সাঁইজীর মহিমা এবং দেওয়ানা ক্যারোল সলোমন
শিরোনামের কৈফিয়ত দিয়া লেখা শুরু করতে চাইছি। ফকির লালন সাঁইয়ের ১১৯তম তিরোধান উপলক্ষে ছেউড়িয়ায় ‘নবপ্রাণ আন্দোলন’ আখড়া বাড়িতে এইবার যে সাধু-গুরুদের জমায়েত হয়েছিল, তার উৎসব শিরোনাম ছিল ‘কি মহিমা করলেন গো সাঁই। ছেউড়িয়াতেই খবর পাই ক্যারোল সলোমন ইন্তেকাল করেছেন ১৩ মার্চ ২০০৯ কিন্তু আমরা জানতে পারি ১৬ অক্টোবর ২০০৯। এই বিলম্বের কারণ অজানা।
পাঠক, এই স্থলে ক্যারোল সলোমন কে ছিলেন? কি তার কৃতি কর্ম এ সকলই যতোদূর সম্ভব বিবৃত করা হবে। আর সাঁইজীর মহিমার কথা বিবৃত করা অসাধ্য। তবে এতে ক্যারোল সেলোমন কেন দেওনা হয়েছেন তা জানান দেয়া দুঃসাধ্য নয়। কেননা এরূপ আমরাও অনেকেই সাঁইজীর মহিমায় দেওয়ানা হয়া আছি।
অধ্যাপক ক্যারল সলোমনের মৃত্যুর খবর ঢাকাতে পৌঁছেছে জনাব হাসান ফেরদৌস-এর বরাতে। তিনি শুধু এই সংবাদ দিয়াই আমাদের কৃতজ্ঞ করেন নি। তিনি সেলোমনের কথাও অল্পবিস্তর প্রচার করেছেন। বিবৃত করেছেন ফকির লালন শাহ নিয়া সলোমনের কাজের কথাও। তার লেখার ফলে আমাদের যে উপকার হয়েছে সেই কথা মেনে নিয়েও বলতে চাই, কিছু আপত্তিও তৈরি হয়েছে। এই উছিলাতেই লেখার সুযোগ নিচ্ছি। ক্যারল সলোমন শেষবার যখন বাংলাদেশে আসেন (২০০৮ সালে) তখন তার সঙ্গে আমার ধানমন্ডিতে তার রেস্ট হাউসে পরিচয় হয় এবং তিনি যতোদিন বাংলাদেশে ছিলেন আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি। তার সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়া আমি বহু বাহাস করেছি। তিনি আমেরিকা ফিরে যাওয়ার দুইদিন আগে আমাকে একটা ছোট সাক্ষাৎকার দেন (যা এখানে পাঠকদের জন্য বাংলায় তরজমা করে ছপা হলো)। ফলে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনও এই লেখার একটা হেতু বলা যায়। হাসান ফেরদৌস-এর লেখায় আপত্তির কথা বলেছি, এই উছিলায় কিছু কথা কওয়ার সুযোগ নিবার চাই।
অধ্যাপক সলোমনের বহুল পঠিত ‘বাউল প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বাউল গান বাঙালি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু এই বাউল ঐতিহ্যের ব্যাপারে কোথায় যেন একটা দ্বিধা তাদের মধ্যে কাজ করে। একদিকে তারা বাউলদের মাথায় তুলে রাখে, তাদের সুফি সাধক বলে সম্মান করে। অন্যদিকে তাদের তান্ত্রিক জীবনচারিতা, বিশেষত তাদের যৌন আচার-আচরণ তারা ঘৃণার চোখে দেখে। রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাঙালি মধ্যবিত্ত বাউলদের সঙ্গে পরিচিত হয়, সম্ভবত সেটাও একটা কারণ বাউলদের নিয়ে একপেশে ও ভুল ধারণা গড়ে ওঠার। বাউল দর্শনকে আমরা বিশ্ব মানবতার এক বিশেষ আয়নায় দেখার চেষ্টা করি। এর ফলে বাউল গবেষণা একপেষে হয়ে পড়েছে। বাউল দর্শনের নামে তাদের ধর্মচর্চার আসল চেহারাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। বাউল, তা সে হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক, তারা সবাই এক অভিন্ন যৌন জীবনচারিতায় অভ্যস্ত। যে জীবনচারিতা বাউল দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। কিন্তু এ বিষয়টি লুকিয়ে রাখতেই আমাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।’ বলাবাহুল্য অধ্যাপক সলোমনের এমন ধারা বক্তব্যের প্রতি জনাব হাসানের কোন দ্বিমত নেই এবং বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তক, গবেষকদেরও বিবেচনা এ থেকে খুব ভিন্ন কিছু নয়। দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে অনেকগুলো জঞ্জাল ধরা পড়েছে, এই আবর্জনা অল্পতেই সাফ করা সহজ হবে না।
বলা হয়েছে ‘বাউলগান বাঙালি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এই কথা যদি আমরা মেনে নেই, তাহলে সত্যের বরখেলাপ হবে। যদিও সত্যের বরখেলাপ সত্ত্বেও মেনে নেই, তাও গোড়াতেই প্রশ্ন রাখতে হয়, কোনটাকে মধ্যবিত্ত ও ‘বাউল সংস্কৃতি’ বা ‘লোক সংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন? এই ধারণা সমূহ যে বিশেষ শ্রেণীর হাতে তৈয়ার হয়ে এখনও খবরদারির কাজে লিপ্ত তার ইতিহাস আছে, আছে পুরাদস্তুর ক্ষমতা ও আধিপত্যের রাজ্যপাট। মধ্যবিত্তের যে সাংস্কৃতিক অহমিকা গড়ে উঠেছে তার প্রত্নতত্ত্ব নির্মিত হয়েছে ঔপনিবেশিক জ্ঞানকান্ডের খোয়াড়ের ভিতরে। মনিবের নির্বিচার অনুকরণে দাসত্য মনোবৃত্তির অধিক বস্তু ওতে নাই।
এই দিকটি নিয়া কথা পাড়তে গেলে ম্যালা কথা কওয়া দরকার। সেই ফুসরত এইখানে নেব না। মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য ‘বাউল’ সংস্কৃতিরইবা প্রয়োজন পড়ল কেন? এই প্রশ্নও সরল কোন সওয়াল নয়। যাই হোক এই বিষয়ে অধিক কথা না বলে একটি কোটেশন টুকে দেই-- ‘আধুনিক সংস্কৃতি বনাম লোক সংস্কৃতির শ্রেণী ভেদটা রাজনৈতিক। অধিপতি শ্রেণী জনগণের সংস্কৃতিকে সবসময়ই লোক সংস্কৃতি, পল্লীগীতি ইত্যাদি বলে উপেক্ষা করে। যখন তাকে গুরুত্ব দেবার ভান করে তখন তাকে ‘আধ্যাত্মবাদ বা ‘মরমিবাদ’ বানিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যে এই ধারার মানুষের চিন্ত, প্রজ্ঞা বা জ্ঞানচর্চাও মূল ধারার কোন বিষয় নয়। এক ধরনের রহস্যবাদী মিস্টিক তৎপরতা যা সমাজের প্রান্তিক কোন গোষ্ঠীর বা গুহ্য কায়কারবারের সঙ্গে যুক্ত। আভিজাত্যের এই বিভাজন মেনে লোক সংস্কৃতির প্রতি সময় সময় অধিপতি শ্রেণীর সদয় আতিশয্যে আমাদের মোহিত হবার কারণ নেই। [ভাবান্দোলন পৃ-৫৪]
‘বাউল সংস্কৃতি’ বা ‘লোক সংস্কৃতি’ বলে মধ্যবিত্ত যা চর্চা করে তা ইংরেজি’ Folk Culture-এর পরিভাষাগত ধারণার অধিক কিছু নয়। বাংলার ভাব (দর্শন, যদিও পশ্চিমা অর্থে নয়) চর্চার ধারাকে মধ্যবিত্ত ‘বাউল সংস্কৃতি’ বলে একটা আরামদায়ক খাচে ফেলে নাড়াচাড়া করতে চান। কিছুটা গান কিছুটা গাঁজা আর বাকিটা বাঙালী সংস্কৃতির ভাবালুতা মিশ্রিত সেক্যুলার উৎসাহে, এই ধারায় তারা লালন সাঁইজীর কালাম (বাক্য, পদ) কে বুঝতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। অধ্যাপক সেলোমনকে যখন প্রশ্ন করি : মহাশয় লালনের গানে আপনার আগ্রহ কেন? তিনি জবাব দেন: আমি পয়লা পশ্চিম বাংলায় বাউল গান শুনে উৎসাহি হয়ে গানের মানে বুঝতে চেষ্টা চালাই। ডাক্তারি থিসিস সমাধা করে ঠিক করি পরের প্রজেক্ট হবে বাউল গান। তো, লালনকে যেহেতু বাউল কবিদের শিরোমণি গণ্য করা হয় তাই স্বভাবই তার উপর প্রধান মনোযোগ পড়ে।
জনগণের সংস্কৃতি চর্চার এই ধারাকে যারা ‘বাউল সংস্কৃতি’ নাম অভিধায় বুঝতে চান তাদের সঙ্গে সলোমনের মতের শতভাগ মিল রয়েছে। অভীষ্ঠও তথাস্তু। কিন্তু আমাদের বলবার কথা আলাদা। বাংলার ভাব চর্চার গতিপ্রকৃতি, শক্তি ও সম্ভাবনা এই অভিধায় বুঝতে চাইলে কিয়ামতের আগের দিনও বুঝন সমাধান হবে না। আর লালন সাঁইজীর কালামকে সর্বোৎকৃষ্ট বাউল বাক্য ঘোষণা দিয়া নদীয়ার ভাবের বৈপ্লবিক ইতিহাসের দিকে পশ্চাতদেশ ফিরায়া দাঁড়ানোর আমল নেহায়েতই অজ্ঞান নয়। এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক ভেদ-বুদ্ধি সঞ্জাত। আমাদের চিন্তাচর্চার গহ্বর পশ্চিম বাহিত জ্ঞান আর ঔপনিবেশিক তালিম মোতাবেক গঠিত হওয়ায় এই দুর্গতি অতি সহজেই মোচনযোগ্য নয়। তেমনি এই ধারা ভেদ-বুদ্ধি জাত বিবেচনার মূলে রয়েছে ‘সেকুলার’ ডাক নামের সাম্প্রদায়িক খাসিলত। কাজেই এর মোকাবিলা রাজনৈতিকভাবেই হতে হবে। হতে বাধ্য।
আশাকরি পরিষ্কার যে, সাম্প্রদায়িক ও ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি বহাল রেখে, ‘বাউল’ অভিধায় নিম্নবর্গের জাত-পাত, নারী-পুরুষসহ যাবতীয় আত্মপরিচয়ের ভেদবিরেধী লড়াইয়ের শক্তিশালী ধারাকে নিছক মরমিবাদী লোকসংস্কৃতির পরিচয় বানানো হয়েছে তা সব অর্থেই শ্রেণীবিদ্বেষী এবং ভয়ঙ্করভাবে সাম্প্রদায়িক। ফলে কতপ্রকার দেশী-বিদেশী তাত্ত্বিক চর্চা রয়েছে তাদিয়ে প্রগতিশীলতার আভরণে প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র এখন আর অন্তত গোপন কারবার জো নাই। কাজের কথা হলো এর মোকাবিলা করা, মোকাবিলার তাগিদ অনুভব করা। সলোমন জানান, রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাঙালি বাউলদের সঙ্গে পরিচিত হন। এই কথাটি ঐতিহাসিক নিরীখে নিলে গোলমেলে মনে হয়। তবে একথা সত্যি যে, আজকের বাঙালি মধ্যবিত্ত বাউল ধারা বা সংস্কৃতি নামে যাকে চিহ্নিত করে তার চিন্তা-ঐতিহ্য প্রকটভাবে রাবীন্দ্রিক। ফলে রবীন্দ্রনাথের বাউল দর্শন যে আমাদের জন্য খোশ নসিবের কারণ হয় নি, এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা যদি মেনেও নেই রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাঙালি বাউল চিনেছে তাতে বিশেষ ক্ষতি নাই। কারণ নদীয়ার ভাবের যে বৈপ্লবিক ইতিহাস এর সাথে তথা কথিত বাউল সংস্কৃতির কোন যোগ নাই। এর বৈপ্লবিক তৎপরতা বুঝতে হলে প্রথমেই উপনিবেশিক বাঙালিত্বের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তার জানাজা হওন দরকার। পরিহাসের কথা এই যে, সেই লক্ষণ আমাদের মাঝে দেখা যাচ্ছে না। সলোমনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কোন বিরোধ নেই। তার ইন্তেকালে আমরা বাঙালি দরদী একজন বিদেশী হারিয়েছি বলে দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু এই লেখার উদ্দেশ্য সেদিকে গড়াচ্ছে না। সেলোমন সাঁইজীর মহিমায় দেয়ানা হবার কোশেশ পেয়েছেন। আমরাও সাঁইজীর মহিমা দর্শনে দেওয়ানা, কৃপাপ্রার্থী। কিন্তু এ ধারা সাঁইজীর মহিমার নামে যা কিছু চিহ্নিত করেছে তা বানানো মাল। এবং দেওয়ানা হয়েছে এর বাহ্যিকতায়। আমরা দেয়ানা এর অরূপ-স্বরূপ অর্থাৎ সাঁইজীর ‘করণ’ সম্পর্কের জন্য-- ‘বস্তু’ ও ‘ভাব’ নিরূপনে; ঐতিহাসিক কর্তারূপের সম্পর্ক মিমাংসায়। পাঠক এ অতি তরল নয়, এইটুকু আমার তরফে খেয়াল রাখতে বলি।
অধ্যাপক সলোমন বলেছেন, ‘বাউলদের তান্ত্রিক জীবনচারিতা বিশেষত তাদের যৌন আচার-আচরণ তারা (বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্ত) ঘৃণার চোখে দেখে।’ আগেই বলেছি নদীয়ার ভাব-ধারায় ‘বাউল’ ডাক নামের দ্বারা আজকে যা প্রচলিত তেমন কিছু নেই। কিন্তু এই ধারায় ‘তন্ত্র’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা। এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণার জন্য যে পরিমাণ ছওয়াল-জবাব দরকার তার জায়গা অকুলান। স্বীকার করি অনেক কাজ এখনো বাকি। অতি নগণ্যভাবে কয়েক কথা পাড়তেছি।
সাঁধু-গুরুদের জীবন চর্চায় ‘তন্ত্র’ আছে এবং এর দার্শনিক এবং তৎপরতার গুরুত্ব নদীযার বৈপ্লবিক ভাব বোঝার জন্য ভীষণ রকম জরুরি। মধ্যবিত্ত বাউল সংস্কৃতির ভিতরে যে যৌনতার সন্ধান করে বেড়ান এটা আদৌ সে রকম কিছু নয়। সাধুগিরির নামে গাঁজাখোরী, নারীলোলুপতা, ব্যাভিচার ইত্যাদি মধ্যবিত্তের কল্পনায় নিজেদের উৎকট আকাক্সক্ষা পূরণে বোধ হয় অনেকখানি সফল হয়েছে। পাঠক, সাঁইজীর কসম, লালনের ‘করণ’ চর্চার সঙ্গে এসবের কানাকড়ি যোগ নাই। আর একটি উদ্ধৃতি দেব, ‘তন্ত্র’ কহিল শরীরের মধ্যে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুন্মা নামক নাড়ি আছে বা শরীরে গঙ্গা, যমুনা ও স্বরস্বতীর প্রবাহ বিদ্যমান।’
শরীর বলিতে বিশ্বব্রহ্মান্ড বুঝি, এই শরীরচর্চা বা তন্ত্র বলিতে আমি শারীরিক সম্পর্ক বুঝি।
অর্থাৎ মনুষ্য শরীরে ভাষার এক বিশেষ রূপ আছে। আমাকে এই রূপটিকেই বুঝিতে হইবে, এই ইঙ্গিত আমি বাংলার তন্ত্র অর্থাৎ শরীর ও ভাষার অভেদ জ্ঞান হইতে যে ভাবচর্চা সেই দৈহিকতার ধারা হইতে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করিয়াছি। (ভাবান্দোলন পৃ-১৯৪)
পাঠক, আশাকরি এবার ‘বাউল সংস্কৃতির’ মধ্যে মধ্যবিত্তের যৌনতা খোঁজাখুজির সঙ্গে বাংলার ভাবের তান্ত্রিক ধারার ভেদ পরিষ্কার হবে। তবে এই বিষয়ে আরো বিস্তর কথা বলার প্রয়োজন স্বীকার করে রাখছি। অধ্যাপক সলোমনের অপরাপর সিদ্ধান্ত নিয়েও নদীয়ার ভাবধারার বিরোধ আছে। ফলে তার কথা ধরে আগানোর আগে নদীয়ার ভাব চিন্তার জন্য আমাদের তৈরি করা দরকার। পাঠক, এইখানে সলোমনের বয়ানের উছিলায় আমি যে কথাগুলো বলছি, এটা শুধু একা সলোমনের বয়ান নয়, বরং বাঙালি গবেষক, একাডেমীর অথর্ব অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ মূলধারা ডাকনামে আমরা যাকে চিনি তারই তৈরি করা বয়ান। সলোমনের মত দেশী অথবা বিদেশী গবেষকগণ শুধু এই বয়ানের তাত্ত্বিক শৃঙ্খলা আবিষ্কারে ব্যাতিব্যস্ত হয়েছেন।
কিন্তু বাংলার ভারের ঘরের মানুষ এই খপ্পরে পড়তে পড়তেও রেহাই পাইয়া গেছে কোন রকমে। অধ্যাপক সলোমনের প্রতি আমাদের অশ্রদ্ধা নাই। তার ইন্তেকালে আমরা শোকাহত। কিন্তু কথাগুলোও বলা দরকারি মনে করেছি।
অধ্যাপক সলোমনের মতো ভবিষ্যতেও হয়তো সাঁইজীর কৃপায় কেউ বাংলার ভাব বুঝার জন্য আন্তরিক মেহনত করবেন। ফলে তৈরি করা ‘বাউল সংস্কৃতির’ কদর্য পোশাক যেন আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি তার জন্য নদীয়া তার ভাবের প্রকৃত প্রেমিককে চিরকালই বরণ করার জন্য ব্যাকুল। রামকৃষ্ণ, নিত্যানন্দ, জালালুদ্দিন থেকে শুরু করে অনেক ভাবের মজনুকে নদীয়া অকৃপনভাবে ভালোবেসেছে। তবে লালনসাঁই এর মহিমায় নদীয়া যতখানি গর্বিত হয়েছে, বাংলার ভারের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। লালন সাঁই বুঝতে পেরেছেন নদীয়ার এই ভারের ধারা সহজ, সত্য কোন পথ নয়। এ কাজের পথ। কিন্তু সাঁইজীর কালামে লেখা পাই ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজী’ বাংলার ভাব ধারা আর মধ্যবিত্তের চর্চিত ‘বাউল সংস্কৃতির’ সঙ্গে ফারাক আকাশ আর পাতাল। পাঠক সাঁই-এর কালাম উদ্ধৃত করে বলি-
‘গোলে পড়িস নে’
যাই হোক, অধ্যাপক ক্যারেল সলোমনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোও এই লেখার একটি হেতু। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করতে চাই।
অধ্যাপক সেলোমন শুধু লালনের গান নিয়েই কাজ করেননি। তিনি বাংলা ভাষা নিয়েও অতি মেহনতি কাজ করেছেন।
তার বাংলা ভাষায় লিঙ্গ ও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে কিভাবে, লেখাটি পড়লেই পাঠক আমার কথার মাজেজা টের পাবেন। সলোমন আমাকে জানিয়ে ছিলেন তিনি ১৫০টি লালনের গান ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। বাংলা ভাষা শিখন পদ্ধতি নিয়ে তিনি বৃহৎ কাজ করতে চেয়েছিলেন। সেই কাজ তিনি শুরুও করেছিলেন কিন্তু মৃত্যু তাকে সেই অবসর দেয় নাই। আমরা বাংলা ভাষা, লালনসাঁই এবং মানুষের প্রতি তার মেহনতি দরদকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবো। সেলোমনের অনূদিত গানের কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি,
Everyone aska: Lalan,
What's your religion in this World?
Lalan answers: How does religion look?
I've never laid eyes on it.
Some wear malas [Hindu rosaries]
around their necks,
Some tasbis [Muslim rosaries] and
So people say
they've got different religions.
But do you bear the sign
of your religion
when you come or where you go?
এই গানের ব্যাখ্যায় সলোমন যা লিখেছেন, বিনয়ের সঙ্গে বলছি তা গ্রহণযোগ্য নয়। লালন বাউলমন্ত্রে দীক্ষা নিয়া ঘর বাড়ি ছেড়ে বাউল হন নাই। নদীয়ার ভাব চর্চার ইতিহাসের ধারায় এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। পাঠক বহুত কথা কওয়া হয়েছে যার সঠিকতা বেঠিকতা নির্ণয় সত্যিই মুশকিলের। বাংলার ভাবের আর এক মজনু জালাল উদ্দীন খাঁ বলেন-
‘মানুষেতে বিবাদ ঘটে মানুষে মিটায় গোল
মানুষেতেই জ্ঞান বুদ্ধি, মানুষেতেই ভুল
কাঁটা দিয়ে কাটা খোল, মরিসনে আর
বিষের জ্বালায়।
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি