- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
কী ‘নাই’? জাতি না কি জাতীয় সংবাদমাধ্যম?
............................
ষোলো আর সতেরো তারিখের নয়টা করে দৈনিক প্রত্রিকা নিয়া বসলাম, সাতটা বাংলা আর দুইটা ইংরেজি। উদ্দেশ্য; ষোলো তারিখের ফারাক্কা দিবসকে ঐতিহাসিকভাবে ও দিবস আকারে পত্রিকাগুলা তাদের খবরে কিভাবে কতটা জায়গা দিলো। বাংলাদেশের মানুষ ও পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা চলছে--ইনডিয়ার ‘পানি কূটনীতি’র অংশ হিশাবে বাংলাদেশের নদীতে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ ক্রমশ কমতে থাকার ফলে দেশের জলজীবন ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আছে,--সেই ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদী দিবস--ফারাক্কা দিবস। পানি ও পরিবেশের ওপর এমন প্রতিবন্ধকতার সময়ে এটা ছাড়া আর কোনো বিষয় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রধান জাতীয় এজেন্ডো হতে পারে? আমাদের উদ্দেশ্য ছিল; এমন একটা জাতীয় এজেন্ডায় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের অবস্থান যাচাই করা। আপাতত ছাপা মাধ্যমে প্রকাশিত দৈনিকগুলাই ভরসা। মোট নয়টা দৈনিক; ইত্তেফাক, যুগান্তর, প্রথম আলো, সমকাল, নয়া দিগন্ত, আমার দেশ, ডেইলি স্টার ও নিউ এজ।
.........................................
জাতীয় সংবাদমাধ্যম কারে কয়?
ষোলোই মে ছিল চৌত্রিশতম ফারাক্কা দিবস। কিন্তু সেদিন প্রায়সব দৈনিকগুলাই ফারাক্কা দিবসের খবরটা হাপিশ করে দিয়েছে, বা সে উপলক্ষে বাংলাদেশের সামগ্রিক পানি সমস্যা নিয়ে সম্পাদকীয় বা মন্তব্য তো দূরের কথা, খবরটাই দেয় নাই তারা। পরের দিনও দিবস পালনের কোনো খবর পত্রিকাগুলা দেয় নাই।
বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের বেলায় দেশটাকে নানা ইস্যুতে চাপে রাখা--দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলাতে তুলনামূলক দুর্বলতম অবস্থানে রাখার জন্য ইনডিয়া ‘পানি কূটনীতি’র আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের জন্মের বছর চার না পেরোতেই এই কূটনীতি কার্যকর করে ইনডিয়া ঊনিশশো পঁচাত্তর সালে। ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হয় সেবছর (পড়ুন: ফারাক্কা যেভাবে এলো)। পানি কূটনীতির পঁয়ত্রিশ বছর পর আজ পর্যন্ত চুয়ান্নটি আন্তর্জাতিক নদীর বাংলাদেশ প্রবেশমুখে ইনডিয়া হয় ব্যারাজ নয় ড্যাম বানিয়েছে। নদীর স্বাভাবিক জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত। জলজীবন বিপর্যস্ত। মানুষসহ সব প্রাণ ও পরিবেশ হুমকির মুখে। প্রথম বাঁধ- ফারাক্কা চালু করার পরের বছরই বাংলাদেশের জনমানুষের নেতা মওলানা ভাসানী প্রতিবাদী লংমার্চের (পড়ুন: আলাপচারিতায় হক-কথা সম্পাদক) আয়োজন করেছিলেন ঊনিশশো ছিয়াত্তর সালের ষোলোই মে। সেই থেকে ওই দিনটাকে ফারাক্কা দিবস হিশাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের জীবন সহ সব প্রাণ ও পরিবেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারি অস্ত্র--ইনডিয়া যে পানি আগ্রাসন চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সক্রিয়তার প্রতীকি দিবস- ফারাক্কা দিবস।
প্রাচীনতম দৈনিক, ইত্তেফাক ফারাক্কা দিবসের খবরটা দেয় নাই। প্রকাশনার সাতান্ন বছর পেরিয়ে ইত্তেফাক দাবি করে তারা ‘আস্থায় শীর্ষে’। কাদের আস্থা? যেই দেশের প্রায় সব প্রধান নদী-প্রবেশ মুখে প্রতিবেশী দেশটি বাঁধ তৈরি করে পানি প্রত্যাহার করে, সেই দেশের মানুষের আস্থা? সবচেয়ে বেশি প্রচারসংখ্যাওয়ালা প্রথম আলোও খবরটা চেপে গেছে। সর্বোচ্চ প্রচারসংখ্যাওয়ালা দৈনিক--ডেইলি স্টারও সেদিন খবরটা দেয় নাই। ডেইলি নিউ এজ ফারাক্কা দিবসের খবরটা দিয়েছে তৃতীয় পাতায় এক কলামে একদম নীচে, শিরেনাম--‘হিস্টরিক ফারাক্কা ডে টুডে’। শিরোনাম যথার্থ না। যথার্থ শিরোনাম হতে পারতো ‘বিএনপি’র স্টেটমেন্ট অন ফারাক্কা ডে’, কারণ পুরো নিউজটা হচ্ছে এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিএনপির বিবৃতি নিয়া। বিএনপি’র বিবৃতিটা নিউ এজের সংবাদকক্ষে না পৌঁছালে খবরটা তারা দিতো, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই, অন্তত নিউজটা পড়ে সেটা ভাবা যায় না। খবরটা স্রেফে মেরে দিয়েছে দৈনিক যুগান্তরও। দিবসের খবরটা হাপিশ করে দিয়েছে যেইসব দৈনিকগুলা, সমকালও আছে তাদের দলে। ষোলো তারিখে দিবসের খবর যারা গায়েব করে দিয়েছে: ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল ও ডেইলী স্টার পরের দিনও দিবসের কর্মসূচী নিয়া কোনো খবর দেয় নাই। কালের কণ্ঠ ও ডেইলি নিউ এজ ষোলো তারিখে দায়সারাভাবে দিবসের খবর দিলেও সতেরো তারিখে কোনো কর্মসূচীর খবর দেয় নাই।
বাংলা দৈনিকগুলার মধ্যে ষোলো তারিখে ফারাক্কা দিবসের খবরটা দিয়েছে নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও কালের কণ্ঠ। প্রথম পাতার প্রথম কলামে সাদামাটাভাবে খবরটা দিয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত। খবরটা ছাপাতে কোনো বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় নাই, না বক্স না ছবি না কোনো ব্যানার। অবশ্য খবরটা বিস্তারিত, ফারাক্কা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ইনডিয়ার নদী আগ্রাসন ও তার ফলে বাংলাদেশের জলজীবনের সংকটের চিত্র খবরটাতে এসেছে। পত্রিকাটি বিএনপির বিবৃতিটা খুব গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছে সবার আগে। অন্যদিকে যেই ফোরামটি দেশে ও দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের পানি সমস্যা নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সক্রিয় আছে--সেই আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির নামটা ছেপেছে ভুলভাবে। এদিনের পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদকীয় ফারাক্কা ও লংমার্চ বিষয়ে। ফারাক্কা দিবস নিয়ে একপাতা জুড়ে বিশেষ আয়োজনও ছিল দৈনিকটির। দিবস পালনের খবরাখবর পরের দিন মানে সতেরো তারিখে মোটামুটি গুরুত্বের সাথেই দিয়েছে নয়া দিগন্ত।
এদিন ফারাক্কা ও পানি সমস্যা বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পাঠককে খবর পৌঁছে দিয়েছে দৈনিক আমার দেশ। প্রথম পাতায় উপরের অর্ধেকে দুই কলাম খবর দিয়েছে পত্রিকাটি, লং মার্চ সমাবেশের ছবিসহ। খবরটার উপশিরোনামটি লক্ষ করার মতো; ‘৩৪ বছরেও পানি সমস্যার সমাধান হয়নি’। তার মানে, শুধু ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিন হিশাবে নয়, বর্তমানে প্রধানতম জাতীয় সমস্যা হিশাবে এই দিবসের অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতার কথা পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছে পত্রিকাটি। প্রথম পাতা থেকে দ্বিতীয় পাতায় টপকি মারা খবরটিতে পানি প্রত্যাহার, বর্তমানে নদীগুলার অবস্থা এবং বাংলাদেশের জলজীবনে এর প্রভাব বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে পত্রিকাটি। খবরের শেষে দুটো চিঠির টেক্সট জুড়ে দিয়েছে পত্রিকাটি। তখনকার ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে মওলানা যে চিঠিটি লিখেছিলেন সেটি, ও তার জবাবে ইন্দিরার লেখা চিঠিটি। তাছাড়া ফারাক্কা দিবসকে কেন্দ্র করে ইনডিয়ার পানি প্রত্যাহার ও দেশের বিপর্যস্ত জলজীবন বিষয়ে একটা ধারাবাহিক প্রতিবেদন--‘উজানে বাধা, ভাটিতে বিপর্যয়’ এর দ্বিতীয় কিস্তি এদিন আমার দেশ ছেপেছে শেষের পাতায়, ছবিসহ চার কলামে। পাশাপাশি, ফারাক্কা দিবসে নয়া দিগন্তের বাইরে শুধু আমার দেশই একপাতা জুড়ে একটা বিশেষ আয়োজন করেছে ওই দিন। তাছাড়া পত্রিকাটির সার্বিক সহযোগিতায় তাদের পাঠক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি এবার রাজশাহীতে দুই দিনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচী পালন করেছে। পরেরদিন মানে সতেরো তারিখে সেই কর্মসূচীর খবর ছিল পত্রিকাটিতে, প্রথম পাতায় একদম উপরের পাতায় ডান দিকে তিন কলাম জুড়ে, ছবিসহ। দিবসটি উপলক্ষ করে দেশে আয়োজিত কর্মসূচীর মধ্যে ওই গণসমাবেশ ও সেমিনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, সন্দেহ নাই। শুকিয়ে যাওয়া পদ্মার চরে, রাজশাহীর বড়কুঠিতে ওই গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশজুড়ে অন্যান্য কর্মসূচীর খবর পত্রিকাটি দিয়েছে শেষের পাতায় নীচের দিকে দুই কলামে, বিস্তারিতভাবে। তাছাড়া ‘উজানে বাধা, ভাটিতে বিপর্যয়’ নামের ধারাবাহিক প্রতিবেদনটির এদিন ছিল তৃতীয় কিস্তি, ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায় তিন কলামজুড়ে, তিন কলাম ছবিসহ।
সব মিলিয়ে, একমাত্র দৈনিক আমার দেশ’ই বিষয়টিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জাতীয় এজেন্ডা হিশাবে হাজির করেছে পাঠকের সামনে। জাতীয় এজেন্ডার খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে পত্রিকাটি, জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা পালন করেছে। নয়া দিগন্তকেও কোনোরকমে এই দলে ফেলা যায়।
বাদবাকী দৈনিকগুলা যে এই বিষয়টি তাদের খবর-সম্পাদকীয়-মন্তব্যে পুরাপুরি এড়িয়ে গেলো তার কী কারণ থাকতে পারে? প্রতিবেশী দেশের বানানো অর্ধশত বাঁধের কারণে বাংলাদেশের জলজীবন, প্রাণ ও পরিবেশ ইতিহাসের নজিরবিহীন হুমকির মুখে। আর ফারাক্কা দিবস হচ্ছে এই ইস্যুতে দেশের জনমানুষের প্রতিরোধ দিবস। এই দিবসটি কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলা ইনডিয়ার পানি কূটনীতিসহ সামগ্রিক পানি আগ্রাসন ও বাংলাদেশের পানি সমস্যার বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখবে--এটাই হওয়ার কথা ছিল। আমরা দেখলাম সেটা হয় নাই। সামর্থ্যের অভাব নাকি সিদ্ধান্তের?
এমন একটা জাতীয় ইস্যুতে খবরাখবর দেয়া বা জনমত তৈরি করার সামর্থ্যের অভাবে ভুগছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো? যদি তা-ই হয় তবে সে বড় হতাশার কথা। রাষ্ট্র হিশাবে আমরা এইটুকু সামর্থ্য অর্জন করতে পারি নাই! হলফ করে বলা যায় এটা তাদের সামর্থ্যের অভাব নয়, বরং ইতিহাসের প্রেরণা এবং জনমানুষের বজ্রকঠিন ঐক্যে'র নিশানা মুছে ফেলার শক্তিমত্তা প্রদর্শন। এই শক্তির সরবরাহ, নানা সময় ঢাউশ ঢাউশ 'বিশেষ সাপ্লিমেন্ট' পয়দা করার কাজে যারা সহায় থাকে সেই তারাই মওজুদ আছে।
আর এই এড়িয়ে যাওয়ার পিছনে অন্য একটা সিদ্ধান্ত কবুল করা আছে মনে হয়, তবে সেটা ভয়ের কথাই বটে। এই এড়িয়ে যাওয়ার কারণ, মওলানা ভাসানী। বাংলাদেশের মানুষকে একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে ধার্য করে সেই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কায়েমের যে লড়াই মওলানা চালিয়েছেন জীবনভর--তাতে করে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের’ ব্যানার ধারী গোষ্ঠীর কাছে বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়েছেন। সেই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, যারা কি না নিজেদের এখনো একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান--একটা রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদেরকে একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী বা জাতি হিশাবে ভাবতেও পারে না। বরং স্বাধীনতা লাভের এত বছর পর আমরা তাদের দেখছি--দুনিয়ার পরাশক্তি ও আঞ্চলিক পরাশক্তির হয়ে এই দেশে রাজনৈতিক ঠিকাদারের ভূমিকায়। কাজেই জাতীয় আত্মপরিচয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পুরোধা মওলানা (পড়ুন: পানি ও রবুবিয়াতের রাজনীতি) তাদের জন্য বিপজ্জনক বটে।
সব মিলিয়ে কারণ যাই হোক, ফল দাঁড়ালো এই যে; বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদপত্রগুলা এই সিদ্ধান্ত নিলো--তারা ফারাক্কা দিবসের বা বাংলাদেশের পানি-প্রাণ-পরিবেশের সংকটের খবর এড়িয়ে যাবে কিংবা এ বিষয়ে তারা কোনো জনমত তৈরি করবে না! তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের নাই কোনটা--জাতি নাই? না কি জাতীয় সংবাদমাধ্যম নাই?
পদ্মা কিম্বা যমুনা না বাঁচলে কি শহুরে নদীরা বাঁচবে?
.................................
ঢাকার নদী ও খালগুলা বাঁচাতে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের তৎপরতার সাথে পাঠকরা খুব পরিচিত, খবরে এবং খবরের বাইরে নানা এনজিও প্রোগ্রামের মাধ্যমে পত্রিকা দুটি সক্রিয়। ফারাক্কা দিবসে অর্থাৎ ষোলোই মে’তে প্রথম আলোর ফিচার পাতা ‘ঢাকায় থাকিতে’ এমন একটা ফিচার ছিল ঢাকার শাহজাদপুর খাল এর দুরবস্থা নিয়া; পত্রিকাটির ভাষায় ‘খরায় দুর্গন্ধ বর্ষায় জলাবদ্ধতা’। রাজধানীর নদী খাল জলাশয়ের এই দুর্গন্ধ ও জলাবদ্ধতা দূর করতে পত্রিকাটির আগ্রহ আছে বোঝা যায়, দেখা যায়। অথচ, যেই অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলার অবাধ জলপ্রবাহের ফলে বাংলাদেশের জলজীবন টিকে আছে ভারসাম্যপূর্ণভাবে, সুপ্রাচীনকাল থেকে, সেই নদীগুলার দুরবস্থা নিয়া পত্রিকাটা চিন্তিত না। পদ্মা আর যমুনা যদি আটকে থাকে ফারাক্কা আর টিপাইমুখে তবে বুড়িগঙ্গা আর তুরাগে জলপ্রবাহ আসবে কোত্থেকে? এটা কখনো প্রথম আলো কিম্বা ডেইলী স্টার তার পাঠককে জানায় নাই।
..................................
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রধান ‘এনভারনমেন্টাল ইস্যু’ কী?
...................................
ফারাক্কা দিবসে যদিও দৈনিক সমকাল দিবসের খবরটা চেপে গেছে কিন্তু বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় প্রশ্নে দৈনিকটি যে উদ্বিগ্ন সেটা বোঝা যায়। সেদিন ‘পরিবেশ’ বিষয়ে একটি উপসম্পাদকীয় ছেপেছে দৈনিকটি। তরুণ ‘প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক’ পাভেল পার্থ ওটা লিখেছেন, শিরোনাম ‘মহাসড়কের জন্য পাহাড়ের মৃত্যুদণ্ড কেন?’। পরিবেশ ইস্যুতে জরুরি প্রশ্ন এটা, সন্দেহ নাই। ফারাক্কা দিবসে পাহাড় রক্ষা করার কথা বলা যাবে না--এমনও না। কিন্তু এমন দিবসে এমন একটা বিষয় কিভাবে ‘পরিবেশ’ ইস্যুর বাইরে যায়? অবশ্য যে পত্রিকা ফারাক্কা দিবসের খবরটাই দেয় না, সেখানে নিশ্চয় এ বিষয়ে লেখার সুযোগ নাই, সেটা আমরা বুঝতে পারি। একই সাথে আমাদের আশা--বাংলাদেশে ‘পরিবেশ আন্দোলনে’ সক্রিয় ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো সংবাদপত্রের পরিসরের বাইরে হলেও পানি আগ্রাসন বিষয়ে সক্রিয় রইবেন। অবশ্য এই আশা পূরণ হবার কোনোই আলামত আমরা অতীতে দেখি নাই। বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের জায়গায় এই বিষয়ের চেয়ে, পানি ও প্রাণের এই বিপজ্জনক অবস্থার চেয়ে বড়ো ইস্যু আর কী হতে পারে?
...................................
অনৈতিক ও অপেশাদার সাংবাদিকতার নজির
ফারাক্কা সমস্যার মতো জাতীয় এজেন্ডায় দৈনিক আমার দেশ জাতীয় সংবাদপত্র হিশাবে প্রশংসার যোগ্য ভূমিকা রেখেছে, অবশ্যই। কিন্তু ওই একই দিনে পত্রিকাটি একই বিষয়ে সাংবাদিকতার একটা বড় খারাপ নজির তৈরি করেছে। ফারাক্কা দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ আয়োজনে প্রধান রচনা হিশাবে তারা আহমদ ছফা’র একটা লেখা যেমন করে পুনর্মুদ্রণ করেছে, তা খুবই অনৈতিক ও অপেশাদার সম্পাদনার নজির হয়ে আছে। পানি আগ্রাসন ও মওলানার লং মার্চ বিষয়ে ‘তাঁর পথরেখা’ নামে ছফা’র ওই লেখাটি প্রথম ছাপা হয় উনিশশো চুরানব্বই সালে, একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায়। দৈনিকটি অনেক কাট-ছাট করে ছেপেছে লেখাটি; যেটুকু ছেপেছে তাতেও প্রচুর সম্পাদনা করেছে--নীতিগত ও ভাষাগত সম্পাদনা, বাক্যগঠনের ধরন পাল্টিয়েছে, তাছাড়া বানানরীতিও পাল্টিয়েছে। অর্থাৎ লেখাটি ‘সংক্ষেপিত-ব্যাপকভাবে সম্পাদিত ও বানানরীতি পরিবর্তিত’ করে পরে ছাপানো হয়েছে। কিন্তু দৈনিকটি এর কিছুই পাঠককে জানায় নাই। লেখার শেষে সম্পাদকীয় বক্তব্য যা আছে তা হলো-- ‘পুনর্মুদ্রিত’। অর্থাৎ দৈনিকটি বলছে, ঊনিশশো চুরানব্বই সালের সাপ্তাহিক ‘রাষ্ট্র’র তৃতীয় বর্ষের তেরোতম সংখ্যায় মহাত্মা আহমদ ছফা’র যেই লেখাটি ‘তাঁর পথরেখা’ শিরোনামে লেখা হয়েছিল, সেটাই তারা হুবহু পুনর্মুদ্রণ করেছে। এই বক্তব্য সত্য নয়। আজ পর্যন্ত পত্রিকাটি এ বিষয়ে কোনো সংশোধনী দেয় নাই।
Available tags : জাতীয় ইস্যু, সংবাদ প্রতিবেদন, ভাসানী, ফারাক্কা,