোদ্ধাদল সেপ্টেম্বর ১১ বিমানবহর পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অনুপ্রবেশ থামানোর মত উদ্যোগই ছিল গরহাজির।

“সন্ত্রাসী”র সাথে মোলাকাত

যারা একটি সফল অভিযান পরিচালনায় সেপ্টেম্বর ১১-তে এসেছিল, অনবরত মিথ্যাচার আর কর্পোরেট মিডিয়ার অবিরাম প্রপাগান্ডার মুখে, এখানে তাদের সম্পর্কে কিছু  নোক্তা দিয়ে রাখা দরকার। প্রথমত, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিজেরা প্রথমে “যুদ্ধ চালু” করে নাই। নতুন সহস্রাব্দের “প্রথম যুদ্ধমূলক হামলা”ও তারা করেনি।

যে যুদ্ধে তারা লড়াইরত মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে“ইসলামী পূর্ব”র বিরুদ্ধে “খ্রিস্টীয় পশ্চিম” একহাজার বছর আগে সেই ক্রুসেড়ের সময় থেকেই আরম্ভ করেছে। যাকে এখন যুক্তরাষ্ট্র মাহাত্ম্য দান করে। নিকট অতীতে এই যুদ্ধটা আবার জারি করা হয় যখন ১৯৬০ দশকে ফিলিস্তিনীদের বসতবাড়ি উচ্ছেদ সাধনে ইজরায়েলি আগ্রাসন বেগবান করতে লিনডন জনসন ব্যাপক মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ সহযোগিতা শুরু করে। অথবা বাবা-বুশের ৯০তে “মরু ঝড়” তৈরির নির্দেশ দানের পর থেকে। তা যাই হোক না কেন, যদি বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগনে যা করা হল তাকে যুদ্ধমূলক হামলা (act of war) বলে গণ্য করা হয় তাহলে ঠিক একই কথা খাটে ইরাকি ভূখন্ডের উপর “উড়ে যাওয়া” প্রতিটা মার্কিন বিমান ফ্লাইটের বেলায়, সেই পয়লা দিন থেকে। বর্তমান সহস্রাব্দের প্রথম যুদ্ধমূলক হামলাটি ঘটে একেবারে পয়লা দিন, তৎকালীন প্রধান সিপাহসালার (Commander-in-Chief)  বিল ক্লিন্টনের অধীনে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-জাহাজ থেকে। যারা ৯/১১ ঘটিয়েছে তাদের সম্পর্কে খুব সৎভাবে এ কথাটা বলা যায়, অবশেষে তারা একই ধরনের প্রতিউত্তর দিয়েছে যে ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্র এযাবৎ তাদের জনগোষ্ঠীর সাথে করে আসছিল।

এতদিন গায়ে সয়ে, সবুর করে বহুদিন অপেক্ষার পর এটা করা হয়। এমকি ১৯৯৩ সনের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ঘটনা আমলে নিলেও নির্দ্বিধায় বলা যায়, এত দীর্ঘকাল চুপ করে থাকা ধৈর্য ও সংযমের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা ছাড়া অন্য কিছুর নজির হতে পারে না। তারা “নির্দোষ বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু” বানায় নাই। ৯-১১তে পেন্টাগনের যেকয়জন মারা গেছে তাতেই হিসাব চুকেবুকে গেছে বলারও কোন যুক্তি নাই। সেই ভবন ও অভ্যন্তরে অবস্থানকারি সমেত সবকিছুই স্বাভাবিক ও নির্ভেজালভাবেই সামরিক লক্ষ্যবস্তু। একই কথা প্রযোজ্য বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের বেলায়ও...।

ঠিকই। আসলেই। ব্যাপারটা আরো ভালো বোঝা যাক, রাজি তো? এটা ঠিক যে তারা একরকম বেসামরিকই (civilian) বটে। কিন্তু নির্দোষ (innocent) কি? হে, একটু থামা দরকার! তারা তো আমেরিকার দুনিয়াব্যাপী আর্থিক সাম্রাজ্যের একেবারে কলিজার মধ্যের কলাকৌশল-প্রণয়নকারী কারিগর বাহিনী। যার “মহাশক্তিধর মুনাফা যন্ত্র”র কাছে সবসময়ই বাধাঁ ছিল মার্কিন নীতির সামরিকতা, এবং তারা এটা স্বেচ্ছায় ও জেনেশুনেই তো করেছে। তুলনামূলক উচ্চশিক্ষিত এইসব উপরতলার বিশিষ্টজনদের ‘না জানা’  (ignorance) -- আদতে ‘জানতে না চাওয়া’ (ignore) শব্দটারই তো উপজাত। ফলে তা গ্রহণযোগ্য কোন সাফাই হতে পারে না। তারা যেসমস্ত কর্মকান্ডে জড়িত ছিল, এবং অনেক ক্ষেত্রে সেসমস্ত আরো জোরদার করছিল তার পরিণতি ও ফলাফল অন্যান্যদের জন্য কি দুর্ভোগ বয়ে আনতে পারে এটা ততটুকুই না বুঝার কারণ ছিল, যতটা তারা সে বিষয়গুলা দেখতে চাওয়াকে সম্পূর্ণই অগ্রাহ্য করেছে। আমি সত্যিই আগ্রহী হতাম সেটা শুনতে যদি এর চেয়ে ভালো, কার্যকর অথবা বস্তুত টুইন টাওয়ারের বিবশ নন্দনে বসবাসকারী ঔসব পাতি-আইখমানদের জড়িত থাকার জন্য অন্যকোনো শাস্তি যথাযথ হত। [দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ইহুদি নিধনের জন্য বানানো বিশেষ নাৎসি সেলের প্রধান ছিলেন এডলফ আইখমান। এই সেলের কার্যক্রম ও দায়দায়িত্ব বিচারের আলোচনায় একটা ব্যবস্থার সাথে পরিচালনাকারী ব্যক্তি ও অধস্তনদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত অপরাপর সদস্যের সংশ্লিষ্টতার সম্পর্ক বিষয়ে বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক হান্না আরেন্ডট’র তত্ত্বের ইঙ্গিত ব্যবহার করা হয়েছে। পড়তে পারেন, ‘আইখমান ইন জেরুজালেম: এ রিপোর্ট অন দ্য বেনালিটি অব ইভিল’]

যে মানুষগুলো বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগন অভিযানে উড়ে গেছে তারা মোটেই “কাপুরুষ” নয়। বরং এই অভিধাটি লাগসই হলো সেইসব “চোয়াল-শক্ত ছোকরাদের” যারা এয়ারক্রাফট নিয়ে বাগদাদের অরক্ষিত আকাশসীমায় চোরাগোপ্তা প্রবেশ করে আমোদ পায়। যখন একের পর এক বোমায় ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয় সত্যিই নিরপরাধ হাজার হাজার দুর্ভাগা বেসামরিক ইরাকিকে। এতসব ঝুকি তৈরির পর তো অবশ্যই স্থানীয় ভিডিওর দোকানে ঘোরার সময় একজন তদ্রুপ হামলা আশা করতে পারে। শুধুমাত্র তাই নয়, সেইসব “লড়াইরত নারী এবং পুরুষ” যারা কম্পিউটারের সামনে বসে বর্হিদেশ পারস্য সাগরের জাহাজে পরামর্শ দেয় আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত কক্ষের আয়েশ উপভোগ করে যখন কিনা পাশবর্তী দেশে নির্বিচারে জনবহুল জায়গায় ক্রজ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। সেপ্টেম্বর ১১তে যারা আঘাত হেনেছে তাদের সম্পর্কে যাই কিছু বলা হোক না কেন, তাদের অদম্য সাহস প্রতীয়মান, আপন লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বেচ্ছায় নিজের জান কোরবান করেছে তারা।

এরা “ইসলামী মৌলবাদে” ডুবে থাকা কোন “ধর্মান্ধ”ও ছিল না।

কেউ চাইলে একে সঠিকভাবেই “বেপরোয়া” কাজ বলে বর্ণনা করতে পারে। যদিও এ বেপরোয়া মনোভাব নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত; এই বোধকে “স্বাভাবিক”ও বলা যায়। নিজেদের সন্তানদের কচুকাটা গণহত্যার মুখামুখি দাঁড়িয়ে যে কোনো লোকই আবেগি প্রতিউত্তর দিবে, বিশেষত যখন কিনা এ নির্মমতাকে অন্য কেউ থোড়াই আমলে আনে (যেকোন ইহুদি ত্রাণকর্তাকে এব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে দেখুন কি বলে)।

কট্টর ধর্মীয় অনুপ্রেরণার বশবর্তী কারো জন্য, দুর্বিসহ পরিস্থিতি বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া পয়দা করবে তাতে আর এমনকি রহস্য বা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত লুকায়িত আছে। এতে ইসলামের বিশেষ ভাগিদার হবার মতো আলাদা কিছু নাই। বস্তুত, সেপ্টেম্বর ১১ হামলার আগে যোদ্ধাদলের একমাসের কর্মকান্ড ও গতিবিধি তদন্ত করে এফবিআই যে প্রতিবেদন দিচ্ছে তাতে বেশ পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে তারা কেউ মৌলবাদি মুসলমান না। এখন পর্যন্ত জানা মতে এটাই প্রমাণিত যে তারা সেকুলার একটিভিস্ট, সৈনিক, যারা ধর্মবিশ্বাসের একগুচ্ছ নীতিমালা নয় বরং বেশি প্রণোদিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের তিক্ত বাস্তবতা থেকে। যদিও নিঃসন্দেহে নিজ দেশের ধর্মগুরুদের সাথে তাদের অন্তরিক সম্পর্ক ছিল।

তদুপরি তাদের কর্মকান্ড ‘হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতা’র ধারেকাছেও যায় না।

উন্মাদগ্রস্ততার অসুস্থ অবস্থা আদতে মার্কিনদের মজ্জাগত। যারা ভাবে একটা দেশ গণ্যহত্য করে চিরদিনের জন্য দায়মুক্তি পাবার প্রায় “ঐশ্বরিক অধিকার” প্রাপ্ত। এটা তাদেরও বেলায় বেশ ভালভাবে খাটবে যারা কিনা গণহত্যার শিকার হয়েও তা ঠেকাবার জন্য কোন না কোন বস্তুগত উপায় এস্তেমাল করে না। মানসিক সুস্থতা এই উদাহরণের আলোকে বরং এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়: এটা সেই ইচ্ছাশক্তি যাতে হানাদারকে ধ্বংস বা বিচারের চেষ্টা করা হয় অথবা অপরাধ সংগঠনে তাদের সামর্থের উৎসমূলের ক্ষতি সাধন করা। (আমরা কি এখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালিন জর্মানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের “কৌশলগত বোমা হামলা” নিয়ে আলাপ জুড়াব, এবং এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপরটাও)।

যোদ্ধাদলকে সরকারিভাবে যে ‘শয়তান’-এর সাক্ষাত অর্বিভাব বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, কী আসলে এর পিছনে কাজ করছে।

শয়তান: যারা এ ফাও ধারণা আকড়ে থাকতে পছন্দ করবেন তাদের জন্য নিখুঁত উপযুক্ত চেহারাটা হবে সেই জিঘাংসাপরায়ণ প্রতিকৃতি, মেডেলিন অলব্রাইটের দেহ ধরে যার পুনরাগমন ঘটেছে। [জর্জ লুকাস-এর স্টার ওয়ার সিনেমার] ‘জাব্বা দ্য হাট’-এর চরিত্রের মত আরাম কেদারায় বসে যে ঘোষণা করছে, ইরাকের নির্দোষ তরুণদের উপর সে সম্মিলিত মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগের জিঘাংসা চাপাবে। শয়তানের বাণী তো শুনা যাবে মার্কিন বীর “স্টরমিন নর্মান” সোয়ার্টজকফ এর মুখ থেকে। যারা পদ্ধতিগত অমানবিক নির্যাতনকে আমলেই আনেনা এবং নিছকই “আনুসঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি”র নামে অনায়াসে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করতে কার্পন্য করেনা। শয়তান শব্দটা তো সেইসব মানুষজনের মানসিকতা চিত্রায়ণে অক্ষরে অক্ষরে লাগসই হয়, যাদের কাছে ঔরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণযোগ্য বা এমনকি মুহূর্তের জন্যও সহনীয় হয়।

এমন ধরণের শয়তানরা না থাকলে তো সেপ্টেম্বর ১১-র পাল্টা-আক্রমণের মত ঘটনা কখনোই ঘটত না। তো, বাচ্চা বুশ থেকে ধার করে বলা যায় যদি “দুনিয়া এইসব শয়তান মুক্ত না হয়” তাহলে সেপ্টেম্বর ১১ আবাবিল পাখির নিশান হয়েই হয়ত শেষপর্যন্ত থেকে যাবে।

অনুপাত এবং উদ্দেশ্য বিষয়ে

বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে ১৯৯৩ সনের বিস্ফোরণ সহ হিশাব করলেও “আরব সন্ত্রাসী”রা এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী এবং নিরবিচ্ছন্ন ত্রাস সৃষ্টিকারি বোমা হামলার প্রতিউত্তর দিয়েছে আমেরিকার অভ্যন্তরে মোটে মাত্র চারটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। ওকলাহোমার ব্যর্থ হামলা সহ ধরলে তা পেন্টাগন ঘোষিত শুধুমাত্র বাগদাদে নিক্ষিপ্ত পঞ্চাশ হাজার বোমার এক শতাংশে টেনেটুনে পৌঁছায়। আরবরা সাকুল্যে পাঁচ হাজার জনকে হত্যা করতে সক্ষম হয় যা মৃত ইরাকি শিশুদের প্রায় একশতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে বয়স্ক ইরাকি কিংবা আত্মসমর্পনের পরে যে সমস্ত ইরাকি সৈনিকদের কচুকাটা করা হয়েছে সেগুলা ধরলে তা দশমিকের কোঠায় নেমে যাবে।

সম্পদ/মুনাফাকামিতায় মগ্ন আমেরিকান মুলধারার জন্য কাজের হিশাবটা হবে এরকম: আধা ডজন ভবন আরবরা গুড়িয়ে দিয়েছে এর মধ্যে অবশ্যই একটা ছিল উৎকৃষ্ট বাছাই। বিপরীতে আমেরিকা “কৌশলগত ধ্বংসযজ্ঞ” পরিচালনা করেছে সমস্ত ইরাক জুড়ে। বড়বড় কর্পোরেট মলিকানায় অংশিদারদের লভ্যাংশের ১০০ বিলিয়নের একটা চোট বসিয়েছে যেখানে আমেরিকা পুরা ইরাকের অর্থনীতি তছনছ করে দিয়েছে।

এরমাধ্যমে আমেরিকাকে তাদেরই দাওয়াইয়ের সামান্য একটা ডোজ দেয়া হয়েছে। এটাকে কেবল একটা “প্রতিশোধ” বা “বদলা” বলা চলে। অবধারিতভাবেই আমেরিকা এটা নিজগুণে কামাই করেছে। কিন্তু মুশকিল হল প্রতিশোধ বিষয়টা বিবেচিত হয় সমান মাত্রায় ফিরত দেবার বিষয় আকারে। যা এখানে খাটানো যাচ্ছে না। উপরের পরিসংখ্যান মোতাবেক ৪৯৯৯৬ টা বোমার বিস্ফোরণ এবং আরো ৪৯৫০০০ আমেরিকান হত্যা করলে “সন্ত্রাসী”-দের পক্ষে একটা “সমান সমান” জায়গায় আসা সম্ভব। শুধুমাত্র বাগদাদে ইরাকি শিশুদের মুত্যুর বদলা নিতে হলে। তাহলেই সংখ্যাগত সাযুজ্য আসতে পারে। ক্ষতিসাধনের প্রকৃত আনুপাতিক সাজুয্য আনতে হলে ন্যূনতম ৩০০০০০ ভবন গুড়িয়ে দিতে হবে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মারতে হবে।

এটাই যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করার জন্য ঢুকেছে তাদের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বলতে হয় আমেরিকা তার কৃতকর্মের দেনা শোধ করতে শুরু করেছে মাত্র। মাশুল গোনা, যেটা তারা বলে থাকে, সেটাই হবে আসল ঠেলা (জর্মানদের জিগান)। বিশ্বাস করার মত এমন কোন কারণ ঘটে নাই যে, যারা হামলা পরিকল্পনা করেছে তারা কড়ায়গন্ডায় বদলা তুলে নিতে চায়।

‘সংবাদ’ মাধ্যম সেপ্টম্বর ১১-র পর থেকে যে প্রলাপ বকতে শুরু করেছে তাতে অন্তত সত্যের একটা লেশ আছে। এটা ঠিক যে মধ্যপ্রাচ্যের লোকজন “ঠিক” আমেরিকানদের মত না। মোটেমাত্রই না, কারণ তারা আমাদের কায়দায় “জীবনের মূল্য” মাপে না। এটা দ্বারা বুঝতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যবাসীর আমেরিকানদের মত মুনাফা কামানোর জন্য অথবা বর্ণবাদি বিদ্বেষে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার কোন ইতিহাস নাই। ফলে আমরা বুঝতে পারি মধ্যপ্রাচ্যবাসীরা জীবনের কত মূল্য দেয়, সবার জীবন, আপন পর সকলের জীবন তাদের কাছে কতমূল্যবান। তাদের প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক উচ্চতর মাত্রায়।

একটি মানবিক কৌশল প্রণয়ন

সর্বোপরি যে কেউ একটা নিশ্চিত আশাবাদ খুঁজে পাবেন। সেপ্টেম্বর ১১-তে স্বল্প মাত্রার হামলা পরিকল্পনাটা যারা তত্ত্বাবধান করেছে, এমনকি তাদের চিন্তার ভিতরে নিহিত থাকা মানবতাবাদও বলা চলে একে। তাদের যুক্তি গড়ে উঠেছে এই ধারণায় ভর করে যে, আমেরিকার জনগণ তাদের বরাতে যা করা হয়েছে/ হচ্ছে তা মার্জনা করে দিয়েছে। আসলে শুধু তাদের বরাতেই হচ্ছে না, বস্তুত তারা সক্রিয়ভাবে দুষ্কর্মে অনেকাংশে নিজেরাই লিপ্ত। বিশেষত, তাদের কোন ধারণাই নাই যে দুর্ভোগ এবং অত্যাচার ভোগ করতে কেমন লাগে। এখন তারা নিজেরাই সেই মজা কিছুটা টের পাচ্ছে।

দৃশ্যত, চিন্তাটা হল কিছুটা সময় দেয়া যাতে টনিক শরীরে কাজ করতে শুরু করে। অন্যদের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট করতে তারা যতটা উৎসাহী ছিল তার তুলনায় এখন নিজেরা হাতেনাতে যে যন্ত্রণা ভোগ করছে সেটা মোটেমাত্রই ভিন্ন কিছু তো না-ই বরং অধিক কষ্টদায়ক সেই বোধটা জাগানো।

আরো খোলাতাই করে বললে, আশাটা এরকম যে, মাশুল না দেওয়ার যে অনুমিত বর্ম আচ্ছাদনে তারা এতদিন নিরাপদ আস্তানায় থেকে যা ইচ্ছা করে গিয়েছে সেটার অন্যথা দেখে হুঁশ ফিরবে। “আমাদের বাচ্চাদের খুন করা বন্ধ কর, যদি নিজেরটা নিরাপদ রাখতে চাও” --সোজা সরল এইনীতি ঠিকঠাকমত মেনে চলবে। বলা যায় এটা আমেরিকান জনগণের জন্য “জ্ঞান ফিরানোর চিকিৎসা” (reality therapy) যাতে তারা শেষ পর্যন্ত ‘সঠিক কাজটা করা’র সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।

যদি সৎভাবে এই সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে হয়, তবে পর্যাপ্ত সংখ্যক আমেরিকানের জেগে উঠতে হবে, ইরাকের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এখনই তুলে নিতে দরকারি সবকিছু করতে হবে। অথবা বেশকিছু আমেরিকান যুদ্ধাপরাধের হোতার বিচার করে ঝুলিয়ে দিতে হবে। যেমন, হেনরি কিসিঞ্জার’র কথা মনে আসছে, একইসাথে মেডেলিন অলব্রাইট, কলিন পাওয়েল, বিল ক্লিন্টন, বুড়া জর্জ বুশ। তাহলেই আমেরিকার মাটিতে সামরিক হামলা চটজলদি বন্ধ হবার কারণ ঘটতে পারে।

বিকল্পের সন্ধানে

দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, যত মহৎপ্রাণ তারা হন না কেন, এই পরিস্থিতিতে মানবতাবাদি আকাঙ্ক্ষা সবসময় অপূরণীয় থেকে যেতে বাধ্য। এহেন ঘটনা ঘটার জন্য অনেক উন্নত চরিত্র এবং বোধবুদ্ধি সম্পন্নতার উদয় ঘটতে হবে, যা গড়পড়তা আমেরিকানদের মধ্যে গরহাজির। পরিকল্পনাকারীরা সম্ভবত আমলে আনেন নাই যে, কয়েক প্রজন্ম সংবাদমাধ্যমের ছাঁচে গড়ে তৈরি হওয়ার পর এদের মধ্যে মানুষ্য প্রজাতির স্বাভাবিক চিন্তা ক্ষমতাটাও লোপ পেয়েছে। অথবা এটাও হতে পারে যে, আমেরিকান বয়স্কদের বিপুলাংশই পাভলভিয়ান প্রণোদনা/সংবেদ এর মধ্যে স্থিতু প্রজাতির স্তরে নেমে এসেছে। যাদের কাছে আর যুক্তির আবেদন বলে কিছু নাই। তবুও নৈতিকভাবে দায়বদ্ধতা অনুভব করেছে এদেরকে একটা সুযোগ দেয়ার জন্য যাতে আমেরিকানরা এখান থেকে বেরুতে পারে।

কিন্তু এই চেষ্টা বৃথা, সুযোগ কোন কাজে লাগবেনা। বেশিরভাগেরই কর্ণকুহরে কিছুই প্রবেশ করেনি। তারা এই সত্য অনুধাবনেও রাজিনা যে দুনিয়ার অক্ষরেখা হঠাৎই সরে গেছে। তারা এখন আর ‘নিয়ন্ত্রক’-এর আসনে নাই। যথারীতি আমেরিকানরা তাদের চিরাচরিত রক্তলোলুপ অভ্যাসে ফিরে গেছে। বদের বদ ছোট বুশ’র একটু সতর্কভাবে চলার হুঁশটাও নাই, যে সে আদতে কি চায়। বিলি গ্রাহামের মত মৌলবাদি চক্রের খ্রিস্টান পাদ্রিদের সাথে মিলে ঘোষণা করেছে, ‘নব্য ক্রুসেড’, বলা শুরু করেছে ‘শয়তান মুক্ত দুনিয়া’ গড়ার জন্য ‘অনন্ত বিচার’।

অসহায়কে ঘুষিতে চোয়াল বাঁকা করে দেবার উদগ্র বাসনা বরাবরের মতই চেপে বসেছে। কিন্তু এইবার ঘটনা আলাদা, পাশা উল্টে গেছে। এইবার অসহায় আর অসহায়ত্বের মধ্যে ডুবে নাই, অন্তত আগের মত কেউ আর নিরুপায় বসে নাই। এইবার, কোথাও একজায়গায়, হতে পারে আফগান পাহাড়ের কোন গুহায়, সম্ভবত ব্রুকলিনের কোন বেজমেন্ট, কিম্বা হতে পারে স্থানীয় কেউ সহযোগে--অন্যকোথাও কেউ তৈরি হচ্ছে।

পিছন ফিরে, ভবিষ্যত প্রজন্মের কারো কাছে হয়ত ব্যাখ্যাতীত মনে হবে যে, কেন আমেরিকানরা সময় থাকতে নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারলনা। প্রকৃতির সাধারণ একটি সূত্রকেও কেন তারা গ্রহণ করতে পারলনা যা একজন অভিনেতার মুখেও উচ্চারিত হয়। যেরকম লরেন্স ফিসবার্ন কটন ক্লাব মুভিতে বলেন, “তোমাকে অবশ্যই জানতে হবে, কাউকে যদি ঠেলে প্রান্তসীমায় নিয়ে যাও, তখন সেও পাল্টা আঘাত হানে”।

যেরকমটা তাদের করা উচিত।

যা তারা অবশ্যই করবে।

এবং যা নিঃসন্দেহেই তারা ঘটাবে।

এই সমতা বিধানের মধ্যে ইনসাফ বর্তমান।

 

শেষের নোক্তা

উপরের আলোচনাটা একটা চটজলদি মন্তব্য ধরনের। সেপ্টেম্বর ১১’র পাল্টা হামলার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ বলা চলে। স্বীকার করি সব জায়গায় বিশদ হতে পারি নাই, এমকি কিছু ভুলও করেছি। যেমন, সেদিন কেবল মৃত ইরাকি শিশুদের আত্মারাই হাজির হয় নাই বরং কচুকাটা করা তাদের ফিলিস্তিনি স্বজনরাও শরিক হয়ে থাকবে। কিম্বা ইন্দোচায়না, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, কোরিয়া বা জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে মুহূর্তের মাঝে আনবিক বোমায় পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মৃত আত্মারাও সারি বেধে হয়ত অংশ নিয়েছিল।

আর মুখাবয়বহীন লাখলাখ ফিলিপিনো, আদি ইন্ডিয়ানদের গণহারে গণহত্যার যেসব জায়গাগুলা-- হর্সশো বেন্ড এবং বেড এক্স, স্যান্ড ক্রিক এবং ওনডেড নী, ওয়াশহিতা, বিয়ার রিভার এবং মারিয়াস থেকে হয়ত উঠে এসেছে।

ফোর্ট ক্লার্কে ১৮৩৬ সনে যাদের গুটিবসন্ত ছড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে এরা কি তারা? নাকি, ১৮৬০ সনের বস্কু রোডেনডোর নির্যাতন শিবিরে ক্ষুধা ও পিপসায় যারা ধুকেপুকে মরেছে, তারা? সম্ভবত তারাও হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি প্রদেশজুড়ে যেসব আদিবাসীদের মাথার ছাল তুলে সাহেবরা বিজয় উৎসব করেছে? অথবা সেইসব রারিতান? যাদের ছিন্ন মস্তকে লাথি দিয়ে বলখেলা হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গাটিতে যেখানে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র দাঁড়িয়ে ছিল। কিম্বা কেউ কান পাতলে সেইসব চাপা আর্তনাদও শুনতে পাবেন, একদা দাস ব্যবসার নামে জীবিত মানুষের হাড়মাংস বিক্রি করতে করতে যা ওয়াল স্ট্রিট নাম ধারণ করেছে।

এই তালিকা বেশুমার, বড় দীর্ঘ, বড় বেদনাদায়ক।

আমেরিকার কপালে কি আছে কে জানে, তবে খুব অল্প, খুব সামান্যই মিটাতে হবে। তাদের অপরাধের পুরাপুরি দায়শোধ বা প্রাশ্চচিত্ত কোনদিনই পরিপূর্ণ হবেনা।


Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি

View: 5005 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD