‘কোর্ট মার্শাল’: নাটক থেকে বিডিআর বিচারের কাঠগড়া
‘কোর্ট মার্শাল’ নাটকটি প্রথম দেখি ২০০২- এ মহিলা সমিতি মঞ্চে। নতুন নাটক দেখছি তবু ঘটনার চেয়ে অভিনয় শৈলীই আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। একটা সেনা কোর্টে আসামীর বিচার হচ্ছে। মনে পড়ে দু’জন আসামীর দু’জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় কষ্ট পেয়েছিলাম। সেদিন বিষয়ের চেয়ে উপস্থাপনার চমৎকারিত্যই আমার মত তরুণকে বেশি নাড়া দিয়েছিল।
নির্বাচিত সরকারের আমলে ২০০৯ এ নাটকটি মঞ্চস্থ করা শুরু করে থিয়েটার আর্ট ইউনিট। (জেনেছি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নাটকটি নিষিদ্ধ ছিল।) ‘কোর্ট মার্শাল’ নাটকের পুনরাগমন আমাকে আবারও নাটকটি দেখতে প্ররোচিত করে। সাতবছর আগের দেখা নাটকটি যেন নতুন অর্থ নিয়ে আমার কাছে হাজির হলো। বিগত আড়াই বছরের অভিজ্ঞতাই এর কারণ। এ সময় গুলোতে সেনাশাসন, সেনাআইন, সেনাসমর্থিত সরকার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন চুক্তির চেষ্টা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সামরিক শক্তি প্রয়োগ, ছাত্র-শিক্ষকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন, অপারেশন ডাল-ভাত; সর্বোপরি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মাথায় উচ্চ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ ,আবার সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারাই বিচারকার্য পরিচালনা-- এতসব ঘটনা ‘কোর্ট মার্শাল’ সম্পর্কে কৌতুহল আরো বাড়িয়ে দিল।
গত ২২ সেপ্টেম্বর নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বাবিদ্যালয়ের মুক্ত মঞ্চে। আমার মতো বিশেষ আগ্রহের কারণেই হোক অথবা অপরাপর বিষয়ে অনাগ্রহ বশতই হোক নাটকটি উপভোগ করতে ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল দেখার মত।
একটি আদালত কক্ষ, তিনজন বিচারপতি, বাদী-বিবাদীর দু’জন আইনজীবী, বাদীপক্ষ ও কজন সাক্ষী, জেরা করার জন্য দুটি কাঠগড়া, একজন গার্ড। (সেনা পোষাক না থাকলে সাধারন আদালত বলেই মনে হবে)।
সংগঠিত সেনাবিদ্রোহের বিচার করতে কোর্ট মার্শালের আয়োজন। প্রথম আসামী বীর উত্তম সিপাহী নওশাদ। জবানবন্দি অনুযায়ী তার অপরাধ গুলাগুলির শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হয়ে সে দেখে ক্যাপ্টেন রফিকের রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ লাশ। যেহেতু আশে পাশে আর কেউ ছিল না সুতরাং তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হলো। আসামী পক্ষের আইনজীবী মেজর মাহমুদের প্রশ্ন: “সিপাহী নওশাদের কর্তব্যবোধ এবং শৃঙ্খলাজ্ঞান ছিল উন্নত। তাহলে এরকম একটা লোক কেন সেনাবিদ্রোহে যোগ দিল?” বিচারক-১ আরো ১৯জন বিদ্রোহীর বিচার করতে হবে বলে সময় নষ্ট না করে রায় ঘোষণার ইঙ্গিত করেন প্রধান বিচারপতি কর্নেল রাব্বিকে। মেজর মাহমুদ বলেন-- “স্যার বিচার ব্যবস্থা কিসের জন্য? সাক্ষ্য প্রমাণ যুক্তির আলোকে সত্যকে আবিষ্কারের জন্য। আদালত যদি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তা হলে এ প্রহসন মূলক বিচারের...” মেজরকে থামিয়ে প্রধান বিচারপতি সিপাহী নওশাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন।
দ্বিতীয় আসামী সিপাহী আকবর। তার রেজিমেন্টের সিও সাহেবের ভাষ্য মতে “ন্যায়নিষ্ঠ সৈনিক, নিজের কর্তব্যে সে সচেতন ও সমর্থ, আদর্শ সৈনিক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-- সেনাবিদ্রোহে নিজেকে যুক্ত করে পরিকল্পিত ও স্বজ্ঞানে ক্যাপ্টেন সাব্বিরকে হত্যা ও মেজর এফ এ খানকে খুন করার চেষ্টা; আত্মপক্ষ সমর্থন না করেই সে তার অপরাধ স্বীকার করে নেয়। আসামী আকবরের স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি পেয়ে বিচারক-২ রায় ঘোষণার তাড়া দিলে মেজর মাহমুদ আপত্তি তোলেন, “... সন্দেহাতীতভাবে অভিযুক্তকে শাস্তি প্রদান করাই কোর্টের কাজ... আমি নিজ কানে শুনেছি সিপাহী আকবর হত্যা করেছে। আমার প্রশ্ন কেন সে হত্যা করলো? একজন সাদাসিধা নিয়মিত সৈনিক তার অফিসারদের উপর গুলি চালাবে কেন? এই হত্যার মোটিফ কি। এমন কি ঘটনা সেনাবাহিনীর মতো শৃঙ্খলাবাহিনীতে ঘটলো যার জন্য সিপাহী আকবরকে হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডে ইন্ধন যোগালো?
বিদ্রোহের কারণ খুঁজতে গেলে বের হয়ে আসে সিপাহীদের উপর অব্যাহত অন্যায় অবিচার, হেয় প্রতিপন্ন করাসহ চাকরের মত আচরণ। সৈনিকের আত্মমর্যাদায় কতটা আঘাতের পর এ ধরনের অবস্থান নিতে বাধ্য হয় একজন সৈনিক! নাটকে উঠে আসে আইন অনুযায়ী একজন সৈনিকের আরদালী হিসেবে কাজ হচ্ছে: অফিসারের পোষাক ও আসবাবপত্র ঠিক রাখা। কিন্তু তাদের দিয়ে যা করানো হয়- মেজর মাহমুদের ভাষায় “আরদালী মানে সেবাদার তো অফিসারের চাকর, বাজার থেকে মাল নিয়ে আসো, বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে এসো, খাবার বানাও, খাবার সার্ভ করো, মেমসাহেবের কাপড় ইস্ত্রী করো। সেবার কাজে কোন বিঘ্ন ঘটলে তার সাথে জন্তু জানোয়ারের মতো ব্যবহার করো। দাস প্রথা সেই কবে শেষ হয়েছে কিন্তু তার প্রেতাত্মার দৌড় আজো বহাল রয়েছে।”
একই রেজিমেন্টের সুবেদার মান্নান এক পর্যায়ে উপলব্ধি করেন সিপাহী আকবরের মত সিপাহীদের এ ধরনের অভিযোগ যদি তিনি সিও সাহেবকে জানিয়ে দিতেন তাহলে বোধ হয় এ হত্যাকাণ্ড ঘটতো না, বিদ্রোহ হতো না।
তাই সুবেদারের উত্তরে মেজর মাহমুদকে বলতে শুনি--“হতো তার পরও খুন হতো এই সমাজের এটাই রীতি। ছোট-খাট মানুষের অভিযোগ চেপে যাও আর বড় মানুষের ভুল দেখতে পেলে চোখ বন্ধ করে নাও। ... খুন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো হবে, কারণ খুনের কারণগুলিকে আমরাই প্রশ্রয় দিচ্ছি পরিচর্যা করছি”।
এক্ষেত্রে ১৯৭৫-র নভেম্বর বিদ্রোহের কথা মনে করা যেতে পারে। সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিরুদ্ধে সিপাহীদের বেশ কিছু অভিযোগের অন্যতম একটি ছিল আরদালীর মত ব্যাটম্যান প্রথা যা দাস প্রথার নামান্তর। পরবর্তীতে সৈনিকদের দাবির মুখে সেনাবাহিনী থেকে এই ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়।
ফেব্র“য়ারীতে ঘটে যাওয়া বিডিআর বিদ্রোহেও পারিবারিক কাজে সৈনিকদের ব্যবহার করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, গালিগালাজ ও নির্যাতনের কথা উঠে এসেছে।
নাটকের সেনাবিদ্রোহ আর বিডিআর বিদ্রোহ যেন মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছিল আমাদের কাছে। আমরা যেন দু’জন বিডিআর জাওয়ানের ‘কোর্ট মার্শাল’ দেখছিলাম। বিডিআর বিদ্রোহের আগে তাদের দাবিদাওয়া জানানো হয়েছিল, বিদ্রোহের আগে লিফলেট আকারে তা বিলি হয় যা মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জেনেছি কিন্তু জাওয়ানদের অভিযোগ “বিডিআর সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সৈনিকদের দাবি উত্থাপন না করে কর্মকর্তরা নিজেদের জন্য গাড়ী ও বাসস্থান দাবি করেন।” (২৬ফেব্রুয়ারি, প্রথম আলো)
বিষ্মিত হতে হয় ১৯৯৩সালে প্রথম মঞ্চস্থ হওয়া নাটকটি ২০০৯সালের ঘটে যাওয়া বিডিআর বিদ্রোহের ভবিষ্যত বাণী করছে দেখে। নাটকটি কোনো একটা সেনাবিদ্রোহের বিচার কাজকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল। (আর বিডিআর ও সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান।)
ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহে ২৫-২৬ তারিখে ৫৭জন সেনাঅফিসারসহ মোট ৭৪ জনের মৃত্যু একটি অপূরনীয় ক্ষতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও আমাদের এত সেনাঅফিসার হারাতে হয় নি। সেখানে যে নৃশংসতার সাথে হত্যাকাণ্ড ও অপরাপর অপরাধ সংগঠিত হয়ে তা সৈনিকসুলভ নয়। এর বিচার হওয়া চাই দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু সেটা হতে হবে প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমেই। তবুও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিলেই কি বিদ্রোহ হবেনা এ নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব? বিডিআরে এ নিয়ে তিনবার বিদ্রোহ হলো, সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ হয়েছে অনেকবার, প্রতিবারই বিচার (?) হয়েছে। তারপর ও বিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু এসব বিদ্রোহের শেষ কোথায়?
এবারও এর বহুপক্ষীয় তদন্ত হয়েছে। বিদ্রোহ কেন হয়েছে এসংক্রান্ত দুটি সরকারী তদন্তু প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে সেনাকর্মকর্তা ও সরকারের উপর পূঞ্জীভুত ক্ষোভই এ নৃশংস বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার পটভূমি তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেনাকর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ও ন্যায়সংগত দাবিদাওয়াগুলো তোলা হয়েছে তা কিভাবে দূর করা হবে তার কোনো রূপরেখা এখনো সরকার স্পষ্ট করে কিছু বলে নি বা কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় নি।
এ ধরনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর দিক থেকে অযৌক্তিক আক্রোশ ও আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ আচরণ আশঙ্কা করা হচ্ছিল। তাই অনেক মানবাধিকার সংগঠন উদ্বেগের সাথে আশঙ্কা ব্যক্ত করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যেন, এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমরা আরও হত্যাকাণ্ডের জন্ম না দিই।
বিডিআরদের মৃত্যুগুলো যে স্বাভাবিক মৃত্যু নয় নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা দুটি হত্যা মামলাই এর প্রমান। যদিও এসব মামলার অগ্রগতি নেই বললেই চলে। সর্বশেষ হাবিলদার রেজাউল করিমের মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার ভাগ্নে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন-- তার শরীরে অনেক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল, কারাগারে থাকাকালীন নির্যাতনের কারণে নিজের মৃত্যুর আশঙ্কার কথা বলেছিলেন তার মামা রেজাউল।
পুলিশ রিমান্ডে ৫৩৭জন বিডিআর সদস্য স্বীকারুক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর ৮৪জন আদালতের কাছে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন জানান। তাদের অভিযোগ জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারুক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।
বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সভাপতি ড. সি. আর. আবরার বলেন, ‘‘স্পেশাল ট্রাইবুনাল হোক আর যাই হোক, সেখানে যেন আপিল করার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বিচারের বিষয়টি স্বচ্ছ এবং প্রকৃত দোষীরা চিহ্নিত হবে। ...এখন দোষীদের বিচার ও নিরপরাধীদের ন্যায়বিচার পাওয়াটাও সরকারের আরেকটা বড় চ্যলেঞ্জ”। সে চ্যালেঞ্জ সরকার ও বিডিআর কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে মোকাবেলা করেছেন তা দেখে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা ভীত ও শঙ্কিত।
দু ধরনের বিচার হচ্ছে
ক. প্রতিষ্ঠানের বিচার: বিডিআর বিদ্রোহের অপরাধে সীমান্তরক্ষার ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠনের নামে শাস্তি দেয়া হলো যেভাবে-- ১. প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন ২. পোষাক পরিবর্তন ৩. সামরিক ক্ষমতা কমিয়ে আনা ৪. গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন ৫. আরো বেশি সেনানিয়ন্ত্রণ ৬. ভবিষ্যৎ বিদ্রোহের বিচার সেনাআইনে করার ব্যবস্থাসহ আরো বেশ কিছু পরিবর্তন যা এখনো মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় নি।
খ. বিদ্রোহীদের বিচার : ১. বিদ্রোহ জনিত অপরাধ : বিচার হবে বিডিআর আইনে, ইতোমধ্যে তিনসদস্য বিশিষ্ট বিচারক প্যানেল করা হয়েছে এবং বিচারের কাজও চলছে। ২. হত্যা, লুন্ঠন, নৈরাজ্যসহ অপরাপর অপরাধের বিচার হবে দ্রুত বিচার আইনে; যার তদন্ত করছে সিআইডি।
‘কোর্ট মার্শাল’ প্রকৃত পক্ষে কেমন হয় তা আমাদের মতো বেসামরিক লোকজনের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। নাটকের ‘কোর্ট মার্শাল’ বাস্তবের সামরিক আদালতের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। হয়ত আরো ন্যায়সঙ্গত বিচার হয় সেখানে, কিন্তু আমরা যদি নাটকের কোট মার্শালের সাথেও তুলনা করি বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়াকে তাহলে আমাদের যারপরনাই ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হতে হয়। এর কারণ:
১. ‘কোর্ট মার্শালে’ বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষেরই আইনজীবী নিয়োগের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিডিআর জাওয়ানদের ক্ষেত্রে তারা শুধু নিজ খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে তাদের পরামর্শ নিতে পারবেন। তাদের আইনজীবী জেরায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে না।
২. ‘কোর্ট মার্শালে’ বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু বিডিআরদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং কারাগারে ৫৫জন বিডিআর সদস্যের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। (বিদ্রোহ চলাকালীন নয় জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন ।)
৩. বিডিআর বিদ্রোহের বিচারের ক্ষেত্রে সভাপতি (প্রধান বিচারপতি) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেনাকর্মকর্তা বিডিআর মহা-পরিচালককে। তিন সদস্য বিশিষ্ট বিচারকদের বাকী দুজনের একজন বিডিআর কর্মকর্তা লে.কর্নেল ও অপর জন মেজর।
নাটকে বিদ্রোহীদের প্রতি বিচারকদের মনোভাব আমাদের উদ্বিগ্ন করে। মেজর মাহমুদের কারণ খোঁজার চেষ্টা দেখে ভয় পেয়ে বিচারক-২বলেন- ‘‘কিন্তু এই করে ও আকবরকে বাচাঁবে কিভাবে?’’ প্রতি উত্তরে বিচারক-১ ‘‘আকবরকে কিভাবে বাঁচাবে সেটা কোনো প্রশ্ন না। প্রশ্নটা হচ্ছে ও আর কাকে কাকে মারবে।” গ্রহণযোগ্য বিচার ও স্বচ্ছ তদন্তের ফলে বের হয়ে আসতে পারে প্রকৃত ঘটনা যা আর কখনো এসব কারণে বিদ্রোহের সম্ভাবনা তৈরি করবেনা।
৪. বিদ্রোহের বিচার সেনাআইনে করার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাইলে ১০জন আমিকাস কিউরিয়াই’র মধ্যে ৭জনই সেনাআইনে বিচার সম্ভব নয় বলে মতামত দেন। যদিও তদন্তকমিটির সুপারিশের আগেই যায়যায়দিন পত্রিকায় একজন বিচারক বিদ্রোহের বিচার বিডিআর আইনে সম্ভব এবং তা করতে সরকার বাধ্য বলে মতদেন। সে অনুযায়ী বর্তমানে বিদ্রোহের বিচার বিডিআর আইনেই চলছে। উল্লেখ্য সেনাআইনে বিচারের সুপারিশ করা হয় তদন্ত কমিটিতে, বিডিআর মহা-পরিচালকও ছিলেন, যিনি এখন বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়ার প্রধান বিচারপতি। তাই তার অধীনে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিডিআর জাওয়ানসহ সাধারণ জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
৫. বিদ্রোহের পর দায়িত্ব পাওয়া বিডিআর মহাপরিচালক জাওয়ানদের অভিভাবক। কিন্তু বিচারের আগে ৫৫জন জাওয়ানের অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্পর্কে তার নিরবতা বিশেষ আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বিদ্রোহীরা অফিসারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিলেও অনেকে রক্ষা করেছে অফিসার, তাদের পরিবার পরিজনদের। বেঁচে আসা মেজর মোকাররম বলেন ‘‘কেউ কেউ দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে ,ভাল সৈনিকরা আবার দরজা খুলে দিচ্ছে, কারণ বাতাস না এলে দম ফেলানো যাচ্ছে না। ভাল জাওয়ানরা পানি দিচ্ছে, চুরি করে বিস্কুট দিচ্ছে।” (৫ মার্চ সাপ্তাহিক ২০০০) অফিসারদের রক্ষা করতে জীবন দিতে হয়েছে বেশ কজন বিডিআর জাওয়ানদের। এই দিকগুলোও অতিশয় গুরুত্বের সাথে সংবেদনশীল হয়ে বিবেচনা করতে হবে।
একটি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যেমন সৈনিকের প্রয়োজন তেমনি অফিসারেরও প্রয়োজন। এ বিষয়টি জনগণ-সৈনিক-অফিসার সবাই জানে এবং মানে। এক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের ধরণ কেমন হওয়া উচিত বিডিআরের মূলমন্ত্র এর একটি ভাল দৃষ্টান্ত।
‘ ভ্রাতৃত্ব-শৃঙ্খলা-দক্ষতা’ বিডিআরের মূলমন্ত্র। যা বিদ্রোহের দিনও বড় করে দেয়ালে লিখাছিল। তাহলে কেন এর ব্যত্যয় ঘটেছিল তাই শনাক্ত করাই হওয়া উচিত সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার বিচেনা।
বাস্তবে ভ্রাতৃত্বের সে বন্ধন খসে দিনে দিনে দূরত্বের যে দেয়াল তৈরি হয়েছিল বিদ্রোহের ভিতর বিশৃঙ্খলা যা আমরা পিলখানায় সংগঠিত হতে দেখলাম। আমাদের মনে রাখা উচিত এটি বিশৃঙ্খল ও অসংগঠিত হওয়া সত্ত্বেও ছিল সমর্থনপুষ্ট।
কিন্তু উভয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ কেন নষ্ট হলো তাকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিশোধে মানসিকতা নয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে একমাত্র ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ফিরে আসবে শৃঙ্খলা, বৃদ্ধি পাবে দক্ষতা। বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে হলে এইসব বিষয়ে প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিতে হবে। কারো উস্কানিতে আবেগে জর্জর হয়ে আমরা যেন নিজেরদের জন্য আরো বড় ধরণের ক্ষতির কারণ না হই।
নাটকে মেজর মাহমুদ তাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ খুঁজেছেন বারবার। কেননা বিচারে শৃঙ্খলার নামে শুধু শৃঙ্খলিত করার ঘোর বিরোধী তিনি । বিদ্রোহের পেছনের কারণ খুজার চেষ্টাকে তাই দর্শক বারবার করতালি দিয়ে সমর্থন করে গেছে।
বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করতে মেজর মাহমুদ বলেন- “ ইওর অনার, এই আদালত শাস্তি বিধান করছে বিদ্রোহে অংশ গ্রহণকারীদের। কিন্তু জানতে চাচ্ছেনা বিদ্রোহের কারণ”।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর বিডিআরকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে প্রথম বিদ্রোহ হয়েছিল। ২০০৯ এ আবার বিদ্রোহ হলো একই দাবির সাথে যোগ হয়েছে আরও কিছু ন্যায়সঙ্গত দাবি। সেনাবাহিনীতে ও অনেকগুলো বিদ্রোহ হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহকে শুধু বিচারিক কাঠামো, আইন-আদালতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে এর রাজনৈতিক সমাধান দরকার। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ ভাইয়ে ভাইয়ে এ সংঘাত রক্তপাত দেখতে চাই না। আমরা এর গ্রহণযোগ্য বিচার ও সুষ্ঠু সমাধান চাই। রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় করার এটাই একমাত্র পথ।
একসাথে দেশের অভ্যন্তরে এত অধিক সংখ্যক সেনা অফিসার হারানোর বেদনা ধেকে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা অন্যকারে সুযোগসন্ধানী পুরিকল্পনা বানচাল করতে পরবো। আমাদের অফিসারদের উপর, তাদের স্বজনদের উপর যে অত্যাচার হয়েছে তা সৈনিক সুলভ নয়, প্রকৃত সৈনিকরা এইধরণের অমানবিক, নৃশংস ও জঘন্য কর্মকাণ্ড চালাতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। খুঁজে বের করতে হবে প্রকৃত দোষীদের। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একই সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে নীরাপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায়।
পক্ষপাতমুক্ত, প্রতিশোধমুক্ত, গ্রহণযোগ্য বিচার করতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যকার ব্যবধানই বাড়বে - “...সেই সমস্ত কারণগুলাকে শনাক্ত করে অপসারনের ব্যবস্থা করা হোক, যা একজন মানুষকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেয় না। সকল প্রকার সামাজিক বিভেদের রেখা নিশ্চিহ্ন করে সত্যিকারের ন্যায়ের শাষন প্রতিষ্ঠা করা হোক”। আর যদি এতে আমরা ব্যর্থ হই তাহলে মেজর মাহমুদের আশঙ্কাকেই আবারও সত্যে পরিণত করবে -- “এই নিছক বিচারের নামে প্রহসন সাময়িক শান্তি ফিরিয়ে আনবে কিন্তু বপন করে রাখছে আরো একটি বড় ধরনের বীজ”। সেটা কোনোভাবেই সুখকর নয়, কারো জন্যই কাম্য নয়। বাংলাদেশকে যেন সে ভার আর বইতে না হয়।
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি