ইরানের যুগান্তকারী বিপ্লব: পনের বছর পর


একবাল আহমদ
Monday 13 July 09

চলতি সপ্তাহে ইরানের ইসলামী সরকার তাদের বিপ্লবের পনের বছর-পুর্তি উদযাপন করেছে; যার মাধ্যমে তারা ইরান থেকে উৎখাত করেছিল এক পুরাতন ও স্বৈরতান্ত্রিক আমলাতন্ত্রের। বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত হন আয়াতুল্লাহ রূহুল্লাহ খোমেনী এবং রেজা শাহ পাহলভীর রাজত্বের অবসান ঘটে; যার (রেজা শাহ্) উপাধি ছিল রাজাদের রাজা, আর্যজাতির আলোকবর্তিকা, বিশ্বের সৌন্দর্যবানদের পৃষ্টপোষক, অভিজাত ও শক্তিমানদের আশ্রয়দাতা এবং যে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত স্বৈরশাসক। ইরানের এই বিপ্লব ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নাটকীয় ও চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোর একটি, এবং এটি ছিল টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ইতিহাসের সর্বপ্রথম বিপ্লবী ঘটনা প্রবাহ, যা ওয়াশিংটন সহ পশ্চিমা-জগতের সকল রাজধানীগুলোতে মহাআলোড়ন তুলেছিল। তথাপি মাত্র পনের বছর পর আজ এই ঐতিহাসিক ঘটনা ইরানের বাইরের দুনিয়া প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে, যা আধুনিককালের স্মরণ শক্তির ক্ষণস্থায়িত্বকে প্রতিফলিত করে। একইসাথে নতুন ক্ষমতা-হয়ে উঠতে চাওয়া শক্তির চোখেও এই বিপ্লব যে বেশ নিষ্প্রভ বনে গেছে তারও ইঙ্গিত বহন করে।

তথাপি ইতিহাসবিদরা ইরানি বিপ্লবকে একটি যুগান্তকারী বিপ্লব হিসাবেই উপস্থাপন করে। এই বিপ্লব আধুনিক ইতিহাসের অন্য যেকোনো ঘটনার চেয়ে ফরাসি বিপ্লবের সাথেই অধিক তুলনীয়। ফরাসি বিপ্লবের মতোই এই বিপ্লবের গুরুত্ব এর তাৎক্ষণিক ফলাফলে নয় বরং সেসব প্রবণতায় যা এই বিপ্লবের প্রভাবে উদ্ভূত হয়েছে এবং যেসব ভীতি এ বিপ্লব জাগিয়ে তুলেছিল। ফরাসি বিপ্লব যেমনিভাবে ইউরোপে এক নবযুগের সূচনা করেছিল তেমনি ইরানি বিপ্লবও মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশেষত তৃতীয় বিশ্বে অনুরূপ প্রভাব ফেলেছিল। ফরাসি বিপ্লব যেমন ইউরোপে একটি যুদ্ধ-বিগ্রহের সূচনার ইঙ্গিত দিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে ইরানি বিপ্লবও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াকে প্রভাবিত করেছে। আবার, ফরাসি বিপ্লব ঠিক যেমনিভাবে ইউরোপে ব্রিটেনের প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি হুমকি স্বরূপ হয়েছিল এবং পরবর্তীতে যার ফলে ইউরোপে ব্রিটেনের হস্তক্ষেপ বেড়ে যায়, ঠিক তেমনি ইরানি বিপ্লবের ফলেও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনস্বার্থ সর্বপ্রথম হুমকির মুখে পড়ে এবং পরিণতিতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপ আরও প্রসারিত হয়।

iranian peoples support

অন্যভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ইরানি বিপ্লব ছিল ফরাসি বিপ্লবের মতোই অনন্য এবং পরবর্তী বিকাশের ভিত্তি প্রসবিনী, ঠিক যেমনি ফরাসি বিপ্লব ছিল শিল্প-বিপ্লবের যুগে। জানুয়ারি ১৯৭৮ এ শুরু হওয়া গণজাগরণের সফল সমাপ্তি ঘটে ১৯৭৯ সনের ১১ ফেব্রুয়ারি। উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে চীন, আলজেরিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম, লাওস, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক এবং গিনি-বিসাউ প্রভৃতি দেশে সংঘটিত দীর্ঘ সশস্ত্র-লাড়াইয়ের বিপ্লবী মডেল থেকে ইরানের এই গণবিপ্লব ছিল সর্বপ্রথম ব্যতিক্রম। দীর্ঘ সশস্ত্র-লড়াইয়ের বিপ্লবী-মডেলের বিপরীতে ইরানে ঘটেছিল এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান এবং এটি ছিল সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অব্যাহত গণআন্দোলন। মাত্র একবছরের মধ্যে, ১৯৭৮ - ইরানে প্রায় ৩০ হাজার আন্দোলনকারী নিহত হয়। এই আন্দোলন সরকারী দমন-পীড়নের মুখেও এর জঙ্গি কিন্তু সংঘাতহীন (non-violent) চরিত্র এবং শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার জন্য ছিল অতুলনীয়। সাধারণভাবেই, এই বিপ্লবের মনোযোগী পাঠ গণঅভ্যুত্থান ও আন্দোলনমুখী রাজনীতির শিক্ষা গ্রহণের জন্য জরুরি।

ইরানি বিপ্লব তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী লড়াই-সংগ্রামের অগ্রভাগের শ্রেণী-নির্ভরতায় একটি গুণগত পরিবর্তন নির্দেশ করে, তা হলো এর শহুরে চরিত্র। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের প্রায়সব বিপ্লবই ছিল মুলত কৃষক বিপ্লব এবং এগুলো সংগঠিত হতো গ্রামকে কেন্দ্র করে গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এমনকি যেসমস্ত দেশে (কিউবা, আলজেরিয়া) শহুরে জনগণের সমর্থন বিপ্লবের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেসব দেশেও বিপ্লবের সফলতার ক্ষেত্রে গ্রামীণ জনগণই কেন্দ্রীয় চালিকাশক্তি হিসাবে দেখা হতো।

ইরানি বিপ্লবই হলো এই ধরনের কাঠামোর বাইরে আসা প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ এক নতুন ধরনের বিপ্লবের নজির। এই বিপ্লব সাংগঠনিক দিক থেকে ছিল প্রধানত শহুরে এবং উৎপত্তিগত দিক থেকে ছিল সম্পূর্ণতই শহর কেন্দ্রিক। এই আন্দোলনের কর্মীরা এসেছে মুলত শহরের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও শ্রমিকশ্রেণী থেকে। এবং এর সমর্থনের ক্ষেত্র প্রসারিত হয় মূলত দোদুল্যমান-সর্বহারার অংশগ্রহণে, যারা শাহ-এর কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষে ভূমি সংস্কারের ফলে গ্রাম থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরে এসে ভিড় জমায়। ১৯৬০ সালে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আধুনীকিকরণের অংশ হিসাবে শাহ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পুঁজিঘন কৃষি খামার গঠন প্রকল্প গ্রহণ করে যার ফলে দ্রুত নগরায়ন ঘটে (যা বেমগ ভুট্টোর ‘কৃষিনীতি নির্ধারক’রা পাকিস্তানের জন্য এখন সুপারিশ করেছে) এবং অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরে ভিড় জমাতে শুরু করে, সাংস্কৃতিক সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে এবং ক্রমাগত হারে বিকট বৈষম্য দেখা দেয়। উক্ত পরিস্থিতিই ইরানের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি রচনা করে এবং তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেও এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে থাকে, বিশেষ করে সেসব দেশে, যারা কোনো প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়াই নিজেদেরকে বাজার অর্থনীতির সাথে যুক্ত করতে চায়, ঠিক যেভাবে তারা একদা চেয়েছিল সমাজতন্ত্র নকল করতে।

iranian peoples support 2

সাধারণ ধর্মঘটকে প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে বিপ্লবী ক্ষমতা দখলের সাফল্যে ইরান এক অবশ্যপাঠ্য নজির স্থাপন করেছে। এই ধর্মঘট অব্যাহত ছিল ছয়মাস এবং এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ ধর্মঘট। শাহের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৮ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। যখন ইরানের আবাদান ও আহবাযের তেল শোধনাগারের শ্রমিকরা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং প্রমাণ করে দেয় যে, সাধারণ ধর্মঘট ঊনিশ শতকের মার্কসবাদী এবং সিন্ডিকালিস্টদের কল্পনারও অধিক ফলপ্রসূ। যেখানে তারা সাধারণ ধর্মঘটকে বিপ্লবী লড়াই সংগ্রামের একটি সংযোগ রক্ষক উপাদান হিসাবেই শুধুমাত্র গণ্য করে। পরবর্তীকালে দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিকারাগুয়া এবং ব্রাজিল সহ অন্যান্য দেশে সংঘটিত অনুরূপ ঘটনাপ্রবাহ এটাই প্রমাণ করে যে ইরানে যা ঘটেছিল তা একটি নতুন ধরনের প্রবণতার জন্ম দিয়েছিল।

ইরানি বিপ্লবোত্তর সময়কালে তৃতীয় বিশ্বের অনুগত স্বৈরশাসকদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হয়। এবং ঐ সকল দেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের পন্থা বেছে নেয়। ইরানই সর্বপ্রথম কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকার ব্যবস্থার অনুপযোগীতা দৃষ্টি গোচরে আনে যা বিশ শতকের ষাট ও সত্তর দশক থেকে পশ্চিমা দেশ সমুহ এবং যথাক্রমে কমিউনিস্টদের দ্বারাও আনুকুল্য পেয়ে আসছিল। উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিউবার পর ইরানের বিপ্লবই ছিল সর্বপ্রথম ফলপ্রসূ গণবিপ্লব। তবে বাতিস্তার অধীনে কিউবা থেকে শাহের অধীনে ইরান একটু ব্যতিক্রম ছিল। শাহের অধীনে ইরান পশ্চিমা বশংবদ একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহণ করেছিল। নিক্সন ডকট্রিনের আর আর আঞ্চলিক প্রভাবশালীদের (regional influential) মতন ইরানও ছিল একটি কেন্দ্রীভূত ও দমনমূলক সামরিক রাষ্ট্র। রেজাখান পাহলভীর (১৯২৫-৪১) ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে আধুনিকায়নের ছদ্মাবরণে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র (oriental despotism) ইরানে তার যাত্রা শুরু করেছিল। ইরানের তৈল, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং ভিত্তিহীন এক রাজবংশের কায়েমী স্বার্থ এসব মিলে ইরানের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতন্ত্র আরও সুদৃঢ়রূপ লাভ করে।

reza sha

পাহলভী শাসনের শেষ দিকে ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি (regional power) হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্ধিতহারে তৈল উত্তোলন, শাহের অবাস্তব উচ্চাভিলাষ এবং নিক্সন ও জিমি কার্টারের সময়কার মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয় এক্ষেত্রে ইরানের সহায়ক হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও কর্পোরেশনগুলোর নিকট ইরান ছিল একটি আদর্শ মিত্র। যে তার তেলসমৃদ্ধ উপসাগর পাহারা দেয়ার জন্য ব্যয়বহুল মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র নগদ টাকায় মুক্ত হস্তে ক্রয় করত, এবং যা ছিল একটি পশ্চিমা ঘেরা স্বৈরতান্ত্রিক স্থিতিশীল দ্বীপ (Island of stability); মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমিকার্টার বিপ্লব শুরু হওয়ার একমাস পূর্বে ইরানকে এই নামেই আখ্যায়িত করেন। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতোই পাহলভী শাসনের উপরিকাঠামো ইরানের সমাজের অভ্যন্তরভাগকে স্বাভাবিকভাবে খুব কমই প্রভাবিত করতে পেরেছে, যার সাথে প্রায় কোনো সপ্রাণ সর্ম্পকই রচিত হয় নি। কেননা, সমাজের প্রয়োজনসমুহ যথাযথভাবে পূরণ করা এবং এর চাহিদা সমুহের সাথে খাপ-খাওয়ানো এবং তার অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সমুহের সাথে তাল-মিলিয়ে স্থিতিশীলতা বাজায় রাখা; এসব কোনোটারই সামর্থ্য বা কর্মদক্ষতা এবং দূরদর্শীতা পাহলভী সরকারের ছিল না। ফলে জনগণের জন্য পাহলভী সরকার ও রাষ্ট্র একটি গলগ্রহ হয়ে ওঠে যা তারা আর বহন করতে পারছিল না। তাই এদের উৎখাত করার যে আন্দোলন তা ব্যাপক জাতীয় ঐকমত্য লাভ করে। যা ইতিহাসে সত্যিই বিরল। ঠিক একই রকম অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের আরও অনেক দেশে ভিন্নমাত্রায় বিরাজ করছিল। ইরানি বিপ্লবের কিছুদিন পরপরই দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনায় গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। এবং আলজেরিয়া ও মিশরে এখন বিদ্রোহ চলছে।

ইরানের শাহের পতন সাক্ষ্য দেয় যে, ব্যয়বহুল ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিস্তার রাষ্ট্রেকে অসহনীয় বলপ্রয়োগকারী ও যন্ত্রণাদায়কে পরিণত করে। একটি নিরবচ্ছিন্ন গণঅভ্যুত্থানের মোকাবিলা করতে গিয়ে ইরানের সাড়ে চারলাখ সদস্যের এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল। সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীর ননকমিশন্ড অফিসার ও টেকনিশিয়ানরা বিদ্রোহ করেছিল; অনবরত অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আমদানির ফলে ১৯৭২ সাল থেকে এদেরকে ব্যাপক হারে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া এই সৈনিক বিদ্রোহ টেকনিশিয়ান ও বিমানবাহিনীর ক্যাডেটদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহীরাই পাহলভী বংশের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

ইরানি বিপ্লবের ক্ষেত্রে একটি অসাধারণ বৈপরিত্য লক্ষ্য করা যায়। তা হলো, এই বিপ্লবের ঐকান্তিকতা, ব্যাপ্তি এবং সামাজিকভাবে সংগঠিত যে গোষ্ঠী এতে যুক্ত হয়েছিল; সেসব দিক বিবেচনায় ইরানি বিপ্লব ছিল সবচেয়ে আধুনিক এবং বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনায় তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসরমান বিপ্লব। অথচ, বিপ্লবী ক্ষমতা হস্তগত করে ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিরর ধারক একটি ধর্মীয় নেতৃত্ব; যারা মধ্যযুগীয় সাংস্কৃতিক বোধ এবং প্রতিশ্রুত অনাগত ঐশ্বরিক স্বর্ণযুগে বিশ্বাস করে। অধিকাংশ পন্ডিতকুলেদের মতে একমাত্র শাহের দমন-পীড়নের ফলেই এমনটি ঘটে ছিল। শাহের শাসনামলে একমাত্র মসজিদেই জমায়েত হওয়া ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল, এবং কারণের মধ্যে আরেকটি ছিল ইরানের শিয়া ঐতিহ্য (শহিদী জজবা এবং আয়াতুল্লাহদের ক্ষমতা)।

সাম্প্রতিককালে ইরানি বিপ্লবের ক্ষেত্রে শিয়া ধর্মতত্ত্ব ও এর ধর্মতাত্বিক যাজকীয় প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও ক্ষমতার উপর গুরুত্ব প্রদান করে যেভাবে আলোচনা করা হয় তা অতিরঞ্জিত এবং বিভ্রান্তিকর। তবে এ বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় ধর্মতাত্ত্বিক উলেমাদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব অর্জনের স্পষ্টতর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে আন্তোনিও গ্রামসি কথিত অসামঞ্জস্য-উন্নয়ন পরিবেশে গড়ে ওঠা আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক শক্তির ক্ষমতা বিষয়ক আলোচনায়। গ্রামসির উক্ত ধারণা আমাদেরকে এও বুঝতে সহায়তা করে যে, কিভাবে মানব ও বৈষয়িক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশে এতো শক্তিশালী একটি বিপ্লব বিয়োগান্তকভাবে বিপথে চলে গেছে। যদিও এই বিষয়টা একবারেই ভিন্নতর এবং অনেক জটিল একটি প্রসঙ্গ।

তরজমা: মাহবুবুল আলম তারেক

সূত্র:

'Iran's Landmark Revolution: Fifteen Years Later' in The Selected Writings of Eqbal Ahmad.Edited by Carollee Bengelsdorf, Margaret Cerullo, and Yogesh Chandrani. Columbia University Press.2006.


Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি

View: 6141 Posts: 1 Post comments

ইরানের বিপ্লব

বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। একবাল আহমেদ তার সমসাময়িক বিশ্বের ঘটনাঘটন বিশ্লেষণে তুখোড়। প্রায় ক্ষেত্রেই তিনি ঘটনার তাৎক্ষণিক ফলাফল ও সদূরপ্রসারি পরিণতি বুঝতে ভুল করতেন না। মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কিত তার লেখনিই প্রমাণ। যদিও ‘আধুনিক’ ও সেক্যুলার ভাবধারার প্রতি তার অতি আস্থা এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্বিচার বিশ্বাস তাকেও আর দশজনের মতো তার সময়কালের মধ্যে তৈরি হওয়া ইতিহাসের নতুন উপাদান ও গতিপ্রবাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণায় পৌছাতে সাহায্য করেনি। ইরানের বিপ্লবকে তিনি যেভাবে যুগান্তকারি এবং ফরাসি বিপ্লবের সাথে তুলনা করে এর ফলাফল ও ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন সেটা নিসন্দেহেই অসাধারণ। কিন্তু ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মোড় ফেরানোর বাইরে সেটা আর অগ্রসর হতে পারেনি। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন রাজনৈতিক কর্তাসত্তার আর্বিভাবের শর্ত তৈরি করেছে ইরানের এই ঘটনা তাতেও তার দৃষ্টি পড়েনি। তার স্বভাবসুলভ বিশ্লেষণে আন্দোলনের চরিত্র ও কৌশল নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন এবং অত্যন্ত সাহসের সাথে দাবি করেছেন যে এটা আর সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য একটা অভিজ্ঞতা তাতে একবাল আহমদকে খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু যেখানে একবাল আহমদের চোখ একবারের জন্যও পড়েনি, সেটা বেশ আশ্চর্যের, তা হলো ইরানের এই শহুরে মধ্যবিত্তের জাগরণে ও নের্তৃত্বে কিভাবে উলামা সম্প্রদায়ের কার্যকর প্রভাব এবং অভ্যুত্থান পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠেছিল সেই বিষয়ে তার ভাবনার অভাব। ইরানের অভ্যন্তরীণ মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক মেলবন্ধনের সুনির্দিষ্ট একটা প্রক্রিয়া ছিল। ইসলাম একটা বিপ্লবী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম কিনা এবং পশ্চিমা ইতিহাসের বাইরে দাড়িয়ে তার সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশিক সাংস্কৃতিক বোধ-চেতনার বিরুদ্ধে বিপ্লবের অভিমুখকে পরিচালিত করা সম্ভব কিনা সেইসব বিতর্কগুলো বেশ জোরালোভাবেই হাজির ছিল। সব যে ফয়সালা হয়েছিল তা অবশ্য নয়। তাছাড়া বেশ জোরের সাথেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা তখন উচ্চারিত হয়েছে। যেটাও ইসলামি আন্দোলনের চরিত্রে আধুনিকতার সাথে বিরোধের আর একটা পাটাতন ছিল। ইরানের জন্য যেটা ছিল সেখানকার বামপন্থী বা তুদে পার্টির সাথে মূল বিকর্ত। এগুলোতে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত আলী শরীয়তির মতো লোকরাই কেবল অংশগ্রহণ করে নি বরং শিয়া আলেমদের মধ্যে থেকে আয়াতুল্লাহ মুতাহ্হারি বা বেহেশতির মতো উলেমারাও অংশ নিয়েছিল। মতাদর্শিক বোঝাপড়া নির্মাণের লড়াইয়ের ভিতর দিয়েই নিজেদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে তারা সংহত করেছিল। পিছন থেকে এসে পাল্টা ক্যু করে গণআন্দোলনের ফসল কুক্ষিগত করে নি। এমনকি, সরকার পরিচালনা ও পররাষ্ট্রনীতি (মার্কিন দূতাবাস সংকট, রাশিয়ান ইস্যু ইত্যাদি) নিয়ে যখন তুদে পার্টিসহ অপরাপর বামপন্থীদের সাথে বিরোধ তৈরি হয়, যা শেষপর্যন্ত রক্তাক্ত সংঘাতের রূপ নেয় তাতেও খোমেনির অনুসারীদের প্রতি জনগণের সমর্থন এবং আস্থায় বিশেষ চির ধরে নি। কিংম্বা কোনো কার্যকর প্রতিরোধের মুখোমুখিও হতে হয় নি। এটা অবিকশিত বা অসম-উন্নয়নের মাঝে পশ্চাৎপদ সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতিবন্ধকতা বলে যে সংক্ষিপ্ত রেফারেন্স আন্তোনিও গ্রামসির বরাতে তিনি পেশ করেছেন তা সঠিক নয়। ঠিক একই কারণে তার কাছে মনে হয়েছে আধুনিক জমানার এতো বৃহৎ ও বিপুল প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি বিপ্লবের অনাকাক্ষিত গন্তব্যে যাত্রা করতে হয়েছে। একবালও শেষপর্যন্ত গৎবাধা ‘মোল্লা’ ও ‘মাল্লাতন্ত্র’ বিষয়ক চিন্তার বাইরে যেতে পারেন নি। এক্ষেত্রে, মিশেল ফুকোর পর্যবেক্ষণ উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। ফুকো বরং অনেকদূর অগ্রসর হয়ে, প্রেজুডিস মুক্ত হয়ে চিন্তা করতে কামিয়াব হয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে নি, তার কারণও ছিল।
Home
EMAIL
PASSWORD