চীন মায়ানমার সম্পর্ক: একটি অনুসন্ধান


মাহবুবুল আলম তারেক
Monday 09 November 09

ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে পরাশক্তির নৌআধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মায়ানমার বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে ব্যবহৃত হওয়ার ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে জ্বালানী ও কৌশলগত শক্তিভারসাম্য সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় কার কার কি অবস্থান ও স্বর্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পৃক্ত তা আমাদের আশু মনোযোগের দাবিদার। বাংলাদেশের জন্য মায়ানমার-চীন সম্পর্কের নানান দিকগুলো সেই প্রাসঙ্গিতকায় পাঠকরা জরুরি। সম্পর্কের মোড়বদল বা নতুন শর্তযুক্ত হলে কি ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তাও আগাম আন্দাজ করতে না পারলে আমাদের নিরাপত্তা ভাবনা এবং পররাষ্ট্রনীতির অভিমুখ নির্ণয় করা অসম্ভব। কারণ মায়ানমার ইস্যুতে এর আগের যে কোনো সময়ের চাইতে আমরা এখন অনেক বেশি নাজুক অবস্থার মধ্যে আছি। অনেকেই প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য আর ভারকেন্দ্রের জায়গাগুলো গুলিয়ে ফেলছেন। বাস্তব স্বার্থগত সম্পর্কের জড়াজড়ি আর মেরুকরণের গতিপ্রক্রিয়ায় নতুন যে উপাদানগুলো যুক্ত হতে পারে বা হচ্ছে তার দিকে নজর রাখছেন না। অতিসরলীকরণ আর গৎবাধা সূত্র দিয়ে সবকিছু বোঝাপড়ার চেষ্টা আমাদের রাজনীতিক বিশ্লেষণে ধরাবাধা একটা প্রকট প্রবণতা। সেখান থেকে বের হয়ে এসে তথ্য-উপাত্ত নির্ভর বিশ্লেষণের সাথে পরাশক্তির প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে উদ্ভূত বিষয় থেকে নিজেদের বিপদগুলো নির্মোহভাবে শনাক্ত কার দরকার। একই সাথে সম্ভাব্য মিত্র অনুসন্ধান ও নিরাপত্তা ভারসাম্যের অনুকুল পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের কাজও করতে হবে এই বাস্তব পরিস্থিতির ভিতরেই। আর কূটনীতির পাশাপাশি সবচাইতে জরুরি বিষয় জনগণকে সাথে নিয়ে, সমগ্র পরিস্থিতি জানিয়ে গণপ্রতিরক্ষার চর্চায় রক্ষাকবচ প্রস্তুত করা।

 

ভূমিকা

মায়ানমার ও চায়না পরস্পরকে “সহদোর” হিসাবে সম্বোধন করে যা থেকে তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অনুমান করা যায়। আর মায়ানমারের দিক থেকে ঐতিহাসিকভাবেই চীন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী কারণ চীনের সাথে তার ১৩৪৮ মাইলের এক বিশাল সীমান্ত রযেছে। চীন-মায়ানমার সম্পর্ক পারস্পরিক ভূখন্ডের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং আপোষমুলক অনাগ্রাসন নীতিসহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি মুলনীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। তারপরও মায়ানমার চীনের সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারে সবসময়ই সজাগ ছিল এবং চীন ও মায়ানমারের সম্পর্ক অনেক উত্থানপতনের মধ্যদিয়ে গিয়েছে। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই সম্পর্কের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র, ইওরোপীয়ান য়ুনিয়ন, জাপান ও অন্যান্য বহুমুখী দাতা প্রতিষ্টানসমূহ তাদের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেয় এবং এমনকি কয়েকটি পশ্চিমা দেশ অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করে। ফলে মায়ানমার তার টিকে থাকার জন্য চীনমুখী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এখন প্রশ্ন হলো এই আন্তর্জাতিক অসহযোগিতার পরও কি শুধমাত্র চীনের সহায়তায় মায়ানমার তার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে বা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? ১৯৮৮ সাল থেকে চীন ও মায়ানমারের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি, উভয়ের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং মায়নমারের সাথে চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষণ করলে হয়তো এর একটি স্বরূপ ধরা যেতে পারে ।

ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক পটভূমি

চীনের সাথে মায়ানমারের দুই লাইনের সম্পর্ক ছিল, দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্ক এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক। চীনা বিপ্লবের পর কমিউনিস্টদেরকে সহায়তার কারণে চীনের সাথে মায়ানমারের দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তবে ১৯৮৫ সালে চীন মায়ানমারের কমিউনিস্টদেরকে সহায়তা দেয়ার নীতি ত্যাগ করে এবং ১৯৮৮ সালে মায়ানমারের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার এক বছর পরেই এক আভ্যন্তরীণ কোন্দলে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টিও খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়। এই সুযোগে সামরিক সরকার সীমান্তবস্থিত কমিউনিস্ট গোষ্ঠীসমূহের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে সমর্থ্য হয়। রাস্তাঘাট নির্মাণ, পাওয়ার স্টেশন স্থাপন, স্কুল, হাসপাতাল স্থাপন, বাণিজ্যিক সুবিধাপ্রদান এবং সীমান্ত-বাণিজ্য প্রভৃতি উন্নয়ন কর্মকান্ডে সহযোগিতার বিনিময়ে কমিউনিস্টরাও তাদেরকে সহযোগিতা করার নীতি গ্রহণ করে। এবং এর পরপরই থান শুয়ে ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে চীন ভ্রমণ করেন এবং বর্তমান সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেন। এর পর থেকেই মূলত মায়ানমার পরাশক্তিসমূহের নিকট থেকে অস্ত্র আমদানি না করে নিরপেক্ষ থাকার নীতি ত্যাগ করে এবং চীনের অস্ত্র দিয়ে তার সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ করার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একই সাথে চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহায়তার আশ্বাসও আদায় করতে সক্ষম হয়। ফলে অল্পকিছুদিনের মধ্যেই জোটনিরপেক্ষ মায়ানমার চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। এমনকি বর্তমানে এই সামরিক সরকার তার টিকে থাকার জন্য সম্পূর্ণতই চীনের উপর নির্ভরশীল। যেকারণে অনেকে আবার বলে যে মায়ানমার চীনের একটি মক্কেল-রাষ্ট্রে (client-state) পরিণত হয়েছে।

বাণিজ্যিক সম্পর্ক

ক. গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভারসাম্যহীন বাণিজ্যিক অংশীদার

মায়ানমারের বহির্বাণিজ্যে চীন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দখল করে আছে। ১৯৮৮ সালে এর পরিমাণ ছিল মোট রপ্তানির ৩৩% যা প্রথম স্থান দখল করে, এবং মোট আমদানির ২৩% যা ২য় স্থান দখল করে, যদিও অবশ্য তখন মায়ানমারের পুরো বহির্বাণিজ্যের পরিমাণই ছিল খুব সীমিত। তবে এর পর থেকেই চীনের সাথে ময়ানমারের বাণিজ্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। ৯০র দশক থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সময়কালে চীনে রপ্তানি করার তুলনায় মায়ানমারের আমদানির পরিমাণই বৃদ্ধি পেতে থাকে দ্রুত গতিতে। ২০০৩ সালে যখন চীনে মায়ানমারের রপ্তানি ১৯৮৮ সালের ১৩৩.৭ মিলিয়ন ডলার থেকে মাত্র ১.৩ গুণ বেড়ে ১৬৯.৪ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়, তখন চীন থেকে আমদানি ১৯৮৮ সালের ১৩৬.২ মিলিয়ন ডলার থেকে ৭.১ গুণ বেড়ে ৯৬৭.২ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়, যার ফলে ২০০৩ সালে চীনের সাথে মায়ানমারের বাণিজ্য ঘাটতি গিয়ে দাড়ায় ৯৭.৭ মিলিয়ন ডলারে যা ঐ বছরে মায়নমারের মোট বাণিজ্য ঘাটতির চেয়ে ও চারগুণ বেশি।

খ. রপ্তানি: অর্থনীতিক উন্নয়নে খুবই দুর্বল ভূমিকা

চীনে মায়ানমারের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য ছিল কাঠ, রতœ পাথর, এবং ফলমুল ও বাদাম। তবে পরবর্তীতে তা কাঠের উপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ২০০০-২০০৩ এই সময়কালের মধ্যে কাঠ মোট রপ্তানি পণ্যের ৭০% দখল করে নেয় ।

কাঠের উপর এই নির্ভরশীলতা বরং চীনের সাথে মায়ানমারের রপ্তানি বাণিজ্য আরও স্থবির করে দেয়, কারণ কাঠ সরবরাহের প্রাকৃতিক উৎস খুবই সীমাবদ্ধ। যার ফলে এই কাঠ রপ্তানি মায়ানমারের বৃহয়দায়তন অর্র্থনীতিক ও শিল্প উন্নয়নে কোনো গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে ৯০র দশকে আবির্ভূত নতুন রপ্তানি পণ্য শীম ও ডাল, যা ভারতের বাজারে রপ্তানি হয়, এবং গার্মেন্ট যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইওরোপীয় য়ুনিয়নের মার্কেটে রপ্তানি হয় তা জাতীয় অর্থনীতিতে বেশি প্রভাবশালী হিসাবে আবির্ভূত হয়। এর ফলে মায়ানমার সরকারও কাঠ রপ্তানি প্রক্রিয়ার দেখভাল করার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে এবং কিছু বিশেষজ্ঞ সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন যে, যদি সরকার অবিলম্বে কাঠ রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে তাহলে মায়ানমার অদূরভবিষ্যতে তার একটি রপ্তানি দ্রব্য হারাবে।

গ. আমদানি : প্রধান সরবরাহ উৎস

১৯৮৮ সালে সীমান্ত বাণিজ্য শুরু হওয়ার পরপরই চীন দ্রুতই মায়ানমারে প্রধান পণ্য সরবরাহকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়। তখন থেকেই চীন থেকে মায়ানমারের আমদানি বাড়তে থাকে। এই আমদানি দুটি সময়কালে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ে, ১৯৯০’র দশকের প্রথমার্ধে এবং ২১শতকের শুরুর দিকে। এবং ৯০র দশকের শেষের দিকে চীন থেকে মায়ানমারের যে আমদানি ছিল তার মোট আমদানির এক পঞ্চমাংশ তা ২০০৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় মোট আমদানির এক তৃতীয়াংশে। চীন থেকে আমদানি সর্বপ্রথম দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় ১৯৮৮ সালে দ্বারখোলা নীতি গ্রহণের পর। ফলে ১৯৮০ এবং ১৯৮৫ এই দুই অর্থবছরে ভোগ্যপণ্য যেখানে মায়ানমারের মোট আমদানির যথাক্রমে ৬ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ ছিল সেখানে ১৯৯০ এবং ১৯৯৫ এই দুই অর্থবছরে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ শতংশ এবং ৪২ শতাংশে। বলা বাহুল্য, চীন ছিল এর প্রধান সরবরাহকারী। তবে নব্বইর দশকের দ্বিতীয়ভাগে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দেয়। কারণ বাণিজ্য-ঘাটতি অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় মায়ানমার সরকার ভোগ্যপণ্যের আমদানির উপর, বিশেষ করে বিলাস দ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় নয় এমনসব দ্রব্যের উপর, নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। পুনরায় ২১ শতকের শুরুর দিকে চীন থেকে আমদানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে, কারণ ইতিমধ্যে নব্বইর দশকের শেষভাগে মায়ানমারে গার্মেন্ট শিল্পের “বিস্ফোরণ” ঘটে। মায়ানমারের ঐ গার্মেন্ট শিল্পের জন্য টেক্সটাইল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহে প্রধান ভূমিকা পালন করে চীন। ফলে পুনরায় চীন প্রধান আমদানি উৎস হিসাবে আবির্ভূত হয়। এবং ২০০০-২০০৩ এই সময়কালে চীন থেকে আমদানি বাৎসরিক ২২.৭ শতাংশ হারে বেড়ে চলে।

ঘ. সীমান্ত বাণিজ্য : ময়ানমারের অর্থনীতির আয়ুরেখা

মায়নমার ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য প্রধানত তাদের সীমান্ত বাণিজ্যের উপরই নির্ভরশীল। যদিও দুই দেশের সীমান্ত বাণিজ্য চীনের মোট বহির্বাণিজ্যের তুলনায় খুবই কম (১ শতাংশেরও কম) তবুও এটি মায়ানমারের সাথে চীনের বাণিজ্যের বেশিরভাগই দখল করে আছে। ২০০৫ সালে মায়নমারে চীনের রপ্তানির ৫৮ শতাংশ এবং মায়ানমার থেকে চীনের আমদানির ৮২ শতাংশই ঘটে সীমান্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে। এবং ২১ শতকের শুরুতে দুই দেশের এই সীমান্ত বণিজ্য আরও নিয়মতান্ত্রিক ও প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার ফলে এবং রাস্তাঘাটের উন্নয়নের ফলে ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। ফলে সীমান্ত দিয়ে মায়ানমারে চীনের রপ্তানি ২০০১ অর্থ-বছরেরর ২৬১.২ মিলিয়ন ডলার থেকে ২.১ গুণ বেড়ে ২০০৫ অর্থবছরে ৫৪০.৬ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়, একই সময়ে সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার থেকে চীনের আমদানি ২০০১ অর্থ-বছরের ৯৩.৭ মিলিয়ন ডলার থেকে ২.৪ গুণ বেড়ে ২০০৫ অর্থবছরে তা ২২৩.৫ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও মায়ানমার সরকার তাদের উপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করার জন্য শুধু চীনের সাথেই নয় বরং থাইল্যান্ড, ভারত ও বাংলাদেশের সাথেও সীমান্ত বাণিজ্য চালু করে তথাপি চীনের সাথে বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়। এবং চীনের সাথে সীমান্ত বাণিজ্যই মায়ানমারের অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

অর্থনীতিক এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা

চীন এবং চীনের বিনিয়োগ উদ্যোগসমূহ অর্থনীতিক সহায়তার মধ্য দিয়ে মুলত মায়ানমারের শিল্প, অবকাঠামো ও জ্বালানী খাতের উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত। তবে চীন তার অর্থনীতিক সহযোগিতা কার্যক্রম পুরোপুরি উম্মুক্ত করে দেয় নি এবং মায়ানমার কর্তৃপক্ষও আবার অন্যদেশ থেকে অর্থনীতিক সহযোগিতা গ্রহণ করার জন্য নিজেদেরকে উম্মুক্ত করে রাখে নি । ফলে প্রকৃত খবর জানার জন্য আমরা শুধু মিডিয়ার কিছু বিক্ষিপ্ত সংবাদের মধ্যে হাতড়ে বেড়াতে পারি। এবং প্রায়শই চীনের অর্থনেতিক সহায়তা কার্যক্রম শুধু বিনিময় ভিত্তিক বাণিজ্যের চেয়ে বেশি কিছু নয়। এমনকি যদিও চীন বিনা সুদে বা খুবই অল্প সুদে লোন সরবরাহ দিয়ে থাকে, কিন্তু তারা আবার সেটা রপ্তানি পণ্যসমূহের মুল্যের সাথে যোগ করে দিয়ে উসুল করে নেয়। এবং বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত ছাড়া বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে প্রকৃত অর্থনীতিক সহায়তা কার্যক্রমকে আলাদাভাবে নির্দেশ করা সম্ভব নয়। বিক্ষিপ্ত তথ্য উপাত্ত সমূহ থেকে যেটা বুঝা যায় তা হলো চীন ১৯৯৭ সালের দিকে মায়ানমারের প্রতি তার অর্থনীতিক সহায়তা কার্যক্রম ব্যাপকহারে স¤প্রসারিত করে যখন যুক্তরাষ্ট্র নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মায়ানমারের উপর আরও কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

চীন মায়ানমারের তিনটি ক্ষেত্রে তার অর্থনীতিক সহায়তা এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিয়োজিত করে, অবকাঠামো উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনীতিক উদ্যোগকে সহায়তা প্রদান এবং জ্বালানী খাত।

ক. অবকাঠামোগত সহায়তা

অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে মায়নমারকে দেয়া চীনের অর্থনীতিক সহায়তাগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯০ সাল থেকেই মায়ানমার ব্যপক বিদ্যুৎ ঘাটতিতে ভুগছিল, এবং সরকার হাইড্রো-পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য ব্যাপকহারে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। চীন ১৯৯৬-২০০৫ সময়কালের মধ্যে ৬টি হাইড্রো পাওয়ার প্লান্ট এবং ১টি থার্মাল পাওয়ার ষ্টেশন স্থাপন করে দেয়, যা মায়ানমারের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ মেটাতে সক্ষম। এবং ২০০৬ সালের মার্চ মাসে আরও যে ১১টি হাইড্রো পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় তার মধ্যে ৭টিই দেয়া হয় চীনকে।

চীন মায়ানমারের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আর যে সহায়তা প্রদান করে তার মধ্যে “আইয়াওদ্দা সড়ক প্রকল্প’’(Ayeyawaddy Transportation Project) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের য়ুনান থেকে মায়ানমারের ইয়াংগুনের থিলওয়া বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়ন সাধনই এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এর অধীনে ভামো পর্যন্ত নদীপথের ড্রেজিং করা, ভামোতে একটি কন্টেইনার পোর্ট নির্মাণ করা এবং সেখান থেকে চীনের সীমান্ত বন্দর মুজে বা লিউজেল পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর মূল উদ্যেশ্য হচ্ছে মায়ানমারের মধ্যদিয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা, যার ফলে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইওরোপের সাথে তার বাণিজ্যের পরিবহন খরচ ও সময় অনেক বেচে যাবে, এবং মালাক্কা প্রণালীর সংঘাত এড়িয়ে চলা যাবে। তাছাড়া বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও সহজেই প্রবেশ করা যাবে। বাংলাদেশে সমুদ্র সীমা নিয়ে বর্তমান সমস্যার জন্য চীনের কৌশলগত অবস্থান ও গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে যা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রে যে কোনো সংঘাত সৃষ্টি হলে তাকে কেন্দ্র করে ভারত-মার্কিন নৌশক্তি সমাবেশের পাল্টা চীন কি ধরণের তড়িৎ প্রদক্ষেপ নিতে পারে এটাও আমরা এই কৌশলগত সামরিক ভারসাম্য থেকে অনুমান করতে পারি।

খ. রাষ্ট্রীয় মালিকানায় অর্থনৈতিক উদ্যোগসমূহ

২১শতকের শুরু থেকেই মায়ানমার সরকার ব্যাপকহারে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কলকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৮৫-৯০ সালের মধ্যে এধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় ১৯টি যা ১৯৯৫ সালের মধ্যে ৯২টিতে দাঁড়ায় এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরে ২০-৩০টি করে স্থাপিত হতে থাকে। এরপর ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ৫৩টি এবং ২০০২ সালে স্থাপিত হয় ২৩১টি সরকারি শিল্প-কারখানা। এসব কলকারখানা স্থাপন করা হয় মূলত আভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ এবং কৃষি ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করার উদ্যেশ্যে। কিন্তু চীনের সহায়তা ছাড়া মায়ানমার এসব কখনোই স্থাপন করতে পারত না। তবে মায়নমারের যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি এসব পরিচালনা করার দায়িত্বে আছে তার অযোগ্যতা, ব্যাবস্থাপানায় দুর্বলতা এবং দুর্নীতির বদনামের এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। ফলে অর্থনীতিক এবং ব্যবস্থাপনাগত স্বায়ত্বশাসনের অভাবে হয়তো দ্রুত বেড়ে চলা সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহ মায়ানমারের জন্য শেষমেষ একটি বোঝা হিসাবেই দেখা দিতে পারে।

গ. জ্বালানী খাত উন্নয়ন

অক্টোবর ২০০৪ থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে চীনের ঈঘঙঙঈ মায়নমারের জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সাথে ৬টি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এছাড়াও আরও ৪টি চীনা কোম্পানি মায়ানমারের তেল ও গ্যস ক্ষেত্রে ব্যাপকহারে বিনিয়োগ করে। এসব কোম্পানি ইতিমধ্যেই ১৬৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ফেলেছে। তাছাড়া ২০০৪ বা ২০০৫ সালে চীন তার বিদেশে বিনিয়োগের ২৬টি প্রকল্পের মধ্যে ১৬টিই করে মায়ানমারে যা তার মোট বহির্বিনিয়োগের ৭০ শতাংশ। এই বিনিয়োগের সবটাই করা হয় জ্বালানি ও খনিজ খাতে। মায়ানমারে চীনের আরেকটি বড় প্রকল্প হচ্ছে, একটি পাইপ লাইন নির্মাণ পরিকল্পনা যেটি নির্মিত হবে রেহিন প্রদেশর উপকূলে শুয়ে ফিল্ডের অ-১ ব্লক থেকে চীনের য়ুনান প্রদেশ পর্যন্ত। এই ফিল্ডে কয়েকটি গ্যাস ব্লক রয়েছে এবং অ-১ ব্লকটিতেই শুধু ২.৮৮-৩.৫৬ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস মজুদ আছে। পেট্রো-চায়না মায়নমারের সাথে উক্ত ফিল্ড থেকে ১৩ বছরের জন্য গ্যাস উত্তোলনের একটি চুক্তি করেছে যা শুরু হবার কথা ২০০৯ সাল থেকে।

মায়ানমার ইতিমধ্যেই পাইপ লাইনের মাধ্যমে থাইল্যান্ডে গ্যাস রপ্তানি শুরু করে দিয়েছে এবং ২০০৫ সালে এই রপ্তানি থেকে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার যা ছিল ঐ বছরের সর্বোচ্চ বৈদেশিক আয়। এবং অচিরেই মায়ানমার গ্যাস রপ্তানি করে চীন থেকেও বৈদেশিক উপার্জনের একটি বড় উৎস পাবে। তেল ও গ্যস রপ্তানি মায়ানমারকে এর প্রতিবেশি দেশসমূহের উপর কূটনীতিকভাবে একটি সুবিধাজনক অবস্থানের সুযোগ করে দেয়। এমনকি ভারতও মায়ানমারের অ-১ ব্লক থেকে গ্যাস পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা মায়ানমারের সাথে আরও সহজ শর্তে গ্যাস ক্রয়ের ব্যাপারে চুক্তিও করে ফেলেছে। বিনিময়ে ভারত মায়ানমারকে একটি বাৎসরিক উপার্জনের নিশ্চয়তা প্রদান করে এমনকি যদি সে গ্যাস নাও পায়।

উপসংহার

যদিও ১৯৮৮ সাল থেকেই চীনের সাথে মায়ানমারের কূটনীতিক, রাজনীতিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় তথাপি তাদের অর্থনীতিক সম্পর্ক ১৯৯০’র দশক থেকে বর্তমান সময়কালের মধ্যেই সুদৃঢ় হয়। চীন বর্তমানে মায়ানমারের ভোগ্যদ্রব্য, কাঁচামাল ও মেশিনারি যন্ত্রপাতির প্রধান সরবরাহকারী এবং চীনও মায়ানমারের জন্য একটি বড় রপ্তানি বাজার। মায়ানমার চীনে তার কাঠ, কৃষিপণ্য, খনিজ দ্রব্যাদি, এবং সম্প্রতি তেল গ্যাসসহ প্রভৃতি পণ্য রপ্তানি করে থাকে। ফলে একদিক থেকে চীন থেকে আমদানি ছাড়া মায়ানমারের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা মেটানো যেমন অসম্ভব তেমনি অন্যদিকে চীনে রপ্তানি না করতে পারলে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রারও ঘাটতি দেখা দেবে। অধিকন্তু চীন মায়ানমারের অবকাঠামো, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনীতিক উদ্যোগ এবং তেল ও গ্যাস উত্তোলন ক্ষেত্রে একটা বিশাল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা ও বাণিজিক ভিত্তিতে বিনিয়োগ সরবরাহ করে থকে। এমনকি চীনের সহায়তা ছাড়া মায়ানমার সরকার তার ব্যপক হারে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা, যেমন টেক্সটাইল মিল ও চিনির কলসমূহ স্থাপন বাস্তবায়ন করতে পারত না। যদিও চীনের বৈদেশিক বিনিয়োগ খুব বেশি নয় তবুও সা¤প্রতিককালে তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রে এর বিনিয়োগ চোখে পড়ার মতো এবং চীনা উদ্যোগসমূহ অচিরেই মায়ানমারের দ্রুত বেড়ে চলা এই সেক্টরের প্রধান নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হবে। ফলে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে মায়নমারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চীনের সাথে এর অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। যাই হোক, তারপরও চীনের সাথে এই ভারসাম্যহীন বাণিজ্য মায়নমারের বৃহদায়তন অর্থনেতিক উদ্যোগ ও শিল্পউন্নোয়নের ক্ষেত্রে মোলিক কোন অবদান রাখতে ব্যার্থ হয়। চীনে মায়ানমারের রপ্তানি পণ্যের ৭০ ভাগই হচ্ছে কাঠ। কাঠ ও অন্যান্য প্রধান রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে যে অন্যান্য পণ্যদ্রব্য যেমন শিম, ডাল ও গার্মেন্টস প্রভৃতি রপ্তানি করতে পারলে দেশের ভূমি ও শ্রমসম্পদের ও সদ্ব্যবহার করা যায়, কিন্তু কাঠ রপ্তানি শুধুমাত্র সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের নিঃশেষকরণ।

সন্দেহ নেই চীনের অর্থনীতিক সহায়তা ও বাণিজ্যিক লোনের সরবরাহ বর্তমান ক্ষমতাসীনদেরকে স্পষ্টতই টিকে থাকতে সহায়তা দিচ্ছে, তথাপি মায়ানমারের সমগ্র অর্থনীতির বিবেচনায় এটা একটা সমস্যারও সৃষ্টি করছে। সে জায়গা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে মায়ানমার সেটা দেখার বিষয়। কিংবা আদৌ তারা সে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন হতে পারে। মোটের উপর চীনের সাথে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক মায়ানমারের বর্তমান ক্ষমতাসীনদেরকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞর মধ্যে টিকে থাকার হাতিয়ারই হিসাবেই যতটা সুযোগ করে দিয়েছে তার তুলনায় কিন্তু মায়ানমারের বৃহদায়তন অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রাখতে পারবে না কিনা সেটা বিচার্য। এই দিকগুলোর সাথে সাথে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান রাজণৈতিক গুরুত্ব এবং সামরিক ও কৌশলগত অবস্থানের চাপে যে শক্তিভারসাম্যেও সমীকরণ তৈরি হচ্ছে তাতে মায়ানমার বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে।

 

View: 8387 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD