নাট্যচর্চায় ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র আহাজারি, ইতিহাসের বয়ান অথবা ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িকতার পুনরাবৃত্তি


কামাল উদ্দিন
Wednesday 07 October 09

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের পাঁচজন প্রতিনিধির পাঁচটি নাটক নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। এই সংকলনটির সাথে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও জড়িত, বিশেষ করে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সৃজনশীল তরুণ নাট্যকার কর্মশালার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ঐ কার্যক্রমেরই একটা পরিণত রূপ এই পাঁচ তরুণের একত্রে পাঁচটি নাটকের সংকলন। তবে সংকলনভূক্ত নাটকগুলোর মধ্যে ঢাকার মঞ্চসহ একাধিকবার বিটিভিতে প্রচারিত নাটকটি হলো “বিভাজন”। নাট্যকার রুমা মোদক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাতচল্লিশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পটভূমি, রাজনৈতিক পক্ষ, মতাদর্শ ও ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপাদান দিয়ে ‘বিভাজন’ নাটকটি রচনা করেছেন।

নাটকটিতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, মূলত কিছু লোকের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতেই হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে অখণ্ড ভারতকে বিভক্ত করা হয়; ফলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। এই বর্ণনা বা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি নতুন নয়। সিদ্ধান্তের উৎস, অভিষ্ঠও পুরনো। তবু আমরা এখানে এই নট্যকারের ইতিহাস বোধ, বয়ানের উদ্দেশ্য ও সাংস্কৃতিক রূপায়নকে আলোচনার জন্য বাচাই করেছি। কারণ, আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে সাংস্কৃতিক চর্চা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবাদী চৈতন্য, ইতিহাস-উত্তরাধিকারের পথসন্ধান, আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার স্বীকৃতির জন্য লড়াইয়ের নানান দাগ ও গৌরবের চিহ্নগুলো কোন অর্থ কিভাবে তৈরি করছে তাকে শনাক্ত করা জরুরি। আমরা একইসাথে দেখতে চাই, বর্তমান প্রজন্মের এইধারার সংস্কৃতিজীবিদের কাছে আদৌ ঔপনিবেশিক মনোগঠনপুষ্ট প্রগতিশীলতা ও ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র চর্বিতচর্বনের বাইরে এসে দাঁড়ানোর তাকত অর্জিত হয়েছে কিনা। বিদ্যমান লড়াই-সংগ্রাম ও নিপীড়িত শ্রেণীর মুক্তির প্রশ্ন ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট পর্বে যে রূপ ও আকার নিয়ে-- যে অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়-- তাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে ঐতিহাসিক গতিপ্রক্রিয়ার মধ্যে অনুধাবনের কোনো প্রয়াশ আছে কিনা; সেদিকটাও আমরা খতিয়ে দেখতে চাই। কারণ পূর্ববাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আলাদা রাষ্ট্রগঠনের দাবি, প্রয়োজন ও আকাক্সক্ষা পরিপূরণের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল যে পাকিস্তান আন্দোলন সেই বিশেষ কালপর্বের ইতিহাসই আলোচ্য নাটকের উপজিব্য।

১.

নাটকটি বর্তমান বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের উত্তর-পূর্ব অংশের কোনো এক জমিদারকে কেন্দ্র করে ৪৭-এর আগে-পরের কিছু ঘটনা পরম্পরায় রচিত হয়েছে। নাটকের কাহিনী সংক্ষেপ এরকম: জমিদার পুত্র শশী কিশোর একটি টিয়া পাখিকে পোষ মানাতে সারাক্ষণ ব্যস্ত। নাওয়া-খাওয়ায় মন নেই তার। মাস্টার মশাই বন্দী পাখিকে মুক্ত করতে বলায় পাঠশালা যাওয়াও বন্ধ করে দেয় শশী। পাখি পোষ মানানোকে কেন্দ্র করে জমিদার বাড়ির চাকর আমিনুদ্দি’র ছেলে মনিরুজ্জামানের সখ্য হয় শশীর সাথে। মনিরুজ্জামানের বহুদিনের স্বপ্নে পাঠশালার বিভিন্ন বিনোদনধর্মী আয়োজন হাতছানি দেয়। কিন্তু সেখানে পড়ার অনুমতি কেবল গাঁয়ের উচ্চবর্ণের হিন্দু ছেলেদের। শশীর আব্দারে সুযোগ আসে মনিরের। মনিরকে সাথী করার শর্তে আবার শুরু হয় পড়া-শোনার পালা। দূরন্ত মনির পড়াশোনা ও খেলাধুলায় হয়ে ওঠে সবার নেতা। সুযোগ হয় জমিদার কন্যা কল্যাণী অঞ্জলী ও আমিরনদের খেলার সাথী হওয়ার। পাখির আকস্মিক মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়ে শশী। মাস্টার মশাইয়ের পরামর্শে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মামার বাড়ি কলকাতায়। মনিরের উপর নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে পাঠশালা গমনে। দূরত্ব তৈরী হয় খেলার সাথীদের সাথে। কিছুকাল পর মনির-কল্যাণীর কৈশোরের ভাললাগা ভালবাসায় রূপ নেয়। জানাজানি হলে জমিদার হরপ্রসাদ রায় নির্মম নির্যাতন চালান মনিরের উপর। তীব্র অপমান বোধে তাড়িত সদ্য যুবক মনিরুজ্জামান সে রাতেই নিরুদ্দেশ হয়। কল্যাণীকে বিয়ে দেয়া হয় ভিন গাঁয়ের চৌধুরী বাড়িতে।

স্বদেশী অন্দোলনের কর্মী শশী কিশোর দীর্ঘদিন পর বাড়ি এলে তাকে ডাকাত বলে অপমান করেন হরপ্রসাদ। বৃটিশদের বিরোধীতা করায় তাকে বের করে দেন বাড়ি থেকে। আর স্বদেশী আন্দোলনের সহযোগী অভিযোগে ধরিয়ে দেন মাষ্টার মশাইকেও।

আরও কিছুকাল পর মনিরুজ্জামান ফিরে আসে মুসলিম লীগের কর্মী হয়ে। বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সংগঠিত করতে তৎপর হয় সে। জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা মনির। ইতোমধ্যে বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে কল্যাণী। ক্ষমতার নতুন সম্ভাবনা দেখে ব্যবসায়ী কুচক্রী সিরাজ মিয়া। তৎপর হয় সে পাকিস্তান আন্দোলনে। নিজের একমাত্র কন্যা আমিরনের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যান করে মনির। ক্ষীপ্ত হয় সিরাজ মিয়া। অনুমতি ছাড়া সভা করায় মনিরকে অভিযুক্ত করেন জমিদার। সাহসী মনির দীপ্ত কণ্ঠে সভা করার ন্যায্যতা তুলে ধরে। জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা করে।

পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে। সিরাজ মিয়া পরিস্থিতিরি সুযোগ নিতে গ্রামের মুসলমানদের নিয়ে হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। অনুমতি চায় মনিরের। ভয়াবহতার আশঙ্কায় নির্বিকার থাকে সে। বর্ণ হিন্দু অশ্বীনিমাধবের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় হিন্দুরা। জমিদারের নির্দেশনার অপেক্ষায় প্রস্তুতি নেয় লড়াইয়ের। কিন্তু কোনো নির্দেশনা ছাড়াই কুচক্রী সাম্প্রদায়িকদের উস্কানিতে শুরু হয় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। দাঙ্গার ভয়াবহতা আতঙ্কিত করে তোলে হিন্দু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে। অর্থহীন, আত্মঘাতী মনে হয় এসবকে। কিন্তু কিছুই করার নেই তাদের। ‘স্বার্থ আরোপিত বিভাজন’ স্বীকৃত হয় পাকিস্তান নামে।

দেশ বিভাগের ফলে হিন্দুরা দলে দলে গ্রাম ছাড়তে থাকলেও বিভাগ মেনে নিয়ে দেশ ছাড়তে রাজি নন জমিদার হরপ্রসাদ। এমন মানবিক বিপর্যয়ে স্বপ্ন ভঙ্গ হয় মনিরুজ্জামানের। সে তার আত্মীয়-অনাত্মীয়, বন্ধু ও প্রেমিকা কল্যাণীর এভাবে দেশ ত্যাগকে মেনে নিতে পারে না ।

২.

ঔপনিবেশিক কালপর্বে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে উপজীব্য করে নির্মিত এই নাটকটিতে নাট্যকার ‘দেশ বিভাগ’কে ধর্মের নামে আরোপিত বলে দাবি করেন এবং একই সঙ্গে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রামকে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে নাট্যকার যেমন গোপন করেন নিজের কংগ্রেসী রাজনৈতিক অবস্থান তেমনি নাট্যকারের দাবি, ঘটনা বর্ণনায় তার অসাম্প্রদায়িকতার বাণী দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত।

আমরা দেখবো শোষিত নিপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক লড়াইকে অস্বীকার করার লক্ষ্যে তার যে নাট্যপ্রয়াস সেটি মূলত সাম্প্রদায়িকতারই নামান্তর। নাট্যকার নাটকটিতে বিভাজন ও বৈষম্যহীন মানব সমাজের চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু লক্ষ করলে ধরা পড়ে, চিরস্থায়ী প্রথার মারফতে দখলদার ইংরেজদের হাতে চালু করা ভূমি-সম্পর্কের মধ্যে তৎকালীন জমিদার-মহাজন বনাম কৃষক-প্রজার শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব ও উত্থান-পতনের ধারাবাহিক সংগ্রামের পরিণতি যে ঐতিহাসিক অভিমুখে গড়িয়েছে তাকে নাট্যকারের পাতিমধ্যবৃত্তীয় ব্যাখ্যায় মনে হয়েছে সেটা নিছকই ধর্মীয় বিভাজন। এখানকার প্রচলিত ইতিহাস ব্যাখার একটা প্রধান মুশকিলের দিকে এখানে নজর করা যাক। সাধারণত এই ধারার কাছে একটা প্রধান সমস্যার বিন্দু হলো হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। এটাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক লড়াই এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধীতা, তাই প্রতিফলিত হয়েছে নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে। যা অনেকাংশে বাস্তব লড়াইয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। কিন্তু দেশভাগের ষাট বছর পর ‘বিজয়ী জনগোষ্ঠীর’ কোন একজন অসাম্প্রদায়িক পরিচয়ের আড়ালে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল ও অনৈতিহাসিক বিতর্কের কেন জন্ম দিচ্ছেন এবং তা কোন রাজনীতির তল্পিবাহক; নতুন করে বিভাজন আরোপের অপচেষ্টা কিনা এ সকল প্রশ্ন উত্থাপন করা জরুরি মনে করি।

নাটকটিতে ধর্মের নামে দেশ বিভাগকে কিছু লোকের স্বার্থ অরোপিত বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। দাঙ্গার কারণে মানবিক বিপর্যয়ে হিন্দু মুসলিম উভয়ের মধ্যে মানবিকতার উদ্রেক হয়। ফলে তারা উপলব্ধি করে যে, তাদেরকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দাঙ্গার মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আর ঘোর কাটে স্বপ্নের পাকিস্তান রাষ্ট্রের।

হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত উপলব্ধির মধ্য দিয়ে ধর্মের বিপরীতে মানবিকতার জয়গান দেখান নাট্যকার । যা প্রতিধ্বনিত হয় ক্ষমতা হারা একজন হিন্দু জমিদারের মুখ থেকে (যাকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে)।

তৎকালিন পূর্ববাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও শাসন ব্যবস্থায়, সরকারী চাকুরিতে ছিলো সংখ্যালঘু। কৃষক শ্রমিকদের প্রধান শত্রু ছিলো হিন্দু জমিদার ও মহাজন। এ সকল নিপীড়ক ব্যবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক লড়াই তাকে (ঐ শ্রেণীর প্রতিপক্ষ হিন্দু জমিদারের মুখ থেকে...) এভাবে ব্যাখ্যা করা মূলত লড়াইয়ের কর্তাসত্তাকেই অস্বীকার করা। নাটকটির মধ্যে এ রাজনৈতিক লড়াইকে নি-রাজনীতিকরণের লক্ষ্যে যে নাট্যপ্রয়াস তাতে তৎকালীন বাংলার রাজনৈতকি বাস্তবতার যথেষ্ঠ প্রতিফলন রয়েছে (যা সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন নাট্যকার) এবং সেটাকে চিহ্নিত করাই আমার এ লেখার উদ্দেশ্য। আর সেসময়কার লক্ষ পাকিস্তান অর্জনের (দেশ ভাগের) ৬০বছর ও ভিন্নতর রাজনৈতিক বিরোধের জের ধরে জাতীয়মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এ ধরনের অপব্যাখ্যা কারা কোন উদ্দেশ্যে করছে (বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ঐতিহাসিক জাতীয় আকাক্সক্ষার বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের দিক থেকে) সে সম্পর্কে সচেতন হয়ে তা প্রতিহত করা জরুরি মনে করি।

এ পর্যায়ে ‘বিভাজন’ নাটকটি যে সময়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে সেসময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক অবস্থা বাস্তবে কেমন ছিল তা এখানে কিছুটা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কেননা মুসলিম লীগের রাজনীতি আসার আগে এ অঞ্চলের কৃষক-প্রজার কোনো রাজনৈতিক অবস্থান ছিল না বলে নাটকে উল্লেখ করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অসত্য।

বৃটিশ-জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম বাংলার এ অঞ্চলটিতে বহুদিন থেকে হয়ে আসছে। দুদ্দু শাহ তীতুমীরের ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ সকল শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করে বাংলার জনগণ। পূর্ববঙ্গে তখন অল্প ক’জন মুসলমান জমিদার ছাড়া সবাই ছিলো হিন্দু জমিদার ও মহাজন। এরকম অন্যায় ও অন্যায্য ব্যবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রথমে প্রজাপার্টি ও পরে কৃষক প্রজা পার্টির মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। তখনো পর্যন্ত কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ বাংলায় শক্তিশালী হয়ে উঠেনি। জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ প্রশ্নে মুসলিম লীগ, কংগ্রেস কোন দলই প্রথমে সায় দেয়নি। কিন্তু বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান সমস্যাকে মুসলিম লীগই প্রথম উপলব্ধি করে ও স্বীকৃতি দেয়। ১৯৩৫ সালের আইন পরিষদে ভোটাভুটি হলে সকল মুসলিম-সদস্য জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে এবং সকল হিন্দু-সদস্য ও জমিদার এ ব্যবস্থা বহাল রাখতে রায় দেয়। তখন নিখিল ভারতীয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ এই উচ্ছেদের পক্ষে আর কংগ্রেস এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯২৩ সালের ব্যঙ্গল ফ্যাক্ট ছিলো অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অগ্রসর করার রাজনৈতকি পদক্ষেপ।

পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ফজলুল হকের চেষ্টা ছিল কংগ্রেসের সাথে জোটবেধে সরকার চালানো। কিন্তু সেচেষ্টাও সফল হয়নি। তখন বিকল্পহীনভাবে মুসলিমলীগকে নিয়ে কৃষক-প্রজা পার্টির কোয়লিশন হয় মুসলিম লীগের সাথে। অন্যদিকে আবুল হাশিম প্রমুখদের প্রভাবে মুসলীম লীগেরও ব্যাপক পুনর্গঠন হয়। গণমুখী ভূমিকায় আরো সোচ্চার ও আগ্রগামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় জমিদারী-মহাজনী ব্যাবস্থার উচ্ছেদ সাধনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। কৃষক-শ্রেণীর দাবির প্রতিভূ হয়ে ওঠার ফলশ্রুতিতেই মুসলীম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলার অংশগ্রহণ।

বিভাজন নাটকের নাট্যমুখে নাট্যকার দেশবিভাগ নিয়ে ক’টি প্রশ্ন উত্থাপন করেন যা থেকে দেশবিভাগকে কিভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে তা বুঝা যায়-- “মানুষের জন্য কোনটি বড় সত্য? ধর্ম নাকি মানবিকতা? মানুষে মানুষে বহুমাত্রিক মানবিক সম্পর্ককে কি বিভাজিত করা যায়? ধর্ম, শ্রেণী কিংবা সমাজ আরোপিত অন্য কোন বিভাজন দিয়ে?” নাট্যকার ধর্ম ও মানবিকতাকে পরষ্পর সাংঘর্ষিক ও বিপরীতধর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেন, আর মানবিকতাকে বড় সত্য বলে স্বীকৃতি দেন। যা প্রতিধ্বণিত হতে শুনা যায় নাটকের শেষ দৃশ্যে দেশবিভাগে ক্ষমতা হারা জমিদার হরপ্রসাদ রায়ের মুখ থেকে-- “সত্য? কাকে সত্য বল তুমি? ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভাজন? অখন্ড জম্মভুমিরে কিছু লোকের তুচ্ছ স্বার্থে ধর্মের নামে খন্ডিত করা?

ধর্ম বনাম মানবিকতার এ লড়াইয়ে ধর্মীয় আত্মপরিচয় নির্মাণের রাজনীতির প্রতিনিধি মনির আর মানবিকতার প্রধান সমর্থক হরপ্রসাদ। নাটকে যদিও রাজনৈতিক ঘোর কেটে বন্ধু প্রেমীকার বিচ্ছেদ আশঙ্কায় মানবিক বোধে(?) আলোড়িত হতে দেখা যায় মনিরকে। কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা। জমিদারী-মহাজনী রক্তচোষা সুদখোরী ব্যবস্থার নির্দয় নিষ্ঠুর অত্যাচার আর সীমাহীন অমানবিক নিষ্পেষণের হাত থেকে নিস্তার পাবার মানবিক সংবেদনার অবলম্বনই বরং হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এ অঞ্চলে মুসলমান প্রজাদের কাছে তাদের ধর্মীয় আত্মপরিচয়। তাকে আশ্রয় করেই তারা ভাষা দিয়েছিল একটি স্বাধীন ও আত্মনিয়ন্ত্রন কায়েমের রাজনৈতিক সংঘবদ্ধতা নির্মাণের লড়াই। মানবিকতার লালন এবং মর্যাদা রক্ষার আর কি পথ তৎকালে খোলা রেখেছিল অখন্ড ভারত তত্ত্বের ফেরিওয়ালারা?

নাটকে জমিদারের কাছারিতে বসারও অযোগ্য অচ্ছ্যুত মানুষের মর্যাদাহীন জীবনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এর জন্য কারা দায়ী? সেই বিভাজিত সমাজে মানবিকতার স্থান কোথায়? দরিদ্র মর্যাদাহীন এসকল মানুষের জীবনে মানবিকতার অর্থ বা ভূমিকা কী?

মানবিকতার অর্থ যদি অনাকাঙ্ক্ষিত দাঙ্গার বিভীষিকায় মানুষের কাতরতা ও উপলব্দি হয় তা হলে সে মানবিকতার মাধমে রাজনৈতিক সংগ্রামকে অপব্যাখ্যা করা নিশ্চয় কোনো কাজের কথা হতে পারেনা। নাটকটি পড়লে মনে হবে যেন ভারত ভাগের কারণেই একমাত্র দাঙ্গা হয়েছে, তার আগে-পরে কোথাও যেন সেরকমটি ঘটেনি।

হরপ্রসাদ

নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরপ্রসাদ রায়কে নাট্যকার সবচেয়ে ইতিবাচকভাবে রুপায়ন করেছেন। নাটকের সব চেয়ে দৃঢ় চরিত্র এটি।

হরপ্রসাদ রায় সম্ভ্রান্ত জমিদার “অন্যায়ের প্রতিবাদে খেপে উঠেন রোষে, কিন্তু ন্যায় অন্যায় বিচার করেন প্রথাগত বিশ্বাসে। ... মাঝে মাঝে মানবিক বোধে আলোড়িত হয় তার সামন্ত বিশ্বাস”। নাটকে ‘মানবিক-বোধে’ আলোড়িত হতে তাকে একবারই দেখা যায়, ছেলে শশীর আব্দারে হরপ্রসাদ রায় মনিরুজ্জামানকে পাঠশালায় পড়ার অনুমতি দেন আলাদা ব্যাঞ্চে বসার শর্তে - “পুত্রের এ আব্দারটুকু রক্ষা করলে কি বিপন্ন হবে তার সামন্ত শুদ্ধতা, ধর্মীয় প্রথা ? দ্বিধাগ্রস্ত হয় সে। তবু সম্মান জানায় পুত্রের আব্দারে”। বিশেষ ধরনের মানবিক বোধ সম্পন্ন এ সিদ্ধান্ত শশীর কলকাতা যাওয়ার আগে পর্যন্ত বলবৎ ছিল এবং এরপরই মনিরুজ্জমানের পাঠশালা যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। পরবর্তীতে ন্যায়পরায়ন হরপ্রসাদ তার কন্যার সাথে অসমপ্রণয় সম্পর্কের অপরাধে ক্ষেপে গিয়ে মনিরুজ্জামানকে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে শাস্তি দেন। একে তো চাকরের ছেলে তার উপর মুসলিম প্রজা। প্রায় সমবয়সী হলেও কল্যাণীকে এ ধরণের কোনো শাস্তিই দিলেন না। অবশ্য শাস্তি একটা তারও হলো সেটা তার বিয়ে।

গায়েন দলের দোহার মেয়েটিকে তার বাবার কাছ থেকে হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে নেন হরপ্রসাদ। এটাকে নাট্যকার সামন্ত শাসক সুলভ সহজাত বিষয় হিসেবে বর্ণনা করেন। তাকে একজন সংযমী ও দায়িত্বশীল সামন্ত শাসক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি এতটাই সংযমী এর পর অন্যকোনো নারী তার জীবনে আসেনি। মেয়েটির বাবাকে তার কোনো অসুবিধা ও অমর্যাদা না হওয়ার যে আশ্বাস দিয়েছেন তা রক্ষা করেছিলেন বলে নাটকে জানা যায়। যদিও তার স্ত্রীর মর্যাদা পায়নি দোহার মেয়ে।

হরপ্রসাদ মেয়েটিকে কিনে বাবা ও মেয়ে উভয়কেই যেন ধন্য করলেন। কেননা নিম্ন বর্ণের দরিদ্র বাবার পক্ষে এ মেয়েটিকে বিয়ে দেয়া দুঃসাধ্য, তাই রক্ষিতা হিসাবে থাকলে খেয়ে পরে বাঁচবে। তাছাড়া লোভাতুর বাবাকে হাজার টাকার বিনিময়ে অবশিষ্ট জীবনের একটা নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন জমিদার। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কোন বাবার পক্ষে তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন সন্তানকে হাজার টাকার লোভে বিক্রি করে দেয়া আদৌ সম্ভব কিনা আর সেটা যদি সম্ভবও হয় তবে সে সমাজে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের অবস্থা কতটা করুণ ছিলো তা সহজেই বুঝা যায়।

হরপ্রসাদ এমন একজন অসা¤প্রদায়িক শাসক যার প্রতি বর্ণ হিন্দু অশ্বীনিমাধব ক্ষীপ্ত। এর কারণ হলো পুরোহিত অশ্বীনিমাধবকে জিজ্ঞেস না করে মনিরুজ্জামানকে পাঠশালায় পড়ার অনুমতি দেয়া। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ও অশ্বীনিমাধব ও বর্ণ হিন্দুরাই কেবল সক্রিয় কিন্তু কেবল নিষ্ক্রিয়তা দেখান হরপ্রসাদ।

জমিদার হরপ্রসাদ রায় অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসেবেও পূর্ববঙ্গের কৃষক প্রজার শত্রু আবার রাজনৈতিক শ্রেণী হিসেবেও শক্র। নাট্যকার তার কংগ্রেসী রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করেছেন। হরপ্রসাদ স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী শশীকে ডাকাত বলে অপমান করে এবং বৃটিশদের কাছে তাকে নীচু করায় বাড়ী থেকে বের করে দেন। স্বদেশী অভিযোগে পাঠশালার মাষ্টার মশাইকেও বৃটিশ বাহিনীর কাছে ধরিযে দেন হরপ্রসাদ। উল্লেখ্য, কংগ্রেস এ আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলন বলে চি‎হ্নিত করে। যেহেতু কৃষক-প্রজা পার্টিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি তাই সুসলিম লীগকেই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গণ্য করেন নাট্যকার। কিন্তু কৃষক-প্রজা পার্টিকে নয়। কংগ্রেসী হরপ্রসাদ রায়কে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নাট্যকার মুসলিম লীগকে সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্নেষী কতিপয়ের দল হিসেবে চি‎হ্নিত করেন এবং স্বদেশী আন্দোলনকে অস্পষ্ট ভাবালুতা সম্পন্ন গোঁজামিলের আন্দোলন হিসাবে তুলে ধরেন। নাটকে স্বদেশী আন্দোলনের প্রতিনিধি শশী। মনির-কল্যাণীর প্রেমের সম্পর্ক মানতে না পারায় শশীকে অঞ্জলী প্রশ্ন করে “তুমি কেমন বিপ্লবী দাদা?” শশী স্বাধীনতা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বুঝাতে গিয়ে ‘সত্যিকারের মানুষ’ হওয়ার কথা বলে। কিন্তু ‘সত্যিকারের মানুষ হওয়ার’ অর্থ কী জানতে চাইলে সে নিরুত্তর থাকে, কারণ সে নিজেও জানেনা এর অর্থ কী। এভাবে স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা দেন নাট্যকার। মনির-কল্যাণীর সম্পর্ককে মৌন স্বীকৃতি দিতে পারতো শশী, অঞ্জলীর সাথে স্বাধীনতার বা বৃটিশ বিরোধিতার কথা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারতো শশী। এতে পরবর্তী ঘটনার কোনো হেরফের হতো না। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব জাগিয়ে হরপ্রসাদের রাজনীতিকেই একমাত্র স্বীকৃতি দিলেন নাট্যকার।

মনিরুজ্জামান

নাটকের বিপক্ষ চরিত্র মনিরুজ্জামান। নায়ক হওয়ার মত সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হরপ্রসাদের মত রাজনৈতিক দৃঢ়তা তার নেই। দরিদ্র জনগোষ্টীর মুক্তির লক্ষ্যে মোহের বশে মুসলিম লীগ রাজনীতিতে জড়িত হয় মনির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোহ ভঙ্গ হয় তার। উপলব্ধি করে এর অন্তসারশূন্যতা। নাটকে সাম্প্রপ্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা ও প্রেমিকার বিচ্ছেদাশঙ্কাকে এর কারণ হিসেবে চি‎হ্নিত করা হয়েছে। মনিরুজ্জামানকে এভাবে দেখানোর মাধ্যমে নাট্যকার এ জনগোষ্ঠীর পাকিস্তান অর্জনকে স্বপ্ন ভঙ্গ বলে বর্ণনা করেন।

জমিদার বাড়ীর চাকর মনিরুদ্দির ছেলে মনিরুজ্জামান পূর্ববঙ্গের শোষিত, অধিকার বঞ্চিত দরিদ্র শ্রেণীর একজন। গাঁয়ের হাতে গোণা যে কজন ছেলে মৌলভীর কাছে আমপারা পড়তে যায় তাদের একজন মনির। মক্তবের জীর্ণতা ও (হিন্দু বালকদের) সমৃদ্ধ পাঠশালার মধ্যকার হিন্দু মুসলিম ভেদে কাতর হয় বালক মনির। আর উদাস দৃষ্টিতে দেখে উচ্চবর্ণ হিন্দু বালকদের শ্লেট-পেন্সিল হাতে পাঠশালা গমন, মাষ্টার মশাইয়ের শারীরিক কসরত, শিক্ষা দান, খেলার মাঠে সারিবদ্ধ হয়ে গান গাওয়া। গ্রামের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পাঠশালায় খেলাধুলা ও পড়াশোনার সুব্যবস্থা হাতছানি দেয় তাকে। কিছুদিন শশীর সাথে পাঠশালা যাওয়ার অনুমতি পেলেও বসতে হতো আলাদা ব্যেঞ্চে। শশী কলকাতা চলে গেলে তাকে বাদ দেয়া হয় পাঠশালা থেকে। শিক্ষায় এ বিভাজন বোধ ব্যাথিত করে তাকে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে হিন্দু মুসলিম বিভাজন জমিদার প্রজায় বিভাজন মানতে না চাইলেও সত্য হিসেবে জেনেছে। জমিদার কন্যা কল্যাণীর প্রতি কৈশরের ভাললাগা প্রথম যৌবনের ভালবাসায় রূপ নেয়। সাহসী মনিরের ভালবাসার আহ্বানে সাড়া দেয় কল্যাণী। জমিদার কন্যার সাথে অসম প্রেমের অপরাধে হরপ্রসাদ সদ্য যুবক মনিরুজ্জামানের উপর নির্মম নির্যাতন চালান। তীব্র অপমান বোধে অসুস্থ শরীরে সে রাতেই গ্রাম ছাড়ে মনির।

কয়েক বছর পর প্রতিবাদী মনির মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মী হয়ে গ্রামে আসে। জমিদার মহাজন জোতদারদের বিরুদ্ধে বঞ্চিত সংখ্যাগরীষ্ঠ মুসলমানদের সংগঠিত করতে শুরু করে। আন্দোলনের তীব্রতায় শঙ্কিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। আন্দোলনকে দুর্বল করতে হরপ্রসাদ অনুমতি না নিয়ে সভা করার অপরাধে অভিযুক্ত করেন মনিরুজ্জামানকে। সে দৃঢ়তার সাথে তাদের বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা করে।

৪৭’র দেশ বিভাগের পূর্বে এ অঞ্চলের শোষিত সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক রাজনৈতিক লড়াইয়ে মুখপাত্র হয়ে ওঠে মনির। কিন্তু হঠাৎ করেই দাঙ্গার আশংকায় নিজেকে সরিয়ে নেয়া ও দাঙ্গা পরবর্তী ভুল রাজনীতির উপলব্ধি পুরোপুরি আরোপ করেছেন নাট্যকার। যার ফলে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মুসলিম লীগের সাথে এ জনগোষ্ঠীর নতুন রাষ্ট্র গড়ার যে সিদ্ধান্ত একে ভুল বলে চি‎হ্নিত করলেন নাট্যকার। এতে স্পষ্ট হয়-- জন্মলগ্ন থেকেই এ রাষ্ট্রের সাথে আন্দেলনকারী জনগণের কোনো অংশ গ্রহণ বা সম্পর্ক ছিল না।

রাজনৈতিক কর্মী মনিরুজ্জামানকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাকে একজন জনদরদী শ্রমিক বাবার সত্যবাদী নীতিবান নেতা হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে একটা বিষয় প্রতিষ্ঠা করলেন নাট্যকার- সিরাজ মিয়াদের মত নেতিবাচক চরিত্র নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে কিন্তু জনগণের প্রকৃত নেতা এর বিরুদ্ধে। যা শেষ বিচারে নতুন রাষ্ট্রের গণবিচ্ছিন্নতা ও অযৌক্তিকতাকে প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, বাঙ্গালি মুসলমানের রাষ্ট্রগঠনের প্রথম যুগান্তকারি অভিজ্ঞতাকেই নাকচ করে দেবার প্রচেষ্টা এটা। যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ঐতিহাসিক সেই অর্জনের স্মৃতিকে ম্লান করে দিতে পারলেই স্বতন্ত্র স্বধীন রাষ্ট্রের অর্জিত আকাঙ্ক্ষারও গলাটিপে ধরা যায়। সে চেষ্টা ও উদ্দেশ্য আসলে কারা চরিতার্থ করতে চায়?

নাটকে মনিরুজ্জমানের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায় লক্ষ করা যায়, প্রথম পর্যায়টি মক্তবের বালক থেকে গ্রাম ছাড়া পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়টি মুসলিম লীগ কর্মী হিসেবে গ্রামে ফিরে আসা, রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করা ও জমিদারীর বিরুদ্ধে তার অবস্থান আর তৃতীয় পর্যায়টি হল দাঙ্গার আশঙ্কা ও প্রেমিকা কল্যাণীর দেশ ত্যাগের পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অন্তসারশূন্যতার উপলব্ধি।

সমাজের বিদ্যমান বিভাজন রেখা প্রবল ভাবে ফুটে ওঠে যখন হিন্দু জমিদার কন্যার সাথে মুসলিম চাকর মনিরুজ্জামানের উপর প্রেমের সম্পর্কের অপরাধে নেমে আসে অমানসিক নির্যাতন। তীব্র অপমান বোধে অসুস্থ অবস্তায় গ্রাম ছাড়ে মনির। এ পর্যায়ের শুরুতে মনিরকে সম্ভাবনাময় দূরন্ত কিশোর হিসেবে দেখতে পাই কিন্তু বিভাজিত সমাজের চরম অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রাম ছাড়ে সে। যা এক দ্রোহী মনিরের জন্ম দেয়।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক মন্ত্রে বলিয়ান এক নতুন রূপ নিয়ে ফিরে আসে মনির। ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে নয় বরং সমাজের নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সে উদ্যোগী হয়। অল্প দিনর মধ্যেই শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের নেতা হয়ে ওঠে সে। আন্দোলনের তীব্রতায় শঙ্কিত উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় মনির।

একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর লড়াই সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় প্রতিবাদী হয়ে ওঠা মনির চরিত্রকে প্রতিনিধি আকারে খুবই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে মনিরুজ্জানকে নিরাজনীতিক করার যে অপচেষ্টা তাকে অরোপিত ও অস্বাভাবিক বলে মনে হয়।

তৃত্বীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক ব্রা‏হ্মণ অশ্বিনীমাধব মনিরুজ্জামানকে হরপ্রসাদের বিরুদ্ধে উস্কানী দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সে নিজে থাকে নির্বিকার। অমঙ্গল আশঙ্কা হয় যুবকের। জমিদার হরপ্রসাদ ও বর্ণ হিন্দু যারা সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তাদের বিরোধিতায় অমঙ্গল আশঙ্কা করে না মনির। কিন্তু একজন দুর্বল চিত্ত ধর্মীয় পুরোহিতের উস্কানীতেই ভীতিকর পরিস্থিতির আশঙ্কায় ত্রস্ত হয় সে!

সিরাজ মিয়া যখন দাঙ্গার অনমুতি চায় তখন মনির নিষ্ক্রিয় থাকে। তার প্ররোচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় দাঙ্গা থেকে এবং তার রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। দঙ্গা বাঁধানো আর রাজনৈতিক সাক্রিয়তাকে একাকার করে ফেলেন নাট্যকার। যেন সেসময় রাজনৈতিক সক্রিয়তামাত্রেই রক্তলোলুপ দাঙ্গাপরায়ন কোনো হিংস্র মানুষের মুখচ্ছবি। যেন স্থবির ও নিষ্ক্রিয় লোক ছাড়া আরসব মুসলীম লীগারই ছিলো খুনি-দাঙ্গাবাজ? এর চেয়ে ভয়াবহ সা¤প্রদায়িক মনেবৃত্তি আর কি হতে পারে?

দাঙ্গা পরবর্তী ভয়াবহতায় কাতর হয়ে পড়ে মনিরুজ্জামান। স্বজন সঙ্গী খেলার সাথীদের দেশ ত্যাগ ব্যথিত ও মর্মাহত করে তাকে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে প্রাক্তন প্রেমিকার বিচ্ছেদাশঙ্কায়। রাজনৈতিক নেতা হয়েও সে উপলব্ধি করে “মোহ, ম্বপ্ন আর ঘোরের অন্তসার শূন্যতা”। এভাবে নাট্যকার রাজনীতিহীন করেন মনিরকে।

দাঙ্গার ভয়াবহতায় ও প্রেমিকা বিচ্ছেদের আশঙ্কায় হঠাৎ করে রাজনৈতিক স্বপ্নে উপলব্ধির সংকট হওয়াটা অস্বাভাবিক। স্বপ্নভঙ্গ হওয়াটা এমন একটা সময়ে ঘটেছে যেখানে নতুন রাষ্ট্র কেবল যাত্রা শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তখনো গণমানুষের বিরোধী কোনো কর্মসূচী ঘোষিত হয়নি। দেশের স্বাধীনতা ছাড়া স্বপ্নের কোনো কিছুই যখন বাস্তবায়ন হয়নি সে ক্ষেত্রে স্বপ্নভঙ্গ বা মোহাচ্ছন্নতার উপলব্ধি সম্পূর্ণ আরোপিত।

মনিরকে সিরাজ মিয়ার মত চক্রান্তকারী হিসেবে উল্লেখ না করার কারণ হল-- ক. তৎকালীন আঞ্চলিক সকল রাজনৈতিক নেতাদেরকে সিরাজ মিয়ার মত কুচক্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে তা একদেশদর্শী ও অনৈতিহাসিক বলে অগ্রহণযোগ্য হবে। এবং সেক্ষেত্রে নাট্যকারের উদ্দেশ্যও উদাম হয়ে যাবে। খ. মনিরুজ্জামানের মত এত ভাল নেতাও আসন্ন ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসাকে বিশ্বাস যোগ্য করতে এটি সহায়ক হয়ে ওঠে।

সিরাজমিয়া

পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি সিরাজ মিয়া। তাকে পরিচয় করানো হয় “গাঁয়ের সম্ভ্রান্ত মুসলমান” হিসেবে। সম্ভ্রান্ত কারণ “পাটের ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে সম্প্রতি ধনাঢ্য হয়ে ওঠে সে। আর মস্তিষ্কে ক্রিয়াশীল থাকে ক্ষমতার প্রত্যাশা”। নাটকে সিরাজ মিয়া সুযোগ সন্ধানী কুচক্রী এবং সাম্প্রদায়িক। সিরাজ মিয়াকে এভাবে চি‎হ্নিত করা হয় কিন্তু হরপ্রসাদের জমিদারীতে অন্যায় অত্যাচার ও একচ্ছত্র ক্ষমতার আস্ফালন ছিল কিনা কিংবা দরিদ্র প্রজাকে শোষণ করে যে জমিদারী ব্যবস্থা-- তার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন না নাট্যকার। জমিদারী শ্রেণীর বিপরীতে ব্যবসায়ী শ্রেণীর উত্থানের এই যে ঐতিহাসিক ঘটনা তাকে জমিদারী নৈতিকতা দিয়ে বিচার করেছেন নাট্যকার। অর্থের সাথে ক্ষমতার স্বাভাবিক অনুগমনকে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় অস্বাভাবিক ও চক্রান্তমূলক মনে হয় তার কাছে।

আমিরন

নাটকে আমিরন একমাত্র মুসলিম কিশোরী, যে খেলার মাঠে মিথ্যা বলে। প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে অঞ্জলীকে সন্ধ্যাবেলায় স্নান করতে বাধ্য করে এবং ফযরের সময় সুললিত কন্ঠে কোরান পাঠ করা মনির-কল্যাণীর প্রেমের ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেও সে ঘটনা আমিরন জানিয়ে দেয় জমিদার হরপ্রসাদকে।

আমিনুদ্দি

নাট্যকার আমিনুদ্দি চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন, যে কিনা রোজখাটা চাকর হলেও জমিদার হরপ্রসাদ রায় ও তার পরিবারের জন্য সদা চিন্তিত। কখনো তাকে নিজ সন্তান মনিরুজ্জামান বা তার জনগোষ্ঠীকে নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা যায়নি। হরপ্রসাদ রায় মনিরুজ্জমানকে মেরে রক্তাক্ত করলেও তার কাছে একে সুবিচার বলে মনে হয়। আবার রাজনৈতিক ভূমিকায় মনিরুজ্জামানের দৃঢ় আচরণে জমিদার যেন তাকে শাস্তি দেন তা প্রত্যাশা করেন বৃদ্ধ আমিনুদ্দি। এপর্যন্ত আমিনুদ্দিকে কেন মুসলমান হতে হলো তা বুঝা না গেলেও এরপরই বোঝা যায় তার ভূমিকা। তাকে ধর্মভীরু হিসেবে চি‎হ্নিত করতে কখনো তার মুখ থেকে ইনশাআল্লাহ শব্দ কখনো বা হাসান হোসেনের পুঁথি পড়ে ব্যাকুল হতে দেখা যায়। কেননা ধর্মভীরু হওয়া সত্ত্বেও আমিনুদ্দির কাছে পাকিস্তান আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে হয়নি কখনো। দেশবিভাগের পর জমিদার বাড়ীতে বিজয়া দশমীর পূজা না হওয়ায় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়। আর বড় কর্তার অবর্তমানে গ্রাম অন্ধকার হয়ে যাবে বলে তার আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠা কৌতুহল উদ্দীপক।

অশ্বীনিমাধব

নাটকে বেশ কিছু বিষয়ের সমাধান দিতে অশ্বীনিমাধবের সাম্প্রদায়িক কুচক্রী চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয়েছে। যেহেতু হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চক্রান্তমূলক ও উষ্কানিমূলক ছিল এবং মুসলমানদের দিক থেকে এর নেতৃত্ব দেন সিরাজ মিয়া। হিন্দুদের দিক থেকে নেতৃত্বের প্রশ্নটি মীমাংসা করতে পুরোহিত অশ্বীনিমাধবকে তুলে ধরেন নাট্যকার। এর ফলে হরপ্রসাদেও সাফসুতরো রূপ তুলে ধরার আয়োজন সম্ভব হলো।

ব্রা‏হ্মণ্যবাদী অশ্বীনিমাধবকে চক্রান্তকারী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় তথাকথিত আধুনিক প্রগতিশীল মনে একধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। কারণ এই চক্রান্তকারী চরিত্রটি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নায়েব, গোমস্তা বা জায়গিরদার এ ধরনের ক্ষমতাধর কোনো শ্রেণী থেকে স্বাভাবিকভাবেই আসতে পারতো কিন্তু তা না করে দুর্বল পূজারী শ্রেণীর একজনকে নাট্যকার চি‎হ্নিত করেন। হিন্দু পুরোহিতদের নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে ধর্মকে নাকচ করার যে প্রগতিবাদী(?) অবস্থান (তা স্পষ্ট করেন) সেটা নাট্যকারের চেষ্টা। কিন্তু পুরোহিত চরিত্রটিকে নেতিবাচক চক্রান্তকারী নেতা হিসেবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও নাট্যকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।

হরপ্রসাদের জমিদারীতে হরপ্রসাদের নীতিই সেখানে একমাত্র নীতি। যেখানে হিন্দুদের পাঠশালায় মনিরদের পড়ার অনুমতি দেয়ায় গাঁয়ের হিন্দুদেরকে এর বিরুদ্ধে উস্কানী দেয় দুর্বল চিত্ত অশ্বীনিমাধবরা।

বর্ণ হিন্দুদের কেউ কেউ সায় দিলেও সাহস হয় না হরপ্রসাদরে মুখোমুখি দাঁড়াবার। তারা বুঝতে পারে- মুসলিম বালককে পাঠশালায় পড়ার অনুমতি দেয়া নয় বরং প্রধান ব্রা‏হ্মণ পুঁজারী হয়েও তাকে জিজ্ঞেস না করাই তার এ আপত্তির হেতু। তাকে অগ্রাহ্যের মনোবেদনায় আবারও তাকে উস্কানী দাতা হিসেবে আবিভূর্ত হতে দেখা যায়। প্রায় এক দশক পর মনির রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গাঁয়ে এলে হরপ্রসাদের বিরুদ্ধে উত্থানের চেষ্টা করে সে। এবারও সে ব্যর্থ হয়। মনিরের কাছে অশ্বীনিমাধবকে শকুনের মত মনে হয় এবং সে আঁচ করে আসন্ন ভয়াবহ দাঙ্গার।

কুলীন ব্রা‏হ্মণ শ্রেণীর আধিপত্য ও প্রাধান্যের দিন শেষ হয়ে ক্ষত্রিয় জমিদার শ্রেণীর আধিপত্যের যুগে দুর্বল পুরোহিত অশ্বীনিমাধবের যে স্বাভাবিক টানাপড়েন ও মনোবিকার-- তারই প্রভাব জমিদারের অসম্মানের বিরুদ্ধে ক্ষীন প্রতিবাদ করা চেষ্টা। এটা এ পর্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু প্রায় একদশক পর হরপ্রসাদের বিরুদ্ধে মনিরকে উষ্কে দেয়ার চেষ্টা ও সমাজের সব থেকে দুর্বল পুরোহিত একজনকে শকুনের মত মনে হওয়া সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ও আরোপিত ব্যাপার। মনিরের রাজনৈতিক লড়াইয়ের শত্রু হরপ্রসাদ ও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অব্যাহত চক্রান্তের পরও এদের কাউকে শকুন মনে না হওয়া খুবই বিস্ময়কর।

কিছুদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আশঙ্কায় অস্তিত্ব সংকট ও ক্ষমতার সম্ভাবনায় ধ্বংসাত্মক দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেয় বৃদ্ধ অশ্বীনিমাধব। এ সময়ে নাটকে তার চারিত্রিক দৃঢ়তা লক্ষ করার মত। বুঝা য়ায় নাট্যকার চক্রান্তকারী ক্ষয়িষ্ণু ব্রা‏হ্মণকে দাঙ্গার দায় ভার নিতে সর্বাত্তক চেষ্ঠা করেন। যা আগে ও পরের দুর্বলচেতা ব্রা‏হ্মণের সাথে একেবারেই বেমানান।

দাঙ্গার পর এদেশ ছেড়ে হিন্দুস্তান যাওয়ার কথা বলায় হরপ্রসাদের রক্ষিতা শৈলবালা অপমান করেন অশ্বীনিমাধবকে। বাড়ী থেকে ‘পলায়নমুখ’ হলে গাছের ছায়াকে সাপ ভেবে ভয়ে আতঙ্কিত হয় সে ।

কুচক্রীদের উস্কানিতে সাম্প্রপ্রদায়িক দাঙ্গাকে একদল হিন্দু-মুসলমানের অসচেতন উন্মাদনা বলে চি‎হ্নিত করেন নাট্যকার। কিন্তু নাটকে মুসলমান দাঙ্গাকারীদের কথাগুলো লক্ষ করলে বোঝা যায় এগুলো বহুদিনের অন্যায় অবিচার ও অপমানের অভিপ্রকাশ-- “আমাদের ম্লেচ্ছ যবন বইলা ঘৃণা করে। সারা জীবন হিন্দুরা মাথার উপর ছড়ি ঘুরাইলো। জিন্নাহ সাবের পাকিস্তান ঘোষণার পরও কেন হিন্দুদের ডরাইয়া থাকবো। অপমানের বদলা নেবো না”।

হিন্দুদের কাছে এটা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা এবং অধীনস্তদের বেয়াদবির শাস্তি

“ম্লেচ্ছ যবনের দল আদব কায়দা সব ভুইলা গেছে। মুর্খের দল পাকিস্তানের দোহাই দিয়া যা খুশি তাই করবো। আর ইংরেজ রাজত্বে তাই মানতে অইবো”। ইংরেজ রাজত্বে (বাংলায়) হিন্দু দাঙ্গাকারীদের আধিপত্য রক্ষার শেষ চেষ্টা এটি। অবাক হতে হয় চক্রান্তকারীদের দ্বারা সংঘটিত দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমানের মুখে এই বাস্তবতার প্রতিফলন দেখে।

(মেলার আনন্দঘন পরিবেশে) চৈত্র সংক্রান্তির রাত্রিতে পুতুল নাচের মাধ্যমেও (নীল করের বিরুদ্ধে) সমাজের বিদ্যমান অন্যায্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চৈতন্যকে খুঁজে পাওয়া যায়-- যেখানে নীল করের বিরুদ্ধে চাষার পোলা অস্ত্র তুলে নেয়।

দাঙ্গা কোন সমাধান নয়, তা মানবিক বিচারে গ্রহণযোগ্যও নয় কিন্তু ঘটে যাওয়া একটি ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা। দেশ বিভাগের পরে হিন্দু জমিদারদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তি হারিয়ে যে দিশেহারা অবস্থা তাদের জন্য সেটা অবশ্যই কষ্টের। এ ব্যবস্থার সুফল ভোগীদেরও এতে কষ্ট পাওয়া স্বাভাবিক। একইভাবে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের স্বাধীনতার পর করুণ পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখনি যখন ইতিহাসের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পরাজিত শক্তির হয়ে বয়ান নির্মাণের কসরৎ আর তথাকথিত মানবিক কাতরতা ছড়াতে তৎপর হয়েছেন আমাদের তরুণ নাট্যকার। যার জন্য সাতচল্লিশে পরাজিত শক্তি জমিদারকে মানবিকতার মোড়ক পরিয়ে পক্ষ নিয়েছেন আর বিজয়ীদের দাঙ্গাপরায়ন সাম্প্রদায়িক আখ্যায় চিত্রিত করতে প্রাণান্তকর চেষ্টার কমতি রাখেননি। বাস্তব সমস্যা অর্থনৈতিক শোষণকে আড়াল করতে ধর্ম বনাম মানবিকতার গল্প ফেঁদেছেন। তাই ইতিহাসের তলানিতে পড়ে থাকা নিম্নবর্গের মানুষদের নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ বা উজ্জ্বল অর্জন নয়, বরং সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে নাট্যকারের কাছে পুরো ব্যাপারটাই কাল্পনিক অখন্ড ভারতকে খন্ডন (বিভাজন) করার বেদনার আহাজারিতে সমর্পিত।

View: 4151 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD