হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নে উদ্যেগ নাই আপিল বিভাগের

রিমান্ড বলে কিছু নাই

সম্প্রতি বন্ধ করে দেয়া দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা চারটা মামলা’য় মোট বারো দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। এই রিমান্ড কী জিনিস? পুলিশ কখনো আদালতে গিয়া বলে না, এই ব্যক্তিকে আমরা ‘রিমান্ডে’ নিতে চাই। তারা বলে আইনি হেফাজত, আদালতও আইনি হেফাজত মঞ্জুর করে। সংবাদ মাধ্যমে রিমান্ড শব্দটা জনপ্রিয়। তো, অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পর জেলে পাঠানোর কথা, আবার ‘আইনি’ হেফাজতে কেন? বাংলাদেশের আইনে এই সুযোগ রাখা হয়েছে অভিযোগের ‘অধিকতর তদন্তের’ জন্য। পুলিশ যদি স্থির করে যে, গ্রেপ্তার করার পর থেকে আদালতে হাজির করার মাঝখানের সময়ে গ্রেপ্তারকৃতের কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্যাবলী জানা যায় নাই, সেক্ষেত্রে অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে রাখার আবেদন করতে পারে পুলিশ। আদালত নানা আইনি বিষয় বিবেচনা করে পুলিশের আবেদন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু তদন্তের নামে এই আইনি হেফাজতে আসলে কী হয়? মূলত অভিযুক্তের কাছ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করার লক্ষ্যে অমর্যাদাকর আচরণ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার জন্যই পুলিশ অভিযুক্তকে ‘আইনি হেফাজতে’ নিতে চায়। রিমান্ডে’র আইনি খোলস হলো আইনি হেফাজত, আর আইনি হেফাজত কার্যত নির্যাতন।

সর্বোচ্চ আদালত আর সরকার মিলে নাগরিক সুরক্ষা ঝুলিয়ে রেখেছে

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের যে কয়টা সত্যিকারের ইতিবাচক উদ্যোগ আছে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ হিশাবে— তার একটা হলো এই বিষয়টা ধরতে পারা যে, আইনি হেফাজত মানে হচ্ছে, অভিযুক্তকে নির্যাতনের জন্য পুলিশকে একটা সময় বরাদ্দ দেয়া, বন্দী অবস্থায় নির্যাতনের আইনি অনুমোদন দেয়া। বেসরকারি আইনি সহায়তা দানকারী সংস্থা ব্লাস্টের একটি আবেদনের (রিটের) জবাবে দুই হাজার তিন সালে হাইকোর্ট বিভাগ যে সিদ্ধান্ত দেন, সেটা একই সাথে দুইটা বিষয় প্রমাণ করে; এক. প্রচলিত এই ‘আইনি হেফাজতের’ অসাংবিধানিক-মানবাধিকার বিরোধী এবং এর চরিত্র আসলে নির্যাতনমূলক। এমন নির্যাতন থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে হাইকোর্ট বিভাগ বেশ কিছু নির্দেশনা এবং সুপারিশ দেন ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ নামে খ্যাত ওই মামলায়।

হাইকোর্ট বিভাগ স্থির করে নিয়েছেনে যে, বাংলাদেশে আইনি হেফাজতের নামে মূলত নির্যাতন হয়—স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য। ফলে ওই সিদ্ধান্তে আদালত স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন যে, অভিযুক্তকে এরূপ ‘হেফাজতে’ পাঠানোর আগে আদালতকে কি কি বিষয় বিবেচনা করতে হবে—পুলিশের তরফে কি কি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে- হেফাজতে থাকাকালে অভিযুক্তের সুরক্ষার জন্য আদালত কি কি বিষয় নিশ্চিত করতে পুলিশকে বাধ্য করবেন। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে, গত ছয় বছর ধরে সেটি আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। আপিল বিভাগের নিষ্ক্রিয়তা এবং সরকারের অনিহায় সিদ্ধান্তটির ফয়সালা চুড়ান্ত হচ্ছেনা।

কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালতের ওপর ওই রিটের সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলক বিচারিক নজির। মানে হচ্ছে, বিচারিক সিদ্ধান্ত দেয়ার সময় প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে ওই সিদ্ধান্তটি অনুসরণ করা সব নিম্ন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু আরো অনেক মামলার মতো সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা মামলায়ও নিম্ন আদালত ওই সিদ্ধান্তের অবাধ্য হয়েছেন।

সর্বোচ্চ আদালতকে অমান্য করলেন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত

আদালত মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে পাঠানোর পরে ছয় জুন সরকার তার বিরুদ্ধে আরো একটা মামলা দায়ের করে। প্রথম যেদিন তাকে আদালতে আনা হয়, সেই দুই জুন আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে মাহমুদুর রহমানকে প্রধান অভিযুক্ত করে ‘আদালতের কাজে বাধা দানের’ মামলা করা হয় কোতোয়ালি থানায়। সাতই জুন তাকে আবার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এইদিন গ্রেপ্তার কালে ‘সরকারি কাজে বাধা দানের’ এবং ‘আদালতের কাজে বাধা দানের’ মামলায় যথাক্রমে পাঁচদিন ও সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত যথাক্রমে তিনদিন ও একদিনের মানে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সাতই জুন তার বিরুদ্ধে আরো দুইটা মামলা দায়ের করা হয়—রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বিমানবন্দর থানায় একটা মামলা এবং উত্তরা মডেল থানায় সন্ত্রাস দমন আইনের একটা পুরানা মামলায় তাকে অভিযুক্ত হিশাবে অন্তর্ভুক্ত করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন আটই জুন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দশদিন করে মোট দুইদিন রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। আদালত চারদিন করে মোট আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সবমিলিয়ে বারো দিনের পুলিশি রিমান্ডে অর্থাৎ আইনি হেফাজতে মাহমুদুর রহমানকে পাঠালেন আদালত। অবশ্য কার্যত ঢাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মহোদয়রা এই সম্পাদককে পুলিশের নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিলেন। কারণ, একজন বিচারকও রিমান্ড ও জামিন শুনানিতে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া নির্দেশনা ও সুপারিশ অনুসরণ করেন নাই। ঢাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির সবকয়টা আদালতে আগে থেকে যেভাবে সর্বোচ্চ আদালতের এই বাধ্যতামূলক বিচারিক নজির লঙ্ঘিত হয়ে আসছে, এই মামলায়ও তাই হলো।

সাতই জুন একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি কাজে বাধা দানের মামলায় মামুদুর রহমানকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠালেন; অথচ রাষ্ট্রপক্ষ ও পুলিশ এটা প্রমাণ করতে পারে নাই যে, তারা পত্রিকাটির নিজস্ব সম্পত্তিতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে নাই। একই দিন ‘আদালতের কাজে বাধা দানের’ মামলায় অন্য একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এই সম্পাদককে এক দিনের রিমান্ডে পাঠালেন। কিন্তু আদালত এখানে যথাযথ বিচারিক বিবেচনা প্রয়োগ করেন নাই। একজন গ্রেপ্তারকৃত লোক কিভাবে বাইরের ন্যায্য ও আইনি বিক্ষোভের জন্য দায়ী হতে পারে। রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে কোনো বিস্তারিত বক্তব্য না দিলেও আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আটই জুন যে দুটো মামলায় পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করে তার একটার এজাহারে—হিযবুত তাহরীরের বিরুদ্ধে দায়ের করা পুরানা মামলায় মাহমুদুর রহমান অভিযুক্ত নন। পুলিশ কোনো এজাহারে কোনো সংযুক্তি দিয়ে বিস্তারিত কারণ দেখিয়ে তাকে অভিযুক্ত করতে পারে নাই। শুধু একটা ফরওয়ার্ডিং লেটারে বলেছে যে, তাদের ‘মনে হচ্ছে’ বা ‘সন্দেহ হচ্ছে’ গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি তাতে ‘জড়িত’ থাকতে পারে। এই ‘মনে হচ্ছে’র ওপর ভর করে আদালত তাকে চারদিনের রিমান্ডে পাঠালেন। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটির ক্ষেত্রেও পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে আদালতের প্রথামাফিক ভাষায় ‘ক্রেডিবল’ বা ‘আস্থাযোগ্য’ যুক্তি দাঁড় করাতে পারে নাই। ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্ট বলেছিলেন, ‘ক্রেডিবল মিনস বিলিফেবল। বিলিফ ডাজ নট মিন টু মেক বিলিফ। রিজনেবল সাসপিসিয়ন ইমপ্লাইস দ্যাট সাসপিসিয়ন মাস্ট বি বেসড অন রিজনস আর বেসড অন এক্সিসটেন্স অফ সাম ফ্যাক্টস হুয়িচ ইজ উইদিন দ্যা নলেজ অফ দি পারসন।’

অর্থাৎ আদালত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন যে, ‘ক্রেডিবল’ বা আস্থাযোগ্য মানে হলো বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু এই বিশ্বাসযোগ্য মানে ‘মনে করা’ নয়। কোনো মনে করা বা সন্দেহ যদি যৌক্তিক বলে গণ্য হতে হয় তবে এই সন্দেহ অবশ্যই যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আবার সেই যুক্তি হতে হবে অবশ্যই অভিযোগকারীর জানাশোনা আছে এমন তথ্যে-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। ওই রায়ে আদালত পরিস্কার করে বলেছেন যে, পুলিশ যদি কোনো অভিযোগের বিষয়ে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে তদন্ত করতে চায় তবে ওই অভিযোগের মূলে থাকা সন্দেহ এভাবে আস্থাযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেই কেবল আদালত হ্যাঁ বলবেন।

কিন্তু চারটি মামলায় একজন সাংবাদিককে এই যে মোট বারোদিন রিমান্ড দিলেন কয়েকজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, একজনের আদালতেও পুলিশকে এসব বিষয়ে জবাব দিতে হয় নাই। এমনকি মূল এজাহারে নাম ছিল না এমন মামলায় নতুন করে ‘সন্দেহভাজন’ বলে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়ার পরেও এসব মানদণ্ডে যাচাই করার দরকার মনে করেন নাই আদালত। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা নিজেদের কথা বলতে না পেরে আদালত থেকে বেরিয়েও গেছেন—এমন ঘটনাও ঘটেছে। তার পরও একপক্ষীয় শুনাশনির পর তাকে রিমান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নজির হিশেবে যা মোটেই ভাল কিছু নয়।

তাছাড়া হাইকোর্টের আরো নির্দেশনা আছে যে, জিজ্ঞাসাবাদ অভিযুক্তের আইনজীবী ও পরিবারের সদস্য বা স্বজনেরা উপস্থিত রাখা, জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয় আদালতকে নিশ্চিত করতে হবে। চার বছর ধরে সারা দেশে এই নির্দেশনা লঙ্ঘিত হয়ে আসছে। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলায়ও তাই হলো। সবচেয়ে বড়ো কথা, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী; কোনো মামলায় তদন্তের জন্য তিন দিনের বেশি মেয়াদে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। এই নির্দেশনাও লঙ্ঘন করেছে ঢাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি।

গ্রেপ্তারকৃত সম্পাদক আদালতে সর্বশেষ রিমান্ড শুনানিতে তার আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি জানি, আপনারা যা-ই বলেন না কেন, রিমান্ড হবেই।’ বাংলাদেশের সব নাগরিকই এটা জানে। অবস্থা দাড়িয়েছে এমন যে বাংলাদেশে নিম্ন আদালতের কাজ হল, সরকারি নির্যাতনে ‘আইনি’ মোড়ক লাগিয়ে দেয়া। মাঝে মাঝে দায়িত্বশীল, সাহসী এবং নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষার প্রতি দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের রায়। কিন্তু এগুলোকে ঝুলিয়ে রাখে সরকার এবং সর্বোচ্চ আদালতের নিষ্ক্রিয়তা (মানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ), যেমন ঝুলে আছে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলা। ছয় বছর ধরে আপিল বিভাগে আটকে আছে রায়টি, গত দুই বছরে একবারও আপিল বিভাগের দৈনিক শুনানির তালিকায় ওঠে নাই। মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলে পরে হয়তো আটকাদেশ বা তদন্তের নামে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে নাগরিকরা সুরক্ষা পেতো। অবশ্য হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন আদালতের ওপর বাধ্যতামূলক বিচারিক নজির এটা, কিন্তু কোনো আদালতই মানছে না। সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলায় রিমান্ডে নেওয়ার বেপরোয়া চেষ্টা থেকে আপিলটি ফয়সালা করতে সরকারের অনিহার মনোভাব কিংবা উদ্দেশ্য বুঝা যায়, কিন্তু উচ্চ আদালত তথা আপিল বিভাগের নিস্পৃহতার কোন যথার্থ কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  


Available tags : রিমান্ড, নির্যাতন, ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়, উচ্চ আদালতের ভুমিকা

View: 4375 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD