মাহমুদ দারভীশের মৃত্যুর মোকাবিলা এবং কাব্য
মাহমুদ দারভীশ বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানীয় কবিদের অন্যতম এবং বিশেষত আরবের সমসাময়িক কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি মাহমুদ দারভীশ। অনেকে মনে করেন, জীবিত কবি আদোনিসের পরেই মাহমুদ দারভীশের স্থান। কিন্তু তিনি আরো নানা কারণে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ধর্ম, সংস্কৃতি, ক্ষমতা, জাতীয় মুক্তি ও অধিকারের প্রশ্নে আরব ও ফিলিস্তিনের সংকট মোকাবেলায় বিশ্বদৃষ্টি অর্জনে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন এই কবি। ফলে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, জাতীয় কবি, অবিসংবাদিত নেতা, রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের লেখক ইত্যাদি নানা পরিচয়কে অতিক্রম করে তার নামের সাথে যুক্ত হয় প্রতিরোধের কবি। এ প্রতিরোধ আক্ষরিক অর্থে নয়। আবার পরাবাস্তববাদীও নয়। অর্থাৎ দারভীশ এই প্রতিরোধকে কেবল যন্ত্রনির্ভর কিংবা তত্ত্ব ও জ্ঞানের জায়গাতেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি। প্রতিনিয়ত ভাব ও তৎপরতার মধ্য দিয়ে মৃত্যুসহ আরো নানা ঐতিহাসিকতাকে অতিক্রম করে হাজির হয় তার প্রতিরোধ বা মোকাবিলা। সুতরাং এই প্রতিরোধের বিস্তৃতি সীমাহীন, গভীরতায় অন্তহীন, সর্বব্যাপী তার প্রতিরোধ।
উল্লেখ্য, ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ ফিলিস্তিনের আলবিরওয়ায় তার জন্ম এবং ২০০৮ সালের ১০ আগস্ট তিনি মৃত্যু বরণ করেন
এক.
আরবী কবিতার ইতিহাসে মৃত্যু বিষয়ক কবিতার নিজস্ব একটি ঐতিহ্য আছে। আরবী কাব্যের ক্লাসিক সাহিত্যে মুআল্লাকার কবিদের মধ্যে মৃত্যুর যে রূপ ইসলামী-উমাইয়্যা যুগে তা আরো পরিবর্তিত। মুআল্লাকার কবিদের মধ্যে মৃত্যুর অনুষঙ্গ এসেছে দু এক পঙক্তিতে খুবই স্বল্প পরিসরে-- জীবনের প্রতি হতাশা, ক্ষোভ ও ভর্ৎসনার অভিপ্রকাশ নিয়ে তাতে মৃত্যুর বিষয় পঙক্তিবদ্ধ হয়। সে কারণে ক্লাসিক আরবী কাব্যের সমালোচনায় মুআল্লাকার মৃত্যু আলোচনাও খুবই অপ্রতুল। জুহাইর ইবনে আবী সুলমার মুআল্লাকায় মৃত্যুর একটি চিত্র লক্ষণীয়।
ইসলামী ও উমাইয়া যুগে মৃত্যুর ভাবনায় পরকালের স্মরণ প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ইহজাগতিক জীবনে মানবসত্ত্বার আধ্যাত্মিক বিকাশ ও আখেরাতে আমলনামা প্রদর্শনের কঠিন মুহূর্তে দুনিয়াবী জীবনের কর্মকান্ডের অনুশোচনার প্রেক্ষিতে মৃত্যু চিন্তার বিস্তার ঘটে। তদুপরি মৃত্যুভাবনা ইসলামী ও উমাইয়া যুগে বিশেষ বিষয় হয়ে ওঠে নি। পরবর্তী কালে আব্বাসী আমলের কবিতায় মৃত্যু ভাবনা অনেকদূর বিকশিত হয়।
বৈষয়িক কর্মকান্ডের অনুশোচনা ও আখেরাতের প্রতি ভয় ও শুদ্ধি অর্জনের তাগিদ আকারে আব্বাসী আমলের প্রথম দিকের কবিদের কবিতায় মৃত্যুর উপস্থিতি ঘটে। জাহিলী যুগের কাব্য আঙ্গিকে রচিত মৃত্যুর চিত্র আবু নুয়াসের কবিতায় বিশেষভাবে স্থান পায়। নুয়াসের কবিতায় মৃত্যুর বিষয়টি মূলত তার ব্যক্তিগত জীবনের মদ্যপান, নারীমোহ ও বিলাসী কর্মকান্ডের একটি বিরাট কালপর্ব থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রেরণা হয়ে আসে। জীবনের শেষ মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতি গভীর উপলব্ধি আর পরকালের কঠিন পরিস্থিতি তাকে ভীত সন্ত্রস্ত ও অস্থির করে তোলে, বাস্তব জীবনের এই শানে নুযূল থেকে নুয়াসের কাব্যগাথায় পরকাল, অনুশোচনা, অনুতাপ, মৃত্যু, সময় ও জীবনের যে প্রজ্ঞাপূর্ণ, ভাবভাস্বর ছন্দময় বয়ানের বুনন তৈরি হয়- আবুল আ’লা আল মাআরীর মৃত্যু তা থেকে অনেক স্বতন্ত্র ও পরিণত। বিষয়, আঙ্গিক, নন্দনকলা সবদিক থেকেই।
ইহজাগতিকতার মধ্যে জীবনের সন্ধান এবং একই সাথে পরমার্থিকতার গভীর ধ্যান, উপলব্ধি ও অবলোকনে আল মা’আরির যে আত্মনিবেদন তাতে বিপরীতভাবেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তার ঈষৎ হতাশাবোধ। শব্দ বিন্যাস, উপমা-চিত্রকল্প, প্রতীকের অনন্যতা, বাক্য গঠনরীতি ও অলঙ্কারিক স্বাদ রসায়নে আল মাআরী খ্বুই উঁচুমানের একজন মৌলিক কবি। আরবী কবিতায় মৃত্যু এবং আত্মার স্বার্থক ভাব ও প্রতীকায়ন ঘটে তার কবিতায়। আল মাআরীর বিকশিত ও স্বতন্ত্র মৃত্যুর শক্তিবলয়কে মুতানাব্বী অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হন। আল মাআ’রী, মুতানাব্বী উভয়ই তাদের কবিতার ভিত্তিমূল রচনা করেছেন দার্শনিক জায়গা থেকে। দার্শনিক অবস্থান থেকে তাদের কাব্যের যে রূপায়ণ তার ভাবগত উপজীব্য সঞ্চারিত হয় সমসাময়িক লোকজ্ঞান, সংস্কৃতি ও গ্রীক দর্শন থেকে। এরপর আরবী কবিতায় মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা বিশেষ কোনো রূপ নিয়ে হাজির হয় নি। এমনকি সাম্প্রতিক সময়েও নয়। উপরন্তু আল মাআরী এবং মুতানাব্বী অভিনব শব্দ চয়ন রীতি, বাক্য বিন্যাসের অভূতপূর্ব কৌশল, বিশেষ উৎকর্ষিত কাব্যকাঠামো সামগ্রিক অর্থে নন্দন ও শিল্পগুণে কবিতাকে যে স্তরে উন্নীত করেছেন তা এখনো পর্যন্ত ভাব ও অলঙ্কারিক ব্যাঞ্জনায় প্রাসঙ্গিক। এবং সমসাময়িকও বটে। তবে দারভীশের কাব্যমানসগত ও প্রবণতাগত বৈশিষ্ট্যের সাজুয্য পাওয়া যায় মুতানাব্বীর সাথে। দারভীশের কবিতায় ধ্রুপদী কাব্যের অনুসংযোগ ঘটেছে সাধারণভাবে মুতানাব্বীর সাথে। যে কারণে কবি হিশেবে মুতান্নাবীর সাহস, সাধনা ও দৃঢ়তা দারভীশকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। মুতানাব্বীর দর্শন হলো আশাবাদ ও শক্তিবাদ। সমাজ বাস্তবতার নানান দ্বন্দ্ব-উপদ্বন্দ্বের ফলে সমাজে যে শ্রেণীকরণ ঘটে, তাতে এক শ্রেণী অপর শ্রেণীর উপর কর্তৃত্ব ও শক্তি আরোপ করে। আর শক্তিশালী শ্রেণীর হাতে দমিত হয়- নিপীড়িত হয় দুর্বল শ্রেণীগুলো। মুতানাব্বীর অবস্থান এই শক্তিহীনদের কেন্দ্র করেই তৈরি হয়। তার ভাব, কাব্য গড়ে ওঠে এখান থেকেই। অর্থাৎ শক্তিহীন, দুর্বলদের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ চিত্রায়ণ মুতানাব্বীর কাব্যমানস প্রতিফলিত। শক্তিমান করে তোলার জন্য অক্ষম ও দুর্বলদের মানসিকতাকে আঘাত করা ছিলো তার ব্যতিক্রমী অবস্থান। নিজেকে ছোট মনে করা, অতিবিনয়ী হওয়া, হিনমন্যতায় ভোগা, নিরীহপনা করা এবং দুঃখ, দারিদ্র্য ও পরনির্ভরতার যে স্বভাব মানুষের মধ্যে বিশেষত শক্তিহীনদের মধ্যে বিদ্যমান কবি তাকে চরমভাবে ঘৃণা করেন এবং প্রত্যাখ্যান করেন। মৃত্যুর বিষয়টিও মুতানাব্বীর মধ্যে একইভাবে যুক্ত হয়।
মুতানাব্বী মৃত্যুকে সরলভাবে দেখেন নি। তার দেখার ও ভাবনার অবস্থানটি পর্যালোচনামূলক ও বিচারসাপেক্ষ। নানা সংগতি নিয়ে মৃত্যু উপস্থিত হয় তার কাব্যে। রূঢ়তা ও লাঞ্চনার উপর মৃত্যুকে প্রাধান্য দেয়া ছিলো মৃত্যুকে প্রশ্নসংকুল করে তার দেখার পূর্ব অবস্থান। কিংবা এটি তার প্রথমকার দেখা। দ্বিতীয়ত-- মুতানাব্বী মৃত্যুকে দেখেছেন সাহসের প্রতীক আকারে। যে কারণে মৃত্যুকে তিনি তুলনা করেছেন সমুদ্রের সাথে। তুলনা করে দেখেছেন মৃত্যুকে ঘুমন্ত বা নিস্ক্রিয় মুহূর্ত হিসাবে। এই নিস্ক্রিয়তা একটি মুহূর্তের সন্ধিক্ষণ মাত্র। মূলত মৃত্যুই জাগৃতির ও চৈতন্যের সাথে বিশেষিত। মুতানাব্বী বলেন-
“যাপিত জীবন এক ঘুম, মৃত্যু এক জাগ্রত চৈতন্য। এবং উভয়ের মধ্যে মানুষ এক আনন্দময় কল্পনার প্রত্যয়। . মৃত্যুভাবনা- জীবন ও মৃত্যু কিংবা ঘুম আর চৈতন্যের মধ্যবর্তী রূপ ও মুহূর্ত আকারে ইংগিতময় হয়ে ওঠে তার কাব্যে। মুতানাব্বী বলেন-
“জেনে রাখো তোমার জাগরণ আর নিদ্রার ভাব ছাড়াও এই দুই অবস্থার আরেকটি অর্থ আছে। কিন্তু এই তৃতীয় অর্থটি কী? এটি নিশ্চয়ই গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। বস্তুত মুতানাব্বীর মৃত্যুভাবনার মৌলিক অবস্থান সম্ভবত এখানেই। এই দুইয়ের মধ্যবর্তী অবস্থান বা সন্ধীক্ষণ থেকেই মাহমুদ দারভীশের মৃত্যুবিষয়ক কাব্যযাত্রা। দারভীশ যেমন বলেন-
“হে মৃত্যু, হে আমার ছায়া যা আমাকে সত্বর নিয়ে যাবে, হে দুইয়ের তৃতীয়।”
দারভীশের মৃত্যুবিষয়ক কবিতার শানে নুযূল ছিলো তার সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি। বিভিন্ন ঘটনা-অনুঘটনের প্রেক্ষিতে তার কবিতায় মৃত্যুর সংশ্লেষ ঘটে। ইসরাইলী আগ্রাসন, হত্যা, লুন্ঠন ও নির্যাতনে যে মৃত্যু ও হতাহতের দৃশ্য, এবং অন্যদিকে প্রতিরোধ লড়াইয়ের শহীদগণ ছিলো দারভীশের মৃত্যুবিষয়ক কবিতার প্রাথমিক উপজীব্য। তাঁর প্রতিটি কাব্য গ্রন্থেই মৃত্যুর প্রসংগ কোনো না কোনোভাবে এসেছে। তবে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তার মৃত্যু চিন্তা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি তার রোগ সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হন। এসময় রোগটি বেড়ে যাওয়ায় একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। তবে অনেক আগ থেকেই কবি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে প্রবলচাপে তিনি হাসপাতালে দীর্ঘদিন বিশ্রামে ছিলেন। এসময় তার সফল অপারেশনও হয়, ১৯৯৮ সালে আরেকবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনি হৃদরোগেই ইন্তেকাল করেন। দীর্ঘদিনের রোগভোগের যন্ত্রণায় একাধিক বার হৃদয়-আক্রান্ত মৃত্যুর যে অভিজ্ঞতা তিনি গ্রহণ করেন সেটি ছিলো মূলত তার স্বপ্ন-আদর্শের সংকট ও স্বদেশমুক্তি সম্পর্কিত তীব্র মানসিক যন্ত্রণার ফসল। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও পুরো ফিলিস্তিন জুড়ে যুগের পর যুগ তিনি আপনজনসহ অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। বেশ কয়েকবার তিনি নিজেও নানা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মৃত্যুর সম্মুখীন হন। মোট কথা তাঁর পুরো জীবন প্রক্রিয়াই একটি মৃত্যুময় দেশকালের বাস্তবতার মধ্যে আবর্তিত ছিলো। ফলে এক মৃত্যুর কালস্রোতে অতিবাহিত হওয়া দারভীশের কাব্যিক জীবনের পরতে পরতে মৃত্যুর যে চিত্র ফুটে উঠেছে একপর্যায়ে তা বিশেষ চিন্তা আকারে পরিণতি লাভ করে। “জিদারিয়্যাহ” (দেয়ালচিত্র) কাব্য গ্রন্থে তার মৃত্যু পরিণত রূপে উপস্থিত হয়। তবে জিদারিয়্যাহপূর্ব কাব্য গ্রন্থগুলোতে মৃত্যুর রূপ দেখা যায় ব্যবহারিক জীবনের নানান ঘটনা কেন্দ্রীক। শোক, শহীদ, প্রেম এবং বিধ্বস্ত ও লুন্ঠিত নগর প্রভৃতি বর্ণনার মধ্যে মৃত্যুর চিত্র ফুটে ওঠে। যেমন কবি বলেন:
শহীদ প্রসংগে
“তেরোটি নক্ষত্র নিভে গেল
নিয়তির খেয়ালচক্রে
কোনো কিছু নয়, শুধু শিশুটির গল্প ভেঙ্গে গেলো”
অথবা,
“মা আমরা কী অপরাধ করেছি
এমনকি আমরা দুবার মৃত্যুবরণ করি
একবার জীবনে মরি
একবার মরণে মরি”।
কিংবা,
“ওখানে মৃতরা, এবং ঔপনিবেশগুলো, মৃতরা এবং বুলডোজার, মৃতরা এবং হাসপাতাল, মৃতরা এবং রূপালী পর্দা অবলোকন করছে--মৃতরা জীবনে বহুবার মৃত্যুবরণ করে, এবং পর্যবেক্ষণ করে মৃতরা মৃত্যুর পরে জীবন যাপন করে। এবং মৃতরা সভ্যতার জঙ্গলকে মৃত্যুরূপে লালন করে। এবং মৃতরা মৃত্যুবরণ করে। এমনকি তারা
পৃথিবীকে বহন করে টুকরো টুকরো দেহ আর জীর্ণ হাড়ের উপর.....”
“আমি যদি জানতাম বৃক্ষের রহস্য
আমি যদি কবর দিতাম প্রতিটি মৃত শব্দ
আমার যদি থাকতো কবরের নিস্তব্ধতার শক্তি”
প্রেম প্রসংগে
“আমি আসবো তোমার কাছে অপেক্ষা হয়ে
আমি ডুবে যাবো তোমার ভেতর আত্মহত্যা হয়ে
আমি ভালোবাসি তোমাকে বিস্ফোরিত হয়ে
আমি ঝরে পড়ি তোমার ভেতর টুকরো টুকরো হয়ে
অথচ কেমন করে বলি আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
কিংবা,
“আমরা বেরিয়ে যাবো খুব শীঘ্রই
বললাম, আমরা বেরিয়ে যাবো অতিসত্ত্বর
আমরা তোমাদেরকে বললাম। খুব অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়বো আমাদের থেকে।
আমরা বেরিয়ে যাবো শুভ্রতার দ্বার প্রান্তে
আমরা উপলব্ধি করি প্রবেশের গূঢ় অর্থ এবং বের হবার অর্থ।
আমরা বেরিয়ে যাবো এক্ষুণি, আমাদের পিতা তাকিয়ে আছেন, যিনি আমাদের ভেতর আছেন তার ভাষার জননী পর্যন্ত।”
নগর প্রসংগে
“যদি মৃত্যু না হতো তুমি হয়ে যেতে কালো পাথর
তুমি হয়ে যেতে জীর্ণ মমিকৃত হাত।
হতো না দেয়ালের কোনো রঙ-
যদি রক্তের কোনো ফোঁটা না হতো।
দীর্ঘ রাজ পথগুলোর কোনো আকার হতো না।”
অথবা,
“ওখানে কামরাগুলোতে মৃতরা ঘুমায় যা তোমরা নির্মাণ করবে
ওখানে এমন জায়গায় মৃতরা সাক্ষাৎ করে অতীতের যা তোমরা ধ্বংস করো
ওখানে পুলগুলো পার হয় মৃতরা যা তোমরা নিমার্ণ করবে
ওখানে মৃতরা আলোকিত করে প্রজাপতিদের রাত”
উপরিউক্ত উদ্ধৃতিগুলোতে মৃত্যুর দৃশ্যপট বর্ণিত হয়েছে কিছুটা বিমূর্ত ভঙ্গিতে। শহীদ, প্রেম এবং হারানো ও ধ্বংস প্রাপ্ত নগরের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মৃত্যু। মৃত্যু এখানে যতোটা রূপকীয়, ততোটাই প্রতীকায়িত হয়েছে তার অন্তর্গত বর্ণনাগুলোতে। প্রতিটি উদ্ধৃতির সাধারণ দিক হলো: মৃত্যুকে সাহস, প্রেরণা, জীবনীশক্তি অর্থাৎ ইতিবাচক ধারণায় তুলে ধরা। এর সাথে উপজীব্য হয়ে আসে কবির সময়কার নিখুঁত বাস্তবতা। কারণ মৃত্যু বাস্তবতা ফিলিস্তিনের প্রতি মুহূর্তের অবিচ্ছেদ্য নির্মম সত্য। বিষয়টি এতোটাই স্বাভাবিক যে, তাকে অস্বীকার করা মানে তার ইতিহাসকেই অস্বীকার করা। এবং অদ্ভূতও বটে। ফলে গাড়ি, বোমা, আত্মঘাতি বিস্ফোরণ, বুলেট, গুলি, পিঠ-পেটে- সারা অঙ্গে ক্ষতের চিহ্ন, ললাটে রক্তের দাগ ইত্যাদি মৃত্যুর সহজ চিত্র গেঁথে যায় তার কবিতায়। আর সহজ ভাষার লালিত্যময় বিবরণের মধ্য দিয়েই গভীর হয়ে উঠেছে তার বিষয়ের উপলব্ধিজাত ভাব ও কাব্য। মৃত্যু তার সামগ্র্রিক জীবন যাপনের মধ্যে বিস্তারিত হয়। কবি তা উপলব্ধি করেন- অবলোকন করেন- জীবনের সমস্ত জটিল সম্পর্কের ভেতর থেকে। কবির দৃষ্টিতে মৃত্যুর প্রকাশ ঘটে নানা মাত্রিকতায়, নানা চরিত্রে, এর কোনো ধ্রুব বা সরল কোনো রূপরেখা নেই।
এই জীব জগতের মানুষের সৃষ্ট জটিল ও রহস্যময় বাস্তবতায় যেমন সংকট ও ধ্বংসের উপায় হয়ে ওঠে মৃত্যু, তেমনি তা এই ধ্বংস ও অবক্ষয় প্রতিরোধের অনিবার্য অবলম্বন হয়ে ওঠে। কারণ এটিই মানুষের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত যেখানে সরলরৈখিকভাবে মানুষ ও মানুষের কোনো সম্পর্ক বিবর্তিত হয় না। ফলে তাতে একই প্রক্রিয়ায় মৃত্যু মূর্তমান হবার কোনো সম্ভাবনা নাই। নিরেট বাস্তবতা থেকেই জীবন মৃত্যুর গতি ও সম্পর্ক বুঝতে হয়। দারভীশ বলেন:
“মৃত্যুর সাথে সে খেলা করে, মৃত্যুর মালা গাঁথে, মৃত্যুর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সে মৃত্যুকে ভালো করে চেনে। চেনে তার সমূহ স্বভাব প্রকৃতি। সে মৃত্যুর রূপ, প্রকরণ ব্যাখ্যা করে: কপালে গুলি, অতপর আমি পর্বতের ঢালে ঝরে পড়ি শকুনের ন্যায়।
আমার গাড়ির নিচে বোমা অতপর উড়ে যায় হাত বেলকনি ঘেঁষে
ভেঙ্গে যায় ফুলদানী, কিংবা
টেলিভিশনের পর্দা। টেবিলের নিচে বোমা, কিংবা পিঠের উপর বোমা
কিংবা গলার নিচে বুলেট।
এভাবেই মৃত্যু তোমার ধারণার চেয়েও অনেক অনেক সম্প্রসারিত।”
বিপরীত দিকে মৃত্যুর প্রতিরোধ যেখানে তীব্রতরো সেখানেও মৃত্যু
বিদ্যমান। কিন্তু এর উৎস, প্রকাশ ও গতিবিধি ভিন্ন। কারণ অন্যায়,
শোষণ ও নির্যাতনের রাজনীতি নির্মূলের মধ্যে যে প্রতিরোধমুখর রক্তের
উষ্ণতা তা আরো বেশি জীবনমুখী এবং সার্বজনীন। কিন্তু তার অস্তিত্ব
লড়াইয়ের মধ্যে। শাহাদাতের মৃত্যুর মধ্যে। দারভীশ বলেন:
“তোমার সংগীতের জন্য ভেঙ্গে পড়ে কাঠুরিয়া, প্রেমিকা, পানির আকাশ।
ভূপৃষ্ঠজুড়ে ভোরের উদ্বোধন ঘটে আর শব্দরা ক্রমাগত বিস্মৃত হয়ে চলতে চলতে যুথবদ্ধ হয় সহস্র হত্যাকান্ডে। মৃত্যু আসে উজ্জ্বল হয়ে
বৃষ্টি নামে প্রবল বর্ষণে। স্বচ্ছ হয়ে ওঠে রিভলবার এবং নিহতজন।
শহীদেরা আসবে তোমার সর্বশেষ উচ্চারণের প্রাচীর ভেদ করে। তারা বসবে তোমার উপর রক্তের মুকুট হয়ে। এবং তোমার স্মৃতির বাহিরে আপেলের চাষাবাদ হয়ে পিছু র্পিছু আসবে তারা।”
“সে চায়না....আমাদের শোকের
পুনরাবৃত্তি চায় না ...এখন আর কোনো বিতর্ক চায় না।
রক্তের দাবি শুধু ফরিয়াদ করে--তুমি প্রতিরোধ করো, লড়াই করো।”
সুতরাং মৃত্যুর কোনো মৃত্যু নেই। মৃত্যু অমর। এই মৃত্যু মৃত্যুলীলা নয়। তামাশা নয়। শোষণ, দখলদারী, বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদী বর্ণবাদসহ যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াইয়ের মধ্যে যে জীবন-মৃত্যু তা মূলত মানুষের সত্যিকারের ইতিহাস সূচনার পূর্বশর্ত। দারভীশের মৃত্যু ভাবনা বৃহত্তর অর্থে বর্তমান সংকটময় জগতের ইতিহাস অতিক্রম করার সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এবং এই মৃত্যু কাজে কাজেই জীবনের অখন্ড অংশ হয়ে ওঠে; ইতিহাসের ভেতর দারভীশের মৃত্যুকে এইভাবে শনাক্ত করার এবং এর রূপ দেয়ার কর্তব্য যতোখানি বাস্তবময়, সপ্রাণ তৎপরতার দিক থেকে তারচেয়ে অনেক বেশি প্রজ্ঞাময় পরমার্থিক। দারভীশ বলেন:
“এই মৃত্যু মৃত্যু নয়। না, আমি আমার যাবতীয় সূচনার কিছুই জানি না।
কারণ, আমি নদীর সমকক্ষ হতে চাই। এমনকি আমি নদী হয়ে যেতে চাই।
না, আমি পারি না মরতে মৃত্যুর মধ্যে, যার মধ্যে মৃত্যু নেই।
পাথর আমার আত্মা,
আমার স্ত্রী, আমার স্বপ্ন পাথর,
তাকে পাওয়ার মতো কোনো চাওয়া নেই আমার
পাথর, যার কোনো রঙ নেই, রূপ নেই।
পাথর আমার রাতের মতো। আর আমার ছায়া এক পাথর।
ঢুকে পড়ে চুপচাপ আমার ভেতরে এবং আমার সবকিছুর ভেতরে।
পাথর আমার রুটি।
মদ আমার পাথর।
আমি পারি না মরতে মৃত্যুর ভেতর
এখন যেখানে মৃত্যু নাই ......
মূলত কোনো কিছুই নাই এইখানে, যা মৃত্যুকে উস্কিয়ে দেয়।”
সাম্প্রতিক সমাজ এবং পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন ও হত্যার যে ইতিহাস তার প্রতিরোধ ও অতিক্রমের প্রশ্নে পাল্টা যে তৎপরতাগুলো সক্রিয় দারভীশের ভাষায়--তার কোনো মৃত্যু নাই। মৃত্যু অসম্ভব। এমনকি এই পরমার্থিক ও প্রতিরোধমুখর শক্তিকে নিঃশেষ করা কিংবা এর মৃত্যুকে অর্থাৎ এর নিঃশেষকরণকে উস্কিয়ে দেয়াও সম্ভব না। এই পথে যারা জীবন দেয়, মৃত্যুবরণ করে--মূলত এই মৃত্যু মৃত্যু নয়। এর কোনো আরম্ভ নাই। শেষ নাই। কারণ এই মৃত্যু আর জীবন অবিভাজ্য। জীবন-মৃত্যু এখানে পরমার্থিক। এই প্রজ্ঞাপারমিতা অন্যায়ের মৃত্যু ঘটানো এবং পরমপ্রজ্ঞার ইতিহাস গড়ার অনিবার্য প্রত্যয়। দারভীশের কাছে এই রূহানি-- নদীর মতো, পাথরের মতো এই দ্বান্দ্বিক উপমার মাধ্যমে বিষয়টির তাৎপর্য আরো প্রগাঢ় করে তোললেন কবি। এটি নদীর মতো প্রবহমান, একই ভাবে তা পাথর- পরম পাথর। এর মৃত্যু ঘটানো, কিংবা নিশ্চিহ্নকরণ সম্ভব নয়। কারণ এর কোনো রঙ নাই। আকার নাই। অধরার মতো অথচ তার আছেময়তা স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী। কবির এই ভাবপ্রত্যয় দেয়ালচিত্র কাব্যগ্রন্থে আরো-বেশি পরিণত হয়ে ওঠে।
দুই.
“জিদারিয়্যাহ” (দেয়ালিকা, দেয়ালচিত্র) নামকরণের ক্ষেত্রে আরবী কাব্যের প্রাচীন নিদর্শন সাবঅ’ মুআল্লাকাহ’র (ঝুলন্ত গীতিকাসপ্তক) মুআল্লাকা শব্দের সাথে যোগসূত্র থাকতে পারে। মুআল্লাকা শব্দের অর্থ ঝুলন্ত। ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত বার্ষিক মেলার কবি সম্মেলনে পঠিত- নির্বাচিত শ্র্রেষ্ঠ কবিতা কাবা শরীফের দেয়ালে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হিশাবে এবং বহুপ্রচারণার উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখার প্রচলন ছিলো। “জিদার” অর্থ দেয়াল, তা থেকে “জিদারিয়্যাহ” অর্থাৎ দেয়াল সম্পর্কিত, দেয়ালে ঝুলানো কোনো কিছু কিংবা দেয়ালিকা বা দেয়ালচিত্র। মুআল্লাকা এবং জিদারিয়্যা- শব্দদ্বয়ের মধ্যে কেবল অর্থগত মিল আছে। অর্থটি হলো ঝুলানোর ব্যাপার। তবে এটি মুআল্লাকার মতো সরাসরি অর্থবোধক নয়। মানে দেয়ালে কোনো কিছু ঝুলিয়ে রাখা হলে এর অর্থ এরকম হয়। এছাড়া আর কোনো মিল সম্ভবত নাই। বস্তুত আরবী কাব্যের একটি ঐতিহাসিক ও ধ্র“পদী তাৎপর্যের জায়গা থেকে দারভীশ হয়তো শিরোনামটি এভাবে নির্ধারণ করেছেন। তবে মুআল্লাকার সাথে আরেকটি ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। একটি কাসীদা বা একটি কবিতা দিয়েই মুআল্লাকা। কাসীদা আরবী কাব্যের একটি বিশেষ রূপ। এর নির্দিষ্ট কাব্য বৈশিষ্ট্য আছে। সেদিক থেকে দারভীশের জিদারিয়্যাহ বা দেয়াল চিত্রও একটি কাসীদা যা পুরোটাই একটি কবিতা। যদিও দারভীশ টানা গদ্যছন্দে জিদারিয়্যার পঙক্তিমালা বিন্যস্ত করেছেন। কোথাও কোথাও অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাত্রাগত বুনন লক্ষণীয়। কিন্তু এটি ছন্দের মুক্তরীতিতে রচিত অন্ত্যমিলমুক্ত কবিতা। তবে আধুনিক ফরাসী কাব্যের রূপগত কোনো প্রভাব থাকতে পারে তাতে। কারণ দারভীশ সরাসরি ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যের একজন ঘনিষ্ঠ পাঠকও ছিলেন। আরবী কাব্যের ধ্রপদী রূপ ও গঠনগতরীতির অনুকরণ না থাকলেও এই কাব্যগ্রন্থে দারভীশ ক্লাসিক কাব্যের ভাবসম্পদ থেকে উপাদান গ্রহণ করেছেন। মুতানাব্বী এবং আবুল আলা আল মাআরীর চিন্তা ও মানস এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
জিদারিয়্যার মূল বিষয় মৃত্যুর প্রতিরোধ ও ধর্মচিন্তা। সেকারণেও এর নাম দেয়াল বা প্রাচীর হতে পারে। কারণ দেয়াল মানে প্রতিরোধের দেয়াল। লড়াইয়ের প্রাচীর। প্রতিরক্ষা বুহ্য। তবে পুরো কাব্যজুড়ে মৃত্যু বিষয়ক ভাব ও ভাষার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। ইহ-পরমার্থিক ভাবনা, স্থান-কাল চিন্তা হতে “আমি”র নির্বিশেষ ও অনন্ত সম্ভাবনাময় ভাবকে ঘিরে মৃত্যুসহ অন্য বিষয়গুলো আবর্তিত হয়েছে।
এখানে মৃত্যুর সাথে ‘আমি’র সম্পর্ক গতিশীল। ভয়, চ্যালেঞ্জ, দুঃসাহসিকতা, আত্মনির্ভরতা, আত্মনিবেদন, দুর্বলতা ও শক্তির প্রকাশই নানা বিশেষণমূলক দ্বান্দ্বিক-উপদ্বান্দ্বিক গতিপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর বিষয়টি স্পষ্ট কওে তুলেছে। উল্লেখ্য, এখানে “আমি” কর্তাবোধক শব্দটি একটি প্রতিনিধিত্বশীল শব্দ। সমগ্র বিশেষ বিশেষ সত্ত্বার নির্বিশেষ রূপ এই “আমি”।
জিদারিয়্যার ভাষাগত আঙ্গিক লিরিকধর্মী। গীতিসুরের প্রবল টানে যে মগ্নতা পাঠককে ভরিয়ে তোলে তা কবির একান্ত দার্শনিক অবলোকন। দারভীশ আবুল আ’লা আল মাআরীর “রিসালাতুল গুফরান” (ক্ষমাপত্র) কিংবা ইতালির কবি দার্শনিক দান্তে অলি গিয়েরির (১২৬৫-১৩২১) ডিভাইন কমেডি থেকে কিঞ্চিৎ রসদ সংগ্রহ করেছেন হয়তো। তবে এক্ষেত্রে নাটকীয় সংলাপের আঙ্গিক প্রধান দারভীশের জিদারিয়্যা ধ্রুপদী কাব্যের ভাব ও ভাষার আলামত সঞ্চয় করে স্বতন্ত্ররূপে নির্মিত হয়। সমসাময়িক ইতিহাসকে অতিক্রম করে যাওয়া এবং বিশ্বজগতকে নতুন করে নির্মাণের বিপুল আকুতি ধরা পড়ে এই কাব্যগ্রন্থে। কিন্তু এর জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে আসে ধ্বংসকামী, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মৃত্যু। এইরকম মৃত্যুর মোকাবেলায় দারভীশের অভিজ্ঞতা দুটি পদক্ষেপে তরান্বিত হয়। প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদী ধ্বংস লীলার মুখোমুখি হওয়া। দ্বিতীয়ত, অবক্ষয়ের মুখোমুখি হওয়া। দারভীশের ভাবপ্রক্রিয়া অনুযায়ী এই দুই অবস্থার নামই মৃত্যু। ফলে উভয় মৃত্যুর মোকাবেলা সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নাই অর্থাৎ মৃত্যুকে মৃত্যুর মাধ্যমেই মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু উপরিউক্ত দুই মৃত্যুকে যে মৃত্যুর মাধ্যমে প্রতিহত করা হবে তা মূলত মৃত্যু নয়। দারভীশের ভাষায়Ñ এর নাম জীবন। “বর্তমান মানুষ” তাকে মৃত্যু বললেও এটি মৃত্যু নয়। যা মৃত্যুকে অর্থাৎ ধ্বংসলীলা, অন্যায়, জুলুম ও বর্ণবৈষম্যকে মোকাবেলা করতে পারে তার নাম মৃত্যু নয়। বস্তুত বর্তমান ইতিহাস মৃত্যুর ইতিহাস। এটি জীবনের ইতিহাস নয়। মানুষের ইতিহাস নয়। তাই মানুষের ইতিহাস যেহেতু মানুষের হাতই নির্মাণ করবে সেজন্য চলমান মৃত্যুর জগতকে মোকাবেলা করে পরবর্তী নতুন ইতিহাসের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে হবে ঐ সকল মানুষকে যাদের মধ্যে প্রচলিত অর্থে মৃত্যু নাই, এমনকি জীবনও নাই মানে স্বার্থবোধ নাই। দারভীশ শহীদের ইচ্ছার প্রতি ইংগিত করে বলেন-
“আর এখন
বৈদ্যুতিক বোতাম একাই কাজ করে। না।
কোনো হত্যাকারী নিহতদের প্রতি কান জাগায় না
অথচ শহীদ, খুনীর দাবির পিছে চলে না।”
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে মৃত্যু বিষয়ে দারভীশের দুটি অবস্থান তুলে ধরা হবে। নিচের কয়েকটি কবিতার উদ্ধৃতিতে এর একটি বিষয় স্পষ্ট করার প্রয়াস থাকবে। দারভীশ বলেন:
১.
“আমি এমন মৃত্যু পাই নি যাতে আমি জীবনকে শিকার করি
আমি এমন কণ্ঠ পাই নি যাতে আমি চিৎকার করে বলি:
হে দ্রুতগামী সময়। তুমি আমাকে নিয়ে গেলে তা থেকে
রহস্যময় হরফরা যা আমাকে বলেছিলো: বাস্তবতা সে তো দৃঢ় কল্পনা।”
২.
“আমি ওখানে দেখি না আমার দেহ,
আমি অনুভব করি না মৃত্যুর আরম্ভ কিংবা আমার প্রথম জীবন
যেনো আমি আমার নধ্যে নই। আমি কে? আমি কি
হারানো, মৃত, নাকি এক নবজাতক?
সময় এক শূন্য বিষয়। আমি ভাবিনি জন্ম
যখন মৃত্যু আমাকে নিয়ে যায় দূর আকাশের দিকে অথচ আমি জীবিত নই, মৃতও নই।
ওখানে কোনো অনস্তিত্ত্ব নাই, অস্তিত্ত্বও নাই।”
৩.
“তারা কি ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি করবে? শুরু কী?
শেষ কী? আমাদেরকে হাকীকত জানানোর জন্য
মৃতদের কেউই আসেনি....
মৃত্যু, আমার জন্য অপেক্ষা করো পৃথিবীর বাইরে
আমার জন্য অপেক্ষা করো তোমার দেশে, যতোক্ষণ না আমি শেষ করি আমার বাকী জীবনের সাথে চলমান কথা।
অপেক্ষা করো তোমার তাবুর কাছাকাছি, যতোক্ষণ না আমি ত্বরফা বিন আব্দকে পাঠ করা শেষ করি।
প্রতিমুহূর্তের সুখবিলাস দিয়ে অস্তিত্ববাদীরা আমাকে প্ররোচিত করে স্বাধীনতায়, ইনসাফে, আর ঈশ্বরদের শরাবে ............
মৃত্যু, আমার জন্য অপেক্ষা করো, যতোক্ষণ না আমি শেষ করি ঝরা বসন্তে জানাজার আয়োজনগুলো....
যেখানে আমার জন্ম, সেখানে আমি বক্তাদেরকে ফিরিয়ে রেখেছি সেসব কথা বারবার বলা থেকে
যা তারা বলেছিলো দুঃখীর দেশ নিয়ে কাল আর কালের,
লড়াকু চেহারায় ডুমুর জলপাইয়ের নির্ভরতা নিয়ে,
আমি বলি: আমাকে ঢেলে দাও নূন হরফে-
যাতে কুরআনের ভেতর সুরা রহমান
আমার আত্মাকে গভীরভাবে পান করে নেয়।”
৪.
মৃত্যু অপেক্ষা করো, যাতে আমি
ভরে নেই: আমার দাঁত ব্রাশ, শাবান, রেজার, সুগন্ধিজল, কাপড়
ওখানে কি আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ?
শাদা অনন্তের ভেতর অবস্থাগুলো কি বদলে যাবে?”
প্রথম দুই উদ্ধৃতির ভাবনা পরের দুই উদ্ধৃতির অর্থ থেকে কিছুটা ভিন্ন। বাস্তব জগতের একটি দার্শনিক বিচার তৈরি করেন কবি এর মধ্যে। বিদ্যমান বিশ্বজগতে যে কর্তাসত্তা ক্রিয়াশীল, শাসনপরায়ণ কবি এই শাসনপরায়ণ কর্তার প্রকৃতি ও বাস্তবতার নিগড় থেকে বেরিয়ে যেতে নিদারুণ ব্যাকুল। কিন্তু কোথায় যাবেন? বাইরে তো কবি দেশকালের কোনো অস্তিত্ত্ব খুঁজে পান না। সেখানে সময় নাই। দেশও নাই। কোনো আছেময়তার প্রশ্ন কবি তাতে যুক্ত করতে রাজী নন। এমনকি যে বাস্তবতার কথা কবি বোঝেন তাতে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নও অবান্তর। কবির ভাষায়--“অথচ আমি জীবিত নই, মৃতও নই” ফলে কবির কাছে বাস্তবতাই পরম এবং ধ্রুব। তাহলে “জীবিত নই, মৃতও নই” মানে কী এবং কোন বাস্তবতার কথা কবি বোঝাতে চেয়েছেন এবং এর সাথে পরমের সম্পর্ক কী করে এলো বা বাস্তবতা কোন প্রক্রিয়ায় জরুরি জ্ঞান বা সত্য হয়ে ওঠে। এই প্রশ্নগুলো অনিবার্যভাবে চলে আসে। এসব প্রশ্ন আর উত্তরের নাটকীয় সংলাপের ভেতর দারভীশ যতোখানি দার্শনিক, ভাবুক, ততোখানিই তিনি কবি। যেকারণে কোনো বিদ্যায়তনিক পদ্ধতির জায়গা থেকে এর বিচার বিশ্লেষণ করা অনেক জটিল। পুরো জিদারিয়া কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করার মধ্য দিয়ে “বাস্তবতা” বলতে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হাকীকত বা মর্মগত সত্য। যেখানে কাল নাই, দেশ নাই, টাইম এবং স্পেসের সম্পর্ক নাই। স্থানকাল নিরপেক্ষ একটি বিষয়। ফলে এর সাথে জীবন বা মৃত্যুর প্রশ্নও অপ্রাসংগিক হয়ে পড়ে। কবি মূলত এই সত্যেরই স্বপ্ন দেখেন, এমনকি এই সত্য কোথাও বাস করার বা কারো ভেতরে লুকায়িত থাকার ব্যাপার না। এই সত্যই “বিশ্বজগত”, এই সত্যই “আমি” এটি যতোখানি উপলদ্ধির ও জ্ঞানগতভাবে অবলোকনের, তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের মধ্যে তা ধারণ করার। এই ইতিহাস নিশ্চয়ই প্রথাগত একরৈখিক সময়, দেহ, ও জীবন-মৃত্যুর সংজ্ঞা দ্বারা সংজ্ঞায়িত নয়। তদুপরি এটি অর্জন সাপেক্ষ। কিন্তু আচম্বিৎ ধরা দেবার বিষয় নয়। লড়াই করে, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে সাধনা করে ধরবার বিষয়। প্রতিষ্ঠার বিষয়।
কিন্তু ৩য় ও ৪র্থ উদ্ধৃতিতে কবিকে স্ববিরোধী মনে হতে পারে পূর্বের আলোচনা মতে। এই দুটি উদ্ধৃতির ভাষাগত কাব্যিক ঢঙ্গের কারণে কবিকে আধ্যাত্মবাদী মনে হতে পারে। কারণ দৃশ্যত কবি মৃত্যুই কামনা করেন ও মৃত্যুর আকাক্সক্ষার পাশাপাশি দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছেদের মতো সূফীবাদী আবহ তৈরি হয়েছে বলে মনে হবে।
বিষয়টি ঠিক এরকম নয়, তবু যদি সূফীভাবনার সাথে মিলে যায় তাতেও সমস্যা নাই। কারণ দারভীশের সূফীবাদ করা উদ্দেশ্য নয়। দারভীশের প্রশ্ন মূলত, মৃত্যুকে মোকাবেলা করা। বস্তুবাদ আর পুঁজির মৃত্যুলীলা ও নৈতিক অবক্ষয়লীলা। এই দুই মৃত্যুর হল্লাকে মোকাবেলা করা দারভীশের আসল বিষয়। কবি এ দুইয়ের বাইরে যেদিকে অগ্রসর হয়েছেন সেটি স্পিরিচুয়াল বা রূহানী শক্তিসম্পন্ন হওয়ায় কবিতায় যে আবেগ ও সংবেদনার পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাতে তাকে আধ্যাত্মিক সূফীবাদী বুঝলে মুশকিল আছে। কারণ দারভীশের কাছে ব্যাপারটি মূলত রাজনৈতিক। ব্যক্তির শুদ্ধি বা জীবন বিরাগী তিনি ছিলেন না। কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি এর চর্চা করেন নি। একাধিকবার আসা “মৃত্যু, অপেক্ষা করো” বাক্যটির সাথে সংশ্লিষ্ট কথাগুলো প্রচ্ছন্নভাবে মৃত্যুর ঊর্ধ্বে উঠবার প্রবল মানসিক শক্তিরই প্রকাশ, যেহেতু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর ধারণাকে অতিক্রম করে যাওয়া কবির প্রধান লক্ষ্য। এটা না হলে দেশ-কালে ও আমিত্বের সীমায় বাঁধা মৃত্যুসহ সমস্ত চিন্তা ও কাজের মধ্য থেকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। জিদারিয়্যা থেকে নেয়া নিচের উদ্ধৃতিগুলো এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। কবি বলেন:
১.
“ওখানে আমার রাজ্য
ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে আমার পিতার সন্তান
ধরো ইতিহাস...যা চাও সহজাত প্রকৃতিতে তৈরি করো।”
২.
“ফিরে আসো হে মৃত্যু! একাকী, নিরাপদে
আমি মুক্ত স্বাধীন না-ওখানে, না-এখানে। কিংবা ফিরে আসো তোমার নির্বাসনে, একাকী।
তোমার শিকারের উপায়-উপকরণে ফিরে আসো।
অপেক্ষা করো সমুদ্রের দরোজার কাছে। প্রস্তুত করো
আমার জন্য, রুগ্ন পৃথিবীর শুশ্রুষার জন্য,
আমার প্রত্যাবর্তনের মাহফিলের জন্য লাল শরাব।”
৩.
“আমি বাদাম আর আনারের বেষ্টনীর উপর
নিজের অবস্থানকে বেছে নিয়েছি। আমি আমার
পিতা মাতার আলখেল্লা থেকে প্রবাহিত করি মাকড়সার সুতো।
যেখানে এক অচেনা সৈনিক পুরনো অলিগলি অতিক্রম করতো।
কারণ, সে প্রাচীন, আদি লড়াইয়ের অস্ত্র দিয়ে
কালের দূরত্ব মাপতো। হে মৃত্যু! এই কি সেই ইতিহাস
তোমার সমকক্ষ কিংবা তোমার শত্রু,
দুই গহবরের মধ্যখানের আরোহী? যেখানে কবুতর বাসা বাঁধে,
ডিম পাড়ে লোহার হেলমেটে আর যানবাহনের চাকায়
অতিশয় অঙ্কুরিত হয় গরম সব উদ্ভিদ।
তাহলে ইতিহাস, তোমার সমকক্ষ, কিংবা শত্রু কে কী করে প্রকৃতিতে?
যখন পৃথিবী মিলিত হয় আকাশে
এবং বর্ষণ করে পবিত্র বৃষ্টি।”
“কতো সময় কেটে গেলো
যখন আমাদের আবির্ভাব হলো যমজরূপে
সময় আর প্রাকৃতিক মৃত্যু জীবনের জন্য সমার্থক?
অথচ আমরা হামেশাই জীবন্ত। মৃত্যুই যেনো আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে।”
নানান বর্ণনামূলক প্রতীক ও রূপকের ব্যবহারের ফলে উপরের পঙক্তিগুলোর ভাবকে কখনো বিমূর্ত মনে হতে পারে তবে প্রথম উদ্ধৃতিতে ইতিহাসের মধ্যে নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করা, দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে হাকীকতে ফিরে আসার আহবান, তৃতীয় উদ্ধৃতির দীর্ঘ বিবরণে প্রাচীন সৈনিকের লড়াইয়ের অভিযাত্রা, আর বিবদমান সময়ের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, ভেদ, বৈষম্যের আগুন পোড়া গভীর অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে জীবন-মৃত্যুর সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমকারী কবুতরের সংগ্রামী জীবনযাপন ও ইতিহাসে শত্রু-মিত্রের প্রশ্নে নিশ্চয়ই কবির মৃত্যুবিষয়ক প্রস্তাবনা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চতুর্থ উদ্ধৃতিতে আরো বেশি পরিষ্কার। কারণ দারভীশের কাছে মৃত্যুর প্রশ্ন সরল তো নয়ই এমনকি ইতিহাস নিরপেক্ষ কোনো ঘটনাও নয় বরং তার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে নিজের দায় ও কর্তব্যের প্রশ্ন। এই কর্তব্য কবির মানে সমগ্র মানবসত্তার দায়। নিচের এই পঙক্তিগুলোতে বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার। কবি বলেন:
“হে ভ্রান্তির সন্তান, হে আল্লাহর সীমাবদ্ধ আদম সন্তান
তোমাকে প্রশ্ন করার জন্য জন্ম দেয়া হয়নি
বরং কাজ করো... হয়ে যাও উত্তম বন্ধু হে মৃত্যু!
হয়ে যাও এক সাংস্কৃতিক ভাব যেনো আমি উপলব্ধি করতে পারি
তোমার রহস্যময় প্রজ্ঞার মর্ম।”
“মৃত্যু! তোমাকে পরাজিত করেছে
সমস্ত শিল্প।
মৃত্যু! তোমাকে পরাজিত করেছে
প্রতিনিধিদের দেশের গান।
মিশরের তীক্ষè সুঁই, ফেরাউনের কবর ।
তোমাকে পরাজিত করেছে
মন্দীরের পাথর খচিত নকশা।
সে-ই বিজয়ী, আর তোমার রহস্যের আধার থেকে
মুক্তি পেলো মহাকাল।
গান, কবিতা, নান্দনিকতা, শিল্প, স্বপ্ন যেমন জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ দিক তেমনি ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই মানুষের অশেষ মোহ কাজ করে এই বিষয়গুলোর প্রতি। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই এর ছেদ ঘটায়। কিন্তু মৃত্যু নয়। দারভীশ মনে করেন কর্ম, শ্রম, সাহস এবং লড়াইয়ের মধ্যেই মানুষের অস্তিত্ব। সমাজের নতুন অভিমুখ, স্বপ্ন এবং চিন্তা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। এই সম্ভাবনায় শিল্প, সৌন্দর্যসহ জীবনের বহু মৌলিক দিক নতুন করে উন্মোচিত হয়। মানুষের এই অভিযাত্রায় মৃত্যু স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য এক বাস্তবতা কিন্তু কবির কাছে মৃত্যু জীবনেরই এক অংশ। মৃত্যু ছাড়া নতুন জীবন, নতুন সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাই মৃত্যু নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নয়, ভয় নয়, মোহ নয়। মৃত্যু মূলত মানুষের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। কবির চিন্তায় এই ভয়, মোহের মতো স্বার্থের অস্তিত্বকে রোধ না করা হলে মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব নয়। পরমার্থিক জীবনের শর্ত তৈরি হবে না। জীবনকে এগিয়ে নেবার পথে মানুষের মনোজগতে মৃত্যু এক জড়তা তৈরি করে। সাহসের অভাব ঘটায়। মৃত্যুর ভয়-মানসিকতা অস্বাভাবিকতা তৈরি করে। অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন সয়ে যাবার স্বভাব ও অভ্যাস সৃষ্টি করে মৃত্যু। মানুষকে প্রশ্নহীন করে তোলে। এমনকি দাস মনোবৃত্তির প্রকৃতি ও মানসিকতার উদ্ভব ঘটায় মৃত্যু। ফলে মৃত্যু নিয়ে মানুষের এরকম অবস্থানের কারণে শ্রেণীভেদ তৈরি হওয়াও অনিবার্য। ভেদ-বৈষম্য ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলবে যেমন, তেমনি অন্যদিকে আধিপত্যবাদী শক্তির জুলুম, অন্যায় ও বেইনসাফে ভরে যাবে সবকিছু। দারভীশের মৃত্যু নিয়ে এভাবে চিন্তা করার শানে নুযুলটা মূলত একটা সময়ে ফিলিস্তিনী মানুষের লড়াই বিমুখ হয়ে যাবার মানসিকতা। ফিলিস্তিনীদের লড়াইয়ের ইতিহাসে হাল আমলের আপোসের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা কবির ভাবনাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তরুণ সমাজে অতিমাত্রার খেলাধুলা, ভোগ-বিলাস, আনন্দ, বিনোদনের মোহ ও অশ্লীল সাংস্কৃতিক চর্চা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। জাতীয় মর্যাদাবোধ কিংবা রাজনৈতিক সচেতনতার দারুণ সংকট তৈরি হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেণী যারা লড়াই করে যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে তাদের মধ্যে যতোটুকু সচেতনতা গড়ে উঠছে আধুনিকতার এইসব প্রভাবে ততটুকুই আবার হ্রাস পাচ্ছে।
এই লড়াইরত শ্রেণীগুলো যেমন কবির লক্ষ্য তেমনি সকলেই। কবির কাছে প্রতিরোধ কেবল রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক লড়াইও বটে। লড়াইয়ের আদর্শিক লক্ষ্য অনুযায়ী শত্র“ ও তার সমস্ত সম্পর্ক, যোগসূত্র ও অবস্থান নিশ্চিত করে এর বিপক্ষে প্রতিরোধ বিস্তারিত হয়। কিন্তু দারভীশের প্রতিরোধ প্রকাশ্য শত্র“র বিরুদ্ধে যেমন একই সময় তা অন্তরজগতের শত্র“ মৃত্যুর বিরুদ্ধেও। মানে মৃত্যুর ভয়কে মগজ ও মন থেকে মুছে ফেলা। এই ভেতরের শত্র“র অবসান করতে না পারলে বাস্তবিক অর্থে জীবনকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই কবির ভাষায় মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাবার সাহসী উচ্চারণ কাব্যিক ভাবতরঙ্গে ব্যক্ত হয়--“তোমার যাবতীয় রহস্যের আধার থেকে মহাকাল মুক্ত।” মৃত্যুর ভয় প্রতিরোধ করা কবির শেষ কাজ নয়। প্রতিরোধকে সাংস্কৃতিক ও নৈতিক জায়গায় স্থাপন করা তার চিন্তার বিশেষ দিক। কবি বলেন:
“মৃত্যু! অপেক্ষা করো, মৃত্যু হে,
তবে ফিরিয়ে আনি আমার চিন্তার শুদ্ধি
আর আমার স্বাস্থ্য হয়ে উঠবে পবিত্র শিকারী ।
যা ঝর্ণার পাশে হরীণকে শিকার করে না। অতএব আমাদের সম্পর্ক
প্রেমময়, পরিষ্কার।”
এখানে মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত হয়ে পঙক্তিগুলো শুরু হয়। মৃত্যু এখানে চ্যালেঞ্জ হিসাবে আসে। মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করে কবি ‘ইস্তিআদ’ বা পুনরুদ্ধারের গতি প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জিহ্ন’ বা মননের মধ্যে শুদ্ধি আকারে। অর্থাৎ নৈতিক ও আত্মিক শুদ্ধি অর্জনের সাধনা আকারে। এখানে জিহ্ন শব্দটির অর্থ চিন্তা, ভাব, বিবেক ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত। তবে এর সাথে প্রচলিত আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক নাই। কোনো মিল হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু কবির ভাবগত অবস্থানের সাথে সূফীধারার বিস্তর ফারাক আছে। মূলত কবি জিহানে পরিশুদ্ধি ফিরিয়ে আনার কথা বলে মানবসত্ত্বাকে সপ্রাণ ও সজ্ঞান করে তোলার নিবেদন করেছেন অখন্ড প্রক্রিয়ায়। যে কারণে দারভীশ ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে প্রতীকি কায়দায় বসন্তের সাথে সম্পর্কিত করেছেন। মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বসন্তে প্রকৃতিতে প্রাণসত্ত্বা নতুনভাবে জেগে ওঠে। প্রকৃতিতে সজীবতা ফিরে আসে। প্রকৃতি নতুন সাজে, নতুন প্রাণে জেগে ওঠে। ফলে দেখা যায় কবি এখানে অন্তর্গত দিক থেকে প্রতিরোধ নির্মাণ করেছেন সূক্ষ্মভাবে। কারণ কবি মনে করেন প্রকৃতি মৃত্যু চেনে না। মৃত্যু প্রকৃতির বিষয় নয়। ইতিহাসে মৃত্যু বিষয় হয়ে উঠেছে মানুষের। অন্যদিকে শিকার করার জন্য পবিত্র শর্ত আরোপ করলেন। অর্থাৎ শিকারকারীর পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। বেঁচে থাকবার জন্য যা কিছু মানুষ গ্রহণ করে, আহরণ করে সবকিছুই শিকার বা শিকারের আওতাভুক্ত। ফলে তাকে পবিত্র শিকারী হতে হবে। এখানে শিকার শব্দটি প্রতিরোধ যোদ্ধার রূপক হিশেবে এসেছে। যে যোদ্ধার শিকার হবে না অবলা নিরাপরাধ কোনো হরীণ। এই হরীণ শব্দটিও একটি রূপক। যার দ্বারা নিরীহ শক্তিহীনদের বুঝানো হয়। সবদিক খেয়াল করে তাকে লড়াইটা করেই যেতে হবে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয় অর্থে। তাহলে দেখা যাচ্ছে তথাকথিত সূফীধারার সাথে দারভীশকে মেলানো কঠিন। মৃত্যুকে এখনো একটি আলাদা বিষয় হিশেবে ধরে নেয়া হয়। দারভীশ বলেন, মৃত্যু কোনো আলাদা বা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এ কবিতার এই পঙক্তিগুলোতে তা আরো পরিস্কার হয়ে উঠেছে-
“তোমার জন্য তুমি
যখন আমি জীবন পূর্ণ করে দিলাম তাতে তোমার কিছুই নাই।
তোমার প্রতি আমার ভাব নক্ষত্রজুড়ে।”
মৃত্যু বিষয়ক অনেক ধারণা, তত্ত্ব ও দর্শনের ধারা প্রচলিত আছে। কিন্তু দারভীশ সেইসব জায়গায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে দেখেন নি। অধিপতিপরায়ণ রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজ, রাষ্ট্রের সম্পর্কের জায়গায় একটি সংকট আকারে দেখেছেন। এবং তাকে মোকাবেলা করার ভাব ও কাব্যে নিবেদিত কবি দারভীশ।
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি
Mr
প্রিয় কবিকে নিয়ে দরকারি একটা লেখা। অনেক ধন্যবাদ...