- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
ইতিহাস, সামাজিক বিতর্ক ও আদালতের এখতিয়ার
একটি রিট আবেদনের মামলায় মাননীয় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি মোঃ মমতাজ উদ্দিন আহমদ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ গত ২১ জুন শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিশাবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি রায় ঘোষণা করেন। সেই রায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র পুনর্মুদ্রণের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ২০০২ সালে গঠিত প্রত্যয়ন কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকার চাইলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে বলে অভিমতও দেওয়া হয়েছে। প্রফেসর এমাজউদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র পুনর্মুদ্রণের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ২০০২ সালে গঠিত প্রত্যয়ন কমিটির তিনি একজন সদস্য। তিনি তাঁর আত্মপক্ষ ব্যাখ্যা করে একটি বিবৃতি দেন (দেখুন ‘বিচারপতিদের কাজ কি বিচারপতিসুলভ হয়েছে?’ নয়া দিগন্ত ২৩ জুন ২০০৯)। রিট আবেদনকারী এম এ সালাম এই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রফেসর এমাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন। ফলে একই বেঞ্চ প্রফেসর এমাজউদ্দীনকে হাইকোর্টে তলব করেছেন। তাঁর অপরাধ তিনি স্বাধীনতার ঘোষকসংক্রান্ত রায়ের ‘সমালোচনা’ করেছেন। আগামি ২ জুলাই তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে আদালতে হাজির হয়ে বলতে হবে কেন তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী এম এ সালাম আদালতের কাছে নালিশ করেছেন, যাঁরা রায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে আদালতকে কটাক্ষ করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, ‘বিড়ালের গলায় প্রথম রাত্রেই ঘণ্টা বাঁধতে হবে’ (দেখুন আমার দেশ ২৪ জুন ২০০৯)। সেই ঘণ্টা আদালতই বাঁধবে, ইঙ্গিতটা ওদিকেই। এখন বিড়ালরূপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেচারা সাবেক উপাচার্যকে আদালতে হাজির হতে হবে। তাঁর গলায় আদালত ‘ঘণ্টা বাঁধবে’ সেটা উপভোগ করবার জন্য আমরা সাধারণ নাগরিকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ২ জুলাই আমরা যেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করব সেটা হচ্ছে (১) রায়ে প্রত্যয়ন কমিটি সম্পর্কে আদালত যে বক্তব্য দিয়েছেন সেই প্রসঙ্গে প্রফেসর এমাজউদ্দীনের আত্মপক্ষ সমর্থন আদৌ আদালত অবমাননার মধ্যে পড়ে কি না; (২) আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের ব্যাখ্যা উচ্চ আদালত কিভাবে দিচ্ছেন এবং (৩) আসলে ‘আদালত অবমাননা’ ব্যাপারটাই বা কী? বিদ্যমান আদালত অবমাননা আইন কি সংবিধানসম্মত বা গণতান্ত্রিক? চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি আমাদের সাংবিধানিক অধিকার হয়ে থাকে, তাহলে আদালতের ‘রায়’ সমালোচনার অধিকার তো জাতীয় সংসদ আইন করে বা আদালত কোন হুকুমনামা জারি করে হরণ করে নিতে পারেন না। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করবার এখতিয়ার রাষ্ট্রের কোন অঙ্গেরই নাই? তাহলে ২ জুলাই তারিখে আমরা এটাও মনোযোগের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করব যে, ‘আদালত’ কি আদৌ সংবিধানের ঊর্ধ্বে হাজির কোনো সংস্থা, নাকি সংবিধানের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান? রাষ্ট্রের সংবিধান ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক পর্যালোচনার এই জায়গাগুলো অত্যন্ত জরুরি। এটা আমরা, নাগরিকরা, আদালতের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।
প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ প্রত্যয়ন কমিটির সদস্য হিশাবে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, আমরা সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে এই রায় সম্পর্কে সমাজের প্রতিক্রিয়া খানিকটা বোঝার চেষ্টা করব। ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলি স্টার তাদের ২৩ জুন তারিখের সম্পাদকীয়তে বলছে, মেজর জিয়াউর রহমান নন, শেখ মুজিবুর রহমানই ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, এটা ঐতিহাসিক রায় (The Historic HC Ruling)। তবে এটা যে এক ধরনের ‘প্রহসন’ (Irony), সেটাও সম্পাদক মানতে বাধ্য হয়েছেন। ডেইলি স্টারের আক্ষেপ হচ্ছে, আমরাই দুনিয়ায় সেই জাতি যারা ঐতিহাসিক ঘটনাঘটনের চিহ্নগুলো (Landmark) আদালতের রায়ের মাধ্যমে মীমাংসা করি। অথচ একবারও প্রশ্ন তোলেনি এভাবে ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক বিতর্ককে রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘রায়’ দিয়ে মীমাংসা করার এখতিয়ার আদালতের আছে কি না। শেখ মুজিবুর রহমান আদৌ ঘোষণা দিয়েছেন কি দেননি সেই তর্ক এই প্রশ্ন থেকে আলাদা। যদি আসলে ঐতিহাসিক সত্য নিয়েই তর্ক তুলতে হয়, তাহলে মওলানা ভাসানীকে বাদ দিয়ে আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কথা বলি কিভাবে? শেখ মুজিবের আগে অর্থাৎ মার্চেরও আগে মওলানা ভাসানীও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া বহু ছোটখাটো দল এবং বামপন্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলো শেখ মুজিবের ঘোষণার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। আদালত কি সেটাও এখন মীমাংসা করবেন? আসলে তর্কটাই বাজে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাদের নিজ নিজ দলের একচেটিয়া কায়েম করবার দলীয় নোংরা তর্ক। ইতিহাসকে ঐতিহাসিকদের দ্বারা মীমাংসার জন্য ছেড়ে না দিয়ে এই দলীয় তর্কের বোঝা আদালতের মাথায় নেয়া ঠিক হয়েছে কি না সেটাই নাগরিকদের প্রধান বিবেচ্য। এই রায়কে কেন্দ্র করে দলবাজিই আমরা দেখলাম।
ঐতিহাসিক ‘রায়’ কেন? কারণ ডেইলি স্টার বলছে, এটা নাকি নিজ গুণেই সত্য (self evident truth)। অর্থাৎ এর কোনো প্রমাণের দরকার পড়ে না। এমনকি জিয়াউর রহমানও ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু দিয়েছেন শেখ মুজিবের বরাত দিয়ে। এই ‘রায়’ অতএব ডেইলি স্টারের ভাষায় একটি অসাধারণ মুহূর্ত (momentous event)।
এর বিপরীতে একই দিন (২৩ জুন) নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরোনাম হচ্ছে, ÔCourt order hardly helps end social row over political history’(রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে সামাজিক তর্কবিতর্ক মীমাংসার ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ কোন কাজে আসে না)। আমরা একমত। বরং প্রশ্ন তুলেছি ইতিহাস নিয়ে সামাজিক তর্কবিতর্ক মীমাংসা করা আদৌ আদালতের কাজ কি না। কিম্বা এই ক্ষেত্রে ‘রিট পিটিশন’ আইনী দিক থেকে আদৌ করা সঙ্গত কি না। রিট মানে কী? তার সীমা-চৌহদ্দি কতটুকু। যাঁরা করেছেন তাঁদের locus standi কী? তারা কোন অর্থে ‘সংক্ষুব্ধ’? আদালত যদি এর সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে রাজনৈতিক দলের স্বার্থে আদালত ব্যবহৃত হয়েছে এই অভিযোগ উঠবে। আদালতের জন্য সেটা হবে মারাত্মক। এখন ২০০৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন কি দিলেন না তার মীমাংসা দ্বারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আবার নতুন করে শুরু হবে না। তবে বিএনপি’র বিরুদ্ধে বেশ এক কাঠি বিজয় হয়েছে বলে বাহবা পাওয়া যেতে পারে। কিম্বা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে খাটো করবার আনন্দে বিভোর থাকা যায়, কিন্তু ইতিহাস এটাও বলে, একজন তরুণ মেজর হিশাবে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান করেননি। অর্থাৎ চাইলেও কারো ঐতিহাসিক ভূমিকাকে আমরা খাটো করতে পারি না। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেও দেশ স্বাধীন হয়েছে, আর না দিলেও দেশ স্বাধীন হয়েছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের জয়-পরাজয় শেখ মুজিবুর রহমান নির্ধারণ করেননি। নির্ধারণ করেছিলেন বাংলাদেশের লড়াকু জনগণ ও জিয়াউর রহমানের মতো তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা। দলবাজি ও ফালতু তর্কে আমরা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে এসে ঠেকেছি সেই হুঁশ আমরা সকলেই হারিয়ে ফেলছি। আজ আদালতকেও আমরা এই সকল তর্কে টানিয়ে নামিয়ে এনে তার মর্যাদার সর্বনাশ ঘটিয়ে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?
ডেইলি নিউ এইজ তাদের সম্পাদকীয়তে ঠিকই বলেছে, এই ধরনের রায় আমাদের কুতর্ক (parochial controversy) করবার খাসিলত ও রাজনৈতিক বিভাজনকে আরো উসকিয়ে দেবে। যেখানে ইতিহাস নিয়ে সমাজে তর্কবিতর্ক আছে, প্রমাণপত্রাদির ঘাটতি আছে, সেই ক্ষেত্রে আদালত ডিক্রি জারি করে যদি সেই ইতিহাস ছহি করবার চেষ্টা করেন, তাহলে আদৌ সেটা কোন কাজে লাগে কি না সন্দেহ। বরং এই ক্ষেত্রে দরকার আরো নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় গবেষণা ও তথ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহের চেষ্টা। আমরা দলবাজিতে ওস্তাদ, গবেষণা করবার সময় কই? এখন সংক্ষেপে আদালত দিয়ে যে দলবাজি কাজ সেরে নিলাম তাতে আদালতকেই বরং বিপদাপন্ন করে তুলেছি। আদালতের শক্তি দলমত নির্বিশেষে সকল জনগণের বিশ্বাস বা আস্থার ওপর নির্ভরশীল। সেই কারণে দলবাজি ও বিতর্ক এড়িয়ে চলা আদালতের জন্য ফরজ কাজ। তাহলে আদালতের এই ভূমিকা নিয়ে সঙ্গত প্রশ্ন হচ্ছে সাংবিধানিক প্রশ্ন মীমাংসা, সাংবিধানিক ও মৌলিক নাগরিক অধিকার রক্ষা বা আইন-সংক্রান্ত বিষয়াদি ছাড়া ঐতিহাসিক বা সামাজিক বিতর্ক নিষ্পত্তি করবার জন্য রিট পিটিশন উচ্চ আদালতে আদৌ হতে পারে কি না। আদালত এই ধরনের রিট পিটিশন আদৌ গ্রহণ করতে পারেন কি না। আশা করি, স্বাধীনতার ঘোষণা-সংক্রান্ত এই রায় এবং এই রায় নিয়ে তর্কবিতর্ক আমাদের আদালতের এখতিয়ার সম্পর্কেও হুঁশিয়ার করে তুলবে।
যাঁরা ষাট দশকে তরুণ ছিলেন তাঁরা জানেন ষাটের শেষের দিকে তরুণদের পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে কতোবার যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নাই। সেই সময় একুশে ফেব্রুয়ারিতে বহু ছোট পত্রিকা বেরুতো। সেই সময় পত্রপত্রিকা, লিফলেট, ইশতেহার পড়লেই আমরা তার প্রমাণ পাব। এখন তাহলে যে-কেউই আদালতে গিয়ে দাবি করতে পারেন যে শেখ মুজিবুর রহমান বা জিয়াউর রহমান কেউই নন, আমরাই স্বাধীনতার ঘোষক। এই দেখুন আমাদের ঘোষণা কবিতায়, প্রবন্ধে, লেখালেখিতে, ইাশতেহারে ইত্যাদি। ইতিহাস ও আদালত উভয়কেই আমরা কী পরিমাণ হাস্যকর জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। এই হুঁশ আমাদের আদৌ হবে কি না কে জানে! চরম দলবাজি ও বিকৃত বুদ্ধির দেশে সেই আশা দূরাশা বলেই আমি মনে করি।
এই তর্ক আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তার নমুনা হিশাবে নিউ এইজের সম্পাদকীয় গুরুত্বপূর্ণ। নিউ এইজ বলছে, আজ পর্যন্ত কোন ঐতিহাসিক এমন কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেননি যে ২৫ মার্চ তারিখের মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এটাই মনে হয় যে পরিস্থিতির চাপে কিম্বা কৌশলগত কারণে তিনি এই ঘোষণা দিতে পারেননি। নিউ এইজ এটা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ব্যর্থতা’ হিশাবে গণ্য করেছে, কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে ‘failure’ কথাটি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছে। আমি আমার লেখায় অনেকবারই শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়া ও ২৫ মার্চ তারিখে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দেওয়ার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রশংসা করেছি।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আন্দোলন-সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক ভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হিশাবে হাজির করতে চেয়েছিলেন। তিনি হঠকারী ছিলেন না। অতএব আইনী পরিমণ্ডল অতিক্রম করবার বিপদ সম্পর্কে ষোল আনা হুঁশিয়ার ছিলেন। তিনি লেনিন, মাও জে দং বা হো চি মিনও ছিলেন না। ঘোষণা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম তার রাজনীতি নয়। ২৫ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অর্থ হোত পাকিস্তানের আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহী হিশাবে তাঁর বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ হাজির করার শামিল। তাঁকে ফাঁসি দেবার জন্য এই ঘোষণাই ছিল যথেষ্ট। এমনকি আইনী পরিমণ্ডলে থাকার জন্য তিনি তাঁর সাতই মার্চের বক্তৃতা শেষ করেছেন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে। পাকিস্তানকে তিনি ভাঙছেন, এই দায় তিনি নিজের কাঁধে নিতে চান নি। যদি ফেনিল আবেগ বাদ দিয়ে ভাবি, তাহলে এটা খুবই সঠিক সিদ্ধান্ত। এই ধরণের রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের ইতিহাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত করেছে। অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অসাধারণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁদের কাছ থেকে আলাদা করেছে। যদি আমরা এই সহজ সত্যটুকু বুঝি তাহলে আদালতের রায় দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর মধ্যে তাঁকে মহৎ নয়, বরং তাঁকে অপমানই করা হোল। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বাংলাদেশের গণআন্দোলন-সংগ্রামকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে আইনী পরিমণ্ডলের মধ্যে লড়াই সীমাবদ্ধ রাখবার বিচক্ষণতাকেই অস্বীকার করা হোল। অথচ এই অসাধারণ বিচক্ষণতাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি যুগপৎ রাজনীতি ও আইনের ছাত্র হিশাবে পাঠ করি, তাহলে তিনি তখনকার পাকিস্তানের আইনী পরিমণ্ডলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কিভাবে সেই আইন অতিক্রম করে যাবার কৌশল শিখিয়েছেন, তা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারি না। অবাকই হই। আফসোস, আইনের খেদমতগার হিশাবে আদালতের নজর থেকে যখন রাজনীতি ও আইনের এই তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক অন্তর্হিত হয়, তখন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার কোনই উপায় থাকে না।
আসলে ২৫ বা ২৬ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কী ঘটেছিল সেই বিষয়ে আমি এখানে আর কিছু বলব না। বরং পাঠককে ২৫ জুন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় মনজুর আহমদের ‘আদালতের রায় ও ইতিহাসের সত্য’ শিরোনামে সংবাদভাষ্যটি পড়তে অনুরোধ করব। হয়তো আদালতও এই তথ্যাদির সঙ্গে তাঁদের রায় তুলনা করবার অবসর পাবেন। আমি তথ্যের কারবারি নই, বরং তথ্য বিশ্লেষণই আমার কাজ। তথ্যের তাৎপর্য ধরিয়ে দেওয়া এবং ইতিহাসের অভিমুখ কোন দিকে সেই দিকে তর্জনী তুলে পাঠকের নজর কাড়ার চেষ্টা আমি করি। কতোটা সফল হই জানি না। এতোটুকু বুঝতে পারি শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক, জিয়াউর রহমান নন আদালতের রায় দিয়ে এই ভাবে ইতিহাস লিখবার নজির বড়ই অদ্ভুত! বড়ই বিচিত্র! বিচার বিভাগ এর ফলে এমন এক রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ল যার কাফফারা দীর্ঘদিন আমাদের গুনতে হবে। যে সকল পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানের উল্লেখ করেছি, আশা করি সেই সব ইতোমধ্যে বিচার বিভাগেরও নজরে পড়েছে। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও মর্যাদা রক্ষাই এখন আমাদের প্রধান কাজ। আইন-আদালত সম্পর্কে একটি সহজ সত্য সকলেই জানেঃ যে রায় বলবৎযোগ্য নয়, সেটা বিচারকের ‘মত’ হতে পারে, কিন্তু রায় হয়ে উঠতে পারে না। যদি পত্রপত্রিকাই আদালতের রায় না মানে, তাহলে জোর করে তো শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানো যাবে না। দুর্ভাগ্য শেখ মুজিবুর রহমানের, আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে ঐতিহাসিক সত্যের জোরে নয়, বিচারকের রায় দিয়ে তাঁকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বনতে হচ্ছে। এর চেয়ে বড়ো অপমান তাঁর জন্য আর কী হতে পারে?
আদালত রায়ে বলেছেন, প্রত্যয়ন কমিটি স্বাধীনতার ঘোষণা-সংক্রান্ত অসত্য সংযোজন করে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে। কমিটি ‘ইচ্ছাকৃত’ ভাবে ইতিহাস বিকৃত করে দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড করেছে। প্রফেসর এমাজউদ্দীন সঙ্গত কারণেই প্রত্যয়ন কমিটির সদস্য হিশাবে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, আদালত প্রত্যয়ন কমিটির ‘কারো কোন কথা না শুনে’ প্রত্যয়ন কমিটির বিরুদ্ধে এই ‘রায়’ দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, বিচারকরা ‘কুৎসা’ রটিয়েছেন। তবে সব দোষ প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া সঙ্গত নয়। আমরা করি নি, বিএনপি করেছে এই অবস্থান তাঁর প্রধান যুক্তিকে দুর্বল করবে। তিনি তো বিএনপি সমর্থক হিশাবেই সেই কমিটিতে ছিলেন। একমত না থাকলে সেই সময় তাঁর পদত্যাগ করাই শোভনীয় হোত। কিন্তু আইনী প্রক্রিয়া ও ন্যায় বিচারের দিক থেকে প্রফেসর এমাজউদ্দীন অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্নই তুলেছেন। অভিযুক্তদের কোন কথা বা বক্তব্য না শুনে বিচার বিভাগ এই ধরণের রায় দিতে পারেন কি? জুলাইয়ের ২ তারিখে প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের শুনানির মধ্যে আদালতের কাছ থেকে আইন ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে এর একটা সদুত্তর পাবার জন্য আমরা অবশ্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
(সুত্র, নয়া দিগন্ত, ২৭/০৬/২০০৯)
Available tags : আদালত অবমাননা, সাংবিধানিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, আদালত