ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে মার্কিন চাপ প্রয়োগ
পরাশক্তির অবরোধ আরোপের বাইরে নিতে সচেষ্ট তিন দেশ
হালনাগাদ অবস্থা
ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করতে যুক্তরাষ্ট্র খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে। জাতিসংঘের অন্য চার সদস্যের কাছে খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়ে তাদের সম্মতি আদায় করেছে। স্থায়ী কমিটির পাঁচ সদস্যের বাইরে এ প্রস্তাবে একাত্ম হয়েছে জর্মানি এবং ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্রের নালিশ হল, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য এবং জর্মানির এ খসড়া প্রস্তাবে সম্মতি আছে। ইরান বলছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না, বরং শান্তিপূর্ণভাবে জ্বালানি তৈরি করতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। এসব তর্কবিতর্কের ভেতরে ইরান, ব্রাজিল এবং তুরস্ক এ মাসের সতের তারিখে ‘তেহরান ঘোষণা’র মাধ্যমে একটা চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তি মতে, তেহরান রিসার্চ রিএক্টর (টিআরআর) কম শক্তিসম্পন্ন বারোশ' কেজি ইউরেনিয়াম তুরস্কে পাঠাবে, বিনিময়ে তুরস্ক একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একশ বিশ কেজি ইউরেনিয়াম ফেরত দেবে তেহরানকে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার তত্ত্বাবধানে এ বিনিময় সম্পন্ন হবে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ছাব্বিশটি রাষ্ট্রকে চুক্তি পত্রের বিবরণ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। একই চিঠি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী সকল সদস্য রাষ্ট্রের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
জ্বালানি আছে, তেল আছে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কেন
ঠান্ডা-যুদ্ধ চলাকালীন থেকেই ইরান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের দিকে এগুচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাই এটা বাস্তবায়ন করে আসছে। ১৯৫৯ সালের দিকে ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ শ্লোগান নিয়ে তেহরান নিওক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা পাঁচ মেগাওয়াট নিওক্লিয়ার রিসার্চ রিএ্যাক্টর দিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় এর কাজ চলতে থাকে। ১৯৬৮ সালে ইরান নিওক্লিয়ার নন-প্রলিফারেইশন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৭৪ সালের দিকে রেজা শাহ পাহলবী দেখল, পৃথিবীর মাটির তলায় যে পরিমাণ খনিজ জ্বালানি আছে, তা একসময় ফুরিয়ে যাবে। জ্বালানির জন্য পেট্রোলিয়াম খুবই দরকারি উপাদান। কাজেই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট তৈরি করে ২ হাজার ৩ শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় অনায়াসেই। ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মার্কিন-ইরান নিওক্লিয়ার সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বিপ্লবের পর ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সবসর্ম্পক কাটছাট করে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সহায়তায় ইরান তার নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজ শুরু করে। তারপর হঠাৎ করেই আইএইএ ইরানকে নিওক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ করতে বলে। ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের প্রতি বৈদেশিক সমর্থনের মোড় ঘুরে যায়। ফ্রান্স সহ যেসব দেশ ইরানকে ইউরেনিয়াম সহায়তা দিত তারা তা বন্ধ করে দেয়।
পশ্চিমাদের উদ্বিগ্নের কারণ পারমাণবিক চুল্লি না, অন্যকিছু
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ছবি দেখায় যে, ইউরেনিয়াম উৎপাদনের আড়ালে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাও তা জানে না। তেহরান স্পষ্টভাবে নিওক্লিয়ার নন-প্রলিফারেইশন ট্রিটি (এনপিটি) লঙ্ঘন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কথার সূত্র ধরে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ২০০৩ সালের দিকে বলেন, ইরান মাটি খুঁড়ে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করছে এবং নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে সে জ্বালানি উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে। তারপরও আইএইএ তেহরান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট পরীক্ষা করা শুরু করে। সে সময় তারা বলল, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র রোধ চুক্তির শর্ত মানছে না। একই বছর মোহাম্মদ এল বারাদি ইরান সফর করেন এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ঘেঁটেঘুটে বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। নানা তর্কবিতর্কের পরে ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ইরান ভিয়েনায় আইএইএ’র প্রধান কার্যালয়ে এডিশনাল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। এডিশনাল প্রটোকল অনুসারে আইএইএ পর্যবেক্ষক দল ইরানের অভ্যন্তরীণ এবং পারমাণবিক স্থাপনার সকল দলিলাদি, গবেষণা এবং যে স্থানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হবে, সেসব জায়গা খুঁটে খুঁটে পরীক্ষা করে দেখতে পারবে। ওই সময় ফ্রান্স, জর্মান এবং মার্কিন চাপে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা বন্ধ করে দেয়, যদিও সেখানে জ্বালানি ছাড়া অন্যকিছু নির্মাণের চেষ্টা করছে এমন কোনো প্রমাণ কারও কাছে ছিল না। ইরান দাবি করল, ইসরাইলকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করছে, চীন থেকে ইসরাইল পারমাণবিক প্রযুক্তি কিনছে। এমন কি এনপিটি’র সকল দায়বদ্ধতা দূরে সরিয়ে ইনডিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতার চুক্তি করছে, অথচ ইসরাইলকে কিছু বলা হচ্ছে না। এমনকি ইনডিয়া, পাকিস্তানকেও এনপিটিতে স্বাক্ষর করতে কোনো চাপ দিচ্ছে না। এডিশনাল প্রটোকলের কথা তো আসেই না। এসব ঘটনা বা দুর্ঘটনা বলে দেয়, যুক্তরাষ্ট্র আদতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করতেই এতসব কিছু করছে।
ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকার খেসারত
ইরানের অবস্থান এশিয়া-ইউরোপের মাঝখানে। এ কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে তার আলাদা গুরুত্ব। এছাড়া ইরান হল, বিশ্বের অন্যতম খনিজ জ্বালানি, তেল সরবরাহকারী দেশ। আঞ্চলিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে ইরানের তেল রাজনীতির একটা প্রভাব আছে। ইরান ইচ্ছা করলে ইরাক-আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের মিশন বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আবার শান্তিপূর্ণ কায়দায় চলতে দিতেও পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দখলাধীন এ দেশ দুটোর সঙ্গে ইরানের সরাসরি সীমান্ত সংযোগ। তাই ইরানের সামরিক শক্তি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতি আশপাশের এবং বাইরের রাষ্ট্রগুলো শকুনি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের মিশন ব্যর্থ করতে চাইছে ইরান এবং গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করছে।
তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষায় ইরানকেই প্রধান বাধা মানছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ইরানকেও শয়তানের অক্ষশক্তির আখ্যা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা অনেক আগ থেকেই ইরানকে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন থেকে বিরত রাখতে চাইছে। কিন্তু ইরান তা করবে কেন? পারমাণবিক জ্বালানি এখন ইরানের জাতীয় গর্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। কাজেই এটা থেকে বিরত থাকা ইরানের পক্ষে সম্ভব হবে না। ইরানের ৮০ ভাগ মানুষের ইরানের এ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণে সম্মতি আছে। সেখানে ইরান সরকার জ্বালানি সরবরাহ থেকে ফিরে আসার মতলব করলেও তা পারবে না।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ইরান
ইরান আঞ্চলিক শক্তি হিশাবে নিজেকে জাহির করতে চাইলেও প্রতিবেশীদের সাথে তার সম্পর্ক ভালো নাই। আঞ্চলিক এবং নৃতাত্ত্বিকভাবে আজারবাইজানের সঙ্গে নানা বিতর্কে জড়িয়ে আছে। এ ছাড়া কাস্পিয়ান সাগরের সীমানা নিয়ে টানাপোড়েন, ইরাকের সঙ্গে দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধ, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে নানা ইস্যুতে দূরত্বের সম্পর্ক ইরানকে অনেকটা একা করে রেখেছে। যদিও জাতিসংঘ, ন্যাম, ওপেক, ওআইসি’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ইরান। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর পশ্চিমা দুনিয়ার নজর পড়ে ইরানের কৌশলগত অবস্থানের প্রতি। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্ক ইসলামী বিল্পবের পরপরই কাটছাট হয়ে যায়। আর এটা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জিম্মি সমস্যা নিয়ে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর থেকে তার সমর্থন তুলে নেয়। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল ইরাকের দিকে। আরব বিশ্বের ভিতরে সিরিয়াই যা ইরানকে নানা ইস্যুতে সমর্থন করছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া একটা সীমাবদ্ধতার ভিতর থেকেই ইরানকে যথাসম্ভব যুদ্ধাস্ত্র আনজাম দিচ্ছে। ইরাক যুদ্ধের পর সেখানে শিয়া-সুন্নি গৃহযুদ্ধ থেকে ইরান সুবিধা নিচ্ছে এমন অভিযোগ আছে।
বিপ্লব পরবর্তী ইরানের পররাষ্ট্রনীতি
বিপ্লবের পরপরই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রতি ইরানের আচরণ কী রকম হবে তা ঠিক হয়ে যায়। বলা যায়, বিপ্লবের স্রোতেই ইরানের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ হয়। নেতিবাচক ও ইতিবাচক এ দুটি দৃষ্টিভঙ্গিতে ইরান তার পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে। যেমন, ইরান সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি অবস্থান করবে এবং ইসরাইল বিরোধী মনোভাব পোষণ করবে। রাশিয়া, চীন এবং ইন্ডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করবে। আঞ্চলিক শক্তি হিশাবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করবে। এগুলো বাস্তবায়নে ইরানকে অনেকগুলো সমস্যায় পড়তে হবে। ইরানের অভ্যন্তরীণ স্থিতি নষ্ট হওয়ার মত অনেক কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইরানের চারপাশে তৈরি করে রেখেছে। যেমন, ইরাক, পারস্য উপসাগর, আফগানিস্তান, আজারবাইজান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিম্বা ন্যাটো সেনা অর্থাৎ এক্সট্রা রিজিওনাল ফোর্সের (ইআরএফ) উপস্থিতি ইরানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সৃষ্টির কারণ হতে পারে। আবার আফগানিস্তান-ইরাকে আত্মঘাতি এবং বিদ্রোহীদের সাথে ক্রমাগত সংঘর্ষে মার্কিন সৈন্য ক্ষয়, যা অন্যদিকে ইরানকে কিছুটা আশার সঞ্চার করে।
ইরানের ভেতরের খবর
একটি সাংস্কৃতিক বিল্পবের ভিতর দিয়ে ইরানের সব কিছুতেই পরিবর্তন আসে। কিন্তু বর্তমানে ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খুব ভাল নাই। বিল্পবের পর ১৯৭৯ সালে ইরান রাষ্ট্রটি ইসলামী রিপাবলিক অফ ইরান নামে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা গঠন করে। যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা হুমকি ইরানের জনগণ এক চোখেই দেখছে। এ হুমকি মোকাবেলায় খুব একটা অনৈক্য ইরানি জনগণের নাই। অবশ্য অভ্যন্তরীণ বিষয়াশয়ে রাষ্ট্রীয় নেতাদের প্রতি ইরানী জনগণ সন্তুষ্ট নয়। গত নির্বাচনের পরই তা আমরা দেখেছি। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরাপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। পেট্রোলিয়াম ও তেল রফতানির ওপর ইরানের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৯৩ সালের পর ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী শক্তিশালী করা হয়। ইরানের তখনকার অভ্যন্তরীণ গোলমাল সামাল দিতেই ইরান এ বাহিনী গঠন করেছে।
আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইরান
আরবদের সাথে ইরানের সম্পর্ক কখনো ভালো গেছে, এমন নজির নাই। ঐতিহ্যগত বা ঐতিহাসিক--যে দিক দিয়েই দেখার চেষ্টা করি, বিপ্লব সংঘটনের পর ইরান তার শত্রুর তালিকার এক নম্বরে রাখে যুক্তরাষ্ট্রের নাম। অথচ ওই সময়ে আরবদের সাথে বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের খাতির গলায় গলায়। ভূ-রাজনৈতিক, কৌশলগত ও স্বার্থ বিবেচনায় ইরানকে তারা ঘোরতর শত্রুজ্ঞান করে আসছে। ধর্মীয় দিক থেকেও দূরত্ব আছে বিস্তর। ইরানে বিপ্লব হওয়ার পর আরব নেতাদের মনে ভয় ঢুকে যায়, ইরানের বিল্পবী চেতনা ও শিয়া মতবাদ তাদের দেশে না আবার আমদানি হয়। তাই ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় আরব রাষ্ট্র এবং গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) ইরাকের পক্ষাবলম্বন করে। বাহরাইনের শাসকগোষ্ঠী সুন্নি অথচ সেখানকার বেশিরভাগ জনসংখ্যা শিয়া মতাবলম্বী। তাই ইরানকে তারা সবসময়ই এড়ানোর চেষ্টা করছে। এ জন্য বাহরাইন সরকার তেহরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে খুব একটা আগ্রহী না। জিসিস’র সাথে ইরান কখনো মুখোমুখি বাকবিতন্ডায় যায় নাই। বরং উপসাগরীয় তেল, গ্যাস ভাগাভাগি করতে ওমান, কুয়েত, কাতারের সাথে আলোচনা করে আসছে। ইরান এদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করছে। সৌদি আরবের সাথে টানটান সম্পর্ক ইরান-ইরাক যুদ্ধ থেকেই। যুদ্ধের সময় সৌদি আরব ইরাককে অর্থনৈতিক সাহায্য করেছে। তবে আরব রাষ্ট্রগুলো কখনো ইরানের পারমাণবিক চুল্লি নিয়ে উদ্বেগ দেখায় নাই। ইরান ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামকে খুবই শক্তভাবে সমর্থন করছে। ইসরাইলের সাথে কোনো শান্তি আলোচনা বা সুরাহা করতে ইরান সরাসরি নারাজ। দুটি প্রতিরোধ আন্দোলন, প্যালেস্টানিয়ান ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) ও হিজবুল্লাহকে সবরকম সহায়তা দিয়ে আসছে ইরান। কারণ ইরান মনে করছে এ সংগঠন দুটি ইসরাইলি আগ্রাসনকে রুখতে পারবে।
তুরস্কের সাথে স্বার্থের সম্পর্ক
ইরানের সাথে তুরস্কের কোনো সীমান্ত বিরোধ নাই। সে বিরোধ মিটে গেছে ষোলো শতকে। তুরস্কের সবচেয়ে বেশি তেল-গ্যাস সরবরাহকারী দেশ হল ইরান। তুরস্কের কোম্পানিগুলো ইরানের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশ দুটি নিজেদের মধ্যে ভিসামুক্ত যাতায়াত বহাল রেখেছে অনেক আগ থেকেই। দুই দেশের প্রায় হাফ বিলিয়ন লোক ভিসা ছাড়াই আসা-যাওয়া করে। বিপ্লব সংঘটনের পর একমাত্র তুরস্কের সাথেই ইরানের ভালো একটা যোগাযোগ আছে। কিন্তু এতকিছুর পরও কিছুটা জটিলতা থেকেই গেছে। তা হল, তুরস্কের ভিতরে কুর্দি বিদ্রোহকে ইরান সবসময় সমর্থন দিয়ে আসছে। এ সমর্থন থাকলেও ইরানের বাণিজ্যের ক্ষেত্রগুলো তুরস্কের ওপর পুরাপুরি নির্ভর করছে। মধ্য এশিয়া, আজারবাইজান থেকে গ্যাস আমদানিতে ইরানের ভিতর দিয়ে গ্যাস লাইন স্থাপন এবং তেলের জাহাজ যাতায়াতের জন্য ইরানের সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। তেহরান ঘোষণার ফলে সে ক্ষেত্রে ইরান এ ছাড়টুকু তুরস্ককে দিতে পারে। যদিও মার্কিন মিত্রদের পরিচালিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে ইরানের আলাদা কোনো অবস্থান নাই, তারা বরং এটাকে ব্যবহার করে লাভবান হবার নীতিই অবলম্বন করে আসছে। সেখানে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের দুনিয়াব্যাপী অন্যায় আগ্রাসনের বিরোধিতার চেয়ে নিজস্ব স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেয় ইরোপের মিত্র তুরস্কের মত। মাদক নিয়ন্ত্রণ, মধ্য এশিয়া এবং ইরাকে স্থিরতা আনতে দুই দেশ একই সাথে কাজ করছে। তবে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে শাহ এর আমলে, ৭৯ সালে বিপ্লবের আগে ইরানের সাথে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ছিল, ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগি।
সংকট দূর করতে ব্রাজিলের এগিয়ে আসা
ব্রাজিল-তুরস্কের সদিচ্ছার ফলেই তেহরান ঘোষণা সম্ভব হয়েছে। তারা পরস্পরের সহযোগিতায় একটা চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেছে। এতে প্রমাণ করল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ দেশ দুটোর রাজনৈতিক প্রভাব আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনৈতিক অঙ্গনকে নতুন করে বিন্যাসের দরকার আছে, এটা ব্রাজিল সরকার উপলব্ধি করতে পেরেছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে পৃথিবীতে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাতে ইনডিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের মতামতে গুরুত্ব দেয়া উচিত, এ উদ্যোগ তাই প্রমাণ করেছে। একটা গুরুতর সমস্যা কোনো সংঘর্ষে না গিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় সমাধান করা সম্ভব তাও প্রমাণিত হল। বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রাজিলের একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। ব্রাজিলের আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিশ্লেষক এন্তোনিও রামাল্লা সাক্ষাৎকারে তা-ই বললেন। তিনি বললেন, ইরানের ওপর যে শাস্তি আরোপিত হতে যাচ্ছিল, তা ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় কূটনৈতিক আলোচনায় না গিয়ে পেশীশক্তির প্রয়োগ। ব্রাজিল সরকার এটাকে সঠিক বলে মনে করেন নাই। এরকম অবরোধে কোনো সংকট সমাধান সম্ভব না। শান্তি প্রতিষ্ঠা তো নয়ই। তাই ব্রাজিল শান্তি আলোচনাকে এগিয়ে নিতে একটা সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী কমিটির একজন হওয়ার মত দক্ষতা ব্রাজিলের আছে। তাও আরেকবার প্রমাণিত হল। যদিও ব্রাজিলের উল্লেখ করার মত সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি নাই। কাজেই সে ইচ্ছা করলে ইরানের ওপর বলপ্রয়োগ করতে পারবে না। তারা ইরানকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে সঙ্গি করেছে
ব্রাজিল, তুরস্ক ও ইরানের তেহরান ঘোষণা
সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কিংবা যেকোনো ধরনের অবরোধ এড়াতেই তেহরানে যৌথ ঘোষণা হয়। ঘোষণায় তারা বলছে, এনপিটি’র বিধিনিষেধ মেনে যে কোনো রাষ্ট্র ইউরেনিয়াম মজুত করতে পারবে। এটা শুধু ইরানের ব্যাপারেই সত্য না, অন্য যেকোনো রাষ্ট্রেরই বৈধ অধিকার, যদি তা দিয়ে কোনো মারণাস্ত্র তৈরি করা না হয়। তারা এ চুক্তি করছে নিজেদের ভিতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহযোগিতা ও সুসম্পর্ক নির্মাণ করতে। ইরান চুক্তি অনুসারে তুরস্ককে কমক্ষমতা সম্পন্ন ১২ শত কেজি ইউরেনিয়াম দেবে। তুরস্ক একটা সময় পরে ইরানকে ১২০ কেজিউচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ইউরেনিয়াম ফেরত দেবে।
কিন্তু ইজরায়েল এবং তার রক্ষক যুক্তরাষ্ট্র এখন কি করবে? তাদের জন্য একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে দিয়েছে ব্রাজিল-তুরস্ক-ইরান মিলে। এবং তা প্রধান পাঁচ শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতিও উদিয়মান নতুন শক্তি জোটের একটা বার্তা। ক্ষতার ভারসাম্য এবং সমীকরণ আর আগের মত থাকছেনা। বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতায় এ দিকগুলোতে বাংলাদেশকেও নিজের স্বার্থ ও সংযোগ সম্পর্ক খুঁজে নিতে হবে। কারণ আমাদেরও জ্বালানী সমস্যা প্রকট। এবং তা নিরসনের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্থাপনা গড়ে তোলার প্রয়োজন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়ার সাথ একটি সমঝোতা স্মারকও সই করে এসেছেন এব্যাপারে।
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি
ইরান-তুরস্ক
চমৎকার তথ্যবহুল একটি লিখা। বিশেষ করে তুরস্কের সাথে ইরানের যে লাভ-হেইট রিলেশন আছে সেটা জানতাম না। ইরান নিজেকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে জাহির করতে চাইছে এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পেলে ইরানের আমেরিকার সাথে আতাত করার প্রবণতা রয়েছে। এমন অনেক নজীর বিপ্লব পরবর্তী ইরানের রয়েছে। তাই ইরানের মুখে আমেরিকা আর ইসরাইল বিরোধী শ্লোগানকে পপুলার পলিটিক্স হিসেবে আখ্যা দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী ঐক্য জোট ন্যাটোর বিরুদ্ধে তালেবানদের নিরলস যে সংগ্রাম তা সবসময়-ই ইরান খাটো করে দেখে আসছে। বিপ্লব পরবর্তী ইরানের পররাষ্ট্রনীতির বিচারে ব্যাপারটি বেখাপ্পা। আফগান ইনভেইশনের পর, আমেরিকার তাঁবেদার রক্তচোষা হামিদ কারজাইয়ের সাথে ইরানের কোলাকুলি করার দুরভিসন্ধি স্থায়ী ট্র্যাক রেকর্ড হয়ে থাকবে । এছাড়াও ২০০১ আফগান ইনভেইশনের সহযোগী বাহিনী "নর্দান এলায়েন্স" এর গ্যাং লিডার আহমেদ শাহ মাসুদকে( শাহ মৃত্যু পরবর্তীতে রাশেদ গুস্তামকে) সরাসরি সমর্থন দেয় ইরান। যা আমেরিকাকে পর্দার আড়ালে সমর্থন দেয়ার নামান্তর। তাই ন্যাটো কর্তৃক আফগানিস্তানে যে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তার দায়ভার ইরানকেও বহন করতে হবে। অপরদিকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীতে তুরস্কের সৈন্য রয়েছে প্রায় ১৭০০ এর মত। ই.ইউ এর মনোরঞ্জন করতে যে কোন ইন্দ্রিয়পরায়ন পন্থা অবলম্বন করতে রাজী আছে তুরস্ক। অন্যদিকে ইরানের সংবিধান পুরোপুরি সাইয়েদ ব্রাহ্মণ্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ধর্ম ও ক্ষমতার মসনদে একমাত্র সাইয়েদরাই উপযুক্ত এ কথা মনে করে ইরান। হিটলারের জাতিবাদী উন্নাসিক সাম্প্রদায়িক আর্যনীতির সাথে এর তুলনা করা যায়। তাই আমার মতে তাত্ত্বিক হুমকি হলেও, নতুন এই উদীয়মান শক্তি পাঁচ পরাশক্তির জন্য বাস্তবিক ক্ষেত্রে দুষ্টু-ছেলেকে-চকলেট-কিনে না-দেয়া বাবার আতঙ্ক মাত্র।