ইওরোপে ভয়ের সংস্কৃতি


পঙ্কজ মিশ্র
Tuesday 06 October 09

অতি সাম্প্রতিক সময়ে ইওরোপে বাজার-পাওয়া (বেস্ট-সেলার) অনেকানেক বইয়ে দাবি করা হয়েছে যে মহাদেশটি তার মুসলিম জনসংখ্যা কর্তৃক ঔপনিবেশিকীকরণের শিকার হওয়ার ঝুকির মধ্যে আছে, এবং নতুন এই বইগুলো সেখানকার রাজনীতির ময়দানে প্রশংসিত হয়েছে। এমনতরো বিকারগ্রস্থ চিন্তাকে কিভাবে চ্যালেঞ্জ না করে ছেড়ে দেয়া যায়? বৃটেনের দৈনিক দি গার্ডিয়ান-এ গত ১৭ আগস্ট প্রকাশিত আর্টিকলটিতে ইওরোবিয়া-ব্যাবসায়ীদের প্রতি সেই চ্যালেঞ্জ-ই ছুড়ে দিয়েছেন বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাসরত ভারতীয় লেখক পঙ্কজ মিশ্র

আর্টিকলটির সংক্ষেপিত তরজমা করেছেন মোহাম্মদ আরজু

ইওরোপ কি মুসলিমদের দ্বারা দখল হয়ে গেছে? ইওরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু সংখ্যক বিখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিক এরকমটি ভাবছেন বলে মালুম হচ্ছে। ঐতিহাসিক নিল ফার্গুসন আগাম বলে দিয়েছেন যে ইওরোপে উপনিবেশ গড়ার জন্য ভূমধ্যসাগরের দক্ষিন ও পূর্বে এক নওজোয়ান মুসলিম-সমাজ প্রস্তুত হয়ে আছে। এবং ক্রিস্টোফার ক্যাডওয়েল এর মতে মুসলিমরা ইতোমধ্যেই ইওরোপের রাস্তাকে রাস্তা শহরকে শহর জয় করে ফেলেছে। ক্যাডওয়েল হচ্ছেন ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর একজন সাংবাদিক, আমেরিকান, যাকে সম্প্রতি বৃটেনের দৈনিক দি অবজারভার বর্ণনা করেছে ‘‘ইওরোপের ধর্মাচরণ বিষয়ে নিরেট, সাফ-নজরওয়ালা বিশ্লেষক’’ হিশাবে। সুতরাং মুসলিমরা ইওরোপীয় ইউনিয়ন-এর (ইইউ) মোট ৪৯৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৩ থেকে ৪ ভাগ হলেই বা কি? ‘‘সাফ-নজরওয়ালা বিশ্লেষক’’ এর মত বলে কথা! আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে ক্যাডওয়েল এর যে বইটি বাজারে এসেছে-- রিফ্লেকশন্স অন দি রেভ্যুলেশন ইন ইওরোপ: ক্যান ইওরোপ বি দি সেইম উইথ ডিফরেন্ট পপুলেশন ইন ইট?- এ লিখেছেন ‘‘সংখ্যালঘুরা অবশ্যই দেশের আদল গড়তে পারে, তারা দেশ জয় করতে পারে। আজকের ইওরোপে যে পরিমান ইসলামপন্থী আছে তার চেয়ে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সম্ভবত অনেক কম পরিমান বলশেভিক ছিল।’’ নিউইয়র্ক টাইমস বইটির প্রশংসা করেছে ‘‘নৈতিকভাবে চিন্তাশীল’’ হিশাবে আখ্যায়িত করে।

immigration islam and westআলতো করে দেখলে মনে হতে পারে শুধু ইসলামপন্থী বিপ্লবীরাই নয় বরং দ্রুত বংশবিস্তাররত মুসলিমরাও ইওরোপকে ‘‘ইওরোবিয়া’’তে (ইওরোপ+অ্যারাবিয়া=ইওরোবিয়া) রুপান্তরিত করছে। কিন্তু ফিনান্সিয়াল টাইমস-এরই সাম্প্রতিক জরিপে প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে; ইওরোপে অভিবাসী মুসলিমদের জন্মহার কমছে এবং বর্তমান জন্মহার জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি নয়; কিন্তু ক্যাডওয়েল তার বইটিতে দাবি করছেন ‘‘অগ্রসর’’ সংস্কৃতির ‘‘দীর্ঘ নজির আছে ‘আদিম’ যেকোনোটির তরফে আসা হুমকি থেকে নিজের অরক্ষিতাবস্থাকে খাটো করে দেখার।’’ বৃটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ উদ্ধৃত করেছে যে আগস্টের দ্বিতীয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্যাডওয়েল টেলিভিশনে বলেছেন, বৃটেন ও ইইউ নিজেদের ঘরের মাঝের ‘‘জনগোষ্ঠীর টাইম বোমা’’ নিছক অবহেলাভরে দেখছে। ক্যাডওয়েল এটাও নিশ্চিত করে বলেছেন যে ‘‘মুসলিম সংস্কৃতি এমন সব বার্তায় ভরপুর যেগুলো বংশবৃদ্ধি করার নগদানগদ সুবিধের কথা বলা আছে’’, এবং তার কথানুযায়ী--ফিলিস্তিনিরা যতটা ঘৃণা করে ইজরাইলকে ততটা ঘৃণা যদিও মুসলিমরা ইওরোপকে করে না, কিন্তু তাতে কি? ইয়াসির আরাফাত কি ফিলিস্তিনি নারীদের গর্ভকে তার লড়াইয়ের ‘‘লুকায়িত অস্ত্র’’ বলেন নি? একটি বিশ্বাসঘাতক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে লালন-পালন করার বেয়াকুবিপনার জন্য ইওরোপের কি প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত বা কি প্রায়শ্চিত্ত মহাদেশটি করবে সে হিশাব-নিকাশটুকু আর করেননি ক্যাডওয়েল।

বৃটেনের বর্ষীয়ান ও জনপ্রিয় লেখক মার্টিন অ্যামিস যাকে ‘‘অকথ্যের মহান কথক’’(গ্রেট সেয়ার অফ দি আনসেয়েবল) বলে প্রশংসা করেছেন সেই কানাডার সাংবাদিক মার্ক স্টেয়েন তার বাজার-পাওয়া বই আমেরিকা এলোন: দি এন্ড অফ দি ওয়াল্ড অ্যাজ উই নো ইট-এ সেই প্রায়শ্চিত্তের কথা বলে ফেলতে ইতস্তত করেন নি; একটি গণতান্ত্রিক সময়ে গৃহযুদ্ধ ছাড়া আপনি কোনো জনগোষ্ঠীকে স্রেফ ছুড়ে ফেলতে পারেন না। সার্বরা অনেক চিন্তা করে এই ফায়সালা করে ফেলেছে-- মহাদেশের অন্যান্যরা সামনের বছরগুলোতে যেমনটি করবে: আপনি যদি শত্রুর বংশবিস্তার রোধ করতে না পারেন তবে তাদের স্রেফ রোগাক্রান্ত মুরগীর মতো জবাই করে ফেলুন। এবছরে ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড এর জন্য মনোনীত হওয়া বই-- হোয়াইল ইওরোপ স্লেপ্ট: হাউ র‌্যাডিকাল ইসলাম ইজ ডেস্ট্রয়িং দি ওয়েস্ট ফ্রম উয়িদিন-এর লেখক ব্রুস বাউয়ের এর মতে ইওরোপের যেসব কর্তাব্যক্তিরা আজ ‘‘প্লেনভর্তি লোকজনকে তাড়ানোর পরিস্থিতিতে আছেন’’ তারা ‘‘আগামীতে ইওরোপকে উদ্ধার করতে পারবেন।’’

আসলেই এখন এমন রাজনীতিকও আছেন যারা সেই ‘‘অকথ্য’’ কাজটি করতে প্রস্তুত। ডাচ সংসদ সদস্য গার্ট ওয়াইল্ডার্স ইওরোপ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন মুসলিমকে বহিস্কার করার প্রস্তাব করেছেন, যার দল এ বছরের জুনে ইওরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী বড় ডানপন্থী দলগুলোর একটি। এই বহিস্কারের লক্ষ্যে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের প্রস্তাব অস্ট্রিয়ার উগ্রডানপন্থী দলগুলো কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে, যারা গত বছরের নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটের নজিরবিহীন ২৯ ভাগ পেয়েছে। যদিও ইওরোপের অনেক রাজনীতিক ও ভাষ্যকার মুসলিম নারীদের হেডস্কার্ফ-কে (ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে গ্লাকসম্যান-এর ভাষায় যা কিনা ‘‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’’) নিন্দা করতে কিংবা বর্তমানে আমেরিকার একটি নয়া-গোঁড়া (নিও-কনসারভেটিভ) থিঙ্কট্যাঙ্ক-এ চাকুরিরত সোমালি বংশোদ্ভুত ডাচ তর্কবাগীশ আয়ান হিরসা আলি’কে ইসলামের লুথার বলে মেনে নিতে নারাজ। কিন্তু বাউয়েরের নতুন বই সারেন্ডার: আপিজিং ইসলাম, স্যাক্রিফাইসিং ফ্রিডম এর বক্তব্য অনুযায়ী- এইসব সন্দেহবাদী রাজনীতিক ও ভাষ্যকাররা ‘‘ইসলামি-ফ্যাসিবাদ’’ দ্বারা বোকা বনে গেছেন। বাউয়ের লিখছেন-- যেই ‘‘ইসলামি ফ্যাসিবাদ’’ এর চিন্তা ‘‘অবশ্যই খোদ ওসামা বিন লাদেন কর্তৃক উদ্ভাবিত হয়ে থাকবে।’’

বিভিন্ন জরিপ ও মতামত জরিপে বারবারই এই সত্য প্রকাশিত হচ্ছে যে, গড়পরতা ইওরোপের মুসলিমরা আর্থিকভাবে দরিদ্র, সামাজিকভাবে রক্ষণশীল, বৈষম্যের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট কিন্তু সাধারণত তাদের সন্তান সন্ততির ভবিষ্যত নিয়ে তুষ্ট এবং আশাবাদী-- যে সন্তানেরা ধর্মীয় নয় এমন স্কুলে যায় এবং তাদের অন্য ধর্মের সহপাঠিদের আগ্রহের সাথে পসন্দ করে। এমনকি গ্যালপ-এর সাম্প্রতিক মতামত জরিপেও একই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। (গ্যালপ হচ্ছে দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠানটি ১৪০ টির বেশি দেশে কাজ করছে এখন।) ইওরোপজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্মহার শুরুর দিকে অনেক উচু হলেও তাদের পুরুষ ও নারীরা যত বেশি স্বাক্ষর হচ্ছে ততই সেই হার নীচুর দিকে নামছে। জাগতিক আধুনিকতা’র (সেকুলার মডার্নিটি) সহবত লাভ করে এইসব অভিবাসীর অনেকে মায়ের বুকের দুধ ছাড়ার মতো করে তাদের ঐতিহ্যগত বিশ্বাস ছাড়তে শুরু করেছে: ফ্রান্সে মুসলিমদের শতকরা মাত্র ৫ ভাগ নিয়মিত মসজিদে যায় এবং ইওরোপের অন্যত্রও নন-প্র্যাকটিসিং ‘‘সাংস্কৃতিক মুসলিম’’দের সংখ্যাই বেশি।

বারোমাস ধরে সন্দেহ আর অবমাননার লক্ষ্যবস্তু হয়ে বাস করার কারেণ হীনমন্যতার শিকার ইওরোপের সাধারণ মুসলিমরা নিজেদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী তো দূরের কথা এমনকি একই জামাতের বা সম্প্রদায়ের লোক বলে চিন্তা করার কিংবা ইওরোপের বিজয়ীদের আচরণ প্রসঙ্গে মুখ খোলার জায়গা থেকে অনেক দূরে আছে। তাহলে হোয়াইল ইওরোপ স্লেপ্ট, আমেরিকা এলোন, দি লাস্ট ডেজ অফ ইওরোপ মতো রমরমা বাজার-পাওয়া বইগুলো আসলে কি বয়ান করতে চাচ্ছে? এই বইগুলোর আমেরিকান নয়া-গোড়া লেখকদের অধিকাংশই মুসলিম সমাজের ব্যাপারে তাদের জানাশোনার ক্ষেত্রে পরিচিত ছিলেন না; তাদের সবাই এক ধরনের প্রতিবন্ধিত্বে ভুগছেন- যে প্রতিবন্ধিত্বকে দার্শনিক চার্লস টেলর তার সেকুলারিজম, রিলিজিয়ন অ্যান্ড মাল্টিকালচারাল সিটিজেনশিপ শীর্ষক নতুন এক প্রবন্ধ সংকলনে নাম দিয়েছেন ‘‘ব্লক থিংকিং’’ (সহজ করে বাংলায় যাকে ‘ছাচে ঢালা চিন্তাচর্চা’ বলা যায়), যে প্রক্রিয়ায় চিন্তা চর্চা করলে পরে ‘‘খুব আলাদা আলাদা বাস্তবতা একাকার হয়ে ব্যাখার অযোগ্য এককে পরিণত হয়’’।

অতএব ইওরোপ তার অধিবাসী মুসলিমদের দখলে গিয়ে আরাবিয়া হয়ে যাচ্ছে এই ভয় ইওরোবিয়া-ব্যবসায়ীরা ছড়িয়েই যাচ্ছে। এবং বৃটেনের চটকদার ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো যেভাবে নিজেদের স্থানীয় নিউজএজেন্ট ও কারি হাউসের মালিকদের সম্পর্কেও সাদা ইওরোপীয়ানদের মধ্যে ত্রাসের জন্ম দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেভাবেই আমেরিকার ইওরোবিয়া-ব্যবসায়ীরা নিজেদের মিশনে অটল। ক্যাডওয়েল লিখছেন, ‘‘গত অর্ধ-শতাব্দিতে বৃটিশ জনজীবনে এককভাবে বড় ধরনের জৌলুস বৃদ্ধির একটা যদি হয় পাকিস্তানি রন্ধনপ্রণালীর বিস্তার, তবে সেই সাথে এটাও উল্লেখ করার যোগ্য যে ২০০৫-এর ২১ শে জুলাইয়ে লন্ডনের পাতাল রেলের ওপর চালানো ব্যর্থ হামলায় যে বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল তা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও চাপাতি গুড়ার এক ধরনের মিশ্রন থেকে বানানো ছিল।’’

how radical islamঅথচ দক্ষিন এশিয়ার যেসব রন্ধন-প্রণালী বৃটিশ রাজপথে ভোজন রসিকদের স্বাদ মেটায় সেগুলোর অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে নয় বরং বাংলাদেশ কিংবা ভারত থেকে খোশ আমদেদ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। সে যাইহোক, ক্যাডওয়েল এই তথ্য দিতে চাননি যে, পরম আগ্রহে গেলা চাপাতিগুলো তার অনেক বৃটিশ পাঠকের গলা পর্যন্ত উপরে পড়ছে। যদিও ‘‘উনিশ শতকে’’ পাকিস্তানের অস্তিত্ব সম্পর্কে ক্যাডওয়েলের একটি বরাত যে কাউকে বিস্মিত করতে পারে যে তিনি তো তার খোয়াবের গালগল্প আলাদাভাবে বলতে পারতেন! এমনকি ইওরোপের ইতিহাসও তার আয়ত্তে যতটুকু আছে তাও খুব নাজুক বলে মালুম হচ্ছে: তিনি আমাদের বলছেন, ইতালি ‘‘উল্লেখযোগ্য ঔপনিবেশিক ইতিহাস না থাকা’’র দিক থেকে সুইডেনের মতো। ‘‘সাদা সভ্যতা’’র প্রতি ইসলামকে একটা হুমকি বলে আর্নেস্ট রেঁনে ও হিলারি ব্যালক-এর আতঙ্কবাজ লেখালেখির সাথে গলা মিলিয়ে সেসব থেকে তিনি যেভাবে উদ্ধৃত করছেন, তাতে মালুম হয়-- এই লেখকদ্বয় যে ইহুদিদেরকে ইওরোপে ‘‘ভিনগ্রহের’’ ছোটলোক বলে বর্ণনা করেছেন সে বিষয়ে তিনি বেখেয়াল। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে-- ক্যাডওয়েল যিনি কিনা নয়া-গোড়া পত্রিকা উইকলি স্ট্যান্ডার্ড এর সিনিয়র সম্পাদক, তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তিনি জানেন না যে তিনি যার কাছ থেকে নিজের বইটির নামটি ধার করেছেন সেই এডমন্ড বার্ক এর বাড়াবাড়ি রকমের ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল ‘‘মুহাম্মদি আইন’’ সম্পর্কে।

ঔপন্যাসিক ম্যাথিয়াস পলিটিয়েকি’র একটি প্রবন্ধ ‘‘হোয়াইট ম্যান, হোয়াইট নাউ’’ থেকে ক্যাডওয়েল উদ্ধৃত করছেন, ‘‘অজস্র শতাব্দিকাল পরে এই প্রথম বারের মতো ইওরোপীয়রা এমন এক দুনিয়ায় বাস করছে যে দুনিয়ার আদল তারা গড়েনি’’। হুঁশিয়ারির বিষয় হলো এই যে, দুনিয়ার আদল গড়ার দায়িত্ব এখন আমেরিকা নিজেই ভয় ও উদ্বেগসহ অন্যের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে; যদিও কখনো প্রকাশ্যে এই হস্তান্তর-ইচ্ছার কথা জানানো হয়নি। কিন্তু ‘‘আমেরিকা এলোন’’ ধরনের শোকগাথাগুলোর মতোই ক্যাডওয়েলের বইটির প্রতিটি পাতা কালো করে তোলা হয়েছে বর্ণ ও সভ্যতাগত নয়া দুশমনদের চেহারা তুলে ধরে তাদের বিরুদ্ধে ইওরোপীয়দের মনোবল বাড়ানোর জন্য। ক্যাডওয়েলের চেয়ে আরো চিন্তাশীল কোনো নয়া-গোড়া চিন্তক হয়তো গুরুত্বের সাথে তলিয়ে দেখতে পারতেন যে নয়া-উদারবাদী পূঁজিবাদ যখন ইওরোপের ক্রান্তিকালীন অভিজাতদের বিত্তবান বানাচ্ছে তখন তা কিভাবে মহাদেশটির পুরনো সংস্কৃতি ও সংহতিসমূহকে কুরে কুরে ক্ষয় করে ফেলছে। গোলকায়ন (গ্লোবালাইজেশন) এখন ভারত কিংবা চীনের মতো ইওরোপেও বেকারত্ব ও অসাম্যের ব্যাপারে বিস্তর উদ্বেগ উসকে দিয়েছে, অন্য জাতিবিদ্বেষী নয়া-জাতীয়তাবাদ এবং নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিরুপ আচরণের পেছনে মদদ যোগাচ্ছে। সামাজিক নৃতাত্ত্বিক (সোশ্যাল অ্যানথ্রপোলজিস্ট) অর্জুন আপ্পাদুরাই তার ‘‘ফিয়ার অফ স্মল নাম্বারস: অ্যান এসে অন দি জিওগ্রাফি অফ অ্যাংগার’’ শীর্ষক প্রবন্ধে যেমনটি দাবি করেছেন যে; অল্পসংখ্যক শক্তিমান রাষ্ট্র, নিয়ন্ত্রণহীন অর্থনৈতিক প্রবাহ ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আপসের এই দুনিয়ায় অনেক রাষ্ট্রেরই নিজস্ব লঘুত্ব ও প্রান্তিকতা (বাস্তব অথবা কল্পিত) সম্পকির্ত পেরেশানি আড়াল করার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অর্জুনের এই বক্তব্য কিছুটা হলেও সেই জবাব দেয় যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে জাতি-রাষ্ট্রটির ভূ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বহীনতা কেবল দেশটির অতিসক্রিয় রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজির বদৌলতে কিছুটা আড়াল হয়ে আসছে সেই দেশটিতে ঠিক কেন হাতেগোনা কিছু নারীর হেডস্কার্ফ এতো প্রবল হিংস্রতা উস্কে দেয়।

প্রকৃতপক্ষে, ইওরোপে অধিকাংশ মুসলিমের প্রতিদিনের পসন্দ-নাপসন্দ যতটা তাদের কুরআন বা শারিয়াহ’র বুঝ দ্বারা নির্দেশিত হয় তার চেয়ে অনেকানেক বেশি নির্দেশিত হয় গোলকায়িত অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে। পূর্ণ এবং সমমর্যাদার নাগরিকত্ব প্রত্যাশী এই মুসলিমদের অনেকের সামনেই জরুরী প্রশ্ন হলো-- অনেক ইওরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের পুরনো ধাঁচের উদারনৈতিকতাবাদ (যা ঐতিহ্যগতভাবে সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তা ধারণ করে বেড়ে উঠেছে) সংখ্যালঘুর পরিচয়সত্ত্বাকে জায়গা দিতে পারবে কি না এবং ইওরোপের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়সমূহ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের আলামত সহ্য করতে পারবে কি না। এসব প্রশ্নে ইওরোপের জাগতিকতাবাদী (সেকুলার) বুদ্ধিবৃত্তিক মুরব্বীদের একাংশের জবাব হচ্ছে-- ‘‘না’’। তাদের দাবি হচ্ছে পুরোপুরি ইওরোপীয় হওয়ার লক্ষ্যে মুসলিমদের অবশ্যই তাদের ধর্মীয় সকল চিহ্ন ত্যাগ করতে হবে।

আত্মপরিচয়ের আত্মহত্যা’র এই দাবি’র আরো নির্মম ইতিহাস ইওরোপে আছে। দার্শনিক ভলতেয়ার ‘‘জাহেল’’ ও ‘‘বর্বর’’ ইহুদীদের আক্রমণ করে যুক্তিবোধ ও সভ্যতার রক্ষক হিশাবে তার কৃতিত্বকে আরো উজ্জ্বল করেছিলেন। তার ভাষায় এই ইহুদীরা তাদের খোদায়ী কিতাবের দাস এবং ‘‘এরা সবাই তাদের অন্তরে প্রবল উন্মত্ততা নিয়ে জন্মেছে’’ (নাৎসিরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাদের বক্তৃতাবাজিতে ভলতেয়ারের রচনাবলীর বিশাল অংশ ব্যবহার করেছিলো)। আজকের ফ্রান্সে মুসলিমরা নিজেদের নারীদের সাথে অসদাচরণ ও চাতুর্যপূণ দ্রুততার সাথে বংশবৃদ্ধি করার যে অভিযোগে অভিযুক্ত এবং তারা নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তল্পিতল্পা ছাড়তে যে যন্ত্রণাপূর্ন তাগাদা মোকাবিলা করছে, এই একই রকমের ‘সমন্বয় প্রক্রিয়া’র আরো চরমতম মূল্য দিতে হয়েছে ১৯ শতকের জার্মানির ইহুদিদের। বিতাড়নের পালা শেষে যেসব ইহুদী তাওরাত ও তালমুদ চেপে রেখে কঠোরভাবে বুর্জোয়াকরণ প্রক্রিয়ার নিজেদের সঁপে দিয়েছিল, সমাজের মধ্যে হজম (অ্যাসিমিলেশন) হয়ে যেতে চেয়েছিল, তারাও আলোজ্বালায়ন (এনলাইটমেন্ট) পরবর্তী ইওরোপীয় ইহজাগতিকতাবাদী (সেকুলার) জাতি-রাষ্ট্রগুলোতে শুধু তাদের সম্পর্কে চালু থাকা পূর্বধারণার কারেণ অরক্ষিত হয়ে রইলো।

muslim in europeফ্রান্সের জেন্ডার ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং ২০০৭ এ প্রকাশিত ‘‘পলিটিকস অফ ভেইল’’ বইটির লেখক জোয়ান ওয়ালশ স্কট-এর দেয়া ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক ইতিহাস বিষয়ক ব্যাখ্যা এই বাস্তবতা প্রকাশ করে যে, বর্ণ বা ধর্মের দিক দিয়ে যারা ‘‘অপর’’ তাদের বিরুদ্ধে সহিংস থাকার পূর্বসিদ্ধান্ত হচ্ছে ইওরোপিয় সভ্যতা ও নীতিবিদ্যা বাইরে বিস্তার করার প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফ্রান্স হিজাবকে ইসলামের আদিম মুখিনতার প্রতীক হিশাবে ধার্য করে এটাকে সেসময় তাদের উপনিবেশে-- উত্তর আফ্রিকায় মুসলিমদের নিষ্ঠুরভাবে ‘‘শান্তকরণ’’ ও তাদের পূর্ন নাগরিকত্বের বাইরে রাখার ন্যায্যতা দিয়েছিলো। সেকুলারিজম, রিলিজিয়ন অ্যান্ড মাল্টিকালচারাল রিলেশনশিপ-এর সম্পাদকদ্বয়, জিওফ্রে ব্রাহম লিভি ও তারিক মওদুদ যেমনটি লিখেছেন; ‘‘ইওরোপীয় সাম্রাজ্যসমূহ ও সেসবের বর্ণবাদী আধিপত্যশালীরা মুসলিমদের যেভাবে দেখতো ও ব্যবহার করতো এবং আজকে মুসলিমদের ইওরোপে যে দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয়-- এ দুয়ের মাঝে যোগসূত্র আছে।’’

ঐতিহাসিকভাবে, বিশেষত যখন ইওরোপের বিভিন্ন অংশে বসবাসরত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের, যাদেরকে এই সমাজে হজম করা অসম্ভব বলে একসময় ভয় ছিল সেই ইহুদি-ইতালিয়-পর্তুগিজ ও কালো আদমিদের সাথে তুলনা করলে মুসলিমদের ইওরোপে একেবারেই হাল আমলের উপস্থিতি বলতে হয়। ‘‘অস্থায়ী মজুর’’ হিশাবে ওইসব সংখ্যালঘুদেরও শুরু দিককার সময়ে খুব কমই সহ্য করা হতো এবং ভাবা হতো সমাজে তাদের দ্রুত সমন্বিত করার পরিস্থিতি তৈয়ার কখনো করা যাবেনা। একটা নওজোয়ান, গোলকায়িত (গ্লোবালাইজড) এবং উচু মাত্রায় রাজনৈতিক প্রজন্ম থেকে আসা মুসলিমরা এখন তাদের জন্য উন্মুক্ত জনপরিসরে প্রবেশ করতে, অথবা উগ্রপন্থা গ্রহণ করতে, অথবা তাদের মাতাপিতার মতো পিছু হটে অপ্রতিরোধী অসন্তোষের মধ্যে জীবন যাপন করতে প্রস্তুত। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোন পথটি এ প্রজন্মের মুসলিমরা পসন্দ করবে তা নির্ভর করছে মুসলিমদের মেজবানরা-- সাধারন ইওরোপিয়রা এবং একই সাথে ইওরোপীয় সরকারগুলো কেমন দ্রুততার সাথে ও সানন্দে তাদের জন্য মহাদেশটিতে আপন ঘরের মতো স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি তৈয়ার করবে। ঔপন্যাসিক জোসেপ রস ১৯৩৭ সালের এক লেখায় তখনকার ইওরোপের সবচেয়ে নিগৃহীত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ‘‘ইহুদিরা কেবল তখনই পূর্ণ সাম্য ও বাহ্যিক মুক্তির মর্যাদা অর্জন করবে। যখন ‘মেজবান জাতিসমূহ’ তাদের নিজেদের অন্তরনিহিত মুক্তি এবং একই সাথে (অপরের মুসিবতে দরদ দেখিয়ে) মর্যাদা অর্জন করবে।’’ ১৯৩৭ সালের ইওরোপের কাছে এই চাওয়া খুব বেশি বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু এই নৈতিক চ্যালেঞ্জ শেষ হয়ে যায় নাই-- একটি অপরিবর্তনীয় অর্জনে পরিণত হওয়ার বদলে সভ্যতা এখনো আদর্শের বুলি হয়ে রয়েছে-- এবং এটাকে মোকাবিলা না করে এভাবে ফেলে রাখার যে খেসারত হবে তা অপরিমেয়।

.....................................

ফটো ক্যাপশন ১. পঙ্কজ মিশ্র।

ফটো ক্যাপশন ২. অতি সম্প্রতি ইওরোপে রমরমা বাজার পাওয়া বইগুলোর কয়েকটির প্রচ্ছদ। ইওরোপ ও আমেরিকার নয়া-গোড়া লেখকদের এই বইগুলো ‘ইওরোবিয়া’র ভীতি ছড়াচ্ছে।

ফটো ক্যাপশন ৩. ইওরোপের এই নওজোয়ান, গোলকায়িত (গ্লোবালাইজড) এবং উচু মাত্রায় রাজনৈতিক প্রজন্ম থেকে আসা মুসলিমরা এখন তাদের জন্য উন্মুক্ত জনপরিসরে প্রবেশ করতে প্রস্তুত। কিন্তু নয়া-গোড়া সাংবাদিক ও রাজনীতিকরা এদের ইওরোপের শত্রু আখ্যায়িত করে বলছেন-- আপনি যদি শত্রুর বংশবিস্তার রোধ করতে না পারেন তবে তাদের স্রেফ রোগাক্রান্ত মুরগীর মতো জবাই করে ফেলুন।

View: 4321 Posts: 2 Post comments

politics of fear

ইউরোপের এই ভাবনাগুলো নতুন কিছু নয় বলেই আমার মনে হয়। প্রফেসর হান্টিংটন এর "clash of civilization" থিওরিকে আরেকবার ইউরোপের গলধঃকরন করানোর প্রচেষ্টাই করছে নব্যরক্ষনশীলেরা। তার জন্য যে জুজুর ভয় দেখানো হচ্ছে তার গোড়া আসলে খুজতে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে। এই কথাগুলো না বললে আসলে যুক্তরাষ্টের ওয়ার অন টেরোরিজম এর ফাইটা আর হালে পানি পাবেনা। নতুন করে যে যুদ্ধটা আমেরিকা ঘনীভূত করতে চাচ্ছে এই দক্ষিন এশিয়ায় তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচারনার অংশ হিসেবে তার "fanatic islam" এর ইউরোপ বিজয়ের গল্প ফাদতে হচ্ছে। এটাই প্রমান করে ইউরোপের দেউলিয়াপনা কোথায় গিয়ে থেকেছে।

না। ভাবনা তো মোটেই নতুন না। গত তিন বছরে জনপ্রিয় হৈছে এমুন প্রবন্ধ এবং রাজনৈতিক কলামে বিষয়টা ক্যামনে আইছে সেইটাই মিশ্র ইলাস্ট্রেইট কর্ছেন।
Home
EMAIL
PASSWORD