ট্রানজিট থেকে কানেক্টিভিটি : ইনডিয়ার প্রয়োজনের রকমফের
এ মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের কথা ছিল। কিন্তু সেটা স্থগিত হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, জানুয়ারির দিকে পরিকল্পিত সফরটি স্পন্ন হতে পারে। এই সফর নানা কারণে আলোচিত হচ্ছে। বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরের কথা শোনা যাচ্ছে। অর্থনীতিক ও রাজনীতিক দিক থেকে বেশকিছূ গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুবিদা এবার বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিতে চাইছে ইনডিয়া। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ কি পাবে সেটা স্পশ্ট নয়। কিংবা আরো জরুরি প্রশ্ন, কি বিবেচনায় বাংলাদেশ ইনডিয়ার চাওয়াগুলো আমলে নিবে; কোনটাকে কিভাবে দেখবে সেই সব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় স্বর্থ ও বাস্তবতার আলোকে তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ চোখেই পড়ে না। ধরাবাধা ওকালতি আর পাল্টা বিরোধিতার বাইরে এসে কার্যত কাজে লাগতে পারে এমন দিকনির্দেশনামূলক আলোচনার একান্তই অভাব। এখানে সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ধারাবাহিক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হাজির করা হচ্ছে। পড়ুন এর প্রথম কিস্তি।
এক.
ট্রান্সশিপমেন্ট, ট্রানজিট, কানেক্টিভিটি; শব্দগুলি পরিস্কারভাবে আলাদা হলেও এসব শব্দ-পরিশব্দ ব্যবহার করে একটি সুবিধাই বাংলাদেশের কাছ থেকে ইন্ডিয়া চেয়ে আসছে সাতত্রিশ বছর ধরে। সোজা কথায়, নিজের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে একটি পরিবহন পথ চাইছে দেশটি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক কিংবা এডিবি’ও সাম্প্রতিক বছরে ইনডিয়াকে এই সুবিধা দিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। দুনিয়াজুড়ে অর্থব্যবস্থার চালক ওই প্রতিষ্ঠানগুলি যে বিস্তৃত অবকাঠামোর মধ্যে দেশটির ওই চাওয়াকে জায়গা দিয়েছে সেটির নাম এশিয়ান হাইওয়ে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে; ওই হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের সামনে দেয়া তিনটি রুটের প্রথম ও দ্বিতীয় রুটটি। নিজের ট্রানজিটের প্রয়োজনকে প্রথমত কানেক্টিভিটি শিরোনামে আঞ্চলিক অংশীদারীত্বের অর্ন্তভূক্ত করেছিল দেশটি। এবং এবার আর্ন্তজাতিক প্রকল্পের মধ্যে নিজের প্রয়োজন মেটানোর উপায় যেভাবে ইন্ডিয়া খুঁজে বের করেছে, তাতে করে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনীতির দক্ষতা স্পষ্ট।
বাংলাদেশের জন্মের পরপরই ১৯৭২ সাল থেকে ইনডিয়ার সাথে নৌযোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই বছর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাকব তাঁর বই ‘সারেন্ডার এ্যাট ঢাকা’য় বাংলাদেশ-ইনডিয়া বাণিজ্য চুক্তির ৫ নম্বর ধারাটি এভাবে বর্ণনা করেন, ‘‘দু’দেশের সরকার একমত হয়েছে যে, উভয় দেশের পারস্পরিক বাণিজ্যের স্বার্থে নিজেদের জলপথ, রেলপথ ও সড়কপথ ব্যবহার এবং এক দেশের মালামাল অন্য দেশের ভূ-খন্ড দিয়ে একই দেশের দুই স্থানের মধ্যে চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’’ ১৯৭৪ এর জুলাই মাসে ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মালামাল পরিবহনের ঐক্যমতই ছিল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর ইনডিয়াকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ-ইনডিয়ার মধ্যে সম্পাদিত বাণিজ্য চুক্তিতে নৌ, সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিটের উল্লেখ থাকলেও পরে সেটার বাস্তবায়ন আটকে যায়। নৌপথে ট্রানজিট চালু ছিল আগেই, বাংলাদেশে বিতর্ক দেখা দেয় সড়ক পথে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া প্রসঙ্গে। ১৯৮০ সালে ওই চুক্তিটি নবায়ন করা হয়, যার ৭ নং ধারাটি ছিল ১৯৭২ সালের বাণিজ্য চুক্তির পুনরূল্লেখ মাত্র। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে স্বাক্ষরিত সাফটা চুক্তিতেও একই ধরনের কথা বলা হয়। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে ভারত বাংলাদেশের ২৫ ক্যাটাগরির পণ্য শুল্ক মূল্য সুবিধা দেওয়ার একতরফা ঘোষণা দেয়। এরপরই ইনডিয়া পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট সুবিধা আদায়ে কূটনৈতিকভাবে আবার প্রচেষ্টা শুরু করে।
২৮ জুলাই ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে ইনডিয়াকে এমন সুবিধা দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টিকে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ সুবিধা বলে উল্লেখ করা হয়। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে কাজ আর এগোয় নি। ২০০০ সালে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত দু‘দেশের সচিব পর্যায়ের বাণিজ্য পর্যালোচনা বৈঠকে ভারতের পক্ষ তাদের ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ সুবিধার বিষয়ে একই প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। পরের বছর বাংলাদেশে সরকার বদল হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের আমলে ইনডিয়ার তরফে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছিল না। ২০০৫ সালের সার্ক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে ‘কানেক্টিভিটি’র ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এরপর থেকে সার্কের পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন সহ নানা আঞ্চলিক ফোরামে ‘কানেক্টিভিটি’র প্রস্তাবে দেশটি জোর দিয়ে আসছে। যে প্রস্তাবের মূলকথা হলো, এ অঞ্চলের দেশগুলোকে পরস্পর ‘কানেক্টেড’ করার জন্য প্রধানত স্থল ও নৌ যোগাযোগকে অবারিত করতে হবে। যে যোগাযোগ কাঠামোর অংশ হিসাবে ইনডিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চল একদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে অন্যদিকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দেশটির পশ্চিমাংশের সাথে যুক্ত থাকবে। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ‘ট্রানজিট’ সুবিধার দাবি ভারত ছেড়ে দেয় নি। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে ইনডিয়ার বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জয়রাম রমেশ সফরে এসে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে তাদের প্রস্তাবের কথা বাংলাদেশ সরকারকে আবারো আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন। পরের বছর ১০ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড: ইফতেখার আহমেদের সাথে তার কার্যালয়ে দেখা করে তাদের প্রস্তাব পুর্নব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে তাদেরকে ট্রানজিট দিতে হবে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইনডিয়ার পররাষ্টমন্ত্রী প্রণব সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় আসেন। এ সফরে ট্রানজিট বিষয়ে আলোচনা হয়। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়টি আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।
বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা কেউ কেউ ট্রানজিট সুবিধার পক্ষে কথা বলেছেন এখানে সেখানে। কিন্তু এ সর্ম্পকিত আলোচনায় বাংলাদেশের তরফ থেকে ইনডিয়াকে কি বলা হয়েছে বা হচ্ছে, তা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জনগণকে জানায় নি বাংলাদেশ সরকার। কিংবা ইনডিয়া ঠিক কেন ও কিভাবে ট্রানজিটের প্রয়োজনীয়তার কথা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তুলে আনে, সেটা নিয়েও বাংলাদেশের কোনো সরকারই দেশের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ফোরামগুলোতে আলাপ তোলে নি, যাতে করে এ বিষয়ে জাতীয় ঐক্যমত কায়েম করা যায়।
একপক্ষ বলেন; উত্তরপূর্বাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যগুলোর বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীগুলোকে রুখে দেয়ার জন্যই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট প্রয়োজন ইনডিয়ার। সুতরাং বাংলাদেশের উচিত হবে না এই সুবিধা দেয়া। কারণ এতে করে একদিকে, সামরিক ও কৌশলগত রসদপাতি বাংলাদেশের ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে চলাচল করার ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণে বাড়বে। অন্যদিকে, সাতকন্যার বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে। এই দুই যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে ইনডিয়াকে যেকোনো ধরনের ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার বিরোধিতা যারা করেন, তাদের কেউ কেউ এটাও বলেন যে, একটি স্বশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের উচিত হবে না সাতকন্যার বিদ্রোহীদের ক্ষতি করতে ইনডিয়াকে সহযোগিতা করা।
সাতকন্যার বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীগুলোকে কি ‘স্বাধীনতাকামী’ না ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ না কি ‘সন্ত্রাসবাদী’ সে আলাপে না গিয়েও বলা যায়, ইনডিয়া ইতোমধ্যেই সাতকন্যা’য় তাঁর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা ছাড়াই। বাংলাদেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের মাথার ওপর নেপালের মাঝখানের অপ্রশস্ত করিডোরকে সামরিক ও কৌশলগত সরঞ্জামাদি পরিবহনের কাজে ব্যবহার করেই দেশটি সাতকন্যা রাজ্যসমূহের নানা স্বশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তাছাড়া ওই রাজ্যসমূহে নিয়মিত যুদ্ধাবস্থা সামাল দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় সমরশক্তি স্থায়ীভাবে মোতায়েন আছে, স্বাভাবিকভাবেই। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটিজিক স্টাডিজ’ প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের বাৎসরিক সামরিক ব্যায়সহ সামরিক বিষয় সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত পেশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৯ সালে ইনডিয়ার সামরিক বাজেট ৩২.৭ বিলিয়ন ডলার। সামরিক খাতে বাজেটে এত বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ অন্যতম কারণ হলো; একদিকে সাতকন্যায় প্রয়োজনীয় সমরশক্তি স্থায়ীভাবে মোতায়েন রাখা, অন্যদিকে সময় সময় জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সমরশক্তি ও সম্ভার মূল ভূখন্ড থেকে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে পরিবহনের প্রচুর খরচ। সন্দেহ নেই, ট্রানাজিট সুবিধা থাকলে পরে দ্বিতীয় ধরনের খরচটা অনেকানেক কমাতে পারতো ইনডিয়া। কিন্তু শুধু এমন সুবিধার ওপর ভর করে যুদ্ধাবস্থা সামাল দেয়া যায়না নিয়মিত। সুতরাং ইনডিয়ার ট্রানজিটের প্রয়োজন স্বল্পমাত্রায় সামরিক নয়।
এ প্রয়োজন অনেকটাই আপাতদৃষ্টিতে অর্থনৈতিক। প্রথমত, শিলিগুড়ি করিডোরের বদলে সোজাসুজি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পরিবহন খরচ ও সময় কমে যাবে অনেক গুণ। দ্বিতীয়ত, সাতকন্যায় কোন সমুদ্র বন্দর না থাকার ফলে ভারত প্রাকৃতিক সম্পদ ও উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানীর জন্য ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কলকাতা বা হলুদিয়া বন্দর ব্যবহার করতে হয়। এতে করে ইনডিয়ার খরচ হয় ছয় থেকে সাত হাজার কোটি রূপি। ট্রানজিট পেলে সে পথ দাঁড়াবে মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার। দূরত্ব, সময়, অর্থ-সবই বাঁচবে ভারতের। ট্রানজিট সুবিধার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারলে খরচ হবে ৮০০-১০০০ কোটি রূপি। তাছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যেগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্পায়ন এর ওপর দেশটি এখন জোরারোপ করেছে। যাতে করে ওই অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির মাধ্যমে বিদ্রোহ প্রশমিত করা যায়। দীর্ঘমেয়াদে এই উন্নতি সামরিক অভিযানকে পূর্ণাঙ্গ সাফল্য এনে দেবে।
নেছার আমিন, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট
nasar1000@gmail.com
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি
good
Thanks to Nesar Amin.