প্রতিবেদন : ফারাক্কা যেভাবে এলো


আতাউর রহমান রাইহান
Saturday 15 May 10

উত্তরের হিমালয় পর্বতমালা থেকে নেমে আসা ও তিন দিক ঘিরে থাকা প্রতিবেশী ইনডিয়ার নানা অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোই মূলত বাংলাদেশের জলজীবনের (ওয়াটার সার্কেল) সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমানে প্রায় সব নদীতেই পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্থ, প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক মাত্রার তুলানায় পরিমাণ অনেক কম। বাংলাদেশের জলজীবন ঘোর সংকটে, কাজেই কৃষি-স্বাস্থ্য--সবমিলিয়ে দেশটির প্রতিবেশ এক বিনাশী করালগ্রাসে আক্রান্ত। কারণ প্রায় সব নদীর উজানে, নিজের অংশে হয় ব্যারাজ নয় ড্যাম তৈরি করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে ইনডিয়া। যেমন পদ্মা, আর্ন্তজাতিক নদীগুলোর একটা--হিমালয় থেকে নেপাল ও ইনডিয়ান ইউনিয়নভূক্ত পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্য হয়ে নদীটি বাংলাদেশে ঢুকেছে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ সীমানা ঘেষে। ইনডিয়ায় নদীটির নাম গঙ্গা। সীমান্তের এগারো মাইল উজানে ফারাক্কা এলাকায় নদীটিতে উনিশশো চুয়াত্তর সালে ব্যারাজ চালু করেছে ইনডিয়া--ফারাক্কা ব্যারেজ। সাড়ে তিন দশকজুড়ে নদীর প্রবাহ ঠেকিয়ে পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মা এখন প্রায় মৃত নদী। বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জীবনধারা আটকে যাচ্ছে ফারাক্কায়, ক্রমশ। 

 

পরিকল্পনা: ১৯৫১

ব্যারাজ তৈরিতে ইনডিয়ান ইউনিয়নের পরিকল্পনার খবর ওই দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে। ব্যারাজ নির্মাণের উদ্দেশ্য হিশাবে ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে ভাগিরথী ও হুগলী নদীতে নিয়ে যাওয়া হবে।

প্রাথমিক প্রস্তুতি ও কূটনৈতিক তৎপরতা: ’৫১ থেকে ’৬০

পাকিস্তান কূটনৈতিক আপত্তি জানায় ইনডিয়াকে, পরের দশ বছর ধরে দেশ দুটি প্রধানত চিঠি মারফতে আলাপ চালায়। তখন ইনডিয়া শুধু দুটি দেশের ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ’ বিষয়ক আলোচনায় রাজি হয়। ১৯৫৪, ’৫৫, ’৫৬ ও ’৬০ সালে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সরাসরি আলোচনা হয়--সচিব, মন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে। অন্যদিকে ইনডিয়া ব্যারাজ তৈরির প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ করে।

ব্যারাজ তৈরি শুরু: ১৯৬১

বন্যায় নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আলোচনার জন্য নির্ধারিত ইনডিয়ার বিশেষজ্ঞ দল পাকিস্তানের বিষেশজ্ঞ দলকে ওই বছরের জানুয়ারিতে চিঠি মারফত জানায় যে, তারা ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি করতে শুরু করেছে।

গঙ্গা থেকে ‘পানি সমস্যা’, পাকিস্তানের আলোচনার চেষ্টা: ’৬১ থেকে ’৬৭

উনিশশো একষট্টির মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ‘গঙ্গা সমস্যা’ নিয়ে মন্ত্রী বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব দেন ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে। এপ্রিল মাসে দেয়া জবাবে ইনডিয়া অপেক্ষা করার অনুরোধ জানায়--আরো তথ্য দেয়া নেয়ার লক্ষ্যে। পরে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আরো চারটি বৈঠক হয়। সর্বশেষ সে বছরের ডিসেম্বর মাসে চতুর্থ বিশেষজ্ঞ বৈঠকে ধার্য হয় যে, চুড়ান্ত আলোচনার আগে আরো তথ্যের দরকার হলে পরে তা চিঠি মারফত ব্যবস্থা করা হবে।

ইনডিয়ার তরফে প্রতিশ্রুতি: ’৬৮ থেকে ’৭০

সাত বছর পরে আবার আলোচনা শুরু হয় ১৯৬৮ সালের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠকের মাধ্যমে। তখন বৈঠকটিকে কূটনৈতিকভাবে ‘পানি সমস্যা’ সংক্রান্ত বৈঠক বলা হয়। পরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলো সচিব পর্যায়ে উন্নীত করা হয়, এবং সচিব পর্যায়ের পাঁচটি বৈঠক হয়। পাকিস্তান আমলে ‘পানি সমস্যা’ নিয়ে সর্বশেষ সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয় ১৯৭০ সালের জুলাইয়ে। পয়ষট্টির যুদ্ধের পরের ওই প্রথম দ্বিপাক্ষিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আর্ন্তজাতিক চাপ থাকায় ইনডিয়ার তরফে তুলনামূলক ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। আলোচনা এইটুকু আগায় যে, ফারাক্কা ব্যারাজে পাকিস্তানকে কিছু পানি ছাড় দেয়া হবে।

ফারাক্কা ব্যারেজ অপ্রাসঙ্গিক: ’৭২ থেকে ’৭৪

বাংলাদেশ আমলে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করার আগে দুদেশের মধ্যে কোনো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠক হয় নাই। নানা ইস্যুতে দুই দেশের মন্ত্রীপর্যায়ে আলোচনা হলে পরে সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হতো যে, ইনডিয়ার কাছ থেকে তারা আশ্বস্ত হয়েছেন--ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার আগেই পানি-বন্টনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ঊনিশশো চুয়াত্তরের মে মাসে মুজিব-ইন্দিরা শীর্ষ বৈঠকেও পানি-বন্টন প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে নাই দেশ দুটি। উল্টো বাংলাদেশ ও ইনডিয়ার যৌথ ঘোষণায় বলা হয় যে, পদ্মায় পানি সরবরাহ বাড়ানোর দরকার আছে। পরে সে বছরের জুন মাসে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে ইনডিয়া প্রস্তাব দেয়--বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত খাল খুড়ে গঙ্গায় পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রস্তাব দেয়--নেপালে ও ইনডিয়ার উত্তরাঞ্চলে জলাধার নির্মাণ করে বর্ষা মৌসুমে পানি জমিয়ে রেখে তা দিয়ে শুকনো মৌসুমে প্রবাহ বাড়ানোর। দুই পক্ষই নিজেদের প্রস্তাবে ছাড় না দেয়ায় আলোচনা ব্যর্থ হয়।

ব্যারেজ চালু হলো পরীক্ষার নাম করে: ১৯৭৫

ঊনিশশো পচাত্তরের শুরুর দিকে ইনডিয়া চিঠি মারফত বাংলাদেশকে জানায় যে, ফারাক্কা ব্যারাজের সাথে ভাগিরথী-হুগলি নদীর যেই সংযোগ খাল করা হয়েছে, সেই ফিডার খালটি চালু করে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। সেই বছরের আঠারো এপ্রিল ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার জানায় যে, দুইদেশের মন্ত্রীপর্যায়ে সমঝোতা হয়েছে। একুশে এপ্রিল থেকে একত্রিশে মে পর্যন্ত মোট একচল্লিশ দিন ভারত ফিডার খাল দিয়ে গঙ্গা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করবে। সে অনুযায়ী ইনডিয়া প্রত্যাহার শুরু করে, কিন্তু আর কখনো সেই ‘পরীক্ষামূলক পানি প্রত্যাহার’ শেষ হয় নাই। এভাবে পরীক্ষার নাম করে ইনডিয়া ফারাক্কা বাঁধ চালু করে।


Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি

View: 8744 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD