- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
আদালত অবমাননা কারে কয়, মানে এমন অবমাননার সংজ্ঞা কি? কি করলে বা না করলে আদালত অবমাননা হয়, মানে এমন অবমাননার আওতা ও পরিধি কতোদূর? এমন প্রশ্নের জবাব জানার সুযোগ বাংলাদেশের নাগরিকদের নাই। কারণ, আদালত অবমাননা বিষয়ে বাংলাদেশে কোন আইন নাই।
ফলে, রাষ্ট্রের অংশিদার যারা--সেই নাগরিকরা অসহায়। রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ বিচার বিভাগ। মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার সমূহ রক্ষা ও বলবৎ করতে নির্বাহী বিভাগকে বাধ্য করা ছাড়াও নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ মিটানোর দায়িত্ব আদালতের। যার কাছে গচ্ছিত রয়েছে এই দায়িত্ব খোদ তাদের সামনে এখন অসহায় নাগরিকরা। বাংলাদেশের কোন নাগরিক দাবি করতে পারছেন না আদালতকে এই ক্ষেত্রে কতোটুকু এখতিয়ার বিধিবদ্ধ আইন হিসাবে দেওয়া রয়েছে। নাগরিকদের স্বাধীনতার সোমা কঠায় শেষ এবং আদালতের এক্তিয়ার কতোটুকু। কোন আইন নাই তাই জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অধীনস্থ রেখে আদালতের কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাইতে পারছে না কেউই। একদিকে অবমাননা বিষয়টির সুর্নিদিষ্ট কোনো আইন গরহাজির, অন্যদিকে ‘আদালত অবমাননা’র খোলা তলওয়ার ঝুলছে মাথার ওপর। প্রয়োগ হচ্ছে ইচ্ছামাফিক।
আইন কানুন বিষয়ে যারা বিস্তর তত্ত্ব-তালাশ রাখেন, তারা হয়তো এতক্ষণে এ বিষয়ে একটা আইনের নাম বিড়বিড় করতে শুরু করেছেন। কনটেম্পট অব কোর্টস অ্যাক্ট, নাইনটিন টুয়ান্টি সিক্স--যার বাংলা ‘উনিশশো ছাব্বিশ সালের আদালত অবমাননা আইন’-- হয় বটে। কিন্তু এটা এমন কোনো আইন না, যেটা দেখে আমরা বলতে পারি-- এই আইনটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন আদালত অবমাননার সংজ্ঞা কি, অবমাননার আওতা ও পরিধি কতোদূর-- ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে এই আইন অবমাননার বিষয়টিকে বিধিবদ্ধ আইন ও শাস্তি নির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যে তৈরিই করা হয় নাই। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিলো পুরাপুরি আলাদা।
এই প্রসঙ্গ অল্পতেই সারবো; বৃটিশ উপনিবেশ হওয়ার পরে পুরা ভারতের বিচার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বৃটিশ ব্যবস্থার মতো করে যতটা সম্ভব দাঁড় করায় শাসকরা। ওই ব্যবস্থার মধ্যে ভারতে সর্বোচ্চ আদালত--হাই কোর্ট অব জুডিকেচার বসানো হয়। তো, বৃটিশ আইন ব্যবস্থা--কমন ল’ সিস্টেম এর মধ্যে একটা ধারণা কায়েম আছে। সেটা হলো--সর্বোচ্চ আদালতের কিছু জন্মসূত্রে প্রাপ্ত (ইনহেরেন্ট) ক্ষমতা আছে। যেমন সর্বোচ্চ আদালত হলো কোর্ট অব রেকর্ড অর্থাৎ নজির-মান্য আদালত। বিচারিক নজির। অর্থাৎ এই আদালতের রায়, আদেশ ও ঘোষণা এবং আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিশাবে যেসব দলিল বিচারপ্রার্থীরা পেশ করেছে সবই চিরকালের জন্য সংরক্ষিত থাকবে নজির হিশাবে।
আর দুটো বিষয় হলো; এখতিয়ার ও অবমাননা বিষয়ে। এদুটো বিষয় নির্ধারণে সর্বোচ্চ আদালতের একক ক্ষমতা আছে। অবশ্য রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশন বা গঠনতন্ত্রে যদি কোনো ভিন্ন রকম বক্তব্য না থাকে। এক. এই আদালত তার নিজের এখতিয়ার নিজে ঠিক করার ক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ কোন কোন বিষয়ে বিচার করার এখতিয়ার এই আদালতের থাকবে তা আদালত নিজেই নির্ধারণ করতে পারে। দুই. আদালত অবমাননা বিষয়ে এই আদালত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মানে আদালত অবমাননার সংজ্ঞা-আওতা-পরিধি-শাস্তি সবকিছু নির্ধারণের কাজটা পুরাটাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত নিজে করার এখতিয়ার রাখেন, চলতি রেওয়াজে। আর এই আদালত অবমাননা নিয়াই আমরা কথা বলছি।
- আদালত অবমাননা বিষয়ে কোনো আইন নাই
- জবাদিহিতা ছাড়া আদালতের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা
- নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত
তো, বৃটিশ আইন ব্যবস্থা--কমন ল’ সিস্টেম এর একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য হল; ওর মধ্যে ‘লিখিত-পড়িত’ আইন-কানুন ঐতিহাসিকভাবেই বেশি গুরুত্ব পায় নাই। যদিও ওই দেশের জনপ্রতিনিধিরা যেগুলা জরুরি মনে করেছে, ওসব বিষয়ে লিখিত-পড়িত মানে বিধিবদ্ধ আইনও তৈরি করেছে। কখনো সখনো। নাগরিকদের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ হিশাবে ওইসব আইন মানতে ও মানাতে আদালতও বাধ্য। জুরিসপ্রুডেন্স বা আইনের দর্শন এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থার বিকাশের কাজের বেশিরভাগই বিচারক-আইনজীবী ও আইনজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে, অন্যান্য বিষয়ের আইনের মতো আদালত অবমাননার আইনও ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে; প্রথাগতভাবে। দেশটার এক একটা প্রজন্মের বিচারকরা পরিবর্তিত রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে আইনি প্রথাগুলাকে এগিয়ে নিয়েছেন। যোগবিয়োগ- সংস্কার- উন্নয়ন- করেছেন। এরকমই একটা খাপ খাওয়ানোর সমস্যা দেখা দিল ‘আদালত অবমাননা’ বিষয়ে। বিশেষত দখলকৃত ভারতে।
বৃটেনের সর্বোচ্চ আদালতের মতো ভারতের হাই কোর্ট অব জুডিকেচারেরও সর্বময় ক্ষমতা ছিলো অবমাননা বিষয়ে। কিন্তু এক পর্যায়ে সন্দেহ দেখা দিল নিম্ন আদালতগুলা নিয়া। যদি কেউ হাই কোর্টের অধীনে থাকা নিম্ন আদালতগুলার অবমাননা করে তবে কী হবে? নিম্ন আদালত তো আর ‘কোর্ট অব রেকর্ড’ না, তাদের তো আর জন্মসূত্রে এমন কোনো ক্ষমতা নাই। ফলে তারা তো নিজের এখতিয়ার নিজে ঠিক করতে পারে না কিম্বা সে তো আর অবমাননা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কাজেই ওই সন্দেহ দূর করতে কনটেম্পট অব কোর্টস অ্যাক্টটা তৈরি করা হলো। আইনের প্রস্তাবনাতেই বলা ছিলো ‘টু রিজলভ দিজ ডাউটস’, উনিশশো ছাব্বিশ সালের আটই মার্চ আইনটা গ্রহণ করে সরকার--ওই বছরের বারো নম্বর আইন। (পরে উনিশশো একাশি সালে প্রায় একই আইন গ্রহণ করে খোদ ইংল্যান্ডও)। এই আইনে বলা হল; অবমাননা বিষয়ে বিচার করার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের যেই জন্মসূত্রে পাওয়া সর্বময় ক্ষমতা আছে, কেউ যদি কোনো নিম্ন আদালতের অবমাননা করে তবে সেই সর্বময় ক্ষমতা ব্যবহার করে সর্বোচ্চ আদালত ওই অবমাননার বিচার করতে পারবেন।
আইনটিতে মাত্র তিনটি ধারা আছে। নিম্ন আদালত অবমাননার শাস্তির জন্য হাইকোর্ট বিভাগকে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে বলা আছে, নিম্ন আদালত অবমাননার বেলায় সেটা দণ্ডবিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে হবে। শাস্তি হচ্ছে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় সাজাও আদালত দিতে পারবে। আদালতের কাছে মাফ চাইলে অভিযুক্তকে অব্যাহতি বা সাজা কমিয়ে দিতে পারে আদালত। তবে আদালত এর বাইরে সাজা দিতে পারে না। ব্যাস। সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তার নিজের ক্ষমতাবলে নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিতে পারে, অধ:স্তন কোন আদালতকে অবমাননা করার অপরাধে।
আদালত অবমাননা বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের এই জন্মসূত্রে পাওয়া অবারিত ক্ষমতা, অন্তর্গত ক্ষমতা, ইনহেরেন্ট পাওয়ারকেই আমরা এখানে প্রশ্ন করছি। এ এক অসংজ্ঞায়িত, অনির্ধারিত ও সীমাহীন ক্ষমতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোন অঙ্গের এমন কোনো ক্ষমতা বা এখতিয়ার থাকতে পারে না, যা সুনির্দিষ্ট না এবং যার বিপরীতে নাগরিকদের কোন সুরক্ষা নাই। যে ক্ষমতার বিপরীতে রাষ্ট্রের ওই অংশকে নাগরিকদের তরফে প্রয়োজনীয় সমালোচনা ও জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে না। যেমন ক্ষমতা ও এখতিয়ার বর্তমানে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আছে, আদালত অবমাননা বিষয়ে।
কেউ ইংল্যান্ডের নজির পেশ করতে পারেন। ওই দেশে এখনো বাংলাদেশের আইনটার মতো একটা আইন ছাড়া অন্য কোন আইন নাই। তাতে করে ওখানকার নাগরিকদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের সমস্যা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে কথা হল; ওই রাষ্ট্রের পুরা ব্যবস্থাই দাঁড়িয়ে আছে কয়েক শতাব্দি ধরে ধারাবাহিকভাবে চর্চিত প্রথার ওপর, যেসব প্রথা ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ অর্জন করেছে। অলিখিত অথচ নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক। পাশাপাশি দরকার মতো বিধিবদ্ধ আইন-কানুনও তাদের আছে। যেমন একটা আস্ত ‘সংবিধান’ না থাকলেও বেশ কিছু রাজনৈতিক ঘোষণা ও আইন আছে যেগুলোর সাথে প্রাতিষ্ঠানিক রীতিপ্রথা মিলে তাদের রাষ্ট্র নাগরিকদের স্বাধীনতা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে নিশ্চিত করছে। ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগের বেলায়ও তাই।
বিশেষত অবমাননা প্রশ্নে দেশটি উনিশশো একাশি সালের কনটেম্পট অব কোর্টস অ্যাক্টের বাইরেও অনেক দলিল গ্রহণ করেছে। যেগুলোতে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার চর্চা করার জায়গা থেকে নাগরিকরা আদালতকে কোন কোন বিষয়ে সমালোচনা করতে পারেন, জবাবদিহিতা চাইতে পারেন। আদালতের কোনো কাজের সমালোচনা করে মামলায় ফাঁসতে হয়েছে কিম্বা রায়ের সমালোচনা করে তিরস্কৃত হতে হয়েছে এমন নজির ওখানে নাই। কিম্বা বিচারকের ব্যক্তিগত দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার কারণে অবমাননার অভিযোগে কেনো সাংবাদিককে কাঠগড়ায় হাজির হতে হয় নাই ওখানে।
মানে হলো, ‘আদালত অবমাননা’ স্রেফে আইনের বিষয় না। বরং নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন, রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের গণতান্ত্রিক চরিত্র ও প্রকৃতি বজায় রাখার কর্তব্য এখানে আরো বড় হয়ে হাজির হয়। রাষ্ট্রের একটা প্রতিষ্ঠান হিশাবে সর্বোচ্চ আদালত সহ পুরা বিচার ব্যবস্থা কিভাবে চলবে তা নির্ধারণ করার সুযোগ নাগরিকদের থাকার কথা, যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। সেটা শুধু আদালত অবমাননা আইনের প্রশ্ন হয়েই থাকতে হবে, এমনটা জরুরি না। প্রথমত, নাগরিকের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করে আইন হতে পারে। আদালতের কাজ ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার স্বাধীনতার অংশ হিশাবে নাগরিক কেমন মত প্রকাশ করলে বা কী কাজ করলে তা আদালত অবমাননা হবে কিম্বা হবে না, সেটা স্পষ্ট করে আইন তৈরি করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, আদালত অবমাননার ওপর সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আইন করেও একই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
দ্বিতীয়ত, যেমনটা বলছি, এমন একটা উদ্যোগ অর্থাৎ অবমাননা বিষয়ে আইন তৈরির উদ্যোগ চালু আছে গত ছ’বছর ধরে। দুই হাজার এক-দুই হাজার ছয় মেয়াদে একটা আইন সংসদে পেশ করেছিল বিএনপি সরকার। ওই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশ আকারে আইনটি জারি করে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগ ওই অধ্যাদেশটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দিয়ে বাতিল করে দেন। যদিও ওই রায়টার ভিত্তি হিশাবে যেসব যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ, তা ছিল দুর্বল এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধী।
অধ্যাদেশটির বিরুদ্ধে দুইজন আইনজীবীর করা মামলাটি শেষ পর্যন্ত অন্য একটা মামলার সাথে মিলিয়ে নেন বিচারক এবিএম খায়রুল হক ও আবু তারিকের আদালত। একজন বিচারকের ব্যক্তিগত কর ফাঁকি ও পরে সেই অবৈধ অর্থ বৈধ করা বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে এই একই বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে অবমাননার মামলা দায়ের করেন। সুয়ো মটো--মানে নিজেদের মামলা নিজেদের আদালতে নিজেরাই দায়ের করা। নাগরিক স্বাধীনতা তো বটেই বরং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর দিক হল; দুইটা মামলা একসাথে মিলিয়ে ওই রায়ে এমনকি এটাও ধার্য করা হয়েছে যে, কোনো বিচারকের ‘ব্যক্তিগত আচরণের সমালোচনা’ করে যদি কেনো সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে তবে তা-ও অবমাননা বলে গণ্য হবে।
আদালত হিশাবে বিচারকের কর্তৃপক্ষীয় ভূমিকা পালনে বাধা তৈরি করলে কিম্বা ওই কর্তৃপক্ষীয় মর্যাদার হানি করলে তখন তা অবমাননা হতে পারে। কিন্তু ‘বিচারকের ব্যক্তিগত আচরণ’ এর সমালোচনা বা ওই বিষয়ক কোনো খবর প্রকাশকে দুনিয়ার কোনো আইনি-দর্শনের মধ্যে অবমাননা হিশাবে গণ্য করার সুযোগ নাই। এটা ঘোরতর অগতান্ত্রিকতার উদাহরণ। কিন্তু বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগ সেটাই বলেছেন। রায়ের সমালোচনা করলেও আদালত অবমাননা হবে--ওই রায়ে বলেছিলেন বিচারক এবিএম খায়রুল হক ও আবু তারিকের বেঞ্চ।
একটা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশের ধারাবাহিকতা সুদৃঢ় করা, প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করতে যেখানে প্রতিটি নাগরিকদের অংশগ্রহণকে অনুপ্রাণিত করা দরকার। যেখানে সমাজের সম্মিলিত মননশীলতা প্রয়োগের আয়োজনকে ধারণ ও উন্মুক্ত করা দরকার। গতি সঞ্চার করা দরকার আইন-আদালত বিষয়ে বিতর্কে, আলোচনা, পর্যালোচনায়। অথচ চলছে উল্টো রথ। নাগরিকদের নিজেদের চেষ্টাকে রুদ্ধ, সংকুচিত ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে বিকাশ। আইন-আদালতের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়া নাগরিকদের যেন বারণ; রায় নিয়ে বিচার বিশ্লেষণে বসা যেন অন্যায়--অধিকার বহির্ভূত। কেন এই ভয়, কেন এই গলা চেপে ধরা?
যে আদালত স্বচ্ছ ও সুষ্ঠ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত হচ্ছে কিনা তা আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য নাগরিকদের নজরদারির বাইরে নিজেদের রাখতে চায়, আদালতের কোন রকমের আলোচনা-পর্যালোচনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সেই আদালত কি করে সত্যিকারের আদালত হবে? যে আদালত নিজেকে নাগরিকের সার্বভৌম ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের উর্ধ্বে রাখতে চায় সেই আদালত কিভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অঙ্গ হবে? অন্যায় আচরণ, দুর্বলতা, নৈতিক স্খলন, দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটলে খবর প্রকাশে অযৌক্তিক বাধা আরোপ করা কোন পদ বা পেশার উপর ঐশ্বরিকতা আরোপের নামান্তর। গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি এ সংস্কৃতি গড়ে উঠতে দেওয়া যায়না।
অতএব আদালত অবমাননা বিষয়ে এখনই সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা জরুরি। অবারিত ও অপরিসীম ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়ে। যে কারো বেলায় তা ঘটতে পারে। এ বিষয়ে আর কি সন্দেহ থাকতে পারে!
আরো পড়ুন
২. আদালত অবমাননা অধ্যাদেশ বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়
Available tags : আদালত অবমাননা, সংবিধান, নাগরিক অধিকার