মুক্তিযোদ্ধা প্রভাকরণ যা প্রমাণ করে গেলেন


খোমেনী ইহ্‌সান
Monday 06 July 09

হানাদারির দৃষ্টান্ত দেশে দেশে মানুষকে কতখানি পোড়ায়? কী নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করে জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে গুড়িয়ে দেয় এবং মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে ইতিহাসে তার অনুসন্ধান করার গরজ বর্তমান পৃথিবীতে ফুরিয়ে গেছে! বর্তমানে চোখের সামনেই এসবের আকছার নজির তৈরি হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর উষালগ্নে সাম্রজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৈশাচিক হানাদারির বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই এ বিষয়ে মানুষের কান্ডজ্ঞান তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমরা চোখের সামনে দেখলাম ৯/১১-এর পর মুসলমান মাত্রই জঙ্গি এমন অপ্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে আফগানিস্তান ও ইরাক জাহান্নামে পরিণত হলো। লাশের স্তুপের উপর এ দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস লেখা হয়ে গেলো। অন্য সব মুসলিম দেশও পরিণত হলো যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি-ধমকির পাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের হানাদারির রোগ অন্য সব দেশে দ্রুত রফতানি হয়ে গেলো। ইউরোপের দেশগুলো, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইসরাইলসহ দেশে দেশে মুসলামানরা জঙ্গি হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে ইতর জীবনে বন্দি হয়ে গেলো। তারা মানবাধিকার  হারায়নি শুধু আলাদা বিশ্বাসের সমপ্রদায় হিসাবে স্বাধীন জীবন-যাপন থেকেও নির্বাসিত হয়ে গেলো।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হানাদারির অভিযান শুধু আফগানিস্তান ও ইরাকের মানুষের রক্তের উপর দিয়েই চলবে মনে করে অনেক রাষ্ট্রই নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দা করেছিলো। আর সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ বিরোধী কিছু নাগরিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া নির্মোহ অবস্থানও দেখা গিয়েছিলো। বাস্তবে প্রমাণ হতে শুরু করলো এ ভয়ানক মিথ্যে আশা। আখেরে ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন হানাদারির কৌশলগত মিত্ররাও ধরাশয়ী হয়ে যাচেছ। এর বড় প্রমাণ আফগানিস্তান দখলে মার্কিনীদের সামরিক-রাজনৈতিক মিত্র পাকিস্তান ও ইরান। ইরানকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে চরমমূল্য দিতে হচ্ছে। মাথার উপর আগ্রাসনের খড়গতো ঝুলছেই। পাকিস্তান! আরেক দেশের জঙ্গি দমনের দালাল রাষ্ট্র হতে গিয়ে এখন নিজ নাগরিকদের রক্তে হাত লাল করতে হচ্ছে। পাকিস্তান এমন এক ফাদে পড়েছে-যদি নিজ দেশের বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের মার্কিন আগ্রাসন বিরোধিতার কারণে দমন করা না হয় তাহলে প্রভু মার্কিনীরাই তাদের দমন করে দেবে। অথবা জঙ্গিরা খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রই নিজ দখলে নিয়ে যাবে। ঠিক পুলসিরাতের উপর দিয়ে হাটার ব্যাপার। সোজ পথে না চলে কোন দিকে হেঁলে পড়লেই বিপদ। এ এক ভয়ানক পরিস্থিতি।

মুসলমানদের ছাড়া অন্য ধর্মানুসারীরা ও কম্যুনিস্টরা মনে করেছিলো মার্কিন সমারাভিযান হয়তো তাদের উপর নাজিল হবে না। আসলে কি তা হয়েছে? হয় নি। বরং মার্কিনীদের সাথে হাত মিলিয়ে অনেক দেশের শাসকশ্রেণীই মার্কিন হানাদারি চরিত্র ধারণ করতে পেরেছে। এর বড় প্রমাণ শ্রীলঙ্কা ও ভারতের শাসকশ্রেণী।

সামপ্রতিক ঘটনাচক্রকে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জঘন্য ঘটনা হিসেবে শ্রীলঙ্কার তামিল জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন ভেস্তে যাওয়া ও এ আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধা ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণের শহীদ হওয়াকেই বিচার করতে হয়।

map

তামিল জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের আপাত দমন এবং প্রভারকরণের বিয়োগান্তক জীবনাবসান একবিংশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী হানাদারির এক নয়া দৃষ্টান্তে পরিণত হলো। এর অনুসরণে সামনের দিনে দেশে দেশে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে তা ভাবতেও ভয় লাগে। গত কয়েক মাস জুড়ে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী নির্মমতা ও বর্বরতার জালে আটকে ফেলে তামিল মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে পরাস্ত করলো তা নিশ্চয় অপরাপর দেশসমূহের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত স্বাধীনতাকামীদের পরিণতির পথ নির্দেশক। এখন বিভিন্ন দেশের সামনে এই পথই খুলে গেলো-স্বাধীনতার দাবিদার জাতিকে অস্ত্রের জোরে গুড়িয়ে দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়। কোন জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন ও এর বাস্তবায়নে কঠিন আত্মত্যাগেও ফায়দা নেই। বিশ্বসভায় এ নিয়ে কারও মাথা ব্যাথাও নেই। বরং পরাশক্তিসমূহ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে কোন জাতির স্বাধীনতা লাভের কিম্বা আগ্রাসী দখলদার প্রতিরোধের অধিকার নেই, তাহলে সে জাতির জন্য চরম পরিণতিই শেষ কথা। এ জন্য পরাশক্তিসমূজ আপনাকে বর্বর খুনী হতে অস্ত্র-গোলাবারুদ, গোয়েন্দা সহায়তা ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে সহায়তা করবে। যার বলে চোখের পলকেই আপনি একটি জাতির স্বপ্ন সাধ চুরমার করে দিতে পারেন।

আমাদের কারও ভুলে যাওয়া উচিত নয় ৯/১১-এ নিউইয়র্কে কথিত মুসলিম সন্ত্রাসী হামলার কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীতেই আধিপত্য তৈরির মওকা পেয়ে যায়। এ খুনী রাষ্ট্রটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে ভাগ করে এভাবে-তাদের পক্ষের মানুষ শান্তিকামী। তাদের প্রতিপক্ষ মানেই সন্ত্রাসী। এর জের ধরে আফগানিস্তান ও ইরাকের নরক দশা হওয়ার পাশাপাশি ধ্বংসের চোরাবালিতে আটকে যায় ফিলিস্তিনের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন হামাস, ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলির উলফা, কাশ্মিরের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন জইশে মোহাম্মদী, নেপালের মাওবাদীরা, শ্রীলঙ্কার তামিল যোদ্ধারাসহ সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জাতিগুলোর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলো। মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র এসব সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো মার্কিনীদের পক্ষে খোদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশও ভিড়ে যায়। তারা স্বাধীনতার লড়াই বাদ দিয়ে লিপ্ত হয় স্বাধীনতাকামী দমনের যুদ্ধে ও গোপণ তথ্য সরবরাহে।

মূলতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই কায়কারবারে লিপ্ত হয় তার ‘ওয়ার অন টেররের’ পক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দালালি নিশ্চিত করার জন্য। শুধু দালালি নিশ্চিতই হয় নি মার্কিনীদের পক্ষে প্রক্সি ওয়ারও চালু করে দিয়েছে এসব দালাল রাষ্ট্র। যেমন আমরা ফিলিস্তিনে দেখতে পাই অবৈধ ইসরাইল বেশ জোরে-শোরে হামাসকে কোনঠাসা করে গাজায় বন্দি করে রেখেছে। আর আদি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ফাতাহ পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের তল্পিবাহকে। ইসরাইল এমন অসাধারন উপকারের ঋণ শোধ করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু রাষ্ট্র ইরানকে হামলা করার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ভারত তো সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার কুতুবে পরিণত হয়েছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে দুর্দান্ত গোয়েন্দা যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় তামিল জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের বর্তমান পরিণতির ব্যাপার মূলতঃ এর মধ্যেই। কে না জানে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে সারা দুনিয়ার ভয়ঙ্করতম খুনী গোয়েন্দা সংস্থা ইসরাইলের মোসাদ। অস্ত্র সরবরাহ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর নাকের বদলে নরুন পাওয়ার লোভে চীনও হাত মিলিয়েছে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর সাথে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে তামিল জাতির মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন লিবারেশন তামিল টাইগার ইলম (এলটিটিই) চরম পরাস্ত হয় নি শুধু তাদের প্রাণ পুরুষ প্রভাকরনকেও তারা হারালো। এখানে এলটিটিই ছুট একজন মীর জাফরের সাক্ষাৎও দুনিয়াবাসী দেখতে পেয়েছে। তিনি কর্ণেল করুনা। একক তামিল নেতা হিসেবে তার ক্ষমতা অর্জনের পথ খুলে গেছে।

হানাদারির দৃষ্টান্ত নিয়ে উপরে আমরা যে আলোচনা করলাম এটি আমাদের অভিজ্ঞতার এক পীঠ। আরেক পীঠেও কথা আছে। দৃষ্টান্ত আছে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত লড়তে হয়। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে যেতে হয় না। প্রভাকরন ও এলটিটিই শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে তাই বলে গেছেন। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন, পৃথিবীর দেশে দেশে কীভাবে শান্তি ও স্বাধীনতার সাদা কবুতরগুলো রেঁধে মার্কিন যুদ্ধ জাহাজে পাঠায়। মানবাধিকার নামক ডাক-দোহাই  কীভাবে অকেজো হয়ে যায়। যে জাতি এক সময় মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয় সে জাতিও চুপ করে থাকে আরেক জাতির মুক্তিযুদ্ধকে নির্মমভাবে দমন করতে দেখেও। প্রভাকরন তার দীর্ঘ তিন যুগের লড়াইয়ে তামিল জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দিয়ে যেতে পারেন নি। তবে আমরা যারা দেশে দেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানে বিশ্বাস করি তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখেছেন-স্বাধীনতা বিরোধী হানাদাররা দারুণভাবে ঐক্যবদ্ধ। স্বাধীনতার পক্ষের মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ না হলে তাদেরও স্বতন্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েই যেতে হবে। তিনি একটি প্রশ্নও রেখে গেছেন-হানাদারা বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও জাতিতে বিভক্ত হয়ে যদি ঐক্যবদ্ধভাবে পৃথিবীর সব স্বাধীনতা আন্দোলনকে গুড়িয়ে দিতে পারে তাহলে স্বাধীনতাকামীরা কোন দুঃখে ঐক্যবদ্ধ হয় না?

সর্বশেষ কথা হলো প্রভাকরণ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্দান্ত নজির রেখে গেছেন ভারতের চরিত্রের প্রশ্নে। ভারত এক সময় কোন জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে  সহায়তা করলেও সব সময় মিত্র নয়। বরং সেই স্বাধীনতাকে গুড়িয়ে দিতে ভারতের দ্বিধা হয় না। আমরা জানি ভারত এক সময় এলটিটিই গঠনে সহায়তা করেছিলো। কিন্ত এলটিটিইর সাথে মতদ্বৈততা ও ভারতের অভ্যন্তরের তামিলরা যেন স্বাধীনতা লাভের স্বপ্ন না দেখে এমন কৌশল থেকেই ভারতের শাসক গোষ্ঠী বিরোধী পক্ষে অবস্থান নেয়। যা এলটিটিই’র এমন করুণ পরিণতির ভিত্তি তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের কারবারের বিচারও প্রভাকরণের নজির থেকে আমাদের করতেই হবে। আজ এটি প্রমাণিত সত্য ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। সীমানা মুছে দিতে চায়। একের পর এক বাঁধ বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্ব অসম্ভব করে তুলতে চায়। বাংলাদেশের মানুষকে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিতে চায়। এ অবস্থায় আমরা বাংলাদেশের নাগরিকরা কীভাবে ১৯৭১ সালের ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দায় মাথায় নিয়ে ভবিষ্যত ঠিক করবো এটিই দেখার বিষয়। তবে দেখার মধ্যে যেন এই বিবেচনা থাকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্মকান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ও মার্কিন সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রশাসক রাষ্ট্র হিসেবে।

 

লেখক: এক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। 


Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি

View: 5035 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD