আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের

বাংলাদেশের কোন শাসকের ক্ষমতার কনস্টিটিউশনাল ভিত্তি আছে কি নাই সেদিক থেকে না, শাসক হিশাবে তারা কেমন, গণতন্ত্রী কি না- তারই তুলনামূলক বিচারে আমরা অভ্যস্ত। তেমনই বিচার বসেছিল একটি দৈনিক পত্রিকায়। প্রথম আলোর গত ৯ সেপ্টেম্বরেরীক্টি সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমরা এই বিচারের আয়োজন দেখেছি। ‘কালের পুরাণ’ নামের নিয়মিত শিরোনামে ওই লেখা সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছে (আর ইন্টারনেট ভার্শনে www.prothom-alo.com/detail/date/2010-09-09/news/92932বলে ছাপা হয়েছে)। পত্রিকাটি নিজের চিন্তার বাইরের পর্যালোচনামূলক লেখা ছাপে না বললেই চলে, সেই দিক থেকে আমরা ধরে নিতে পারি ওই লেখা পত্রিকাটির সম্পাদকীয় মতামত থেকে আলাদা কিছু নয়। লেখক পত্রিকাটির নিজস্ব লেখকও বটে।আমরা যে বিষয় নিয় লিখতে বসেছি তাতে বিশেষ কোন পত্রিকা বা বিশেষ কোন লেখক গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেখা যায় শাসকের ক্ষমতার সাংবিধানিক ভিত্তিকে পর্যালোচনার বাইরে রেখে ব্যক্তি শাসকের চারিত্রিক গুনাবলী বা দোষ দিয়ে আমরা সামষ্টিক রাজনীতির বিচার করি। এ এক অদ্ভূত ধারা। এই ধারা নিয়েই আমরা কথা বলতে বসাছি।

যেমন লেখক দাবি করেছেন ‘একবার যে সামরিক শাসক, সে সব সময়ই সামরিক শাসক। জিয়া ও এরশাদ সেটাই প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতায় থাকতে তাঁরা গণতন্ত্রের জন্য যতই মায়াকান্না করুন না কেন, নিজেদের গণতন্ত্রী প্রমাণ করতে পারেননি। একজন মৃত্যুর ২৯ বছর এবং অপরজন ক্ষমতাচ্যুতির ২০ বছর পরও অবৈধ শাসক রয়ে গেলেন মাননীয় আদালতের বিচারে; এমনকি ইতিহাসের বিচারেও’। সোহরাবের এই বক্তব্য গুরুচন্ডালী দোষে ভরপুর। তিনি আসলে কি নিয়ে বিচারে বসেছেন? কোন শাসকের ক্ষমতার সাংবিধানিক (কনস্টিটিউশনাল) ভিত্তি আছে কি নাই সেটা, নাকি ‘সামরিক শাসক’ ও ‘গণতান্ত্রিক শাসকের’ শাসন গণতন্ত্রী কি না এর তুল্য বিচার? এ দুয়ের কোনটা আসলে তিনি করতে চাইছেন?

প্রথম বাক্যে বলছেন, ‘ক্ষমতায় থাকতে তাঁরা গণতন্ত্রের জন্য যতই মায়াকান্না করুন না কেন, নিজেদের গণতন্ত্রী প্রমাণ করতে পারেননি’। সামরিক শাসক জিয়া বা এরশাদ এরা দুজন গণতন্ত্রী কি না সেই সন্দেহ মোটেও অমূলক নয়, সেই বিচারে লেখকের বক্তব্য হয়ত গ্রহণ করা যায়। এই বক্তব্যকে ‘মোক্ষম’ মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু পরের সিদ্ধান্তমূলক বাক্যে বলা হচ্ছে, ‘একজন মৃত্যুর ২৯ বছর এবং অপরজন ক্ষমতাচ্যুতির ২০ বছর পরও অবৈধ শাসক রয়ে গেলেন মাননীয় আদালতের বিচারে; এমনকি ইতিহাসের বিচারেও’। এখানে আবার লেখক চলে গেলেন শাসকের শাসন ক্ষমতা বৈধ বা অবৈধ কি না, শাসকের ক্ষমতার সাংবিধানিক ভিত্তি আছে কি নাই, সেইসকল বিচারে। ভেবে দেখা হয়নি যে জিয়া বা এরশাদের শাসন কোনও ঘটনাচক্রে ‘গণতান্ত্রিক’ হয়ে গেলে কি ওই শাসন ক্ষমতার সাংবিধানিক ভিত্তি আছে বলে প্রমাণ হয়ে যেত? তাছাড়া গণতান্ত্রিক হওয়া না হওয়া না হওয়ার অর্থই বা কি? তাঁরা সামরিক বাহিনীর বলেই কি তাঁরা অগণতান্ত্রিক।

অথবা উল্টা করে বলি, কোন শাসন ক্ষমতার সাংবিধানিক ভিত্তি থাকলেই কি সেটা ‘গণতান্ত্রিক’ শাসন হয় বলে আমরা সিদ্ধান্তে আসব? খোদ সংবিধানটিইতো অগণতান্ত্রিক হতে পারে।। শাসকের ক্ষমতার সাংবিধানিক ভিত্তি আছে কি নাই আর শাসক ‘গণতন্ত্রী’--দুইটা আলাদা বিষয়। এমনকি একটার বিচার থেকে আসা সিদ্ধান্ত বা ফলাফল থেকে অপরটা সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কোন সুযোগ নাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার বৈধতা কিম্বা অবৈধতা না কি শাসনের ক্ষমতা গণতান্ত্রিক নাকি অগণতান্ত্রিক – ইত্যাদি অনু্সন্ধনের পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের হুঁশ থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ ভাবে আমাদের রাজনৈতিক হুঁশ নাই বললেই চলে। এমনকি লেখালিখির সময়েও নয়

সমাজে একটা জনপ্রিয় অথচ ফালতু ধারণা ছড়িয়ে আছে যে, ক্ষমতা ‘অসামরিক’ হলেই তা অপাপবিদ্ধ; কথিত সেই ‘অসামরিক” ক্ষমতা যদি সাংবিধানকে ফালা ফালা করে কেটে টুকরা করে পায়ে দলে, তারপরও কোনও দোষ নাই, বরং সেটা হালাল ও সুখকর! এ ফালতু ধারণাটির প্রবর্তকরা নিজেদের মনকে এ বুঝ দিতে পছন্দ করেন যে, এক এগার’র সামরিক ক্ষমতার ঔরসে যে অবৈধ ক্ষমতা কায়েম হয়েছিল, আদালতকে পাশ কাটিয়ে ওদেরই নির্বাহী ক্ষমতার দয়ায় শেখ হাসিনার জেলমুক্তি নেয়াও বৈধ। তারপর আমেরিকান লিভারেজ বা যাঁতাকাঠি ব্যবহার করা ইনডিয়ার হয়ে হাসিনার শাসন ক্ষমতাও হালাল। কারণ একটাই, হাসিনা অসামরিক। ফলে কথিত সামরিক বনাম বেসামরিক শাসন নামে প্রতারণাপূর্ণ একটা তুল্য বিচারের যে মানদণ্ড সমাজে জারি রাখা হয়েছে--এর ওপর দাঁড়িয়ে যে প্রচার তার উদ্দেশ্য হচ্ছে কথিত সামরিক বনাম বেসামরিক শাসন বলে ভাগ করে বিচারের যে ভুল অথচ জনপ্রিয় ধারণা আছে সেটাই সমাজে জিইয়ে থাকুক, জোরদার হোক। এই সুশীল ধারণার আসাধুতা ধরা পড়ে যদি মনে রাখি যে সুশীলদের গত বেসামরিক লেবাসে সামরিক সকারের পক্ষাবলম্বন। যে সুশীল বেসামরিক সরকার মানেই গণতান্ত্রিক মনে করে সেই সুশীলই বেয়ামরিক লেবাসে সামরিক সকারের ঘোর সমর্থক ছিল, এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

মজার কথা হল, এই প্রথম আলোর- ডেইলি স্টার মিডিয়া গ্রুপ দাবি করত এক-এগার’র ক্ষমতা দখল ঘটানোর কৃতিত্ব তাদের। ওই সময়ে ওই ক্ষমতার পক্ষে নিরলসভাবে দুবছর মিডিয়া সাপোর্টও দিয়ে গেছে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গ্রুপ। এক এগার’র ক্ষমতার পক্ষে সুশীল সমাজের নামে লোক জড়ো করার তৎপরতা সম্পর্কেও জনগণ অবহিত। আমরা দেখেছি, এক এগার’র ক্ষমতা নিজেই নিজেকে ‘সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বলে পরিচিত করাত। অথচ এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কথিত সামরিক বনাম বেসামরিক শাসন বলে শঠতাপূর্ণ ভাগ করে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আলো ছলনাময় গীবত গাইছে। যেন সে সামরিক শাসনের কতই না ঘোর বিরোধী। প্রথম আলো ভেবেছে বিদেশী স্বার্থে এক এগার’র সামরিক ক্ষমতার সাথে প্রথম আলোর ঘোরতর সম্পর্কের কথা আমরা বুঝতে পারি নাই, বা বুঝলেও ভুলে গেছি।

সামরিক শাসনের ব্যাপারে মানুষকে বিভ্রান্ত করার পর সিদ্ধান্ত দেওয়া হচ্ছে যে জিয়া এরশাদ সামরিক শাসকেরা, ‘ক্ষমতায় থাকতে গণতন্ত্রের জন্য যতই মায়াকান্না করুন না কেন, নিজেদের গণতন্ত্রী প্রমাণ করতে পারেননি’। খুবই ভাল কথা। একমত হলাম না হয়। পরের অনুচ্ছেদে আবার তুলনা করে লেখা হছে, ‘কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক শাসকেরা কীভাবে মূল্যায়িত হবেন? অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে কোনো শাসকই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রী থাকতে পারেননি’। তাহলে কী দাঁড়ালো? সামরিক শাসকেরা নিজেদের গণতন্ত্রী ‘প্রমাণ করতে পারেননি’। আবার অসামরিক শাসকদেরকে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হচ্ছে যে, তাঁরা ‘গণতন্ত্রী থাকতে পারেননি’।

তাহলে ‘বাংলাদেশে কোন শাসকই যদি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রী না থাকতে পারেন’ তবে কোন শাসন সামরিক নাকি বেসামরিক এভাবে একটা খামোখা ভাগের দেয়াল তুলে বিচারের মানে কি? দরকার কেন? তুলনামূলক আলোচনার পরে এই যদি উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত হয় তাহলে কথিত সামরিক বনাম বেসামরিক শাসন বলে ভাগ করার ন্যায্যতা কোথায়? সামরিক বেসামরিক নির্বিশেষে বাংলাদেশের ‘কোনো শাসকই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রী থাকতে’ যদি নাই পারেন তাহলে সামরিক বনাম বেসামরিক শাসন বলে শঠতাপূর্ণ ভাগ করে তাদেরকে আলাদা করে চেনানোটা অবশ্যই ভুল।

কি উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এটা বলা হোল সেটা বোঝা যায় পরের বাক্যে; ‘শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। রাজনীতিতে তাঁদের আগমনও হয়েছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পটভূমিতে। শেখ হাসিনা যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন দেশে জিয়ার আধা সেনাশাসন। আর খালেদা জিয়া যখন আসেন, তখন এরশাদের পুরো সামরিক শাসন। তাঁদের যূথবদ্ধ আন্দোলনই নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছিল। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে অশুভ শক্তি পিছু হটতে বাধ্য’।

এর মানে জিয়ার বিএনপি আর খালেদা জিয়ার বিএনপির মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফারাকের কথা লেখক আমাদের মনে করাচ্ছেন। খালেদার বিএনপি আশির দশকে জনগণকে সাথে নিয়ে মাঠে আন্দোলন সংগ্রামের কারণে এক ধরনের গণসম্পর্কগত নতুন ভিত্তির দিক দেখা মিলেছিল বলে জিয়ার বিএনপির সাথে একটা ফারাক করছেন সোহরাব। মাঠে আন্দোলন করে এরপর ক্ষমতাসীন হবার অভিজ্ঞতা জিয়ার বিএনপির নাই। এই ঘটনার কি বিশেষ তাৎপর্য আছে, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু তথ্য হিশাবে এই কথা সত্য। লেখক কিন্তু সেখানে থামেন নাই। তিনি এবার দাবি করছেন, ‘এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে অশুভ শক্তি পিছু হটতে বাধ্য’। মনে হচ্ছে, খালেদা-হাসিনার ‘যূথবদ্ধ আন্দোলনে’ ‘ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক শক্তির’ ওপর তাঁর গভীর আস্থা আছে। তিনি এই ‘গণতন্ত্রী শক্তি’ দেখতে খুবই পেরেশান, পছন্দ করেন।

তাহলে এখন প্রশ্ন হল, কে না জানে এক এগার’র ‘সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার’র বিখ্যাত ‘মাইনাস টু ফর্মুলার’ কথা। এই ক্ষমতা তৈরির কারিগর ও প্রকাশ্য ঘোরতর সমর্থক প্রথম আলো। বিদেশী স্বার্থের সুশীল রাজনীতি ছিল এটাই। একদিকে হাসিনা-খালেদাকে মাইনাস করার ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’কে সত্য বলে মানা, তার পক্ষে দাঁড়িয়ে চেঁচানো, অপরদিকে প্রায় একই নিঃশ্বাসে খালেদা-হাসিনার ‘যূথবদ্ধ আন্দোলনে’-র ভেতরে এখনও ‘ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক শক্তি’ দেখতে পাওয়া। ভারী কৌতুক্ককর ব্যাপার। আবার এক ‘অশুভ শক্তি’কেও দেখতে পাচ্ছে লেখক যারা নাকি ‘পিছু হটতে বাধ্য’। তো এই ‘অশুভ শক্তি’টা কে? এ কোন ভাসুর? যার নাম মুখে নিতে নাই। সামরিক বাহিনী? নাকি মতিউর রহমান ও তার সমর্থক অনুসারীদের বিদেশী স্বার্থের সুশীল রাজনীতি? এ তো দেখছি, নিজেই নিজেকে ‘অশুভ শক্তি’ বলে গালাগালি করা। এই গোলমেলে পিঠ বাঁচানো উপলব্ধি আবার কোন আগামী রাজনীতির ইঙ্গিত তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে মনে হচ্ছে।

লেখাটা তিনটা অংশে বিভক্ত। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ সম্প্রতি পরিত্যক্ত বাকশাল রাজনীতির প্রতি যে নতুন ভালবাসা প্রকাশ করেছেন সাংবাদিকদের ডেকে, সেটা নিয়া হল লেখার তৃতীয় অংশ। লেখার প্রথম অংশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যে বাকশালী রাজনীতির পুনর্জাগরণ না, সে দাবির পক্ষে সাফাই হিশাবে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ‘গত মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে যে উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতেও বাকশালের কথা নেই’। এছাড়া হানিফ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, ‘পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দলীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামেই দল নিবন্ধীকরণের দরখাস্ত করেছিল’। একথার ঐতিহাসিক সত্যতা বিন্দুমাত্র নাই। তবু দেখা যাক, হানিফকে পরিত্যাগ করে হাসিনার আওয়ামী লীগকে লেখক বাঁচাতে পারেন কি না।

সংবিধান ও আইনের দিক থেকে দেখলে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবের আনা সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ছিল, মূল সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের শেষে ‘ষষ্ঠ ভাগ ক’ নামে নতুন এক অনুচ্ছেদ যোগ করা, যার শিরোনাম ছিল ‘জাতীয় দল’। সংবিধান সংশোধন করে লেখা এই জাতীয় দলই ‘বাকশাল’। সংবিধানে সাধারণভাবে লেখা হয়েছিল ‘জাতীয় দল’। আর নির্বাহী আদেশে শেখ মুজিব বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘোষণা করে নতুন ও বাংলাদেশের একমাত্র দল হিশাবে বাকশাল নাম ঘোষণা করেন, এই বাকশালই সংশোধিত সংবিধানের ‘জাতীয় দল’। সারকথায়, বাকশাল ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও রাজনৈতিক তৎপরতা এমনকি সেসময়ের সংসদে এমপি হিশাবে যেসব দলের এক দুইজন প্রতিনিধি ছিল, সংবিধানে বলা হয়েছিল তাদের দলগুলাও বাকশালের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য, নইলে দলসহ তাদের সংসদ সদস্যপদ বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে।

এখন এখানে প্রাসঙ্গিক বিষয় হল, চতুর্থ সংশোধনী সংসদে পাশ বলে ঘোষণা করার পর সংবিধানের এই নতুন রূপ আদল ও আইন অনুযায়ী বাকশাল ছাড়া বাংলাদেশে সংবিধান স্বীকৃত কোন রাজনৈতিক দল আর নাই, যা ছিল সবই অবৈধ, বেআইনি। এই অবস্থা চলেছিল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পর্যন্ত। কনস্টিটিউশনের ‘ষষ্ঠ ভাগ ক’ তখনও বহাল; বাংলাদেশে বাকশালই একমাত্র আইনি দল, বাকি সব বেআইনি। কিন্তু এটা বহাল থাকলে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব। কারণ বাকশাল ছাড়া আইনত কোনও দল নাই, আর একের অধিক রাজনৈতিক দল না থাকলে সেটাকে নির্বাচন বলে দাবি করা যায় না। এই পরিস্থিতিতে জিয়া সামরিক অধ্যাদেশ The Second Proclamation (Fifteenth Amendment) Order, 1978 (Second Proclamation Order No. IV of 1978) জারি করে কনস্টিটিউশনের ‘ষষ্ঠ ভাগ ক’ বাতিল করেন। এতেও বাস্তব সমস্যা মেটে নাই। কারণ যারা দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ চায় এদের দল তো আগেই আইনি দৃষ্টিতে একবার বাতিল হয়ে গেছে। এর সমাধান হিশাবে নতুন করে নির্বাচন কমিশনের কাছে দল নিবন্ধন করার জন্য জিয়া নতুন আর এক অধ্যাদেশ (Political Parties Ordinance 1978 (Ordinance no. XLV of 1978) সংক্ষেপে পিপিআর জারি করেছিলেন। এই নতুন নিবন্ধিত দলগুলাকে নিয়াই ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল। (এখানে ভুল বুঝাবুঝি এড়াতে তথ্য হিশাবে বাড়তি একটা তথ্য দিয়ে রাখা ভাল। জিয়ার ১৯৭৮ সালের এই পিপিআর অধ্যাদেশটা ছিল মূলত চতুর্থবার সংশোধিত পিপিআর; ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর পর থেকে মোস্তাক, সায়েম ও জিয়ার হাতে এর আগে তিনবার পিপিআর জারি বা সংশোধিত হয়েছিল, ১৯৭৮ সালেরটাই জিয়ার আমলের শেষ সংশোধন।)

দল নিবন্ধনের প্রয়োজনে বাকশালের সাবেক স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলকে সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করে ঘরোয়া রাজনীতির অধীনে যে নতুন দল গঠন করা হয়েছিল ওই দলের নাম ঘরোয়া সম্মেলনে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পরে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ এই নাম নির্বাচন কমিশনের কাছে নিবন্ধনের জন্য জমা দেয়া হয়েছিল। ফলে হানিফের দাবি, ‘দলীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামেই দল নিবন্ধীকরণের দরখাস্ত করেছিল’ এই কথার কোনও ভিত্তি নাই। হানিফ এমন একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যেন আগে দলের নাম নিবন্ধন পরে ওই নামে দল গঠন ও রাজনৈতিক তৎপরতা চলে। এমনভাবে দল নিবন্ধন আজকেও ঘটে না। দল আগে গঠন, সম্মেলনেই দলের নাম, কমিটি গঠন ইত্যাদি শেষ করার পর ওই কাজের স্বীকৃতির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদনকে নিবন্ধনের আবেদন বলা হয়। বাস্তবে ঘরোয়া রাজনীতির মধ্যে আওয়ামী লীগ কি করতে চাইছে, কিভাবে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সংগঠিত হবে সেসব বিষয় শাসক জিয়ার সাথে একটা সমঝোতার মধ্য দিয়া ছাড়া করার চেয়ে আর কোন উপায় তখন আওয়ামী লীগের সামনে ছিল না। এটাই সে সময়ের প্রেক্ষিতে স্বাভাবিক। ওই সময়ে ঘরোয়া সম্মেলন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠন ও কমিটি গঠনের কাজটা ঘটেছিল, জিয়ার সাথে কথা বলে একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে। একদিক থেকে দেখলে এটা জিয়ার এমন একটা অনুগ্রহ যেটা তাঁর নিজের ক্ষমতা, নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদির স্বার্থে আবার প্রয়োজনও।

ওই সমঝোতা বা অনুগ্রহের দিকটাই বিএনপি ইদানিং মনে করিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে। সারকথায় যার মানে হল, জিয়া এত খারাপ হলে ওই জিয়ার সাথে সমঝোতা করে এখনকার একই আওয়ামী লীগ ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ পেতে গিয়েছিল কেন? মনে রাখতে হবে শেখ মুজিব নিজেই ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’কে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন; বাকশাল নামে একমাত্র জাতীয় দলে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’কে বিলুপ্ত করেছিলেন তিনি। এরপর সেই কলঙ্কের বাকশাল দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা কোনও প্রাক্তন আওয়ামী লীগার বা বাকশালী সদস্যের হাতে ঘটে নাই। এই বাকশালী কলঙ্ক মোচনের দায় নেবার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ‘অবৈধ’ সামরিক শাসক জিয়া। জিয়া বাকশালী সংবিধানের ‘ষষ্ঠ ভাগ ক’ যেটা জাতীয় দল বা বাকশালের জীয়ন-মরণ কাঠি এটাকেই ‘অবৈধ হাতে’ বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। ফলে সহজে বদনামী বাকশাল পরিত্যাগ করে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামে আবার সংগঠিত হতে পারাটা জিয়ার একটা অবদান--এটাই বিএনপির দেলোয়ারের দাবি।

এখানে সামরিক বনাম বেসামরিক শাসন নামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধে তর্কটা যে কতটা বদ-মতলবী তা ধরা পড়ে। শেখ মুজিব নির্বাচিত সংসদের দ্বারা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিরোধী এক সংশোধনী--চতুর্থ সংশোধনীর বলে শেখ মুজিব কোনও ধরনের নির্বাচন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। আর ওই চতুর্থ সংশোধনী দিয়েই সংবিধানের ‘ষষ্ঠ ভাগ ক’ জুড়ে দিয়ে বাকশাল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল বাতিল ও তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। মুজিবের কথিত বেসামরিক শাসন এসব কীর্তি করেছিল। জবরদস্তি করে বেআইনি এসব কাজকে বৈধ বলে দাবি করেছিল। এখন তামাশাটা হল; সামরিক শাসক জিয়া সামরিক ক্ষমতার বলে অধ্যাদেশ জারি করে বেসামরিক ও নির্বাচিত শেখ মুজিবের (‘ষষ্ঠ ভাগ ক’ জুড়ে দিয়ে বাকশাল কায়েম, সব রাজনৈতিক দল বাতিল ও তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি) অসংবিধানিক সব আইনগুলা বাতিল করেছিলেন। অপকর্মগুলা এভাবেই দূরীভূত হয়।

সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে জিয়ার ক্ষমতা দখলের আসলেই কোনও ভিত্তি নাই, এটা সত্যি সত্যিই সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে--আসলেই অবৈধ। কিন্তু ওই অবৈধ শাসকই সামরিক ক্ষমতার বলে অধ্যাদেশ জারি করে রাষ্ট্রকে কলঙ্ক মুক্ত করেছে, কলঙ্কজনক আইনগুলা বাতিল করেছে। আর এই বাতিলের সুবিধা নিয়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ সহ অন্যান্য দলের জন্ম হচ্ছে। জিয়ার ওই সময়ের সামরিক শাসন যেমন তেমন অবৈধ না। একদম খাস অবৈধ। কারণ তখনও পঞ্চম সংশোধনী ১৯৭৯’র জন্ম হয় নাই, ফলে কোনও ঠুটো আইনি কেচ্ছার বৈধতাও জিয়ার নাই। সেটা তখনও অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে তৈরি হওয়া ক্ষমতা। আইনশাস্ত্রের ভাষায় যাকে বিশুদ্ধ ক্ষমতা বলে পরিচয় করানো হয়। যে ক্ষমতা আইনের বাইরে থেকে এসে আইন প্রণয়নের নিজস্ব হিম্মত খাটায়। কিন্তু সেটার বৈধতা বা লেজিটেমিসির বিষয় একটা ভিন্নতর রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। আমরা সেদিকে এখানে যাচ্ছিনা। সারকথায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, বেসামরিক ও নির্বাচিত শেখ মুজিব সংবিধানে ‘ষষ্ঠ ভাগ ক’ জুড়ে দিয়ে বাকশাল কায়েম, সব রাজনৈতিক দল বাতিল ও তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি অপকর্মগুলা করছেন। আর ‘অবৈধ’, সামরিক, অনির্বাচিত জিয়া এসব অপকর্ম ও কলঙ্ক মোচন করছেন ‘অসংবিধানিক’ সামরিক ফরমান জারি করে।

অথচ আমরা এখন রাজনীতি বিচার করতে বসতে দেখছি, যার মাপকাঠি হল, সামরিক শাসন ক্ষমতা মানেই দোষী আর বেসামরিক শাসন মানেই নির্দোষ, নিষ্পাপ ও অপাপবিদ্ধ। নিশ্চয়ই যে কোনও সামরিক শাসন আগের সংবিধানের চোখে অবৈধ গণ্য হতে বাধ্য। কিন্তু এর মানে এই না যে, বেসামরিক শাসন মানেই নির্দোষ, নিষ্পাপ ও অপাপবিদ্ধ। সংবিধান ও আইনকে বলাৎকার করেই বেসামরিক শাসন নির্দোষ সাজতে পারে। শেখ মুজিব এটাই করেছিলেন। এটাই হল, আইনের তামাশা। একইসাথে এখন যারা আদালতের রায়ে আইনের শাসন ফিরে আসল বলে খোয়াব দেখাচ্ছেন, সেটাও স্রেফ আরেকটা রঙ্গ ছাড়া কিছু না।

আইনের তামাশা দেখলাম। এখন লেখকের বাকশাল প্রীতি দিয়ে শেষ করব। মজার ব্যাপার হল, আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে পরিত্যক্ত বাকশাল রাজনীতির প্রতি হানিফ সাহেবকে নতুন ভালবাসা প্রকাশ করার জন্য দুষছেন সোহরাব; এটা এখনকার আওয়ামী লীগের রাজনীতি না--এমন সাফাই গাইছেন সোহরাব। কিন্তু সাফাই দিতে গিয়ে আসলে বাকশাল সোহরাবের কত প্রিয় রাজনীতি সে কথাই প্রকাশ করেছেন। প্রথমে আমরা দেখব, বাকশালের ব্যাখ্যা দেবার দায়িত্ত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে লেখক নিয়ে কি কি বলছেন। একটা তালিকা তৈরি করি। সোহরাব বলছেন, এক. বাকশালের দুটি দিক ছিল--রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে বাকশাল ছিল চরম স্বৈরাচারী। দুই. সেখানে ভিন্ন মতের সুযোগ ছিল না, বিরোধী দল ছিল না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না। তিন. বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলক সমবায়ের কথা বলা হয়েছিল। চার. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বাস্তবায়নের কথা ছিল। পাঁচ. সব কৃষিজমি সমবায়ের অধীনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ছয়. বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, তথা হানিফ সাহেবরা তাতে বিশ্বাস করেন না বলেই ব্যক্তি-মালিকানায় সব ছেড়ে দিচ্ছেন। সমাজতন্ত্রের কথা মুখে আনেন না।

এই ছয়টা পয়েন্ট আলোচিত লেখা থেকে একদম উদ্ধৃত করা। আমি কেবল পরপর এখানে সাজিয়েছি। পয়েন্টগুলার সারকথা হল, ‘বাকশালের দুটি দিক--রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক’। ‘রাজনৈতিক দর্শনের’ দিকটা খুবই খারাপ আর অর্থনৈতিক দিকটা ‘সমাজতান্ত্রিক’; ফলে তা যারপরনাই ভাল। রাজনৈতিক দিকটাকে লেখক নিজেই ‘চরম স্বৈরাচারী’ নামকরণ করছেন। ফলে কাগজ কলম বাঁচাতে ওদিকটা এখানে বাদ রাখছি।

সবদেশেই নির্বিচারে ‘ব্যক্তি-মালিকানার’ ওপর কামান দেগে ‘সমাজতন্ত্র’ বুঝবার ধারা আছে। পেটিবুর্জোয়ার ঈর্ষাজাত ঘৃণা মাখানো ‘পেটিবুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক’ ধারা এটা। লেখক পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্র বুকে লালন করছেন বলে জানাচ্ছেন। দুনিয়ার রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবায় ইত্যাদি যেসব দেশে কৃষি সমবায়ের অভিজ্ঞতা পরীক্ষা নিরীক্ষা ঘটেছিল সেসবের পরিণতি কি--তার খবর রাখার ন্যূনতম দায় বোধ না করে, এখনও তোতা পাখির মত ‘কৃষিজমি সমবায়ের’ পক্ষে কথা বলা রীতিমত একটা অপরাধ। এর ওপর আরও বিপদজনক হল, লেখক বাকশালকে ‘বাধ্যতামূলক সমবায়’ বলে ব্যাখ্যা করছেন। এই বাধ্যতামূলক কাণ্ডকারখানার পরিণতি দেখার জন্য কম্বোডিয়ার কথা কি তিনি জানেন? বাকশাল প্রীতিতে না হোক অন্তত সাংবাদিক হওয়ার কারণে না চাইতেই সেসব খবর এমনিতেই তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে। সেসব খবর আমি শুনব না, চোখ বন্ধ করে রাখব--এমন সিদ্ধান্ত কেউ নিলেই শুধু এসব খবর না জানা থাকা সম্ভব। সেই বাধ্যতামূলক সমবায়ের আমলে কম্বোডিয়ায় মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ হয়েছে, সেসব অপরাধে দগদগে ঘা শুকানোর জন্য কম্বোডিয়া এখন জাতিসংঘের অধীনে বিচার চালাচ্ছে।

আবেগ সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি থাকে, থাকা বোধহয় দরকারও। কিন্তু দুনিয়াদারির খবর না রেখে, দুনিয়ার বাদবাকি মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে না শিখে, কিছু দেখব না জানব না মার্কা পণ করে শুধু পাতিবুর্জোয়ার ঈর্ষাজাত ঘৃণার ওপর থ্যাবড়া মেরে বসে বসে থাকা থকথকে আবেগ সমাজের জন্য ক্ষতিকর, লেখকের নিজের জন্যও আত্মঘাতী।

সবচেয়ে আজব ব্যাপার হল, তিনি বেচারা হানিফ সাহেবকে বকাবকি করে বলছেন, ‘হানিফ সাহেবরা তাতে বিশ্বাস করেন না বলেই ব্যক্তি-মালিকানায় সব ছেড়ে দিচ্ছেন। সমাজতন্ত্রের কথা মুখে আনেন না’। মানে হানিফ সাহেবরা কেন লখকের মধুর স্বপ্ন অনুযায়ী অর্থনৈতিক বাকশাল কায়েম করতে যাচ্ছেন না--এজন্য কঠিন বকা দিয়েছেন। অথচ লেখার শুরুতে তিনি হানিফ সাহেবকে একহাত নিয়েছেন, না বুঝে শুনে ‘বাকশালকে দলের রাজনৈতিক দর্শন’ বলে দাবি করেছেন বলে।

এর মানে দাঁড়ালো, লেখকের নিজস্ব একটা প্রিয় ‘অর্থনৈতিক’ বাকশাল আছে। সে অর্থে অর্থে তিনি একজন খাঁটি আসল ও জেনুইন অর্থনৈতিক বাকশালী।

এসব দেখে শুনে প্রথমে শেখ মুজিবের ও সেই সাথে দেশবাসীর জন্য দোয়া করতে মন চাইছে। আল্লাহ শেখ মুজিব সহ আমাদের সবাইকে বাঁচিয়েছেন--এজন্য শুকরিয়া আদায় করা দরকার বোধ হচ্ছে। শেখ মুজিবকে কম্বোডিয়ার খেমাররুজ নেতা পল পট হয়ে মরতে হয় নাই। তিনি বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন, আমাদেরও বাঁচিয়ে গেছেন। নইলে এসব জেনুইন বাকশালীদের জন্য আজ ‘ক্রাইম এগেনস্ট হিউম্যানিটি’র ক্রিমিনাল বলে শেখ মুজিবের মরণোত্তর বিচার দেখতে হত আমাদের।

এখানে যে লেখক ও লেখা নিয়ে কথা বলেছি উভয়েই একটা প্রতীক মাত্র, এটা রাম রহিম জন যে কেউ হতে পারত। কারণ, আমরা জানি, এই চিন্তা কেবল একজন লেখক, একটি লেখা বা একটি পত্রিকা ধারণ করে না, বাকশালী ধারা টিকে থাকার শর্ত যে পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণী সেই শ্রেণী এখনও বহালতবিয়তে হাজির রয়েছে। আব্দুর রাজ্জাক খোদ ‘বাকশাল’ নাম দিয়েই আওয়ামী তরুণদের নিয়ে আশির দশকের শুরুতে আলাদা দল খুলতে পেরেছিলেন--একথা ভুলে যেতে পারি না। এখন এরা পূর্ণবয়স্ক নিশ্চয়ই। এছাড়া, যারা সিপিবি নাম লুটিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন--তাদের অনেকেই এখনও সমাজে আছেন। প্রথম আলোর লেখা ও লেখক স্বয়ং এদের সবার চিন্তার প্রতীকী প্রতিনিধি মাত্র।

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০

fidaehasan@gmail.com

 

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  


Available tags : সামরিক, বেসামরিক, সংবিধান, বাকশাল, মুজিব, জিয়া

View: 15421 Leave comments (1) Bookmark and Share

ভাল লেগেছে1

লেখাটি ভাল লেগেছে। কম্বোডিয়ার ঘটনাটা কি আরেকটু বিস্তারিত জানতে পারলে ভাল হত ।

Wednesday 13 October 10
Onamoke
Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD