- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
গত ২১ জুলাই জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের চলতি কনস্টিটিউশন সংশোধনের লক্ষ্যে এক বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর প্রস্তাবক এবং কণ্ঠভোটে এই প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়। গঠিত কমিটির ১৫ সদস্যের ১২ জনই আওয়ামী লীগের, বাকী তিন সদস্য ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক--জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু।
এর আগে গত ১৬ জুলাই অর্থাৎ সংসদীয় কমিটি গঠনের পাঁচদিন আগে গণভবনে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে প্রথম সংবাদমাধ্যমকে কনস্টিটিউশন সংশোধনের লক্ষ্যে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠনে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে, তিনি সেখানে জানিয়েছিলেন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হবে।
এরমধ্যে কমিটিতে সদস্যপদের জন্য মনোনীত নাম দিতে, মহাজোটের বাইরে সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন দলগুলোর মধ্যে একমাত্র বিএনপিকেই আনুষ্ঠানিক আহবান জানানো হয়। সরকারি দলের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি পাঠান। চিঠিতে সংসদীয় কমিটি গঠন করতে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে বিএনপি প্রতিনিধির নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়। চিঠির উত্তরে বিএনপি প্রতিনিধি হিশাবে কারও নাম পাঠানোর আগে, ১৯ তারিখ সন্ধ্যায়, অর্থাৎ একদিন আগেই চিঠির ‘অস্পষ্টতার’ তিনটি বিষয় উল্লেখ করে সেগুলো স্পষ্ট করে জানানোর জন্য আহবান করে। বিএনপি প্রথমেই নিজের কোন প্রতিনিধির নাম প্রস্তাব না করায় আওয়ামী লীগ এটাকে নিজের জন্য একটা সুবিধা হিশাবে দেখেছিল। আওয়ামী লীগ চিঠির জবাবে সেসব প্রসঙ্গের সুরাহায় না গিয়ে ২১ জুলাই কেবল মহাজোটের সদস্যদের নিয়েই এককভাবে সংসদীয় কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়।
সব মিলিয়ে এঘটনায় এককভাবে বেপরোয়া মনোভাবে ও একরোখা সিদ্ধান্তে চলতে প্রস্তুত এক আওয়ামী লীগকে আমরা দেখতে পাই। নিজের সিদ্ধান্তের ভিতরে বিরোধী দলকে জায়গা দিয়ে সাথে নেবার পথ বের করার কোন তাগিদ আওয়ামী লীগের আছে তা হাসিনা আমাদের দেখাতে পারে নাই।
সাথে নেবার কথা আমরা তুলছি এজন্য যে প্রসঙ্গটা কনস্টিটিউশন। একটা রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশন মানে এর কনস্টিটুয়েন্ট বা গাঠনিক উপাদান জনগণ -- তবে তা বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন স্বার্থে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। এখানে আমরা বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন স্বার্থে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, বিভক্ত হয়ে আছি এটা একটা বাস্তবতা। এই সত্যকে লুকিয়ে রাখা বা ভুলে গেলে তা আপনাতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। যাওয়ার যেমন কোনই প্রয়োজন নাই, তেমনি আমাদের স্বার্থ-বিভক্তির জন্য এখান থেকে একটা সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিভূমি নাই, বা তা দেখা যায় না, কিম্বা বের করা অসম্ভব-- সে কথাও শতভাগ মিছা। ফলে আমাদের মধ্যে স্বার্থ-বিরোধ-বিভক্তি থাকা সত্ত্বেও সব অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটা সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিভূমি যাকে অনেকে “নাশন্যাল কনসেন্সাস বা জাতীয় স্বার্থ” বলে বুঝিয়ে থাকে -- এর উপর দাঁড়াতে হবে। তার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়াকে যদি কর্তব্যজ্ঞান বলে বুঝতে পারি তবেই সংসদীয় কমিটি ন্যূনতম অর্থবহ হয়। নইলে আমরা যে দলবাজী দেখতে অভ্যস্ত তা আরও কত নিকৃষ্ট ও আত্মঘাতি হতে পারে এরই নতুন এক মহড়া দেখব।
একটা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের লক্ষ্যে কাজ করতে চাওয়া কোন নির্বাচনের লড়াই নয়। এ লড়াই বরং অন্যকেও প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য হওয়ার লড়াই। পরস্পরের ভিন্ন স্বার্থ-বিবাদ সে তো আছেই, সমাজে আজীবন সবাই যার যারটা আদায়ের চেষ্টা করবে। কিন্তু একইসাথে যার যার লড়াই লড়তে গেলে একটা সর্বজনীন পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে তা করা সম্ভব। আমাদের জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ স্বার্থ, বিরোধ, দ্বিধা-বিভক্তি যেমন আছে তেমনি সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর একাট্টা গোষ্ঠীগত সার্বিক স্বার্থও আছে; যাতে ঐক্যমতের ভিত্তিটাই রাষ্ট্র। এটাই সেই পাটাতন যার উপর দাঁড়িয়ে আমরা অভ্যন্তরীণ স্বার্থ বিরোধ বিভক্তির নিরসনে লড়াই করব। কিন্তু এই সাধারণ পাটাতন--একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটা বেশি দরকার বাইরের স্বার্থের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা, নিরাপদ রাখা।
হাসিনা সামরিক শাসনে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান বলে আমাদের জানাচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই হাসিনা এটা সত্যিকরে বলছেন। এখন আমাদের দেখা দু’দুটি সামরিক শাসন আর একটা তত্ত্বাবধায়কের আড়ালে সামরিক শাসন-- এগুলোর মানে কি? এটাই তো সেই বাইরের স্বার্থের শাসন, আমাদের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর সাধারণ স্বার্থের বিরুদ্ধে বাইরের স্বার্থ চেপে বসা, ক্ষমতা দখল। আবার বাইরের স্বার্থে সামরিক শাসন বলছি বলে ওটা কেবল উর্দিপরা লোকের কাজ বলে ভেবে বসার কোন কারণ নাই; খন্দকার মোস্তাক অথবা ফখরুদ্দিন উর্দিপরা কেউ ছিলেন না। পোষাক সিভিল হোক বা উর্দি হোক কিছু যায় আসে না তাতে। এমনকি এক্ষেত্রে শাড়িও সিভিল পোষাকেরই অন্তর্গত হতে দেখেছি আমরা। তবে সবক্ষেত্রেই উর্দির সমর্থন সাধারণভাবে জড়ো থাকতে দেখেছি।
কাজেই পোষাকের চেয়ে ওটা বাইরের স্বার্থের শাসন--এই দিকটা গুরুত্ত্বপূর্ণ। বরং এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাইরের স্বার্থের শাসন, ক্ষমতা দখলের একমাত্র প্রতিরোধক হতে পারে একটা শক্তরাষ্ট্র। জনগোষ্ঠীর সব অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটা সাধারণ ঐক্যমতের ভিত্তি তৈরি করে সেই ভিত্তির উপর দাঁড়ানো রাষ্ট্র। জনগোষ্ঠীর সব অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে একটা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র। জনগোষ্ঠীর নিজেদের ভিতরকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ, প্রতিযোগিতাকে এক রাষ্ট্রের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে ধারণ করার মত রাখতে একটা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র। বাইরের স্বার্থের বিরুদ্ধে শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইলে সামরিক বলের চেয়ে এটাই বড় রক্ষাকবচ।
আমাদের ভিতরে অভ্যন্তরীণভাবে পাহাড়ী-সমতলী বিরোধ আছে, ইসলামী-সেকুলারিস্ট বিরোধ আছে, দলবাজীর বিরোধ আছে যার কোনটাকেই মুখ্য বিরোধ হতে দেয়া যাবে না। এটা তখনই সম্ভব হবে, অপরাপর বিরোধগুলো অভ্যন্তরীণ ও গৌণ করে রাখা যাবে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সাধারণ স্বার্থে, জনগোষ্ঠীর সব অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এমন একটা গঠনতন্ত্রের কথা আমরা ভাবতে পারব। এই প্রয়োজনগুলো আমরা উপলব্দি করতে পারলে এর ভিত্তিতে আমাদের ভিতর এক সামাজিক ঐক্য তৈরি করবে যার একটা গণতান্ত্রিক, ন্যায়বিচার বা ইনসাফ ভিত্তিক বৈশিষ্ট্য গঠনতন্ত্রে প্রতিফলিত হবে।
দেখা যাচ্ছে দলবাজী নয়, সংকীর্ণতা নয় বরং জনগোষ্ঠীর সব অংশের প্রতিনিধিত্ব, একটা ঐকমত্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেখানে এক মাত্রাছাড়ানো আত্মবিশ্বাস, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যা খুশি করার দম্ভে নিমজ্জিত আওয়ামী লীগকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এসব প্রয়োজনীয় দিকগুলোর তুলনায় অতি সামান্য একটা ‘সর্বদলীয়’কমিটি করার কথা বলেও বিরোধীদল বলতে একমাত্র বিএনপিকেও না নিলে যেন আওয়ামী লীগের কিছু আসে যায় না। নিজের সিদ্ধান্তে তারা এমনই থোড়াই কেয়ার করি ভাব প্রকাশ করছে। এমনকি ‘সর্বদলীয়’ কমিটি হবে বলে আগে ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও কেন এককভাবে মহাজোট দলীয় কমিটি ঘোষণা দেয়া হলো এর কোন ব্যাখ্যা ঐদিনের ঘোষণার সাথে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে নাই।
অবশ্য পরিণতি দেখার জন্য আমাদেরকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় নাই। আওয়ামী লীগের এই মাত্রাছাড়ানো আত্মবিশ্বাসী রূপ একদিনের বেশি থাকেনি। পরের দিন ২৩ জুলাই কমিটির যুগ্ম-চেয়ারম্যান সাজেদা চৌধুরী জানাচ্ছেন,“কমিটিতে বিএনপির অন্তর্ভুক্তির রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়নি। তাদের কাছ থেকে কারও নাম প্রস্তাব করা হলে তা সংসদে উপস্থাপন করে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব”।
পরে ২৫ জুলাই ডেইলি স্টার জানাচ্ছে:
The special committee will invite the nominated BNP lawmaker to attend the meetings of the committee and it has the power to issue such invitations," Wares Hossain, Sajeda's public relations officer, told The Daily Star.
"In consultation with the prime minister, if necessary, a special session of the Jatiya Sangsad can also be called to reconstitute the special committee and incorporate the opposition lawmaker," said Wares Hossain quoting Sajeda.
অর্থাৎ দরকার হলে সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহবান করে নতুন করে প্রস্তাব এনে বিরোধী দলের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হবে – কো-চেয়ার সাজেদা চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন তাঁর জনসংযোগ কর্মকর্তা ওয়ারেস হোসেন।
সমাজে ঐক্যমত তৈরির কাজ থেকে হাসিনা আপাতত বহু বহু দূরে। বরং দেখা যাচ্ছে, সবকিছু ঘোট পাকিয়ে এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সাথে নেয়ার জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার জন্য আওয়ামী লীগ ও তিনি মরিয়া হয়ে গেছেন। কিন্তু এখন বিএনপি দূরের কথা পুরা সমাজে যে অনাস্থা অবিশ্বাস এতে জন্ম নিয়েছে, সেটা ঘুচানোরও চিন্তা নাই। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, কনস্টিটিউশন সংশোধন করতে চান বলে আসলে কি করতে চান, এর কাজটাই বা আসলে কি – এটা হয় হাসিনা ওয়াজেদ কিছুই বুঝেন না বা বুঝতে অক্ষম অথবা বিপদজনক কোন এক দলবাজীতে নেমেছেন।
কথায় বলে, ছুড়ে দেয়া ঢিল ফেরত আনা যায় না। সাজেদা বা হাসিনার এখন কিছুই করার নাই, কারণ ঢিল ছোড়া হয়ে গেছে। অতএব এখন ফেলা থুতু চেটে নেবার ঘটনা ঘটানো ছাড়া আর কোন উপায় নাই। ক্ষমতার দম্ভে, হাসিনা কি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন যেন সেই হুশ হারিয়ে ফেলেছে। কনস্টিটিউশন সংশোধনের কাজ, এই প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মাজেজা কি, কতদূর তা যেতে পারে এর কোন ধারণাই তাঁর নাই; এতই নাদান হিশাবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাহী আদেশে দুর্নীতির অভিযোগে আটক অবস্থায় জেলমুক্তি যোগাড় করা ও পরে সোজা ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরে বসে ক্ষমতা হাসিলের আপোষনামায় ক্ষমতাসীন হবার মতই যেন একটা সহজ কাজ, কনষ্টিটিউশন ইচ্ছামত সংশোধন করে নেয়া। মুখে তিনি সামরিক শাসকদের সমালোচনা করছেন, বলছেন সামরিক শাসকদের সামরিক আইনের নামে ক্ষমতা দখল ঠেকাতেই না কি তাঁর এই সংশোধন প্রয়াস। অথচ কারবারের পদ্ধতিগত দিক থেকে সামরিক শাসকদের কাছ থেকে ধীরস্থিরতাও তিনি শিখে নেননি; সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপট তাঁকে ক্ষমতাদম্ভে এতই মাতোয়ারা ও লোভী বানিয়ে ছেড়েছে। হাসিনার ধারণা হয়েছে, কনস্টিটিউশন সংশোধনের কাজ আমাদের দলবাজীর সংসদে একটা আইন পাস করিয়ে নেয়ার মতই রুটিন কাজ।
সাজেদা চৌধুরীর এই এক পা আগে দুই পা পিছে পদক্ষেপের ঘটনায় আর একটা জিনিষ স্পষ্ট হয়েছে। সংসদে আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইনত কনস্টিটিউশনকে ইচ্ছামত কায়দা-পদ্ধতিতে স্বৈর আকার দেবার ক্ষমতা আছে বটে –কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। ক্ষমতার খেলায় দরকষাকষিতে যেনতেনভাবে একটা রাষ্ট্রক্ষমতা যোগাড় করে আসীন হয়ে বসা খুবই সহজ কাজ হতে পারে। কিন্তু সে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাকে জনগণের দৃষ্টি ও আস্থাতে অভিষিক্ত করে নিতে সক্ষম হতে পারা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় এবং সর্বোপরি তা কঠিন ও আসল পরীক্ষার অধ্যায়। সংসদে আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকাটাকেই হাসিনা তাঁর সব ক্ষমতা বলে বুঝেছেন, ক্ষমতার অভিষেক বলেও যে আসল অধ্যায় আছে এটা তাঁর জানা আছে মনে হয় না। এজন্য তিনি সহজেই এদিকটা উপেক্ষা করতে গিয়েছেন এবং ফলাফলে এখন তাকে ফেলা থুতু চাটতে যেতে হচ্ছে। ক্ষমতা ও কনস্টিটিউশন সম্পর্কে কোন সম্যক ধারণা না থাকায় কনস্টিটিউশন সংশোধনের খায়েসের প্রথম অধ্যায়ে একারণে ধাক্কা খেয়েছেন। এই ধাক্কায় স্বভাবতই দুর্দমনীয় মাত্রাছাড়ানো তাঁর আত্মবিশ্বাস চিড় ধরে মুখ থুবড়ে পড়বে। এই পিছু হঠার কিছু বাস্তব কারণ আমরা খুঁজে পাব, কমিটি ঘোষণার পর ঐ ২৪ ঘন্টার মধ্যে ও পরবর্তীতে সমাজের লক্ষ্যণীয় প্রতিক্রিয়াগুলো কী ঘটেছে সেদিকে তাকালে।
অনেকের মত আওয়ামী লীগ বা সে অর্থে হাসিনা মনে করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন জনগোষ্ঠীগত স্বার্থ বলতে কিছু নাই। আছে দুই দলবাজ-- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংকীর্ণ দলবাজী রাজনীতি। জাতীয় স্বার্থ বললে যেভাবে বুঝি সে অর্থে আমাদের রাষ্ট্রের স্বার্থ বলে কিছুই নাই। ফলে হয় এ’দল নাহলে সে দল। এর বাইরে গণস্বার্থ, জনগণের স্বার্থ বলতে কিছু যেন বা নাই। এখন আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংসদে অতএব “সে দল” বিএনপি বাদ, আছে কেবল এ’দল আওয়ামী লীগ; তবু আসলে ঠিক তাও নয়, ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে আছে সর্বেসর্বা শেখ হাসিনা, এক এবং অদ্বিতীয়।
এছাড়া মিথ্যা-আশ্বাসে আওয়ামী লীগ নিজের কাছে যেভাবে বুঝ-ব্যাখ্যা দেয়, “জামাতকে আশ্রয় দেয়া” বিএনপিকে কমিটিতে না রাখলেও সমাজে কোন প্রতিক্রিয়া হবে না, বরং বিএনপিই একঘরে হয়ে যাবে। আর বিএনপি ছাড়া সংসদে বিরোধীদল বলতে আর কি বা আছে! এছাড়া সর্বোপরি, তারা দুই দলবাজ ছাড়া সমাজে আর কে আছে! ফলে মহাজোটের একক একটা কমিটি করে সহজেই পার পাওয়া সম্ভব।
আওয়ামী লীগের এ সমস্ত ধারণাগুলো চ্যালেঞ্জ হয়েছে। হাসিনার “ ’৭২ এর কনস্টিটিউশনে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে কনস্টিটিউশন সংশোধনের” প্রস্তাবনা ও উপস্থাপনা আজ কোন কিছুতে প্রত্যাবর্তন দূরে থাকুক সমাজের নতুন আকাঙ্ক্ষা, জনগণের সব অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যেটাকে জনমত বা national consensus বলা হচ্ছে –এই ভিত্তিতে সংশোধনের কথা উঠে গেছে; যে মৌলিক প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম শুরুতে। ওদিকে কেউ কেউ আরও বলছেন, আগামী ৫০ বছরের উপযোগী করে এক গঠনতন্ত্র চান।
হাসিনা ক্ষমতা ও কনস্টিটিউশন সম্পর্কে কোন সম্যক ধারণা রাখেন না। ক্ষমতা বলতে তিনি ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরে বসে ক্ষমতাসীন হবার আপোষরফা বা ডিল বুঝেন। আর সেই হাসিল করা ক্ষমতায় অর্জিত সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে কনস্টিটিউশনকে যেমন খুশি স্বৈর আকার দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন। মাত্র গত এক সপ্তাহেরও কম সময়ে এই খায়েশ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অবস্থা এমন হয়ে উঠছে যে কনস্টিটিউশন সংশোধনের কথা তুলে হাসিনা যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলেছেন তা আবার ঠিকঠাক বন্ধ করার তৌফিক হাসিলের ব্যক্তিটি সম্ভবত কেউই হবেন না। ড. কামাল হোসেন ঐ একই দিনে চট্টগ্রামের এক সভায় কনস্টিটিউশনকে তাঁর ভাষায় sacred document বা “পুতপবিত্র দলিল” বলেছেন। তাঁর এই “পুতপবিত্র দলিল” খানার অপমৃত্যু ঘটার শুরুর প্রক্রিয়াটা এখান থেকেই হবে বলে মনে হচ্ছে। সুপ্ত হিমবাহের কেবল উপরে ভেসে উঠা ছোট্ট চূড়াকেই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
কনস্টিটিউশন সংশোধন নিয়ে গত ২৪ জুলাই দৈনিক যুগান্তর এক গোলটেবিল আলোচনা আয়োজন করেছিল। সেখানে ব্যারিস্টার রফিকুল হক এক হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। বলছেন,“তাড়াহুড়া করে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করলে তার ফল ভালো হবে না। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংশোধন করা হলে ভবিষ্যতে ওই বিশেষ ব্যক্তি বা দলকেই এ ধরনের সংশোধনের বিরূপ ফল ভোগ করতে হবে। সংবিধান নিয়ে খেলতে গেলে, যারাই খেলবেন, তারাই ভবিষ্যতে ‘ভিকটিম’ হবেন।”
কথাগুলো রফিকুল হক বলেছেন বলেই তা সত্য এবং গুরুত্ত্বপূর্ণ তা নয়। যার সারকথা হলো, বিশেষ ব্যক্তি বা দলের স্বার্থের কথা ভেবে কনস্টিটিউশন সংশোধন হলে বা কনস্টিটিউশনে নতুন কোন অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করলে এরপর, আজ বাদে কাল সেই ব্যক্তি বা দল ক্ষমতাচ্যুত হলে সেই সংশোধনী বা নতুন যুক্ত অনুচ্ছেদ সংশোধনকারীর বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে। একথা খেয়াল রেখেই কনস্টিটিউশন প্রণেতাদের অবজেক্টিভ বা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গীর হতে হয়। বুদ্ধিমানেরা তাই, প্রণীত অনুচ্ছেদ ব্যক্তি বিশেষ না যে কোন ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য হতে পারে একথা মনে রেখে কাজ করে। রিমান্ডের নামে নির্যাতন, নিজের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দেয়া, জবানবন্দী দিতে বাধ্য করা, যা খুশি বলিয়ে নেয়া, ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যা ইত্যাদির পক্ষে যা কিছু বেআইনি “আইনি আচ্ছাদন” আজ ব্যবহৃত হচ্ছে তা একদিন আওয়ামী লীগ হাসিনা সাজেদা সাহারা টুকু ... এদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। কনস্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনীতে বাকশাল অন্তর্ভুক্ত করে সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে অর্থাৎ শেখ মুজিবের হাতে কুক্ষিগত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান কনস্টিটিউশনে প্রদত্ত একই ক্ষমতা নির্বিরোধে ব্যবহার করে গেছেন আর আওয়ামী লীগ জিয়াকে স্বৈরশাসক বলে নাকিকান্নার মাতম তুলেছে।
কাজেই শেখ হাসিনার যে সংখ্যাগরিষ্ঠার দম্ভ, ধরাকে সরা জ্ঞান করা এবং একমাত্র এর উপর ভরসা করে কনস্টিটিউশন সংশোধনীতে হাত দিচ্ছেন যা খুশি তাই ভাবে সেটা করে নিতে পারবেন মনে করছেন –এটা রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন ধারণার সাথে মৌলিকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে এবং আওয়ামী জন্য এটা বুমেরাং হতে বাধ্য।
লোকবাছাই:
হাসিনা কনস্টিটিউশন সংশোধনের কাজটাকে কেমন গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছেন এর কিছু ধারণা পাওয়া যায় গঠিত সংসদীয় কমিটির সদস্যদের নাম অর্থাৎ কাদের নিয়ে তিনি গঠন করেছেন সেদিকে তাকালে। আমাদের সমাজের একটা দাপুটে তবে মিথ্যা ধারণা হলো কনস্টিটিউশন কেবল উকিল-ব্যারিস্টার-মোক্তারদের মুসাবিদার বিষয়। তবু সেদিক থেকেই বিচারে, সুরঞ্জিত বাদে কমিটিতে আইনশাস্ত্রীয় ন্যূনতম দখল আছে এমন সংসদ সদস্য নেয়া হয়েছে ১৫ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন। আর মূলত এই কমিটিকে মনে করা হয়েছে একটা আস্তাকুড়। রেটস খ্যাত যারা ১/১১ এর আমলে হাসিনাকে বাদ দিয়ে একটা আওয়ামী লীগ বানাতে চেয়েছিল তাদেরকেই হাসিনা আসলে এখানে এনে ফেলেছেন। আবার কর্তৃত্বের রশি যাতে আলগা না হয়ে যায় তা ঠিক রাখতে অনুমান করি কো-চেয়ারের আইডিয়াটা এসেছে।
সারকথায়, কমিটির সদস্যরা এখানে প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে কতটুকু কি ভূমিকা রাখবেন, রাখতে পারবেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কমিটি নেহায়েতই হাসিনার সম্মতিতে অনুমোদনের ছাপ লাগানোর জন্য একটা সংসদীয় হাতিয়ার মাত্র।
পরবর্তী পর্ব: কনস্টিটিউশন সংশোধন করে সামরিক ক্ষমতা দখল বা অন্য কোন ক্ষমতা দখল ঠেকানো কি সম্ভব?
ফিদা হাসান। ২৮ জুলাই ২০১০। ই-মেইল: fidaehasan@gmail.com
Available tags : সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্রক্ষমতা, গঠনতন্ত্র