প্রাণসম্পদের হুমকি
বাংলাদেশের অ্যানথ্রাক্স জীবাণু অস্ত্র হতে পারে
দুনিয়ায় অসুখ বিসুখের শাস্ত্রে কিম্বা বিজ্ঞানে রোগ হিশাবেই পরিচিত ছিল অ্যানথ্রাক্স। কিন্তু জৈবপ্রযুক্তি আর জিনগত প্রকৌশলের এই সময়ে এই অ্যানথ্রাক্স অণুজীবকে গবেষণাগারে জৈব অস্ত্র হিশাবে গড়ে তোলা এবং ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
অ্যানথ্রাক্স ঘিরে এটাই এখন উদ্বেগের বিষয়। ব্যাপক প্রাণ বিধ্বংসী অস্ত্র হিশাবে একে এখন ব্যবহার করা সম্ভব। অস্ত্র হিশাবে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হবার ফলে, দুনিয়ার অনেক সামরিক বাহিনী নিজেরাই গবেষণাগারে এটা চাষ বা উৎপাদন করে। সামরিক বাহিনীর হয়ে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়েও করানো হয়। তাছাড়া নানা বিজ্ঞান গবেষণাগার ও ভ্যাকসিন বা ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিও অ্যানথ্রাক্সের মতন অন্যান্য অণুজীব বিষয়ে গবেষণা করে।
দুনিয়ায় এমন নজিরও আছে যে, গবেষণার সাফল্যের পরীক্ষা চালাতে গবেষণাগারে জন্মানো এমন অণুজীব সীমিত আকারে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলাও নিজেদের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য এমন ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাছাড়া শত্রুদেশের জনবল ক্ষয় করতে মানুষের ওপর কিম্বা অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিতে পশুসম্পদের ওপরও জীবাণু অস্ত্র হিশাবে এর ব্যবহারের নজির আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেন ও আমেরিকা জীবাণু যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। উদ্দেশ্য ছিল শত্রু দেশে জীবাণু ছড়িয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো এবং গবাদিপশু মেরে ফেলার মাধ্যমে খাদ্যাভাব তৈরি করা। জীবাণু অস্ত্র নিয়ে তখন এ দুইটা দেশ যে গবেষণা করে সেখানে সম্ভাব্য অস্ত্রের তালিকায় অ্যানথ্রাক্স অন্যতম ছিল। অ্যানথ্রাক্সের বীজগুটি (স্পোর) ছড়িয়ে শত্রুর বড় ধরনের ক্ষতি করা সম্ভব বলে মনে করত আমেরিকার বিজ্ঞানীরা। পরে বিজ্ঞানীরা অ্যানথ্রাক্স এর জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া--ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস থেকে গবেষণাগারে এমন অণুজীব জন্মাতে সক্ষম হন যা কিনা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাখা যায় এবং দরকারমত নানা আকারে অস্ত্র হিশাবে ব্যবহার করা যায়।
সাফল্যের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্কটল্যান্ডের গ্রুইনার্ড দ্বীপে এর পরীক্ষা চালায় বৃটেন। পরবর্তীতে অনেকদিন ওই জীবাণুর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল এবং কয়েক দশক পর্যন্ত এর সংক্রমণ ক্ষমতা ছিল। ১৯৭৯ সালে ওই এলাকা দূষণমুক্ত করতে বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। দূষণমুক্ত অভিযানে ২৮০ টন জীবাণুনাশক গ্যাস এবং দুই হাজার টন সমুদ্রের পানি ব্যবহার করা হয়। উনিশশ আটাত্তর ও উনাশি সালে রোডেশিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে বৃটেন অ্যানথ্রাক্স ব্যবহার করে। আর ভিয়েতনাম যুদ্ধে তো আমেরিকা নানা ধরনের জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করে। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল-মে মাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত সভার্দলোভস্ক শহরের অধিবাসীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সে সময় আমেরিকা প্রচার চালিয়েছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের জীবাণু অস্ত্রের মজুদে দুর্ঘটনা ঘটেছে। জীবাণু অস্ত্র হিশাবে অ্যানথ্রাক্সের ব্যবহারের সবচেয়ে পুরানা নজির পাওয়া যায় উনিশশ’ ত্রিশ সালে। সেবছর কোয়ান্টাং আর্মি মাঞ্চুরিয়ার যুদ্ধবন্দিদের ওপর অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ব্যবহার করে।
২০০১ সালে একজন বিজ্ঞানী আমেরিকায় চিঠির খামে ভরে নানা জায়গায় পাঠিয়ে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে দেন। অনেকে এতে আক্রান্ত হন, মারাও যান কয়েকজন। টুইন টাওয়ারে হামলার পরে এই ঘটনা ঘটে।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তখনই কমপক্ষে ১৭টি রাষ্ট্র জীবাণু অস্ত্র হিশাবে অ্যানথ্রাক্স ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করেছিল। অণুজীব গবেষণা বিষয়ে বিভিন্ন প্রখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যমতে, অণুজীব বিজ্ঞান ও জৈবপ্রযুক্তির জ্ঞান ও সরঞ্জাম ইত্যাদি এখন আর দুর্লভ না। বিশেষজ্ঞ অণুজীব বিজ্ঞানী ও জৈবপ্রযুক্তিবিদদের কাজে লাগিয়ে খুব সহজে অ্যানথ্রাক্স সহ নানা অণুজীবকে জীবাণু অস্ত্র হিশাবে ব্যাপক পরিমাণে জন্মানো যায়। ফলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বাইরেও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন যে কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এটা করতে সক্ষম।
অস্ত্র হিশাবে অ্যানথ্রাক্স তখনই কার্যকর হয়, যখন তাকে এমন আকার ও বৈশিষ্ট্য দেয়া যায় যে তা স্প্রে করে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। ফলে শ্বাস নেয়ার সময় তা সহজে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে, সংক্রমণ হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত অসুস্থতায় ভুগতে শুরু করে, এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মারাও যেতে পারে। তবে এরকম স্প্রে করার উপযোগী করে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু গড়ে তোলা শ্রমসাধ্য ও কঠিন বিষয়। যার কারণে খুব সহজে ও কমখরচে এমন জীবাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব না। এর জন্য জটিল ও সময়সাপেক্ষ জৈবপ্রযুক্তি অনুসরণ করতে হয়।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আগের সংক্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে; ফুসফুসে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তদের প্রতি দশজনের নয়জনই মারা যায়। দ্রুত অ্যান্টিবায়টিক দেয়া গেলে ওই নয়জনে মাত্র একজনের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। অবশ্য অণুজীবের পরিমাণ ও তা ছড়ানোর উপায়ের কার্যকারিতার ওপর মৃত্যুহার নির্ভর করে। তবে অ্যানথ্রাক্স সংক্রামক রোগ নয়। কেবল সরাসরি জীবাণুর সংস্পর্শে আসলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১৯৭০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী ৫০ লাখ মানুষের কোন শহরে ৫০ কেজি অ্যানথ্রাক্স ছড়ালে আড়াই লাখ অধিবাসী আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে এবার অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ার কয়েকদিন আগে শাহজালাল বিমানবন্দরে ৮২ কেজি পাউডার ধরা পড়ে। কাস্টমস কর্মকর্তারা ওই পাউডারকে ইফিড্রিন বলে চালিয়ে দেন। কিন্তু ওই পাউডারে আসলে কি ছিল সেই নিয়ে সন্দেহ করছে সংবাদমাধ্যমগুলা। বিশেষ করে সাপ্তাহিক প্রোব এই নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে তাদের সর্বশেষ সংখ্যায়। খেয়াল রাখতে হবে, অ্যানথ্রাক্স জীবাণুকে পাউডার আকারে ছড়ানো সম্ভব।
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি