ট্রানজিট: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বনাম ইনডিয়ার অর্থনীতিক-মুলা
পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের কাছেই অপরাপর রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ও পারস্পরিক লেনদেন মৌলকভাবেই একটি রাজনৈতিক ব্যাপার, তা যেকোনো বিষয়কে ঘিরেই আবর্তিত হোক না কেন। পররাষ্ট্রনীতি কথাটার মানে তাই। যখন কোনো দুটি দেশ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় পররাষ্ট্র বিভাগের আলোচনার মাধ্যমে সামাধান করতে এগিয়ে আসে বা আসার অনিবার্যতা সৃষ্টি হয় তখন সেখানে যে বাণিজ্য বা অপরাপর বিষয় ইতোমধ্যে রাজনৈতিক শর্তের অধীন হয়ে পড়েছে তা স্পষ্ট। তাছাড়াও রাষ্ট্র সত্তার রাজনৈতিক স্বার্থ ও বিবেচনার স্বতসিদ্ধ ভিত্তিই হোল তার আওতাভুক্ত আরসকল বিষয়কে নিজের অধীন করে নেয়া। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ কোনো প্রয়োজন, সুবিধা বা বিবেচনাই রাজনৈতিক সত্তার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে না। এই বৈশিষ্ট্যসূচক দিকের কারণেই ‘বণিজ্য’ বা ‘অর্থনীতিক’ ইস্যু পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিকোন থেকে নিষ্পত্তির প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই শর্ত মেনে নিয়ে দুটি দেশ আলোচনায় বসে, নিরসনের চেষ্টা চালায়। সেটা বাজারের স্বভাবিক প্রক্রিয়ায় নিজস্ব ভারসাম্য আনয়ন কিংবা নিছক অর্থনীতির গণ্ডির মধ্যে আর কোনোভাবেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তৎক্ষণাত তা হয়ে যায় রাষ্ট্রের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার মতো গুরুতর বিবেচনার বিষয়। যেখানে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা, ঐক্য ও অভিষ্ট অর্জনের সাথে সঙ্গতিপরায়ণ সদূরপ্রসারী কৌশল এবং পরিকল্পনা গ্রহণই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে বিবেচ্য। অভিন্ন জাতীয় অবস্থানের সূচনাই কেবল সাফল্য লাভে প্রয়োজনীয় সেই শক্তি সঞ্চার করতে পারে। বাংলাদেশে কার্যত যা অনুপস্থিত। এই সমূহ বিপদের মধ্যে একটি জাতীয় অবস্থান তৈরির প্রচেষ্টায় ইনডিয়ার প্রস্তাবিত ট্রানজিট নিয়ে ধারাবাহিক বিশ্লেষণের দ্বিতীয় পর্ব এখানে তুলে ধরা হলো। আগামী পর্বে থাকবে এশিয়ান হাইওয়ে নিয়ে আলোচনা। --সম্পাদকীয়
নিজের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সামরিক উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকান্ড সহজতর করতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে ইনডিয়া দীর্ঘদিন ধরে বিরামহীন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে- সব কয়টি সরকার একইভাবে তৎপর ছিল। বাংলাদেশ এযাবত সুবিধাটি দেয় নি ইনডিয়াকে, কিন্তু কেন? এর বিপরীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের অবস্থান দৃশ্যত ভিন্ন ভিন্ন ছিল। আবার কোনো সরকার এই সুবিধা দিতে আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন, উদ্যোগও নিয়েছিলেন, তবে সন্দেহ নাই কোনো ইতিবাচক উদ্যোগই চুড়ান্ত হয় নি এ পর্যন্ত। বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থান দিয়েই শুরু করা যাক।
বর্তমান সরকারের অবস্থান হচ্ছে- ট্রানজিট একটি ‘অর্থনৈতিক ইস্যু’। তারা বলছেন, এটা নিয়ে যারা রাজনৈতিক বিতর্ক করতে চায় তারা আসলে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন চায় না, বরং ভোটের সুবিধা আদায়ের জন্য সস্তা রাজনীতির অংশ হিসাবে তারা ট্রানজিট প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়। যখন বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ট্রানজিটকে অর্থনৈতিক ইস্যু বলছেন, পাশাপাশি অন্যপক্ষ ইনডিয়া তখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভের খতিয়ান দাঁড় করাচ্ছেন। ইনডিয়ার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রানজিট সুবিধা দিলে বাংলাদেশ বিরাট অংকের টাকা পাবে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢুকে প্রতিদিন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় এক হাজার ট্রাক যাবে। প্রতিটি ট্রাক যদি ট্রানজিট ফি হিসাবে এক হাজার টাকা দেয় তাহলে বছরে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভারত অর্থ বিনিয়োগ করবে। ট্রানজিট সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান হবে, বাংলাদেশি নাগরিকরা নিয়োগ পাবে। তাছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যের সাথে সরাসরি বৈধ বাণিজ্য চালু হবে এবং বাংলাদেশও এর থেকে সুবিধা নিতে পারবে।
ঢাকায় নিযুক্ত সদ্যবিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, আমরা ট্রানজিটের ব্যাপারে আগ্রহী। ইনডিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা চালু হলে দুই দেশই আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এতে জাতীয় নিরাপত্তা কোনোক্রমে হুমকির মুখে পড়বে না; বরং এর মাধ্যমে উভয় দেশেরই উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইনডিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সুবিধাগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির উন্নয়নে তা সময়োপযোগী ভূমিকা রাখবে। তিনি জানিয়েছিলেন ইনডিয়া মনে করে ট্রানজিট একটি নিখাদ অর্থনৈতিক ইস্যু, কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে কেন এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হয়েছে তার কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। ঠিক এ অবস্থান নিয়েই বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ট্রানজিটের পক্ষে নিজের দেশে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন। দেশটিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বাড়তি এটুকু যোগ করছেন যে, ট্রানজিট সুবিধা আদায়ে ইনডিয়া তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে- যে সম্ভাবনার কথা বলা ইনডিয়ার পক্ষে সঙ্গত কারণেই অসম্ভব।
আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম যখন দেশটিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো তখন অবশ্য জনমত কোনো বিবেচ্য বিষয় ছিলো না। প্রথমত, রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সশস্ত্রযুদ্ধে ইনডিয়ার বিশাল ভূমিকা ছিলো দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিলো ইনডিয়াস্থ বাংলাদেশ সরকারের হাতে- যেখানে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করেছিলো- কাজেই বাংলাদেশের জনমত তখনই কোনো আঞ্চলিক সম্পর্কের ধরনের কারণে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাবে এমন আশংকা ছিলো না। তৃতীয়ত, যেহেতু আনুষ্ঠানিক শাসন কায়েমের সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির বদল ঘটেছিলো কাজেই ওই টালমাটাল এবং অল্প সময়ে ইনডিয়ার পক্ষেও ট্রানজিট সুবিধার মতো একটি দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামোগত সুবিধা আদায় করে নেয়া সম্ভব ছিলো না। পরে আওয়ামী লীগ কর্তৃক বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি এবং তারও পরে দীর্ঘমেয়াদে সামরিক শাসনে ট্রানজিটের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পাল্টে যায়। নব্বই এর পরে বিএনপি’র নেতৃত্বে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে পরে ট্রানজিট আলোচনা কূটনৈতিক পর্যায়ে নতুনভাবে উঠে আসে। সরকারের বাইরেও নানা নীতিনির্ধারণী ফোরাম ও জনপরিসরে নানা মাত্রায় আলোচনা চলে। সরকার দৃশ্যত ‘যে কোনো ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতা’য় আগ্রহের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি ট্রানজিট আলোচনার টেবিলে বাংলাদেশ অন্যান্য অমীমাংসিত ইস্যু তুলে আনে।
অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর মধ্যে আছে অভিন্ন নদী সমস্যা, সীমান্ত বিরোধ, নেপালের সাথে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা। বরাবরই ট্রানজিট সংক্রান্ত আলোচনায় অন্যান্য ইস্যু তুলে আনার বিরোধী ইনডিয়া। দেশটি ট্রানজিট টেবিলে বড়জোর বাণিজ্য ঘাটতি প্রসঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী হয়েছে। বাংলাদেশকে জানাচ্ছে- বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ট্রানজিট ভালো উপায় হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ক্রমাগত বাড়ন্ত বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি তৈয়ার হওয়ার কারণ পণ্য চলাচলে ইনডিয়ার বাজারবহির্ভূত নানান প্রতিবন্ধকতা আরোপ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গৃহীত নীতির অংশ হিসাবে বাংলাদেশের বাজার স¤প্রসারণে ইচ্ছাকৃত বাধা সৃষ্টি ও অর্থনীতিক স্বক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি পদ্ধতিগতভাবে বৈরী অবস্থান বজায় রেখেছে। সেই নীতির পরিবর্তন করে প্রাথমিক সদিচ্ছার পরিবেশ তৈরি না করে উল্টো ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশকেই উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানী বাড়িয়ে এবং পণ্যের উপর ধার্যকৃত অশুল্ক বাধা তুলে দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে ইনডিয়ার ইতিবাচক অবস্থান দরকার, বাংলাদেশের নয়। বাজারের স্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় প্রাপ্য সুবিধাটুকুই আগে বিনা শর্তে উন্মুক্ত করা দরকার। কিন্তু ইডিয়া একেই এখন রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার বানিয়েছে। আর আমাদেরকে নসিহত করছে বিষয়গুলোকে স্রেফ অর্থনীতিকভাবে দেখতে।
অন্যদিকে ট্রানজিট টেবিলে বসে বাংলাদেশ ‘নিরাপত্তা’ ইস্যু তোলে ইনডিয়াকে কূটনৈতিক ‘না’ বলার জন্য। অন্য একটি রাষ্ট্রের যান চলাচলের জন্য এত দীর্ঘ একটি পথ উন্মুক্ত করে রাখা পরিপার্শিক বাস্তবতা বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি যৌক্তিভাবেই ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে- সন্দেহ নাই। যেমন ঝুঁকি নিতে ইনডিয়াও প্রস্তুত নয়। কখনো কখনো বাংলাদেশ নেপাল-ভূটানে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার প্রস্তাব করেছে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ইনডিয়া বরাবরই তা নাকচ করেছে। ইনডিয়াকে ষাটের দশকের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে বাংলাদেশ- পাকিস্তান তার পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে যোগাযোগের স্বার্থে ট্রানজিট চেয়েছিল। সেটাকে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়ারলাল নেহেরু ‘একটি অদ্ভুত দেশের অদ্ভুত আব্দার’ বলে মস্করা করেছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের নিরাপত্তার প্রতি এমন ট্রানজিট হবে মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশ বলতে পারে যে, নেপাল আর বাংলাদেশের মাঝখানের ১৭ কিলোমিটার করিডোর ছাড়া ইনডিয়া একটা অদ্ভুত দেশই বটে। তাছাড়া ট্রানজিট সামরিক উদ্দেশ্যে যখন ব্যবহৃত হবে তখন উত্তর পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র স্বাধীনতাকামি গোষ্ঠীগুলো শত্র“র তালিকায় ইনডিয়ার সাথে বাংলাদেশকেও অর্ন্তভূক্ত করবে। যার আলামত সাম্প্রতিক ঘটনায় উলফার বিবৃতিতে পাওয়া গেছে। কাজেই বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কথা বলে তখন ইনডিয়া ‘না’ শুনতে পায়। যদি সুবিধাটি দেয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ একমত হয়ে নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলতো তবে তা ভিন্নতরভাবে তোলা হতো। তখন আলোচনা হতো কিভাবে যথাসম্ভব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। অবশ্য একটি রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তা ‘যথাসম্ভব’ পর্যায়ে রেখে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে কি না সেটা অনেক বড় প্রশ্ন। সেই ফয়সালা হলে তার পর প্রশ্ন আসে, ঠিক কোন যৌক্তিকতায় ও স্বার্থের অনুকূলে সেই ঝুঁকি নিতে একটি দেশ প্রস্তুত থাকবে। পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি ও মর্যাদার সম্পর্কই যেখানে অনুপস্থিত সেখানে এতবড় নিরাপত্তা ঝুঁকি নিতে কেন বাংলাদেশ প্রস্তুত হবে?
এরকম আরো বেশ কিছু প্রসঙ্গ বাংলাদেশের তরফ থেকে তোলা হয়েছে যেগুলো ট্রানজিটকে সম্ভব করে তোলার আলোচনা নয়, বরং উল্টোটা। যেমন বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর দুর্বলতা। বলা হয়, ইনডিয়াকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের রেলপথ ও পরিবহনে ব্যবস্থা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যাপক চাপের মুখে পড়বে। দেশের সড়ক যোগাযোগ এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। যানবাহনের বর্তমান চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সবাইকেই। এ অবস্থ’ায় ইনডিয়ার ভারি যানবাহন চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, রাস্তা মেরামত ও প্রশস্ত করতে বিশাল অংকের অর্থের পাশাপাশি ফসলি জমিতেও হাত পড়বে। ব্রিজ তৈরিতে নদীর গতিপথ পাল্টাবে, গভীরতা কমবে। এছাড়া চোরাচালান বৃদ্ধি, মাদকদ্রব্য ও এইডস বিস্তারের ঝুঁকির কথা বলা হয়। দীর্ঘ ট্রানজিট পথের ক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি স্বাভাবিক। এবং দ্বিপাক্ষিক সমন্বয়ে ঝুঁকি নূন্যতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব। একইভাবে; যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর দুর্বলতার ক্ষেত্রে ট্রানজিট বাড়তি চাপ হবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু এই দুর্বলতা তো বাংলাদেশের নিজের প্রয়োজনেই দূর করা দরকার। এবং যে বাড়তি চাপ ট্রানজিটের কারণে আসবে, সেক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও স¤প্রসারণে প্রধানত ইনডিয়ার উদ্যোগ নেয়ার কথা। কিন্তু এটা এমন কোনো সমস্যা নয় যার কারণে ট্রানজিট চুড়ান্তভাবে বাধাগ্রস’ হতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-০৬ দুই মেয়াদে বিএনপি সরকার এসব প্রতিবন্ধকতার কথাই অব্যাহতভাবে ট্রানজিট টেবিলে উঠিয়েছে। এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে; এক. এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে দেশটি আগ্রহী অংশীদার হিসাবে ইনডিয়াকে আলোচনার টেবিলে পায় নি দুই. এটা হচ্ছে না বলার কূটনৈতিক ভাষা। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার যখন এসব বিষয়ে কথা না বলেই তুলনামূলক অনেক বেশি ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে তখন বহু পুরনো ওইসব ইস্যুতে ইনডিয়ার অবস্থান জানান দিচ্ছে যে, প্রথম কারণটিই বেশি যথার্থ ছিল।
ইনডিয়া এ বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশকে একটি চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ট্রানজিটের স্বার্থে যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে উন্নয়ন সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচের কোনো অংশই দেশটি যোগান দেবে না। তাছাড়া ট্রানজিট ফি-এর বিষয়ে সেখানে কিছু বলা হয় নি। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ যানের মতোই দেশটির যানবাহন শুধু টোল দেবে- চুক্তি অনুযায়ী। অর্থাৎ বাংলাদেশ যদি ট্রানজিট প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ করতে বসে তাতে করে লাভের ঘরে থাকবে শূন্য। ‘শূন্য’ লাভের বিনিময়ে আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, ও অবকাঠামোগত ঝুঁকি সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মতো রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবে বাংলাদেশ- যদি ইনডিয়ার ‘অর্থনৈতিক’ প্রস্তাব দেশটি গ্রহণ করে। দেশের বর্তমান সরকার যদি দরকষাকষি করে চুক্তিতে নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছে সত্যিকার অর্থেই এটি একটি সফল ‘অর্থনৈতিক’ ইস্যু হতে পারে, যেমনটি ইনডিয়া জোর দিয়ে বলে আসছে। সত্য হলো ঠিক বিপরীত, যেমনটি আমরা আগের পর্বে দেখিয়েছি- ট্রানজিট ইনডিয়ার জন্যও একটি নিরেট রাজনৈতিক ইস্যু। তাহলে একই ইস্যু বাংলাদেশের জন্য অ-রাজনৈতিক হয় কিভাবে?
ওখানে অবকাঠামো নির্মাণ, অর্থনৈতিক লেনদেন বৃদ্ধি, বাজার স¤প্রসারণ করে কার্যকর উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু করার তাগিদ ইনডিয়া অনুভব করে কেন? ইনডিয়ান ইউনিয়ন কি একটা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ করপোরেশন, যে সাতকন্যা রাজ্যে তার প্রকল্প জোরদার করতে চায়। এবং বাংলাদেশকে আরেকটা অর্থনৈতিক করপোরেশন বা পরিবহন মালিক সমিতি বিবেচনা করে তার কাছ থেকে পরিবহন সুবিধা চাইছে। যদি তা-ই হবে, সেক্ষেত্রে ইনডিয়ার দক্ষ করপোরেট বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যেত যদি তারা বাংলাদেশের সাথে চুক্তিতে এসে অংশীদারিত্বের ব্যবসা করতো। সাতকন্যা সংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করার প্রস্তাব দিতে পারতো দেশটি। যাতে করে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ওই অঞ্চলকে সরবরাহ এলাকা করে সাত-কন্যাকে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থায় অর্ন্তভূক্ত করা যায় কার্যকরভাবে, এবং অবশ্যই ট্রানজিট ব্যবস্থার চেয়েও কম খরচে। চট্টগ্রাম বন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের ওপর থাকায়, শুধু সুবিধা ব্যবহারকারী ভোক্তা হিসাবে সাতকন্যার অর্থনৈতিক প্রকল্প ইনডিয়াকে অনেক বেশি লাভ এনে দিতে পারতো। কিন্তু এমন প্রস্তাব দেয়া ইনডিয়ার পক্ষে সম্ভব না। একটি কারণ বাংলাদেশ-সাতকন্যা সীমান্তের অর্থনৈতিক জোনের মাধ্যমে সমরসম্ভার সরবরাহ সম্ভব না। তার চেয়ে বড়ো কারণ হলো- ইনডিয়া একটা রাষ্ট্র বটে। এবং রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে রাষ্ট্র সবসময়ই রাজনৈতিক ইস্যুতে কাজ করে। সাতকন্যায় উন্নয়নে নির্ধারক উপস্থিতি এবং নিয়ন্ত্রক হিসাবে রাষ্ট্রের হাজিরা অর্থাৎ রাজনৈতিক উপস্থিতি জরুরি।
আগের পর্বে আমরা দেখিয়েছি যে, ট্রানজিট সুবিধা ইনডিয়ার দরকার মূলত, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে চলমান সামরিক তৎপরতা সহজতর করা এবং পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া কাক্সিক্ষত মাত্রায় শুরু করার জন্য। ‘অনুন্নত’ ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে প্রায় বঞ্চিত হওয়ার কারণে ইনডিয়ান ইউনিয়নের এ অঞ্চলের অ-সামরিক নাগরিকরাও অসন্তুষ্ট এবং ক্ষুদ্ধ। এই অসন্তোষ ও ক্ষোভ এর ভিত্তি কি ‘অর্থনৈতিক’? যা দীর্ঘমেয়াদে ইনডিয়ার জন্য আবার সামরিক দুর্যোগ তৈয়ার করতে পারে? যদিও সামরিক দিক থেকে উত্তরপূর্বাঞ্চলে এখন ‘দুর্যোগ’ পরিস্থিতি আগের মতো নেই, আছে ‘দুর্ভাবনা’। ইনডিয়ার এই দুর্ভাবনা কি অর্থনৈতিক? এসব প্রশ্নের জবাব রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ও ইনডিয়া দুপেক্ষরই জানা আছে- রাজনৈতিক। সুতরাং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশে নিশ্চয় তার হিসাবে রাখবে যে, অন্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দুর্ভাবনা দূর করতে কেবল তখনই অংশীদার হওয়া যায় যখন তা শেষ পর্যন্ত নিজের রাজনৈতিক দুর্ভাবনা বাড়ায় না। ফলে বাংলাদেশের মতো স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ট্রানজিট সুবিধা পেতে হলে ইনডিয়াকে অবশ্যই ইসুটিকে ‘রাজনৈতিক’ ইস্যু হিসাবে আলোচনার টেবিলে ওঠাতে হবে। বছরের পর বছর ধরে যেসব বিষয় ট্রানজিট-টেবিলে উঠতে দেয়া হয় নি- অভিন্ন নদী সমস্যা, সীমান্ত বিরোধ, নেপালের সাথে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা, নিজের স্বার্থ আদায়ে বাংলাদেশের চাপে রাখার মতো যেসব বিষয় ইনডিয়ার হাতে আছে- এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা করতে হবে, অর্থাৎ ট্রানজিটের স্বার্থ আদায়ে ওসব বিষয়ে বাংলাদেশকে চাপমুক্ত করতে হবে। তাহলে পরে খুব সম্ভবত বাংলাদেশ সীমিত পরিসরে নিরাপত্তা ঝুঁকির বহনের কথা বিবেচনায় নিতে পারে, যদি নিরাপত্তা ইস্যুতে ইনডিয়া সহযোগিতামূলক ভূমিকা নেয়।
অবশ্য সুবিধা আদায়ে অন্য পথও নিতে পারে ইনডিয়া। বাংলাদেশ যদি তার রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ করতে ব্যর্থ হয়; যদি দেশটি ‘অর্থনৈতিক ইস্যু’তে ইতিবাচক অবস্থান নিয়ে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তকে ঝুঁকিগ্রস্থ করে, নিজের ভূখন্ড ভাড়া দেয়; অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ ইনকরপোরেটেড’ হতে আগ্রহী হয়, তবে ইনডিয়া বর্তমান অবস্থান থেকে সরে না এসেও ট্রানজিট সুবিধা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে ট্রানজিটের হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশ যাতে রাষ্ট্রের জায়গা থেকে রাজনৈতিকভাবে করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে ইনডিয়াকে। উদিয়মা অর্থনীতিক শক্তি ও আঞ্চলিক মুরব্বি হওয়ার খায়েশে বিভোর ইনডিয়া সেটা অবশ্যই করতে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু, বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব পাওয়া প্রধানমন্ত্রী কি করবেন? তাঁর দিল্লী সফর কি আমাদের দুর্দশা বাড়াবে না কমাবে?
নেছার আমিন, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট
nasar1000@gmail.com
Available tags : হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র, ভারত, ভাষা, সংস্কৃতি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি