যেভাবে চলছে বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার


জহিরুল ইসলাম মুসা ও মোহাম্মদ আরজু
Saturday 26 December 09

বিচার বিলম্বিত করছে সরকার

পিলখানাসহ সারাদেশে বিডিআর স্থাপনায় সংগঠিত বিদ্রোহ এবং হত্যাকান্ড সহ ফৌজদারি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। প্রক্রিয়া শুরু করার কথা যখন হচ্ছিল, তখনই আইনজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের অনেকে জানিয়েছিলেন- ‘বিদ্রোহের’ বিচার বিডিআরের নিজস্ব আইনে করতে সরকার আইনত বাধ্য। কিন্তু খুব সম্ভবত বিদ্রোহ চলাকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের তীব্রতার তুলনায় বিডিআরের নিজস্ব আইন- বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার ১৯৭২-এর শাস্তির বিধান অনেক লঘু বলেই সরকার বিকল্প চিন্তা করেছিলেন- সেনাআইনে বিচার। সেই চিন্তা থেকে সুপ্রিম কোর্টে পরামর্শ চাইলেন সরকার। কিন্তু আইনজ্ঞরা যেমনটি বলছিলেন; যেহেতু নিয়মিত বাহীনি হিসাবে বিডিআরের নিজস্ব আইন আছে, কাজেই অন্য একটি বাহীনি- নিয়মিত সশস্ত্রবাহীনি’র আইনের আওতায় বিডিআরের বিচার প্রক্রিয়া আইনত বৈধ নয়। সুপ্রিম কোর্টও তার পরামর্শে একই কথা বললেন। তাহলে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য ফৌজদারী অপরাধের যথাযথ প্রতিকারে কি হবে? এখন পর্যন্ত সরকার বলছেন, সেই বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে করা হবে। এখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি। অবশ্য যেমনটি বলছিলাম, রাইফেলস অর্ডারের আওতায় ‘বিদ্রোহের’ বিচার শুরু হয়ে গেছে ২৪ নভেম্বর থেকে।

বিডিআর ১৫ নভেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, সারাদেশে ছয়টি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় সদর দপ্তর অর্থাৎ পিলখানায় ২টি ও দেশের অন্যান্য স্থানে আরো ৪টি আদালত স্থাপিত হয়েছে। বিদ্রোহের পরপরই এমন ‘বিশেষ আদালত’ গঠনের প্রস্তাব অনেকে করেছিলেন, পাশাপাশি যে তাগিদ থেকে সরকার সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাইতে গেলেন- সেইসব অপরাধের বিচারের দিকনির্দেশনাও এসেছিল। যেমন ঘটনার চার দিন পরই ৩ মার্চ দৈনিক যায়যায়দিনের আইন ও বিচার পাতায় কর্মরত একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার দে লিখেছিলেন; 'The Bangladesh Rifles Order, ১৯৭২-এর ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ Order-এর অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত অথবা তালিকাভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি তিনি যেখানেই থাকুন না কেন এ Order-এর বিধি মোতাবেক অব্যাহতি না পাওয়া পর্যন্ত এ Order-এর বিধিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন। উপরোক্ত বিধিটি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ রাইফেলসের কোনো ব্যক্তির করা অপরাধের বিচার উপরোক্ত Order অনুযায়ী করতে হবে। The Bangladesh Rifles Order, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ২(১), (জে), (কে) অনুযায়ী বাংলাদেশ রাইফেলস এর Special Court (Director- General-সহ দুই সদস্যবিশিষ্ট আদালত) কিংবা Special Court (Director- General-সহ তিন সদস্যবিশিষ্ট আদালত)-এ বাংলাদেশ রাইফেলসের ব্যক্তিদের বিচার সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে।’ জনাব দে জানাচ্ছেন ‘কিন্তু Order-এর ১০(এ), ১০ (বি), ১১, ১৩, ১৪ প্রভৃতি অনুচ্ছেদসমূহে যেসব অপরাধের উল্লেখ রয়েছে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরে ঘটিত হত্যাকাণ্ডের কিংবা লুণ্ঠনের মতো অপরাধ ওইসব বিধির আওতার বহির্ভূত। এ ক্ষেত্রে The Bangladesh Rifles Order, 1972-এর ১৬(এ) অনুসরণ করা যেতে পারে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন সরকার দণ্ডবিধি কিংবা বাংলাদেশে প্রচলিত যে কোনো আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিচারের জন্য বিডিআরের Director General-কে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিতে পারেন। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরে হত্যা ও লুণ্ঠনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা এ বিধি অনুযায়ী সরকারের অর্পিত ক্ষমতাবলে বিডিআরের Director Generalআমলে আনার ক্ষমতা সম্পন্ন . . .’’ কিন্তু সেখানেও একটু মুশকিল আছ। জনাব দে লিখছেন, ‘তবে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৯ (সি) ধারা অনুযায়ী সরকার কোনো প্রথম শ্রেণী ম্যাজিস্ট্রেটকে ১০ বছরের অধিক কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন না বিধায় Director General হত্যা কিংবা লুণ্ঠনের মতো অপরাধের বিচার করার এখতিয়ারসম্পন্ন নন।’ সেক্ষেত্রে সরকার যা করতে পারে, জনাব দে’র মতে, ‘এ অবস্থায় সরকার উপরোক্ত অপরাধসমূহের বিচারের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয়সংখ্যক (ধারা ৪ : দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল অধ্যাদেশ ২০০২) দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে Director General-এর আদালতে আমলে গৃহীত মামলাসমূহ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে (ধারা-৬) স্থানান্তর করতে পারেন।’

এই লেখা প্রকাশিত হবার সাত মাসের পরে ঠিক এভাবেই বিদ্রোহের বিচার কাজশুরু হয়েছে। বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার, ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ২(১), (জে), (কে) অনুযায়ী ‘ স্পেশাল কোর্ট’ গঠন করা হয়েছে মহাপরিচালকের নেতৃত্বে কমপক্ষে দুইজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়ে এবং এটর্নি জেনারেল বা তার প্রতিনিধি কর্তৃক আদালতকে সহায়তা করার বিধান রাখা হয়েছে। বিশেষ আদালতে প্রায় ৩৫০০ বিডিআর জওয়ানকে বিচারের সম্মুক্ষীন করা হবে। এরমধ্যে ২৪ নভেম্বর রাঙ্গামাটিতে এবং ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরায় বিশেষ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল হোসেনের নেতৃত্বে বিশেষ আদালতে বিচারক হিসেবে আরো রয়েছেন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং একজন মেজর পদমর্যাদার কর্মকর্তা। এছাড়াও আদালতকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ১০জন বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিডিআর জওয়ানদের বিরুদ্ধে আনীত বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার, ১৯৭২ এর ১০ক(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিশেষ আদালত সর্বোচ্চ ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং সর্বেচ্চ একশত টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন। একই আইনের ১০ক(৩) অনুচ্ছেদের অধীনে অভিযুক্ত জওয়ান নিজেই আতœপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন এবং এক্ষেত্রে তার নিজের পছন্দের এই বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা অথবা আইনজীবীর সহায়তা নিতে পারবেন। যদিও আইনজীবী কোনো অভিযুক্তের পক্ষে আদালতে শুনানি করতে পারবেন না। অন্যদিকে নিউমার্কেট থানার হত্যা মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দাখিলের পর হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধের বিচার করার জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করার কথা সরকার চিন্তা করবে বলে জানিয়েছে।

কিন্তু ওই মামলা দায়েরের পর দশমাস পার হয়ে গেলেও নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলাটির তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারে নি পুলিশ। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দ একই সাথে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশে জনাব আকন্দ ছাড়া আর কোনো যোগ্য তদন্ত কর্মকর্তা নেই যার ওপর সরকার নির্ভর করতে পারে। সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আবার সময় নিয়েছেন আগামী বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। অন্যদিকে এর আগে বিদ্রোহের তদন্ত করার জন্য যে সরকারি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল তাদের কারণেও দুই পালায় বিদ্রোহের বিচার বিলম্বিত হলো পুরো নয়টি মাস। প্রথম পালায় তারা তদন্ত সমাপ্ত করতে দফায় দফায় অনেকবার তদন্তের মেয়াদ বাড়িয়ে নিলেন- সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা দেয়া হলো আড়াই মাসেরও বেশি সময় পর। যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি- দেশের বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের এখতিয়ারধীন একজন সম্মানিত বিচারক যখন সংশ্লিষ্ট আইন তুলে ধরে জানালেন- বিচার বিডিআর আইনের অধীনেই করতে সরকার আইনত বাধ্য- এবং বিডিআর আইনে বিচার সম্ভবও বটে; সেখানে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করলো সেনাআইনে বিচার করার। উল্লেখ্য সেই কমিটিতে বিডিআর মহাপরিচালক এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবও ছিলেন। সেই সুপারিশ অনুযায়ী সরকার সুপ্রিম কোর্টে পরামর্শের জন্য গেলেন। সুপ্রিম কোর্টও সেনাআইনে বিচার করার আইনগত বৈধতা নেই বলে জানালো। এসব করে আরো সাড়ে ছয় মাস পেরিয়ে গেলো বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে।

বিচারের আগেই শাস্তি পাচ্ছে অভিযুক্তরা

বিচার শুরু হতে যতই দেরি হোক, শাস্তি পেয়েই যাচ্ছেন অভিযুক্ত বিডিআর সদস্যরা। বিচারবহির্ভূত শাস্তি। এ পর্যন্ত ২১৬৬ জন বিডিআর সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদে আটক বা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় নি। অনেককে আটক করা হলেও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে অনেক পরে। ২১৪৪ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যেহেতু রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া কোনো নির্দেশনাই নিম্ন আদালত এবং পুলিশ মানে না সুতরাং রিমান্ড মানে আসলে ঠিক কি সেটা আমরা বুঝতে পারি। ‘অধিকতর তদন্তের স্বার্থে’ আদালত কর্তৃক অনুমোদিত পুলিশ রিমান্ডের শিকার হয়ে ৫৩৭ জন বিডিআর সদস্য নিজের অপরাধ ‘স্বীকার’ করে নিয়েছেন। এমনকি অনেকের থেকে আটক এবং গ্রেফতার দেখানোর মধ্যবর্তী সময়েও জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অধীনে এসব অভিযুক্তরা অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। (এসব তথ্য ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী)। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো নাগরিককে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা অবৈধ। কিন্তু বরাবরের মতো এক্ষেত্রেও এমন জবানবন্দী নেয়া হলো। আদালতের কাছে যে জবানবন্দীর কোনো বিচারিক মূল্য নেই।

স্রেফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ওপর ভিত্তি করে কাউকে শাস্তি দিতে পারেন না আদালত। কিন্ত বরাবরের মতো পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ব্যাপারেও শুধু এক. রিমান্ড দুই. স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ওপর নির্ভর করা হচ্ছে এ পর্যন্ত। সম্ভবত তদন্ত শেষ করতে অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় লাগার এটাও একটা কারণ- তদন্তকারীরা অভিযুক্তদের রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ে ব্যস্ত। অথচ যেমন আলাদা সাক্ষীর সাক্ষ্য বা আইন প্রয়োগকারী বাহীনির নিজস্ব তদন্তের মতো কোনো স্বতন্ত্র উৎস থেকে সত্যায়িত ও সমর্থিত না হলে এমন স্বীকারোক্তির কোনো আইনগত মূল্য নেই। আদালতে বিচারকালীন সময়ে তদন্তের সময়ে গৃহীত জবানবন্দী পরীক্ষা করে নেওয়া হয় এবং জবানবন্দী প্রদানকারী অভিযুক্ত আগের মতামত সমর্থন করেন কিনা- সেটাও জিজ্ঞাসা করা হয়। এছাড়াও সাক্ষ্য আইনের বিধান অনুযায়ী একই ঘটনায় অভিযুক্ত একাধিক ব্যক্তি জবানবন্দী দিলে একজনের জবানবন্দী অন্যজনের জবানবন্দীকে সমর্থন করে কিনা- সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। এরপরেই সেই জবানবন্দীর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।

ইতিমধ্যেই স্বীকারোক্তি দাতা অভিযুক্তদের মধ্যে ৮৪ জন আদালতের কাছে আবেদন করেছেন যে, তারা তাদের জবানবন্দী প্রত্যাহার করে নিতে চান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের থেকে জোরপূর্বক এবং নির্যাতন করে এমনকি ‘ক্রসফায়ার’ এর ভয় দেখিয়ে জবানবন্দী আদায় করা হয়েছে বলে তারা আবেদনে উল্লে¬খ করেছেন। সবমিলিয়ে অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের ও অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখার কোনো নিশ্চয়তা তদন্ত প্রক্রিয়া দিতে পারেনি আজ পর্যন্ত। এভাবে বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী বাহীনির অকার্যকর অংশগ্রহণের কথাই আমাদের নজরে আসে বারবার। যারা নিজেরা তদন্ত চালাতে ব্যর্থ হয়ে অভিযুক্তকে নির্যাতন করে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেন। যার ফলে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আনা গেল কি না তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় থাকে না।

বিচারবর্হিভূত শাস্তির মধ্যে অর্ন্তভূক্ত আছে মৃত্যুদণ্ডও। আইন প্রয়োগকারী বাহীনির হেফাজতে এবং কারাগারে সবমিলিয়ে ৫৫ জন বিডিআর সদস্য মারা গেছেন। সর্বশেষ গত ১১ ডিসেম্বর মারা যান লালবাগ থানায় থানায় দায়ের করা মামলায় প্রথম গ্রেফতার হওয়া বিডিআর সদস্যদের অন্যতম হাবিলদার রেজাউল করিম। রেজাউলের ভাগ্নে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রেজাউলের শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ণ ছিল। কারাগারে থাকাকালে রেজাউল নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর আশঙ্কাও করেছিলেন। নির্যাতনে ফলে এমন মৃত্যুর ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এসব ক্ষেত্রে কোনো তদন্ত হয় নি। দুইটি লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া যাওয়ায় পর পুলিশ নিউমার্কেট থানায় ২টি মামলা দায়ের করেছে, কিন্ত তার অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

যে প্রশ্নটি এখন সরকারকে করতেই হবে তা হলো- তারা কি বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানার হত্যাকাণ্ড বিচার প্রক্রিয়া যেনতেনভাবে ‘শেষ’ করার সাফল্য পেতে চান নাকি সত্যিই অপরাধের শিকার ও অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত- দুই পক্ষের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চান। দ্বিতীয়টি করার আগ্রহ যদি তাদের থাকে তবে যথাযথ আইনগত উপায়ে তদন্ত শেষ করে এবং অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সব অধিকার দিয়েই তবে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। নইলে কোনোভাবেই এটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না যে, প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি বিধান করার সদিচ্ছার পথে সরকার এগুচ্ছে।

ফ্যাক্ট অ্যান্ড ডেটস

ক্স বিদ্রোহ তদন্তে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আনিস-উজ-জামান খান। সদস্যরা ছিলেন যথাক্রমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রফিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির, অতিরিক্ত সচিব এহসানুল হক, পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নূর মোহাম্মদ, কমোডর মোহাম্মদ নাসির, কমোডর সানাউল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মো. গোলাম হোসেন, বিডিআর মহা-পরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম ও আইন সচিব হাবিবুল আউয়াল।

বিদ্রোহের বিচারের জন্য স্থাপিত বিশেষ আদালত ও তার এখতিয়ারধীন বিডিআর সদস্যরা হচ্ছেন যথাক্রমে; রাজশাহী এবং কুষ্টিয়া সেক্টরের জওয়ানদের বিচার হবে ১নং বিশেষ আদালতে। দিনাজপুর এবং রংপুর সেক্টরের জওয়ানদের বিচার হবে ২নং বিশেষ আদালতে। সিলেট, কুমিল্লা এবং ময়মনসিংহ সেক্টরের জওয়ানদের বিচার হবে ৩নং বিশেষ আদালতে। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সেক্টরের এবং চট্টগ্রামের রাইফেল্স ট্রেনিং সেন্টার এন্ড স্কুলের জওয়ানদের বিচারহ হবে ৪নং বিশেষ আদালতে। ঢাকা সেক্টরের জওয়ানদের বিচার হবে ৫নং বিশেষ আদালতে। বিডিআর সদর দপ্তর, সিগন্যাল সেক্টর, সদর রাইফেল ব্যাটালিয়ন, বিডিআর হাসপাতাল ও রাইফেলস সিকিউরিটি ইউনিটের জওয়ানদের বিচার হবে ৬নং বিশেষ আদালতে।

তারিখসমূহ

২৫ ও ২৬ ফেব্র“য়ারি : রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ মোট ৭৩ জন নিহত হন। ফেব্রুয়ারি ২৬ সকালে রাজশাহী, দিনাজপুর, ফেনী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও, এবং বান্দরবানে বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করে।

BDR Mutinyবিদ্রোহের বিচার : ক্রমপঞ্জী

২৬ ফেব্রুয়ারি : বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে সরকারি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে সভাপতি করে।

২ মার্চ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রিকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাকে সভাপতি করে তদন্ত কমিটি পুর্নগঠন করা হয়।

৩ মার্চ : এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন পেশ করার মেয়াদ নিয়ে কমিটি তদন্তকাজ শুরু করে।

৩০ মার্চ : কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত শেষ করার মেয়াদ ১২ মে পর্যন্ত বাড়ায় সরকার।

২১ মে : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পেশ করে তদন্ত কমিটি। ৩০৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন। প্রতিবেদন সেনাআইনে বিচার করার সুপারিশ করা হয়।

২৭ মে : সরকারি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনের ৭ পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করে।

২৭ জুলাই : আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, সেনাআইনের বিডিআর বিদ্রোহের বিচার করা যাবে কি না সেই মর্মে রাষ্ট্রপতি পরামর্শ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠাবেন।

১৭ আগস্ট : সেনাআইনে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের বিচার করা যাবে কি না সেই মর্মে পরামর্শ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠান রাষ্ট্রপতি।

১৯ আগস্ট : রাষ্ট্রপতির পাঠানো রেফারেন্স শুনানিতে আদালতে সহযোগিতা করার জন্য ১০ জন আমিকাস কিউরি নিয়োগ করেন আদালত।

২৫ আগস্ট : আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপতির পাঠানো রেফারেন্সের শুনানি শুরু করে।

১০ সেপ্টেম্বর : সেনাআইনে বিডিআরের বিদ্রোহী সদস্যদের বিচার করা যাবে কি না- এই মর্মে সরকারের প্রর্থিত রেফারেন্সের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট তার মতামত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান।

১৫ নভেম্বর : বিডিআর সারাদেশে ছয়টি বিশেষ আদালত গঠন করে। এর মধ্যে ঢাকায় সদর দপ্তর অর্থাৎ পিলখানায় ২টি ও দেশের অন্যান্য স্থানে আরো ৪টি আদালত স্থাপিত হয়েছে।

২৪ নভেম্বর : রাঙ্গামাটিতে বিশেষ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।

৭ ডিসেম্বর : সাতক্ষীরায় বিশেষ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।

২০ ডিসেম্বর : ফেনীতে বিশেষ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।

হত্যাসহ অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের বিচার : লালবাগ থানার সেই মামলার ক্রমপঞ্জী

২৮ ফেব্র“য়ারি : বিদ্রোহ অবসানের একদিন পরই পুলিশের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) নবজ্যোতি খীসা বাদী হয়ে ঢাকার লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

৭ এপ্রিল : তদন্ত কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট মামলাটি লালবাগ থানায় থেকে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করেন। নিউমার্কেট থানার মামলাটির তদন্ত কাজ পরিচালনা করছেন সিআইডির কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দ।

২৭ এপ্রিল: পিলখানা হত্যাকান্ড মামলা পরিচালনার জন্য আনিসুল হককে প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয় সরকার।

২৩ আগস্ট : প্রথমবারের মতো কোনো পিলখানা হত্যা মামলায় অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট বিভাগ। বিচারপতি এ এফ এম আব্দুর রহমান এবং এস এম এমদাদুল হকের বেঞ্চ অভিযুক্ত আল আমিনের জামিন মঞ্জুর করেন।

১৫ সেপ্টেম্বর : পিলখানা হত্যা মামলায় এই দিন প্রথমবারের মতো একজন অভিযুক্ত জামিনে মুক্তি পান। হাইকোর্ট থেকে প্রাপ্ত জামিনের আদেশ গ্রহণ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিনকে জামিনে মুক্তি দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। ১০ মে আল আমিনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

২৭ জানুয়ারি ২০১০ : মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দাখিলের জন্য ধার্য করা হয়েছে। গত দশমাসে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অনেকবার আদালত থেকে সময় নেয় তদন্ত কর্মকর্তা।

সংখ্যাতথ্য

৭৩ জন নিহত হয়েছেন বিডিআর বিদ্রোহে যার মধ্যে রয়েছেন সেনাকর্মকর্তা, বিডিআর কর্মকর্তা, বিডিআর সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক।

৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বিডিআর বিদ্রোহে।

৫৩৭ জন বিডিআর সদস্য ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অধীনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন ।

৮৪ জন বিডিআর সদস্য আগে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহার করে নেয়ার আবেদন করেছেন আদালতে। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী।

২১৬৬ জন বিডিআর সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

২৯ জন বেসামরিক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

২১৪৪ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

৫৫ জন বিডিআর সদস্য পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহীনির হেফাজতে এবং কারাগারে থাকাকালে মৃত্যুবরণ করেন। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি পরিসংখান অনুযায়ী।

৪০ টি মামলা হয়েছে এ পর্যন্ত সারাদেশে।

(২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী)

সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন। এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করতে পারবেন।’ সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর আওতায় কিংবা অ্যাক্টটির ৫(১) ধারা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করে বিডিআরকে অ্যাক্টটির আওতায় এনে বিচার করা সম্ভব কি না সে প্রশ্নে আপিল বিভাগের রেফারেন্স চেয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী- মতামত না দেয়ার সুযোগ আপিল বিভাগের রয়েছে। এবং মতামত দিলেও সেক্ষেত্রে তা সাধারণ মামলার সিদ্ধান্তের মতো প্রকাশ্য এজলাসে দেয়া হবে না। রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত মতামত পাঠানো হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি রেফারেন্সে পাঠালেন সুপ্রিম কোর্টের কাছে। এর আগে ১৯৯৫ সালে বিরোধীদল কর্তৃক সংসদ বর্জনের অংশ হিসেবে ৯০ দিন সংসদে হাজির না হলে তা সংবিধান অনুযায়ী ‘অনুপস্থিতি’ হিসেবে গণ্য করা হবে কি না সেই প্রশ্নে আইনগত ব্যাখ্যা চেয়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস আপিল বিভাগের কাছে অনুরূপ রেফারেন্স চেয়ে পাঠিয়েছিলেন।

২৭ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান সুপ্রিম কোর্টের কাছে এ মর্মে রেফারেন্স চেয়ে পাঠান যে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার সেনাআইনে করা যায় কি না। প্রার্থিত রেফারেন্সের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করার জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ১১ বিচারপতির ফুলকোর্ট বেঞ্চ ১৯ আগস্ট ১০ জন আমিকাস কিউরিয়াই বা আদালতের বন্ধু নিয়োগ দেন। ২৫ আগস্ট থেকে রেফারেন্স শুনানিতে আমিকাস কিউরিয়াইদের বক্তব্য শোনা শুরু করে আদালত। তারা হলেন- ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমাদ, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আজমালুল হোসেন কিউসি, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ এবং সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএফএম মেসবাহউদ্দিন।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আপিল বিভাগের কাছে চাওয়া রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের শুনানিতে ১০ জনের মধ্যে ৭ জন আমিকাস কিউরিয়াই সেনাআইনের বিচারের বিপক্ষে আইনগত মত দিয়েছেন।

শুনানির প্রথমদিনে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমাদ ও ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তাদের আইনগত বক্তব্যে আর্মি অ্যাক্ট অনুযায়ী বিচার করা বৈধ এবং সম্ভব বলে মত দিয়েছেন। একইদিনে টিএইচ খান বলেন, বিডিআর কোনো ‘ডিসিপ্লিনড ফোর্স’ বা শৃঙ্খলা বাহিনী নয়। বর্ডার গার্ড বাহিনীর বিচার সেনাআইনে করা সম্ভব নয়। তবে সরকার দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এটা করতে পারে। একটি প্রজ্ঞাপনে বিচার প্রক্রিয়াকে সেনাআইনের আওতায় এনে এবং যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের ব্যাপারে বিডিআর আইনের কার্যকারিতা রহিত করে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সেটা সম্ভব। কিন্তু টিএইচ খান আদালতে এও বলেছেন যে, সেক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে এ উদ্যোগ সাংঘর্ষিক হতে পারে। কারণ ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- অপরাধ সংঘটনের সময় কার্যকর ছিল না এমন আইনের অধীনে কোনো অপরাধের বিচার করা অসাংবিধানিক।

শুনানির দ্বিতীয় দিন ২৬ আগস্ট বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে বিডিআর সদস্যদের আর্মি অ্যাক্টের আওতায় বিশেষত অ্যাক্টটির ৫(১) ধারা অনুযায়ী বিচার করা সম্ভব কি না। এটা সম্ভব নয়। প্রত্যেকটি বাহিনীর আলাদা আলাদা আইন আছে। একটি বাহিনীর আইন অন্যটির ওপর আরোপ করা অসম্ভব। তাছাড়া ব্যারিস্টার আমীর আদালতকে আরো জানান শুধু বিদ্রোহের বিচার করা হলে অন্য অপরাধের প্রতিকার হবে না। সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর লুটপাট, আঘাত, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের বিচার আলাদাভাবে করা উচিত। তিনি বলেন, সেনাআইনে বিচার হলে সেটা সম্ভব হবে না। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২১টি বিদ্রোহের বিচার হয়েছে সেনাআইনের অধীনে গঠিত আদালতে। সেখানে অনেক সেনা সদস্যের মৃত্যুদ- হয়েছে কিন্তু একটি বিদ্রোহেরও প্রকৃত ঘটনা উদঘাটিত হয় নি। তার মতে ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শুধু সাধারণ বিডিআর সদস্যরা জড়িত নয়। সেনাআইনে বিচার করলে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্ণিত করা এবং প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হবে না।’ পরদিন ২৭ আগস্টও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বক্তব্য শোনার পর আদালত ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুনানি মূলতবি করেন। সেপ্টেম্বর ১ শুনানির প্রথমে ব্যারিস্টার আমীরের বক্তব্য শেষ হলে আদালতে আইনগত মতামত দেন ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল বলেন, বিডিআর গঠন হয়েছে ১৯৭২ সালের অধ্যাদেশে। সেই বাহিনীতে আর্মি অ্যাক্ট প্রয়োগ করা যায় না। তিনি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে বলে আদালতকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্টের ২ ধারায় এ আইনের আওতায় কারা আসবে তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিডিআর সদস্যরা ২ ধারার সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না এবং আইনটির ৫ ধারা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করে বিডিআর সদস্যদের ওই আইনের আওতায় নিয়ে আসাও বিদ্যমান আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সম্ভব নয়।’

শুনানির পঞ্চম কার্যদিবসে ২ সেপ্টেম্বর আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম ও আজমালুল হোসেন কিউসি। ড. কামাল ও ব্যারিস্টার রোকনের মতোই মাহমুদুল ইসলাম ও আজমালুল হোসেন কিউসি পরিষ্কার বলেছেন যে, আর্মি অ্যাক্ট অনুযায়ী বিডিআর সদস্যদের বিচার করা সম্ভব নয় এবং আর্মি অ্যাক্টের ধারা ৫ অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করেও নয়। অন্যদিকে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সটিই ফেরত পাঠাতে দিয়েছেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তার মতে, যদি আর্মি অ্যাক্ট অনুযায়ী বিচার বৈধ মর্মে আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয় সেক্ষেত্রে ঘটনাটির তদন্তের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য সংবিধান অনুযায়ী আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য নয়। উল্লেখ্য, মাহমুদুল ইসলাম ও আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া বাকিরা আদালতে সরাসরি বক্তব্য দেন। ওই দুজন বিদেশে থাকায় তাদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করেন তাদের আইনজীবীরা। সর্বশেষ ও ষষ্ঠ কার্যদিবসে এএফ হাসান আরিফ ও এএফএম মেসবাহউদ্দিনও সেনাআইনে বিচারের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।

*জহিরুল ইসলাম মুসা ও মোহাম্মদ আরজু , (আইন বিষয়ক প্রতিবেদক)


Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি

View: 6006 Posts: 1 Post comments

সরকারের দ্বারা বিলম্বিত নাকি "ক্ষমতার" আবদারের কাছে মাথা নত !

সরকারের উচ্চমহল থেকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার পর, মহাজোট সরকারের নির্বাহী প্রধান সামরিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যেভাবে অপদস্ত হয়েছেন তার পরে ন্যায় বিচারের দায়ভার যে এই সরকার নেবে না তা মোটামুটি পরিস্কার। কিন্তু যেনতেনভাবে বিচার শেষ করার পেছনে, সামরিক বাহিনী একচ্ছএ বলপ্রয়োগের যে অধিকার চর্চা করে আসতে দেখেছি তাতে পরিবার শুদ্ধ নির্মুল হবার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়নি বলে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে। তা না হলে অ্যামিকাস কিউরী সহ সুপ্রীম কোর্টের সর্বোচ্চ প্যানেলের যে অভিমত এবং পরামর্শ তা কেন তদন্ত কমিটির সুপারিশের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ন বলে বিবেচিত হবে। আইনী বিষয়ে, তদন্ত কর্মকর্তাদের চেয়ে বিচারকের কম জানাবোঝা আছে বলে আমার মনে হয় না। সেনা আইনে বিচার করা যাবে না এটা আদালতের বক্তব্য। কিন্তু আদালতের আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে হয়তবা এই বিচারকার্যের সমাধান করা হবে না। কারণ, বিচারকার্য নির্ধারিত হবে এখানে বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে। যার ফলাফল হিসাবে ৭৩জনের বিপরীতে ৫৫ জনের বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড আমরা দেখলাম। এই হল বাস্তবতা। বলপ্রয়োগই আইন। ন্যায়বিচার এই বলপ্রয়োগের লক্ষ্য নয়। এটাই certain perspective আমাদের দেশে। " Law has no existence for itself; rather its essence lies, from a certain perspective, in the very life of men."-Savigny
Home
EMAIL
PASSWORD