ইনসাফ ও নাগরিকের মর্যাদা

অবমাননার অপরাধে একজন সম্পাদক ও প্রতিবেদক দণ্ডবিধিতে বর্ণিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ ও কারাদণ্ড ভোগ করছেন। শুধু তাই না, আরো গুরুতর বিষয় এ মামলা চলাকালে সামনে চলে এসেছে। আদালত সংবাদপত্রের ভূমিকাকে বস্তুনিষ্ঠ এবং অনুসন্ধানমূলক তথ্য নির্ভর সংবাদ প্রকাশের প্রচলিত রীতি ও গৃহীত মানদণ্ডকে প্রশ্নবোধক করে তুলেছেন। আদালত অবমাননার অভিযোগের বিপরীতে সংবাদপত্র নিজের পক্ষে বলতে পারবে না যে, আমরা সত্য প্রকাশ করেছি? সত্য প্রকাশ কি করে আদালত অবমাননা হয়? কিন্তু একমাত্র বিচারকরাই বিচার করবেন আদালত অবমাননা হয়েছে কিনা। ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স। সত্য প্রকাশ সংবাদপত্রের রক্ষাকবচ না। কিন্তু বিচারকদের দুর্নীতি যদি সত্য হয় তখন কি হবে? কোন রায়, বিচার প্রক্রিয়া বা বিচারকদের ভূমিকা যদি সংবিধান, ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ বিরোধী হয় তখন কি হবে? একজন ব্যক্তি-বিচারকের সিদ্ধান্ত যদি নাগরিকদের পুলিশি নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেয় তখন? বিচারকদের প্রকারান্তরে নাগরিকদের নজর থেকে এর ফলে আড়াল করবার জন্যই কি বলা হয় ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স? কিন্তু ব্যক্তি বিচারক আর প্রতিষ্ঠান হিশাবে আদালত তো সমার্থক না। কোন লেখায় আদালতের ভাবমূর্তি, জনগণের আস্থা ও কর্তৃত্বের প্রতি বিরূপ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে কি না সেই দিক তবু বিচারকরাই বিচার করবে। যা দাঁড়াবে তা হল, আদালত নিজের সম্পর্কে সমাজে যে আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখতে চায় তারই চর্চা। একটি প্রতিবেদন কতটুকু তা রক্ষা করেছে তার বিচার। নিজস্ব কার্যক্রম, প্রক্রিয়া বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আদালত নাগরিকদের কাছে দৃঢ়ভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোন গুরুতর বরখেলাফ হচ্ছে কি না আদালত মাহমুদুর রহমানের মামলায় আমলে নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। আদালতের সুনাম ও আস্থা কোন কাজে রক্ষিত হবে আর কোন কাজে গুরুতরভাবে তার ক্ষয় হচ্ছে সেসব বিষয় অনুসন্ধানী সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে তুলে ধরা কি নাগরিক কর্তব্য না?

অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করছে, স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে সেই প্রসঙ্গ কি তুলে ধরা যাবে না? সেই কর্মকাণ্ডে কি আদালতের কর্তৃত্ব, কার্যক্রম বিরূপ হুমকির মুখে পড়ে নাই? যা ন্যায়বিচারের পরিস্কার প্রতিবন্ধকতার বাস্তব নজির আকারে আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে; তাকে কিন্তু আপিল বিভাগ অবমাননা আকারে সাব্যস্ত তো দূরের কথা আমলেই নেয় নাই। অন্তত বিচার চলাকালে আমরা সেরকম কোন লক্ষণ দেখি নাই। এই যে অবমাননার অভিযোগে শুধু এক পক্ষের বিচার এবং দণ্ড এটা জনগণের চোখে আদালতের কোন মূর্তি উজ্জ্বল করবে! আমরা এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের রণমূর্তি দেখতে পেয়েছি। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘এরকম একটা শাস্তির খুউব-ই দরকার ছিল’। অথচ পরিহাস, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত ও বাধাগ্রস্ত করা যদি আদালত অবমাননা হয়ে থাকে। শাস্তি হবার কথা তার এবং তার সহকর্মীদের। তবে শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পুরা বিচার ব্যবস্থার বারটা বাজিয়ে তুলতে তৎপর যে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, তাদেরই কিছু হল না। উল্টা যেভাবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, তাতে তো মনে হয় তারা এখন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আদালতকে ব্যবহার করবার ফ্রি লাইসেন্স প্রাপ্ত বলে ভাবছেন। এটা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে অচিরেই সমাজ ও রাষ্ট্রের গাঁথুনি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

সম্পাদক মাহমুদুর রহমান হয়ত সে কথাই বলতে চেয়েছেন। সেকারণে প্রচলিত রীতির বাইরে দাঁড়িয়ে অভিযোগের জবাবে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। নিঃশর্ত মাফ চাওয়ার রেওয়াজে নিরাপদ থাকার চেষ্ঠায় তিনি সত্যের-শক্তিকে নষ্ট করতে চান নাই। তিনি ভেবেছিলেন সত্যের জয় হবে, নিদেনপক্ষে স্বীকৃত হবে। তাঁ হয়ত ভরসা ছিল, কোন পাবলিক অফিসের পদে যারাই আসীন থাকেন তাদের শপথের প্রথম কথাগুলা--‘কারও প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে’ কোন কাজ বা সিদ্ধান্ত না নিতে তারা বদ্ধপরিকর থাকেন। সেটা তারা করবেন না। কারও রাগ বা বিরাগের বশবর্তী হবেন না। কিন্তু মামলা চলাকালে দেখা গেল তার প্রতি অশ্রদ্ধা ও তাচ্ছিল্যের প্রকাশ। তিনি সরাসরি ব্যক্তিগত আক্রমণেরই শিকার হলেন। অপমান এবং মানসিক পীড়নে এজলাসেই অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। শপথ বাক্যের সুরক্ষা মাহমুদুর রহমানের জন্য কোন কাজে আসে নাই।

বিচারকের এজলাসে বসে আপিল বিভাগ ক্ষোভ মিটিয়েছেন। মাহমুদুর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলেন, তার সাংবাদিকতায় পেশাদার ডিগ্রি আছে কিনা অথবা রিপোর্টার অথবা সাব-এডিটর হিশাবে কোন অভিজ্ঞতা তার আছে কি না? মাহমুদ না সূচক জবাব দিলে কোর্ট সম্পূর্ণ তাচ্ছিল্যভরে বিদ্বেষমূলক এক মন্তব্য করে বলেন You are an editor by chance, বাংলা করলে অর্থটা এরকম হয়--আপনি তো আসলে সম্পাদক নন। ফাঁকতালে সম্পাদকের পদ বাগিয়েছেন।

আপিল বেঞ্চ বা বিচারক কিন্তু কোন ঘটনা বা ফ্যাক্টস বিচারের নিরিখ কি হবে এটা নিজে ঠিক করেন না। নিজ জ্ঞানবুদ্ধি বা সমাজে চালু ধারণায় প্রভাবিত হয়ে ইচ্ছামত একটা বিচার পদ্ধতি তিনি বেছে নিতে পারেন না।

প্রথমত, কোন বাণিজ্যিক সংবাদপত্রের সম্পাদক হতে চাইলে, অনুমোদন পেতে চাইলে তার পূর্ব যোগ্যতা কি থাকতে হবে ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট আইন--আবার বলছি, আইন তৈরি ও জারি রাখার এখতিয়ার বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বা আদালতের না। এই এখতিয়ার রাষ্ট্রের নির্বাহি বিভাগ (তথ্য, আইন, স্বরাষ্ট্র ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ের) ও সেইসাথে জাতীয় সংসদের; সংবিধিবদ্ধ, আইন প্রণয়নের দায়িত্ব তাদের। এই আইনে সম্পাদক হবার যোগ্যতা যেভাবে নির্ধারণ করা আছে সারা বিচার বিভাগ, আদালতসহ আমরা নাগরিকরা সকলে ঠিক সেই রূপে তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য। যদি কোন নাগরিক, এমনকি বিজ্ঞ বিচারকগণ (তবে ব্যক্তি নাগরিক অধিকার হিশাবে) মনে করেন, এই আইন কনস্টিটিউশনের পরিপন্থী। তবে তিনি আদালতের কাছে তুলে দেখতে পারেন, নালিশ জানাতে পারেন। রাষ্ট্রের আইনে এখনো পর্যন্ত সম্পাদক হবার জন্য পূর্ব যোগ্যতা হিশাবে, সাংবাদিকতায় পেশাদার ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা অথবা রিপোর্টার অথবা সাব-এডিটরের কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকার কোন শর্তের কথা নাই। কাজেই রাষ্ট্রের আইনে এখনো পর্যন্ত যা লেখা আছে--বিচারকদের ব্যক্তিগত ভিন্ন ধারণা সত্ত্বেও তাই মেনে বিচারকদের এজলাসে বসে কথা বলতে হবে। এডিটর হবার যোগ্যতা বিচারের মাপকাঠি বিচারকের মনের ইচ্ছা মাফিক হতে পারে না, এটা তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত। এটা হতেই পারে মাহমুদুর রহমানের চেহারা, তার পত্রিকা, তার সম্পাদনা, তার পত্রিকার অবস্থান ব্যক্তিগতভাবে বেঞ্চের কারও অপছন্দ। কিন্তু এটা আদালতের এজলাসে আসার বিষয় না। বিচারকদের ব্যক্তিগত অবস্থান সরিয়ে রেখে এসে এজলাসে বসতে হয়। এজলাসের অর্থ এজলাসকে লালসালু আর কাঠের পার্টিশান দিয়ে ঘিরে দিলে বা পেশকারের টুপি আচকানের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয় না, এটা আমরা জানি।

কাজেই এটা পরিস্কার যে, আপিল বেঞ্চ সম্পাদকের যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে, ণড়ঁ ধৎব ধহ বফরঃড়ৎ নু পযধহপব জাতীয় কটু মন্তব্যে খোঁটা দিয়ে প্রমাণ রেখেছেন--আগে থেকেই ঘৃণা ও বিদ্বেষভাবাপন্ন মনে (প্রেজুডিস মাইন্ড) এই বিচার করতে বসেছিলেন। এজলাস থেকে নাগরিকরা কি এরকম ব্যবহারের মুখোমুখি হবে? যদি হয় তবে তা ইনসাফ প্রাপ্তির মৌলিক ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দেবে। সেটা কি আদৌ কোন বিচার হবে?

সম্পাদক হবার নীতিমালায় পূর্বযোগ্যতা থাক বা না থাকুক আমার দেশের বিরুদ্ধে সরকারের হয়রানি ও হামলা-মামলা শুরুর পর থেকে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার তরফে বলা শুরু হয় যে, মাহমুদুর রহমানের সম্পাদক হবার যোগ্যতা নাই। মোজাম্মেল বাবু বিডিনিউজ২৪-এ মন্তব্য লিখে আমাদের সে কথা জানান। যদিও সেখানে যোগ্যতা নাই বলে তিনি কেন মনে করেন, সে কথা তিনি আমাদের জানান নাই। মজার কথা হল, বাবু একাডেমিকভাবে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং পাশ করে বের হবার পর শৈলী (অধুনালুপ্ত) নামের এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ওই পত্রিকার সম্পাদক হবার যোগ্যতা তিনি নিজে কি নির্ধারণ করেছিলেন আমরা জানি না। এছাড়া এ অঞ্চলের ইতিহাস ও রাজনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা মৌলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম বা মানিক মিঞার মত বরেণ্য সম্পাদকরাও এই বিচারে ফাঁকতালের সম্পাদক হয়ে যান। তালিকা আর না বাড়ালেও চলবে।

বাদী নিজেই বিচারক

এই মামলার বাদী বা অভিযোগ দায়েরকারী কে? সুপ্রীম কোর্টের দুই আইনজীবী রিয়াজুদ্দিন খান ও মইনুল হাসান গত দোসরা মে ২০১০ কোর্টে পিটিশন দায়ের করেছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। এটা এমন এক মামলা যার বাদী হিশাবে দুজন আইনজীবী খাড়া করা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বিচার্য বিষয়টা এমনই যে, কার্যত আদালত নিজেই বাদী। কারণ বিচার চলছিল খোদ আদালতের অবমাননা হয়েছে কি হয় নাই তাই নিয়ে। কিন্তু আদালত নিজেই যে বাদী নয় বিচারক মাত্র, এরকম কোন ফারাকের ভাব বজায় রাখার চেষ্টা স্পষ্ট দেখা যায় নাই। বরং আদালতে প্রশ্ন করার ধরন, ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ ইত্যাদি দেখে মনে হয়েছে এরকম কোন ইচ্ছা আদালতের ছিল না। যেন আদালত বিচারের রায় কি দেবেন সেটা আগেই সাব্যস্ত করে প্রেজুডিস নিয়ে বিচারে বসেছেন। মাহমুদুর রহমান তার বক্তব্যে প্রশ্নের উত্তরে নিজেকে ডিফেন্ড কিভাবে করেন, আদৌ করতে সক্ষম হন কিনা সেটা দেখতেও ইচ্ছুক ছিলেন না। মাফ না চেয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনই খোদ আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে বলে মন্তব্য করে বসে আদালত। সেটা অবশ্য একটা খাঁটি প্রশ্ন। কারণ আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারব না কিসে আসলে বাংলাদেশে আদালত অবমাননা হয়। কি করলে বা না করলে অবমাননার অভিযোগ আসবে সেটা যখন আইনের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয় তখন এ বিষয়ে কথা বলাই তো বিপদজনক। মাহমুদুর রহমান শুধু ঝুঁকি নয়, অনির্ধারিত খড়গের নিচে মাথা পেতে বসেছেন। এখন দেখার বিষয় তার ধড় থেকে মাথা আলগা হয়ে যায় নাকি এই খোলা তলোয়ার কোন একটা খাপে পোরার ব্যবস্থা আদালত স্ব-উদ্যোগে নেয়, যাতে বাক, ব্যক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে নাগরিকরা প্রাণ ধারণ করতে পারে।

কনস্টিটিউশনের ১০৮ অনুচ্ছেদঃ ‘আইনি বিধিবিধান সাপেক্ষে’

Supreme Court as court of record The Supreme Court shall be a court of record and shall have all the powers of such a court including the power subject to law to make an order for the investigation of or punishment for any contempt of itself. আদালত দাবি করছে কনস্টিটিউশনের ১০৮ অনুচ্ছেদের এখতিয়ার ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই বিচার কাজ ও রায় দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। খুবই ভাল কথা। কিন্তু আদালতের এই এখতিয়ার প্রয়োগ হতে হবে ‘আইন সাপেক্ষে’; আদালতের ইচ্ছামাফিক না (হাইলাইট অংশ লক্ষ করুন)। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আদালত অবমাননার মামলা পরিচালনা করার মত ১৯২৬ সালের ঔপনিবেশিক আইনটি ছাড়া কোন আইন রাষ্ট্রের নাই। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আমলে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা আদালতের আদেশেই বাতিল করা হয়েছে। এটাই হল বাস্তবতা। তাহলে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রণীত কোন ‘আইনের সাপেক্ষে’ আদালত কনস্টিটিউশনের ১০৮ অনুচ্ছেদের এখতিয়ার ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই বিচার করলেন? তদুপরি, যে দণ্ড দেওয়া হয়েছে সেটা শুধু বিস্ময়করই নয় প্রচলিত চর্চা ও নজিরের বিরোধী। এখানে এখতিয়ার, অপরাধের প্রকৃতি, সংজ্ঞা, শাস্তির পরিমাণ এবং সীমা সবকিছুকেই একাকার করে ফেলা হয়েছে। অপরাধ আমলে নিয়ে বিচার করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই যেমন ইচ্ছা তেমন শাস্তি দানের কর্তৃত্বের সমার্থক না। হতে পারে না। তা হলে একদিকে কার্যত আপিল বিভাগের সামনে দণ্ডবিধি অকার্যকর হয়ে যায়। দুই. আগে থেকেই অপরাধের শাস্তি জানা নাগরিকদের পক্ষে আর কোনও ভাবেই সম্ভব থাকে না। সভ্য পৃথিবীর কোন আইনশাস্ত্রে এটা গ্রহণযোগ্য কিনা সেটা আমাদের জানা নাই।

অপর্যাপ্ত আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যে রায় ও এর বাস্তবায়ন তার প্রতিকার কি?

ওপরে যেসব আইনি মারাত্মক ব্যত্যয়ের কথা এসেছে তাতে বিবাদী এখন কার কাছে গিয়ে প্রতিকার চাইবেন এমন কোন জায়গা আর অবশিষ্ট নাই। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর আপিল বিভাগ এবং সেই আপিল বিভাগের সব বিচারক মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বসিয়ে ‘আইনের সাপেক্ষে’ কথাটিকে এড়িয়ে এই বিচারে বসেছেন। এখানে হয় তারা এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, এই বিচারে কোন ত্রুটি হতেই পারে না, অথবা চেয়েছিলেন ত্রুটি থাকলেও আইনিভাবে যেন ত্রুটি সংশোধনের উপায় না থাকে। অন্তত একটা আপিলেরও সুযোগ মাহমুদুর রহমান পাবেন না তাকে নিশ্চিত করা। এটাকে বলা হয় দরজা জানালা বন্ধ করে বেধে পেটানো যাতে পালিয়েও বাঁচতে না পারে। বিচার ব্যবস্থা সূত্রপাতের মূল ভাবনা হল, সমাজের স্বার্থ বিরোধ চিরন্তন হয়ে আছে, থাকবে। অনেক পথ পেরিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রের শুরুতে সমাজের স্বার্থ বিরোধ নিরসনের উপায় নিয়ে প্রচুর ভাবতে হয়েছিল। ভাবা অপরিহার্য হয়ে ওঠার অনেক কারণ ছিল, তবে এর মূল তাগিদটা এসেছিল রাষ্ট্রের সীমানার ভেতর-বাহির বোধ থেকে। ভেতর-বাহিরের ভেতর মানে, যে জনগোষ্ঠীর সকলে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা পরস্পর বন্ধুভাবে একটা রাষ্ট্রে মিলিত হবে, নাগরিকগণ সকলে। আর বাহির হল যারা রাষ্ট্রের সদস্য নাগরিক না। কিন্তু অভ্যন্তরীণ এই বন্ধুভাব বজায় রাখতে গেলে কিছু পূর্বশর্ত পালনীয় আছে।

একটা সমাজে পরস্পর যেকোন দুই সদস্যের মধ্যে স্বার্থের বিরোধ থাকা যেমন অবশ্যম্ভাবী ভাবে সত্য, ঠিক সমভাবে ওদের দুজনসহ জনগোষ্ঠীর সকলের সীমানার বাইরের বিরুদ্ধে কিছু সাধারণ স্বার্থ থেকে আছে এটাও সমান সত্য। এই সাধারণ স্বার্থের ওপর ভর করেই রাষ্ট্র অটুট দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তবে এই সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিকে যদি শক্তিশালী মজবুত রাখতে হয় তবে প্রথম করণীয় হল সমাজে পরস্পর যে কোন দুই সদস্যের মধ্যে যে স্বার্থ বিরোধ আছে তা নিস্পত্তি-মীমাংসার সংঘর্ষহীন আপোষ রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া। এই আপোষ রাস্তার মূল কথা হল বি-চা-র। রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার, ইনসাফ কায়েম রাখা হল সেই পালনীয় পূর্বশর্ত কর্তব্য। একেই আমরা রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ নামে চিনি। পরস্পর বিরোধী স্বার্থের নাগরিকদেরকে নিয়ে তাদের আবার সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে রাষ্ট্র খাড়া করতে চাইলে এর গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হচ্ছে ন্যায়বিচার, ইনসাফের ভিত্তিতে একটা বিচার ব্যবস্থা কায়েম। তবেই সম-নাগরিকদের বন্ধুভাব আসার বাস্তব শর্ত পূরণ করা হবে।

তাই বিচার ব্যবস্থা সূত্রপাতের মূল ভাবনা হল, সমাজের স্বার্থ বিরোধ চিরন্তন হয়ে আছে, থাকবে। তবে সংঘাত সংঘর্ষের পথে অস্ত্র হাতে নিস্পত্তি না, বি-চা-র এর পথে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যুক্তি পদ্ধতি মেনে চলে আমরা যেন বিরোধের সুরাহা সমাধান বা নিস্পত্তির পথ খুঁজে নিতে পারি। দেখা যাচ্ছে আমাদের আপিল বিভাগ খোদ আদালতের এজলাসকেই বিচারের বদলে বিরোধ সংঘাতে ঘৃণা বিদ্বেষমূলক স্থান হিশাবে রূপ দিচ্ছে।

বাংলাদেশের বিচারের ইতিহাসে আমরা এক অদ্ভূত বিচার দেখছি, যেখানে এক আপিল বিভাগই সবকিছু। নিজেই কার্যত বাদী, নিজেই বিচারক, নিজেই বিচার ও রায়ের ভিত্তি ও পদ্ধতির নির্ধারক, তাও আবার নিজেই আগাম না বলে, লিখিত না করে এজলাসে বসেই তাৎক্ষণিক খেয়ালে নির্ধারিত, নিজেই রায়ের সাজা কি হবে তারও নির্ধারক। আদালত অবমাননার সাজা কি হবে সেটাও কোথাও এখনো লেখা নাই, এজলাসে বসে নিজে নিজেই তাৎক্ষণিকভাবে খেয়ালে তা নির্ধারিত। দুনিয়ার যে কোন বিচার পদ্ধতির মৌলিক ও প্রাথমিক জায়গা থেকে একে বিচার বলে মানা অসম্ভব।

fidaehasan@gmail.com


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 11300 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD